#চোরাবালি_১৫
রেশমা আক্তার
জোহারের সময় ছিল না সোহাকে নিয়ে ভাববার। যদিও প্রথম প্রত্যাখ্যানে আকর্ষণ বেড়েছিল তীব্র। তবু অবকাশ হয়নি দ্বিতীয়বার যাবার। সোহার সাথে দেখা হয়েছিল এরপর প্রায় মাস তিনেক পড়ে। তবে তার আগে একদিন তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ঝরনা ফুপু।
জোহার বাংলোয় পৌঁছে দেখল বেশ কিছু লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে সমস্ত বাংলোটা তোলপাড় করছে। ঝরনা ফুপুর শরীর খুব খারাপ, প্রেসার হাই। জানা গেল, ঝরনা ফুপু বাংলোর ভেতরে সাপ দেখেছেন। বিশালাকার একটা সাপ দেখা গেছে সোহার ঘর থেকে বের হতে। সাপুড়ে দল এসেছে খুঁজতে। সারাদিন বাড়ি, আসবাবপত্র, বাগান, লন, তন্ন তন্ন করে খু্ঁজল সবাই, কিচ্ছুটি পেল না।
অতপর ক্লান্ত ঝরনা ফুপু এসে বসলেন জোহারের সামনে। কুশল বিনিময় সেরে বললেন
– বাবা জোহার, তোমাদের বিয়েটা এবার হয়ে যাক। আমি আর এ মেয়ের দায় বইতে পারছি না।
জোহার কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল। মনে তার অনেক প্রশ্ন, কিন্তু ঝরনা ফুপুকে কি সেটা বলা যায়?
ঝরনা ফুপু বুঝি পড়ে নিলেন জোহারের মন। বললেন
– দেখো বাবা, সোহা আর দশটা সাধারণ মেয়ের মত নয়। আর রিজভি নিশ্চই তোমার মাঝে কোন অসাধারণত্ব দেখেছিল। সেজন্য এসব সম্পত্তি, কম্পানি তোমার নামে দিয়ে গেছে। তার মেয়েটিকেও যে বাঁধতে হবে তোমার। সোহা অবাধ্য কিন্তু সেও তার বাবার নির্দেশ মানতে বাধ্য। আমি রিজভিকে বলেছি সব। যত দ্রুত সম্ভব তোমাদের বিয়েটা হয়ে যাক।
এরপর একদিন জোহারের একটা ফোন এসেছিল পুলিশ স্টেশন থেকে। সোহাকে নাকি সেখানে ডাকা হয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। জোহার গিয়ে জানতে পেরেছিল, সোহার বয়ফ্রেন্ড প্রতীকের রহস্যময় মৃত্যুর ইনভেস্টিগেশনের জন্য ডেকে আনা হয়েছে সোহাকে। ব্যাপারটা কিছুটা ঘোলাটে। যেহেতু সোহা রিজভি আহমেদের মেয়ে তাই পুলিশ অফিসার জোহারকে আলাদা ডেকে কথা বলেছিলেন। জোহারও সুযোগটা গ্রহন করেছিল। বুঝতে পেরেছিল সোহা হয়তো অহেতুক জড়িয়ে যেতে পারে এর মধ্যে। যদিও সোহার ওই সরল, মিষ্টি চেহারা তা বলে না।
জোহার পুলিশের সাথে কি রফা করেছিল বোঝা গেল না। আসার পথে জোহারের গাড়িতে ফিরেছিল সোহা। তাকে বেশ নমনীয় মনে হয়েছিল। অনেকটা পথ আসতে আসতে জোহার জিজ্ঞেস করেছিল, আিসক্রিম খাবে?
আচমকা এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে গেলেও হ্যা সূচক মাথা নেড়েছিল সোহা। জোহার গাড়ি থামিয়ে আইসক্রিম এনেছিল দুজনার জন্য। ফেরার পথে অল্প স্বল্প গল্পও হয়েছিল দুজনার।
ঝরনা ফুপু কিছুদিন যাবৎ বেশ অসুস্থ। তাকে একদিন দেখতে গেল জোহার। মহিলার চোখেমুখে আতঙ্ক। সে নাকি এখন যেখানে সেখানে সাপ দেখতে পায়। বাসার মধ্যেই নাকি অনেক সাপ ঘোরাফেরা করে। অথচ দু’বার এসে সাপুড়ে দল খুঁজে গেছে। বাংলোর চারিদিকে এসিড ছড়ানো হয়েছে। সাপের চিহ্নও নেই কোথাও। আর তাছাড়া ফুপু যতবড় ও যতগুলো সাপের কথা বলছেন, সেটা অস্বাভাবিক। ডক্টর পার্থকে ডাকা হল। তিনি সব দেখে শুনে বললেন, ঝরনার মাথায় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। ঝরনার নিজেরও তাই ধারণা। সে তাই চলে যেতে চান। জোহারকে বললেন
– জোহার বাবা, রিজভির সাথে আমার কথা হয়েছে। তোমাদের বিয়েটা পর্যন্ত আমি আছি এখানে। তারপর আমি চলে যাব। আমি আর এ বাংলোতে থাকছি না।
– কি বলেন ফুপু, আপনি কেন যাবেন?
ঝরনা একটু তটস্থ চোখে চারিদিকে দেখলেন, ফিসফিস করে বললেন
– সে চায় না আমি আর এখানে থাকি
– কে? কে চায় না?
ঝরনা আবারও তাকালেন চারিদিকে, ভয়ার্ত চোখে। কিন্তু এরপর একদম চুপ হয়ে গেলেন। চা নিয়ে এসেছিল সোহা। চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ কুচকালো জোহার। তিক্ত স্বাদের চিনির মিশ্রণ। তবু সামলে নিল নিজেকে। মিষ্টি হাসল সোহার দিকে তাকিয়ে। সোহাও হসলো অমায়িক। জোহারের মনে হল, এই বাদামী চোখের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সে সারাজীবন নিজের চা, কফি নিজেই বানিয়ে নিতে পারবে।
সোহা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল জোহারের প্রতি। পুলিশ যে অহেতুক তাকে স্বন্দেহ করে থানায় ডেকে নিয়েছিল আর জোহার সঠিক সময়ে না গেলে যে তাকে কত হয়রানী হতে হত তাই নিয়ে আলোচনা চলল কিছুক্ষণ।
পরিস্থিতি পাল্টে গেল এরপর। সোহা ফুপুকে জানাল, জোহারকে বিয়ে করতে কোন আপত্তি নেই তার।
সোহা আর জোহারের বিয়েটা এর পরের সপ্তাহেই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিয়ের রাতেই খুব অদ্ভুত ও দুঃখজনকভাবে সাপের বিষে মৃত্যু হল ঝরনা ফুপুর।
এরপর বছরখানেক জোহার আর সোহার সংসার চলল বেশ ভালই। যদিও জোহারকে ব্যস্ত থাকতে হত খুব। সোহাও তার পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ততা দেখাত। সোহার বন্ধু সংখ্যাও কম নয়। প্রায়শই লং ড্রাইভ এবং এক বা একাধিক বন্দুদের নিয়ে আউটিং চলত। বাংলো থেকে কলেজের দূরত্ব অনেক। সোহার ড্রাইভার পরিচিত, পুরানো। রোজ আনা নেয়া করত সোহাকে। কিন্তু একদিন একটা এক্সিডেন্ট হল। মারাত্মক সে এক্সিডেন্টে গাড়িসমেত ড্রাইভার পাহাড়ী পথে উল্টে পড়লেও কোন এক অদ্ভুত উপায়ে অক্ষত ছিল সোহা। ড্রাইভার মারা গেল।
জোহার এরপর তার অফিসের গাড়িতেই পৌঁছে দিত সোহাকে। বাংলোতে একজন বাবুর্চি, একজন কেয়ারটেকার আর মধ্যবয়সী একজন পরিচারিকা থাকত। পরিচারিকার নাম রোহামা। এই রোহামা হঠাৎ একদিন জোহারকে একা পেয়ে বলল
– বাবু, আমি আর তোর এখেনে কাজ করব লাই।
– কেন রে, কিছু অসুবিধা আছে তোর?
– হি…
– কিসের অসুবিধা?
রোহামা চারিদিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলল
– মেমসাবকে ভয় লাগে…
জোহার একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হো হো করে হেসে ফেলল, বলল
– ও এই কথা, তোর মেমসাহেব একটু রাগী বটে। বকাঝকা করে বুঝি খুব? আমিতো দেখার সময় পাইনা। তোরাই তো তোদের মেমসাহেব কে দেখেশুনে রাখছিস। তা, তোরা চলে গেলে চলবে কেন?
– না না বাবু, সে কতা লয়, অন্য বিষয় আচে…
জোহার বুঝল, সোহা রাগী ও বদমেজাজী। নিশ্চই বাজে ব্যবহার করেছে ওর সাথে। তা সেতো সোহা, জোহারের সাথেও করে। একটা বছর পার হয়ে গেল, জোহার আজও সোহার মুড বা মেজাজ বুঝে উঠতে পারল না। ইচ্ছে হলে হাসবে, কথা বলবে, কাছে আসবে। আবার ইচ্ছে হলে দিনের পর দিন গম্ভীর, রাগী মুখে দূরে দূরে থাকবে। ইদানিং তো নিজেদের বেডরুমও ছেড়েছে। নিজের জন্য আলাদা একটা বেডরুম করেছে। প্রায়শই সেখানে একা গিয়ে থাকে। জোহার অনেক বুঝিয়ে, মান অভিমান, রাগ করেও ফেরাতে পারেনি তাকে। আবার ইচ্ছে হলে নিজেই চলে আসছে।
জোহার ভেবে নিয়েছে, বড়লোকের আদরে কিছুটা বখে যাওয়া মেয়ে। তাছাড়া জোহারকে হয়তো সোহা নিজের যোগ্যই মনে করে না। তাই একপ্রকার ক্ষমাঘেন্না করে চলে। বাবার হুকুমে হয়তো বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছে সোহা, জোহার বোঝে সেটা। আপাতত সে রোহামাকে কিছু বেতন বাড়িয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে আস্বস্ত করল।
কিন্তু এরপর প্রায়শই কি না কি দেখে রোহামা ভয় পেতে থাকল। রাত বিরেতে রোহামার চিৎকার চেঁচামেচিতে সবার ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। জোহার বুঝল এসব রোহামার কাজ ছাড়ার বাহাণা। সে মনে মনে ঠিক করল, রোহামাকে ছাড়াতে হবে।
কিন্তু তার কয়েকদিন পরই সিলিংফ্যানে শাড়ি বেঁধে আত্মহত্যা করল রোহামা। সকালবেলা জোহার ঘর থেকে বের হয়ে দেখে বাবুর্চি, কেয়ারটেকার আর সোহা গম্ভীর মুখে ড্রয়িংরুমে রোহামার ঝুলন্ত লাশের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। অথচ কেউ জোহারকে ডাকেনি। আরও আশ্চর্যজনক কথা হল, সোহার হাতে একটা ক্যামেরা। সে ক্লিক ক্লিক করে রোহামার বিভৎস মৃত্যুর ছবি তুলছে। জোহার চিৎকার করে থামাল সোহাকে। জিজ্ঞেস করল,
– পুলিশ কল করা হয়েছে?
সোহা বলল
– ওয়েট জোহার, আমাকে কয়েকটা ছবি তুলতে দাও। পুলিশ ডাকা তো পালিয়ে যাচ্ছে না।
বিস্ময় আর রাগে হতভম্ভ জোহার। দ্রুত গিয়ে ফোন করল পুলিশ স্টেশনে। ডক্টর পার্থও খবর পেয়ে চলে আসলেন। শুরু হল পুলিশি জেরা আর তদন্ত। ক’দিন তোলপাড় হয়ে গেল বাংলোয়। সমস্ত ইনভেস্টিগেশনের পর জোহার আর ডক্টর পার্থ পুলিশকে বোঝাতে সক্ষম হল যে, মানসিক ডিপ্রেশন আর ভয় থেকে মেয়েটি এমন একটা কান্ড করে ফেলেছে। পুলিশ চিনত রিজভিকে। এর আগেও এ বাংলোতে বহু ঘটনা দুর্ঘটনায় মোটা খেসারত দিতে হয়েছে রিজভিকে, আর পরে জোহারকে। অপরাধ বা স্বন্দেহভাজন হিসেবে যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি হয়রনীর শিকার হওয়া থেকে রেহাই পেতে।
সোহা ছিল নির্বিকার। তবে কষ্ট পেয়েছিল জোহার। আহা, রোহামাকে ছেড়ে দিলেই বুঝি ভালো হত। ভয় আর ডিপ্রেশনে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে হত না। জোহার অপরাধবোধে ভূগল কিছুদিন। রোহামার পরিবারকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে যা যা প্রয়োজন সব করা হল।
কিছুদিন যাবৎ সোহার শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। কিন্তু সাহায্যকারী লোক আর পাওয়া গেল না। সোহার জন্য প্রায়শই জোহারকে বাড়িতে থাকতে হয়। কাজের বেশ ক্ষতি হতে থাকল। এরকম একটা সময়ে সুখবরটা দিলেন ডক্টর পার্থ। সোহা মা হতে যাচ্ছে। জোহার অত্যন্ত আনন্দিত। কিন্তু গম্ভীর হল সোহা। তিনদিন সে কারো সাথে কোন কথা বলল না। অতঃপর, একদিন গম্ভীর মুখে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে নিচে এসে মুখোমুখি বসল জোহারের। বলল
– জোহার, আমি এই বাচ্চাটা চাই না
– হোয়াট? এসব কি বলছ সোহা? তোমার কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল?
সোহা স্থির। বলল
– আমার বাচ্চা পছন্দ নয়। তুমি কি ব্যবস্থা করবে, কর। আমি এটা চাইনা।
জোহার স্তম্ভিত। এতটা শান্তভাবে অথচ জোড়ালো সিধ্বান্ত কীভাবে নিতে পারল সোহা?
জোহার সোহাকে অনেক বোঝালো। কোন কাজ হল না। অবশেষে সে ডক্টর পার্থর শরনাপন্ন হল।
ডক্টর পার্থ এসে ঘর বন্ধ করে সোহাকে কি বোঝালো জানেনা জোহার। প্রায় ঘন্টা খানেক পর তিনি বেরিয়ে এসে জানালেন, আপাতত সব ঠিক আছে। সোহাকে সে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। কারণ বাচ্চা থাকা না থাকার এমন হঠকারী সিধ্বান্ত নেবার সময় ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এখন এমন কিছু করলে সোহার জীবনের জন্য তা ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
সোহা নীরব হয়ে গেল। সে পারতপক্ষে নিজের ঘর থেকে বের হত না। কারো সাথে কথা বলত না। জোহার এ সময়ে সিধ্বান্ত নিল, সে সোহাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। অনেক ভেবে সে ঢাকায় ধানমন্ডিতে সোহাদের বাড়ি, নিকুঞ্জভিলায় গিয়ে কিছুদিন থাকার সিধ্বান্ত নিল। অফিসেও তেমন ব্যবস্থা নেয়া হল। প্রয়োজনে জোহার সপ্তাহে একবার করে চিটাগং আসবে বলে স্থির হল।
সোহাকে নিয়ে ঢাকায় আসার পর সোহার অনেক পরিবর্তন এলো। সে ইদানিং কথাবার্তা বলে। জোহারের সাথেও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে সম্পর্ক। মাতৃত্বজনিত চিহ্ন ফুটে উঠেছে সোহার শরীরে।
কয়েক মাস পর সোহা একটা ফুটফুটে মেয়ে শিশুর জন্ম দিল। মা ও বাচ্চাকে দেখাশোনার জন্য একজন আয়া রাখা হল বাড়িতে। দিন, মাস, বছর পার হল। বাচ্চাটা বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। ওর নাম রাখা হল, পিহু। কিন্তু খুব শীঘ্রই বোঝা গেল, বাচ্চাটা একটা শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মেছে। সোহা আর জোহারের বাচ্চাটা আসলে জন্মান্ধ। বিষয়টা নিয়ে জোহার অনেক ডাক্তার কবিরাজ করল। কিন্তু জানলো, কিছুই করার নেই।
সোহা আবার নীরব হয়ে গেল। সে জোহারকে অভিযুক্ত করল। বলল, বাচ্চাটা না এলেই ভাল হত। তার কোন ইচ্ছে ছিল না ওকে পৃথিবীতে আনার।
সোহা ধীরে ধীরে বাচ্চাটার প্রতি নিরাসক্ত হয়ে পড়ছে। জোহার ভীষণ চিন্তিত। সে সোহাকে অনেক বোঝানোর পরও কাজ হল না। বাচ্চাটার প্রতি দিন দিন সোহার বিরক্তি বাড়তেই থাকল। সোহা আজকাল পিহুকে আয়ার কাছে রেখে আলাদা থাকে। বলে, রাতে ও খুব বিরক্ত করে। জোহার সপ্তাহান্তে চিটাগং আসা যাওয়া করে। মাঝে মাঝে সেখানে থেকেও যেতে হয় দু’ চারদিন।
এদিকে একদিন একটা দুর্ঘটনা ঘটল বাড়িতে। কাপড় শুকাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে গেল পিহুর আয়া। ছাদে রেলিং আছে। বৃষ্টিও নেই। তাহলে ঠিক কীভাবে সে পড়ে গেল কেউ বুঝল না। আয়ার বয়স চলিশোর্ধ্ব। তার মেরুদন্ড ভেঙে গেছে। কথা বন্ধ হয়ে গেছে। সে শুধু তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। পিহুর বয়স তখন দু বছর।
আয়ার চলে যাবার পর পিহুর অসুবিধা হল খুব। জোহারই বেশির ভাগ সময় এখন পিহুর দেখাশোনা করে। পিহুর জন্য একজন নতুন আয়া রাখা হয়েছে। তবে ইদানিং সোহা একটু আধটু পিহুকে কাছে নেয়, কথা বলে।
জোহারের মনে হয়েছিল, আসলে সময়ের সাথে সাথে পিহুর প্রতি বিরক্তিটা মায়ায় টার্ন নিয়েছে সোহার। সোহা পিহুকে নিয়ে আজকাল বাগানে খেলে। ছাদে ঘুরতে যায়। বাথটাবে গোসল করে। একসাথে গাড়িতে ঘুরতে যায়। জোহার নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচল। ঠিক এমনই একটা সুখী পরিবারের স্বপ্ন দেখেছিল জোহার, সোহা আর পিহুকে নিয়ে।
জোহার আবার কাজে মন দিল পুরোদস্তুর। সে ভাবল, আর কয়েকদিন পর পিহু আর সোহাকে নিয়ে সে আবার চিটাগং চলে যাবে। পিহুও দেখতে দেখতে তিন বছর পার করল।
জোহার সেবার চিটাগং আটকে গিয়েছিল কোন একটা কাজে। সন্ধ্যা নাগাদ দুঃসংবাদটা পেল সে। পিহু ছাদ থেকে পড়ে গেছে। পিহু যে আর নেই, সেকথা তাকে বলেনি কেউ। ঢাকায় পৌঁছে সে নিকুঞ্জভিলার বাগানে দেখেছিল ভিড়টা। পুলিশ আর লোকজন ঠেলে ভেতরে গিয়ে দেখতে পেয়েছিল ছোট্ট পিহুর কাফনে জড়ানো শরীরটা।
খবরটা পেয়ে ডক্টর পার্থও ফ্লাইট ধরেছিল জোহারের সাথে। বাগানের এক কোণে পিলারে হেলান দিয়ে বসেছিল সোহা। তার চোখদুটি ফোলা। তার আসেপাশে কয়েকজন মহিলা, হয়ত প্রতিবেশী।
বাড়ির ছাদে চারিদিকে রেলিং। পিহু একটা তিন বছরের বাচ্চা, জন্মান্ধ। তার এভাবে ছাদ থেকে পড়ে যাওয়াটা ঠিক মেলাতে পারছে না জোহার।
আর কেন যেন এই প্রথমবার অকারণে সোহার ওপর ভীষণ রাগ হল জোহারের। সে বাহ্যজ্ঞানহীন হয়ে সোহার মুখোমুখি সজোরে তার দুই বাহু শক্ত করে ধরে ঝাঁকুনি দিল
– কীভাবে হল… বল? বলতেই হবে তোমাকে। বল…!
জোহারের এমন অগ্নিমূর্তি কখনও দেখেনি সোহা। এতগুলো মানুষের সামনে ওর এই রূপ দেখে আতঙ্কিত হল তার চেহারা। ডক্টর পার্থ গিয়ে ছাড়িয়ে আনলেন জোহারকে। জোহার অঝোরে কাঁদল পার্থকে জড়িয়ে ধরে। ডক্টর পার্থও পিঠে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিলেন জোহারকে।
পিহুর কবর হল বাগানের এক কোণায়। লোকজন চলে গেল। একজন পুলিশ অফিসার এলেন পরদিন সকালে। তারা পিহুর মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু মনে করছেন না। ব্যাপারটা তদন্ত করতে চায়। কারণ এর আগেও বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিল একজন। এমন সুরক্ষিত ছাদের রেলিং টপকে এক্সিডেন্ট হওয়াটা অস্বাভাবিক।
জোহার শোকার্ত, ব্যাথাতুর গলায় বলল
– আপনি ইনভেস্টিগেশন করুন অফিসার। আমাদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন।
বাড়িতে জোহার বাদে ছিল চারজন লোক। সোহা, পিহু, আয়া, দাড়োয়ান, বাবুর্চি আর ড্রাইভার। প্রত্যেকের আলাদা স্টেটমেন্ট নেয়া হল। সোহাকে জিজ্ঞেস করা হল, সে কাউকে সন্দেহ করে কিনা। সোহা জানাল, সে কাউকে স্বন্দেহ করতে পারছে না। তাছাড়া একটা বাচ্চাকে মারার প্ল্যান করবে কেন এরা? বাড়ির কোন জিনিস খোয়া যায়নি। এমনকি বাড়ির সিসি ক্যামেরাগুলো পর্যন্ত ক্লিয়ার। তবে ছাদে কোন সিসি ক্যামেরা ছিল না। আর আয়া ওইদিন ছিল ছুটিতে। দুপুরবেলা লাঞ্চের পর সোহা একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। পিহুও ঘুমন্ত ছিল পাশে। কিন্তু এরমধ্যে কখন পিহু উঠে গেল, ছাদে চলে গেল একা, সোহা কিচ্ছুটি টের পায়নি। সোহার কান্না প্রসঙ্গটাকে সহজ করে দিয়েছিল।
পিহুর মৃত্যুর পর সোহা ভেঙে পড়েছিল খুব। ডক্টর জোহার প্রায়ই আসতেন ঢাকায়, সোহাকে দেখতে। সোহা প্রায়শই নির্ঘুম রাত কাটায়। রাতে একা একা হাঁটে। খাওয়াদাওয়া করে না। কারো সাথে কথা বলে না। একজন সন্তান হারা মায়ের অবস্থা তো এমনই হয়। ডক্টর পার্থ বললেন, সোহা মানসিকবাবে অসুস্থ। ওর প্রপার মেন্টাল কেয়ার দরকার।
পিহুর মৃত্যুর পর জোহার, সোহার সাথে সহজ গলায় কথা বলতে পারত না। কেন যেন তার মনে হত, পিহুর বেঁচে থাকাটা চায়নি সোহা। একটা অন্ধ বাচ্চা কাম্য ছিল না সোহার। ইনফ্যাক্ট, সোহা তো বাচ্চাই চায়নি। সুতরাং পিহুর মৃত্যুর জন্য সোহাকে দায়ী করা না গেলেও সোহার প্রতি কেন যেন মনটা সহজ হতে পারছিল না। ডক্টর পার্থ জোহারকে বলে গেলেন, জোহার তুমি সহজ হও। যা হবার হয়ে গেছে। তোমার এ উপেক্ষা আর নীরবতা সোহার শরীর আর মনের জন্য বিরূপ হতে পারে। জোহার প্রত্যুত্তর করেনি। এর কয়েকদিন পর পুলিশ অফিসারটি আবার এলেন। নানান কথার মাঝে বললেন।
– জোহার সাহেব, মিসেস সোহা যে মানসিকভাবে সুস্থ তার একটা পরীক্ষা করতে চাই আমরা।
– কেন? হঠাৎ আপনাদের এমনটা মনে হবার কারণ কি?
অফিসার চিন্তিতভাবে ভাবলেন। বললেন
– দেখুন জোহার সাহেব, আমরা আমাদের ইনভেস্টিগেশন করব আমাদের সিস্টেমে এবং আমি চাইব আপনি আমাদের সহয়োগিতা করবেন।
জোহার খানিক ভাবল, বলল
– সোহাকে এরকম কোন কিছুর সাথে জড়াবেন না অফিসার। এমনিতেই বাচ্চাটা চলে যাওয়ার পর ও ভীষণ ভেঙে পড়েছে। আমিও এখন এটা নিয়ে আর খোঁড়াখুঁড়ি চাই না। যে চলে গেছে, সে আর ফিরবে না।
জোহারের শেষের কথাগুলো ছিল কান্নাভেজা।
অফিসার চলে গিয়েছিলেন। তবে তদন্ত বন্ধ করেনি। সোহা এ সময় একটু বেশীই অসুস্থ হয়ে পড়ল। জোহার অনেক চেষ্টা তদবির করে পুলিশি তদন্তপ্রক্রিয়া বন্ধ করল এবং ডক্টর জোহারের পরামর্শে সোহাকে নিয়ে চিটাগং, বাংলোতে ফিরে গেল।
মুন ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠল। সম্বতি ফিরে পেল লানা। জোহার চলে গিয়েছিল অফিসে। লানা উপরে উঠে এসে জোহারের লকার খুলেছিল। অনেক পুরনো এ ডায়েরীটা পড়েছিল একদম নিচের দিকে। জোহারের ছত্রভঙ্গ, এলোমেলো লেখা জোড়াতালি দিয়ে পড়ে লানা এই ঘটনাগুলোই জানতে পেল।
জোহারকে সে একটা কথা আরও বলেছে, বলেছে,
জোহার, মুনকে বাড়িতে একা রেখে কোথাও যেও না।
– কেন? মুন একা কোথায়? তুমিতো থাকছ বাড়িতে সারাক্ষণ
– না মানে, আমিতো সবসময় ওর খেয়াল রাখতে পারি না।
– কি করব বলতে পার? মুনের দেখাশোনার জন্যই তো রুকমিকে রাখা হয়েছিল। একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে এ বাংলোতে। এখন আর কেউ কাজ করতে চায় না এখানে।
আমি কতদিক সামলাব বলতে পার?
লানা চিন্তিত স্বরে বলেছিল
– কীভাবে করবে জানি না, তবে কেন যেন খুব ভয় হচ্ছে। তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারব না।
চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল জোহারের চোখেও।
লানা ডায়েরীটা স্বস্থানে রেখে এসে মুনের গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। মেয়েটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। লানা আলতো করে জড়িয়ে ধরল মুনকে। মুনের গা টা গরম। জ্বরটর আসবে নাতো?
ঘুমে জড়িয়ে আসছে লানার চোখ। সে প্রাণপণ খুলে রাখতে চাইছে চোখ। বাইরে গাড়ির হর্ণ শোনা গেল। জোহার কি ফিরে এলো? আহ, কি নিশ্চিন্ত। এখন ঘুমিয়ে পড়লেও ভয় নেই। জোহার তার কথাটায় গুরুত্ব দিয়েছে তাহলে।
লানা ঘুমের মধ্যেই পরম আদরে বুকে জড়িয়ে ধরতে চাইল মুনকে। কিন্তু তার হাতে কেমন ভেঁজা ভেঁজা লাগল। মুনের শরীরটা এখনও ভেজা কেন? কেমন লোমশ অনুভূতি। লানা চোখ খুলল, তার ঘুম ভেঙে গেছে। তাকিয়ে দেখল, ডোনা শুয়ে আছে তার বুকের কাছে। আর যে হাতটায় ভেজা অনুভূতি লাগছিল, সেই হাতটা তুলতেই দেখতে পেল তাজা লাল রক্ত। লানা তড়িতে উঠে বসল। দেখল, রক্তে ভেঁজা জবজবে শরীরে ডোনার শরীরটা পড়ে আছে বিছানার মাঝখানে। কটকটে লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিছানার চাদর। লানার হাত আর শরীরের পোশাকেও লেগে আছে রক্ত।
চিৎকার করে লাফিয়ে নিচে নামল লানা। তার চিৎকার শুনে বাইরে সিঁড়িতে কারো উঠে আসার ধুপধাপ শব্দ হলো । লানা স্তম্ভিত, বিস্ময় আর ভয়ে স্বন্তস্ত্র। হঠাৎ চোখ পড়ল আয়নায়। সেখানে লিপস্টিক দিয়ে একটা এ্যাংগ্রি ফেস আঁকানো আর লেখা, ” হাউ ডেয়ার ইউ!!”
নিচে টেবিলে ফল কাটার চাকুটা রক্তে ভেঁজা, গেঁথে আছে ফলের সাথে।
( চলবে)