চোরাবালি পর্ব ১৪

0
164

#চোরাবালি_১৪
রেশমা আক্তার

ঘুমের মধ্যে ছটফট করছে লানা। মনে হচ্ছে সে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে।
একটা বড় বাথটাব ভর্তি পানি। মুন বসে আছে পানির মধ্যে। তার নাক বরাবর ডুবে যাচ্ছে পানিতে। মুন বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে। তিন, সাড়ে তিন বছরের বেশ গোল্লুগাল্লু বাচ্চা মুন। তবে এত পানির মধ্যে ভারসাম্য রাখা কষ্টকর হয়ে পড়েছে তার জন্য। সোহা একটা হাত দিয়ে মুনের বাহু ধরে আছে। মুন পানিতে খুব মজা পাচ্ছে। মাঝেমাঝে সে সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে। খিলখিল করে হাসছে সে। সোহার দিকে তাকিয়ে সে বলছে
– তুমিও আসো মম্….

সোহা হাসছে। কিন্তু কেমন যেন সেই হাসি। সে মুনের বাহুটা ছেড়ে দিল। মুন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ল। সোহা এগিয়ে গিয়ে পানির ফ্লো বাড়িয়ে দিল। গভীর বাথটাব আরও পানিপূর্ণ হয়ে উঠল।
মুন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। সোহা দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তার দিকে। কি সুন্দর সোহার হাতদুটো। ফর্সা, নিটোল আঙুল। কিন্তু কি করতে যাচ্ছে সোহা?

ঘুমের মধ্যে আতঙ্কিত লানা। তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। চিৎকার করে তার বলতে ইচ্ছে করছে, মুন পালাও, উঠে এসো পানি থেকে। তোমার বিপদ মুন…. প্লিজ… বেবি…উঠে এসো…

লানার গলা থেকে স্বর বের হচ্ছে না। সে ছটফট করছে নিজের বিছানায়। ক্রুর হাসছে সোহা…। মনে হচ্ছে সে লানার ছটফটানিটা টের পাচ্ছে।
লানা তীব্র স্বরে বলতে চাইছে
– প্লিজ সোহা, এটা করো না। মুন তোমার নিজের মেয়ে… ওকে মারবে কেন? আমাকে মারো…। প্লিজ ওকে নয়….
কিন্তু লানার গলায় কোন শব্দ নেই। তবু কোন অদ্ভুত উপায়ে যেন সোহা শুনতে পাচ্ছে তাকে। হিসহিস করে বলছে , খুব দরদ তাই না?

সোহা এবার শব্দ করে হাসছে। তীব্র কটাক্ষ সে হাসিতে। সোহাকে হাসতে দেখে মুনও তার মমের দিকে তাকিয়ে হাসছে খিলখিল করে। দু’হাতের তালু দিয়ে সে ছলছল শব্দ করছে পানিতে।
আহা, কি পবিত্র, মায়াকাড়া হাসি মেয়েটার। হে খোদা, বাচ্চাটাকে বাঁচাও। আহ, কি পৈশাচিক হাসি সোহার। থামো সোহা… থামো…. প্লিজ থামো…

একি স্বপ্ন নাকি বাস্তব! লানার মনে হল সে গভীর ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু কিছুতেই জেগে উঠতে পারছে না। সে প্রাণপণে জেগে উঠতে চাইছে। সত্যি যেন এটা কোন দুঃস্বপ্নই হয়।

সোহা দুহাতে মুনের দুইবাহু শক্ত করে ধরেছে। এবার এক হাতে সে মুনের মাথাটা চেঁপে ধরেছে পানির মধ্যে। মুনের ছোট্ট শরীরটা নিরুপায়ভাবে ছটফট করছে আর বের হবার চেষ্টা করছে পানি থেকে।
লানা তীব্র চিৎকার করতে চাইছে, পারছে না। তবে তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে এবার শক্ত করে চেপে ধরতে পারল কিছু। মনে হল সে মুনের হাতটাই ধরতে পারল পানির নিচে। শরীরের ভেতর দিয়ে একটা সুতীব্র বিদ্যুৎ প্রবাহ যেন পার হয়ে গেল লানার।
চোখ খুলে, তীব্র ঝাঁকুনি খেল লানা। দেখল মুনকে পানির মধ্যে চেপে ধরে আছে সে। আতঙ্কিত লানা দুহাতে হেচকা টানে তুলে নিল মুনকে। দিশেহারা মুনের নাক, মুখ দিয়ে তখন পানি বের হচ্ছে। গলা আটকে গেছে, নিশ্বাস প্রায় বন্ধ।
লানা দ্রুত উপুড় করল মুনকে। নিজের হাঁটুর ওপর মুনের পেট চেপে ধরতেই গলগল করে মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেল পানি। খকখক করে কাশছে মুন। বাচ্চাটা কাঁদছে এখন।

লানা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল মুনকে। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিল মুখ। গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিল তাকে। টাওয়েল পেঁচিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল
– সরি..সরি, আ’ম সরি বেবি….।
মুন, সব ভুলে তার মম্ কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। লানাও কাঁদছে। ইস, এমন শিশু কি কখনও পারে তার মাকে অবিশ্বাস করতে? যাক, শেষ মুহূর্তে লানা যে আসতে পেরেছে এখানে সেটাই শুকরিয়া খোদার কাছে।

লানা বাথরুমেই অনেক্ষণ মুনকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকল আর ভাবল, সে কি তবে কানেক্ট হতে পারছে সোহার সাথে? নাকি সোহা ইচ্ছে করে আজ কানেক্ট হল তার সাথে? নাকি তাদের কারও ইচ্ছাতেই ঘটেনি এটা? কি হচ্ছে এসব?
তবে ঘুমের মধ্যে লানা এদের কর্মকান্ড দেখতে পেয়েছে এবং তার প্রচন্ড ইচ্ছে আর প্রচেষ্টায় সোহাকে থামিয়ে তার ভেতর আসতে পেরেছে । সোহা নিশ্চই এমতাবস্থায় স্বেচ্ছায় ট্রান্সফর্ম হয়নি আজ? আজ প্রথম সে সোহাকে দেখতে পেল এবং কথা বলল তার সাথে। মুখোমুখি নয়, তবু লানা কিছুটা আত্মবিশ্বাস পেল নিজের মধ্যে।

লানা কাল রাতে ঘুমাতে গিয়েছিল একটু বেশী রাতে। মনটা ছিল বেদনার্ত। জোহারের গলাটা শোনার পর থেকে তাকে দেখার তীব্র ব্যাকুলতা জেগেছিল মনে। জোহার তাকে চেনে না, জানে না, ভালওবাসে না। তবু না চিনেও জোহার ভালোবেসেছিল লানাকে। ক্ষনিকের জন্য হলেও লানা স্পর্শ করতে পেরেছিল মানুষটার হৃদয়। বুঝে নিয়েছিল জোহারের হৃদয়ের গভীরতা। জোহারও যেন এক ভালোবাসার কাঙাল, তৃষ্ণার্ত মরুভুমি বুকে নিয়ে বেঁচে আছে। অপেক্ষায় কাটছে তার দিনরাত। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, এই ভাবনায়।

লানাও চায়, জোহার আর মুনের জীবনটা ঠিক হয়ে যাক। সোহা শোধরাবে সে আশা ভুল। তবে সোহাকে থামাতে হবে। একটা কোন উপায় ভাবতেই হবে। নইলে এ ধ্বংসের খেলা থামবে কি করে?

মুন, লানার কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমের মধ্যেই কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর। মুনের ভেজা পোশাক পাল্টে লানা শুইয়ে দিল তাকে বিছানায়। এটা জোহারের বেডরুম। সোহা তো সাধারণত নিজের ঘরেই থাকে। আজ কি মনে করে একেবারে জোহারের বাথরুমে, তাও আবার মুনকে গোসল করানোর সময় এসে হাজির?

লানা নিজেও খানিকটা ভিজে গেছে। খুব ক্লান্ত লাগছে তার। মুনকে ঘুমন্ত রেখে সে নিচে নামল। অর্ধেক সিঁড়ি নামতেই জোহারের সাথে চোখাচোখি হল। জোহার বাইরে ছিল, মনে হল কেবলই ঢুকল বাড়িতে। সোহাকে উপর থেকে নামতে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে সে। চোখে ভয় মিশ্রিত কৌতূহল। বলল
– তুমি উপরে ছিলে এতক্ষণ? মুন কোথায়?
লানা ক্লান্ত স্বরে নামতে নামতে বলল

– মুন ঘুমিয়ে পড়েছে…
জোহারের চোখে খানিকটা অবিশ্বাস। সে লানার পাশ কাটিয়ে উপরে উঠতে উঠতে বলল
– এ অসময়ে মুন ঘুমোবে কেন?

লানা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল। তাও ভালো, জোহার সোহার ওপর ভরসা করছে না।

লানা ফিরে এসে কিচেনে ঢুকল। কিচেনটা এলোমেলো। লানা যদিও কিছু করতে পারে না, তবুও একটু কফি করে নিতে পারল।
টেবিলে এসে বসে দু’ চুমুক দিতেই জোহার ফিরে এলো। সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে।

সোহা আজকাল চা, কফি একদম পছন্দ করে না। জোর করে দিতে চাইলেও নেয় না। আজ এমন নিজেই নিজের কফি বানিয়ে কেমন আয়েশ করে চুমুক দিচ্ছে। আশ্চর্য।
লানা বলল
– জোহার, ডক্টর পার্থকে একটাবার ডেকে আনো। মুনের শরীরটা মনে হয় ঠিক নেই, একটু দেখে যাক।
– কেন, কি হয়েছে মুনের?

লানা কফিতে চুমুক দিল। জোহারকে কি বলবে সে ঘটনাটা। জোহারতো কিছুতেই বিশ্বাস করে না তাকে। মুন যে আজ পানিতে ডুবে গিয়েছিল প্রায় সেটা তো জোহারের জানা উচিৎ।

– তেমন কিছু না। পানিতে একটু বেশী দাপাদাপি করেছে। হয়তো ঠান্ডা লেগে গেছে। একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। তুমি ডক্টর পার্থকে খবর দাও, এসে একটু চেকআপ করে যাক।

জোহার হতাশ মুখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। উল্টোদিকের চেয়ারে বসতে বসতে বলল
– তুমি কি স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গেলে সোহা? কি করি তোমায় নিয়ে বলতো? আমি আর পারছি না বুঝলে? এবার ভাবছি আমেরিকায় গিয়ে তোমাকে একজন বড় সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাব

– কেন একথা বলছ…?

লানার মনে কৌতূহল। জোহারের চোখে হতাশা। জোহার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
– একমাস হয়ে গেল। ডক্টর পার্থ হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছেন।
– হোয়াট…
উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল লানা
কিছুটা অবাক জোহার

– সোহা, তোমাকে চেকআপ করতে এসে ওই সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিলেন ডক্টর পার্থ, তুমি কীভাবে ভুলে যেতে পার?

লানা ব্যাথাতুর চোখে তাকিয়ে আছে জোহারের দিকে। জোহার বলল
– প্রথমে আমি ভেবেছিলাম অন্যকিছু। কিন্তু তাকে হাসপাতালে নেবার পর জানা গিয়েছিল, তার হার্ট এ্যাটাক হয়েছে। ওনার সহকর্মীরা ভীষণ অবাক হয়েছিলেন জানো। কারণ, ওনার হার্টে নাকি কখনই কোন প্রবলেম ছিল না। তবুও মানুষের শরীর বলে কথা।

লানা আবার ধপাস করে ছেড়ে দিল নিজেকে চেয়ারে।

– জোহার, জোহার সামনে আমাদের অনেক বড় বিপদ ধেয়ে আসছে। তোমাকে সাবধান হতে হবে

– মানে…?

লানার কেমন যেন দিশেহারা লাগছে । বলল
– তুমি আমাকে বিশ্বাস কর বা না কর, তুমি আমাকে পাগল ভাবলেও কথাগুলো আমি বলব জোহার।
– কি এমন কথা সোহা?
লানার চোখে কান্না। সে কেমন দিশেহারা গলায় বলল
– জোহার, তুমি মুনকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাও। সোহা থেকে অনেক দূরে…। সোহা তোমাদের জন্য ভয়ঙ্কর। ও কাউকে বাঁচতে দেবে না। প্লিজ তুমি এ বাংলো ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাও। নিজের কথা না ভাবো, মুনের কথা ভাবো।

থ হয়ে জোহার তাকিয়ে থাকে অনেক্ষণ। ডক্টর পার্থর মৃত্যুর পর জোহার বড্ড একা হয়ে গেছে। সোহাকে সামলাবার আর কেউ রইল না। এখন দেখা যাক, আমেরিকায় সোহার বাবা যদি কোন উপায় করতে পারেন। আশ্চর্যজনক কথা হল, সোহার বাবা রিজভি সাহেব, সোহাকে নিয়ে তার আমেরিকায় যাওয়াটা কেন যেন সমর্থন করছেন না। এমনকি ব্লু সি বিচের ভরাডুবিতেও তিনি নির্লিপ্ত। জোহারের একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে, শেষপর্যন্ত সোহার বাবা কম্পানিটা বাঁচাতে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং জোহারের ওপর খানিকটা বিরক্তি দেখিয়েছেন। জোহার বিব্রত, তবুও এই মুহূর্তে তার শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। আফটার অল সোহা তার মেয়ে। কাগজপত্র তৈরি হতে খানিকটা সময় গেল। তার ওপর ডক্টর পার্থর মৃত্যুটাও তাদের জন্য শোকের। মানুষটা এ পরিবারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল।

– এই বাংলোটা এমনিতেও হয়তো ছাড়তে হবে আমাদের সোহা। দেখি, ফিরে এসে একটা ব্যবস্থা করব। এখন এ ক’টা দিন একটু শান্ত থাকো। আর উল্টোপাল্টা কথা বলা বন্ধ কর প্লিজ।

লানা নিজের চোখ মুছে স্থির হল। বলল
– তোমার কম্পানি হারাবে না, জোহার। তোমার বাংলোটাও থাকবে। দেখবে, কেউ না কেউ হাত বাড়াবে তোমার দিকে। তোমাকে সাহায্য করবে।

মুচকি হাসল জোহার। হয়ত অবান্তর কথা শুনে ব্যাঙ্গ করল।

– তেমন বন্ধু আমার কই সোহা?
লানা মায়াবী, ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। মনে মনে বলল
“এই যে আমি, লানা। সোহার রূপ ধরে বারবার তোমার কাছে আসি। তোমার কাছে এসে তোমাকে, মুনকে দেখতে দেখতে কখন যে এত মায়া জমে গেল, কখন যে এতটা ভালোবেসে ফেললাম তোমাদের, নিজেও জানলাম না। ”

মুখে বলল
– আছে, পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও নিশ্চই তোমার জন্য কেউ আছে

অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে জোহার। মাঝে মাঝে হঠাৎ সোহাকে তার বড্ড অচেনা লাগে। তার পাশে থাকা এই মেয়েটা কোনদিনও তাকে বুঝল না। ভালোবাসা তো দূরের কথা, ঠিকঠাক মত সংসারধর্মটাও হল না তার সাথে। মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় সব ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু মুনের কথা ভাবলে, তা আর হয়ে ওঠে না। কিন্তু এই যে এখন যে সোহা বসে আছে তার সামনে, আশার কথা শোনাচ্ছে, ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে, উদ্বেগ দেখাচ্ছে জোহার আর মুনের জন্য, এসব কেমন যেন বিভ্রান্ত করে দেয় জোহারকে। মাঝে মাঝে সোহা এমন করে কথা বলে। তখন সত্যিই মনে হয়, সোহার মাঝে এ অন্য কেউ। হাস্যকর হলেও তখন সত্যিই ওই কথাটা মনে হয়, যখন সোহা তাকে বলে, আমি সোহা নই, অন্য কেউ। কি যেন একটা নাম বলে নিজের?

জোহারের মনটা খুব খারাপ। আজকাল তার আগেকার সেই ফিটফাট ভাবটা আর নেই। চুল গুলো এলোমেলো, জামা কাপড়ের পরিপাট্যও নেই। সারাক্ষণ কি যেন ভাবছে। ইউ এস এ তে যাবার গোছগাছ করতে গিয়ে সে বাড়িতে অনেক জিনিস খুঁজে পেয়েছে। জিনিসগুলো সোহার। জোহার জিনিসগুলোর সাথে সোহাকে ঠিক মেলাতে পারে না।

এ বাংলোটা অনেক পুরাতন। রিজভির বাবা এ বাংলোটা কিনেছিলেন এক সময়। তার মৃত্যুর পর আমেরিকা থেকে ফিরে এসে কোম্পানির দায়িত্ব নেয় রিজভি।

সোহা যখন বারো, তেরো বছরের, তখন তার ছোট ভাই তিহাম মারা যায় এ বাংলোতে। সোহার মা রাখিও এ সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। নানন ঘটনা দুর্ঘটনায় রিজভি এদেশের পাট চুকিয়ে আমেরিকায় চলে যাবার সিধ্বান্ত নেয়।

এসময় বেশ কয়েকজন কাছের ও বিশ্বাসভাজন কর্মচারী রিজভিকে এতবড়, প্রতিষ্ঠিত একটা প্রতিষ্ঠান ভেঙে না দিতে অনুরোধ জানাল। রিজভি ভাববার সময় নিলেন।
অবশেষে রাজি হলেন।

রিজভির চলে গেলেন তবে কোন এক রহস্যময় কারণে তার তেরো বছর বয়সী মেয়ে, সোহাকে রেখে গেলেন বাংলাদেশে। বলে গেলেন দু’ এক বছরের মধ্যেই হয়তো ফিরে আসবেন আবার। তিনি তার এক জ্ঞাতি বোন, ঝরনা বুবুর তত্বাবধানে রেখে গেলেন সোহাকে, এই বাংলোয়। সোহা সেই থেকে তার ঝরনা ফুপুর তত্বাবধানেই বড় হয়েছে।

রিজভি চলে যাবার পর সব ঠিকঠাকই ছিল। তবে কয়েক বছরের মধ্যে রিজভি আর ফিরলেন না। সোহা যখন কলেজে পড়ে তখন ব্লু সি বিচের অবস্থা পড়তির দিকে। ঠিক এমন সময় জয়েন করে একজন তরুণ, মেধাবী এমপ্লয়ি, জোহার।
জোহার জয়েন করার পর ব্লু সি বিচের চেহারা ফিরতে থাকল। সে সময় জোহারের রোজ কথা হত , ভিডিও কনফারেন্স হত রিজভির সাথে। রিজভি এই দূর্দান্ত স্মার্ট, দক্ষ, সৎ ও পরিশ্রমী ছেলেটিকে পছন্দ করে ফেললেন।
এর কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন রিজভি ফিরে এলেন একা। তবে অল্প সময়ের জন্য।

রিজভি এসে অনেকগুলো কাজ করলেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কাজ হল, তিনি
জোহারের ব্যাপারে অনেক খোঁজ খবর করলেন। ফিরে যাবার আগে একদিন জোহারকে ডেকে যা বললেন, তার জন্য জোহার মোটেই প্রস্তুত ছিল না। রিজভি বলেছিলেন,

– জোহার, আমি আমার এই সমস্ত প্রপার্টি তোমার নামে করে দিতে চাই।
আতকে উঠেছিল জোহার। বসের কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত?
রিজভি বলল
– তোমাকে চিনতে আমার একটুও ভুল হয়নি জোহার। তবে এই সমস্ত প্রপার্টির সাথে আমি তোমাকে আরও একটি প্রপার্টি দিয়ে যেতে চাই। আমি সোহাকে রেখে যাচ্ছি বাংলাদেশে।

– কি বলছেন স্যার? কিন্তু কেন?
– কিছু সঙ্গত কারণেই আমি সোহাকে নিজের সাথে নিতে চাচ্ছি না জোহার। তাছাড়া আমি সোহাকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই। ওর বয়স এখনও আঠারো হয়নি। নইলে বিয়েটা আইনত দিয়েই যেতাম। নো প্রবলেম, ঝরনা বুবু খুব শক্ত মানুষ। আমি ওনার তত্বাবধানে সোহাকে রেখে যাব। সোহা আর তোমার বয়সের ব্যবধানটা সামান্য বেশি। তবু ও কিছু নয়। সোহার কলেজ শেষ হলেই তোমাদের বিয়েটা হয়ে যাবে। আমি ওখান থেকে সবকিছু ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রন করব।

– একটা প্রশ্ন করতে পারি স্যার?
– করো…
– এইসব প্রপার্টি আপনি চাইলেতো সোহার নামেই দিতে পারেন, আমাকে কেন?
– এ প্রশ্নের উত্তর আমি এখন তোমাকে দিব না জোহার। সোহা ছেলেমানুষ। তাছাড়া তুমি হবে আমার জামাতা। সব তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি মানেই সব ছেড়ে যাচ্ছি, তা তো নয়। তোমার ওপরও আমার পূর্ণ খবরদারি থাকবে। তুমিও আমার নিয়ন্ত্রণাধীন। এতদিন আমার অধীনে কাজ করে আমার ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি সম্বন্ধে জেনেছ নিশ্চই তুমি?

জোহার মাথা অবনত করেছিল। তার অল্প কয়েকদিনের মধ্যে রিজভি আইনত কম্পানি হস্তান্তরের সমস্ত কর্মকান্ড সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন। সোহা ছিল নির্বিকার। সে দুঃখিত হলেও তার বাবার এই অদ্ভুত চলে যাওয়ায় ছিল নির্বিকার। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লেগেছিল জোহারের। তবু এই অপূর্ব সুন্দরী, বাদামী চোখের মেয়েটির স্বত্ব লাভে আপ্লুত ছিল মন। অত গভীর চিন্তার প্রয়োজন পড়েনি তাই।

রিজভি চলে যাবার পর, অফিসের সর্বময় কর্তা হয়েছিল জোহার। ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছিল খুব। তবে সকলের সহযোগীতা পেয়েছিল সে। কিন্তু সোহার উদাসীনতা দেখেছিল দিনের পর দিন। সোহা কলেজে ভর্তি হয়ে বেশ উৎফুল্ল, স্বাধীন জীবন উপভোগ করছে। মাঝে মাঝে বেশ খটকাও লাগত জোহারের। সোহাকে একা রেখে বাবা মাকে যেতে দেয়া কি ওর ঠিক হয়েছে?

এখানে একা থেকে যাওয়ার উদ্দেশ্যটা নিশ্চই জানে সোহা। কই, কখনও জোহারের দিকে অমন দৃষ্টিতে তাকায়নি তো সোহা। বরং কোন উপলক্ষ, অজুহাতে বাংলোতে গেলে সোহা তাকে এড়িয়ে যাবারই চেষ্টা করে। তবে কি বয়সের ব্যবধানটা একটা বড় কারণ? কিসের ব্যবধান? এতো সামান্য ব্যাপার। নাকি সোহা নিজেই এখনও পড়ে রয়েছে কৈশরে?

দ্বিধা ছিল, তবু অপেক্ষাও ছিল। কিন্তু একদিন ঝরণা ফুপু গোপনে ডেকেছিলেন তাকে। আড়ালে ফিসফিস করে বলেছিলেন,
– রিজভি শুধু তোমাকে তার অফিসের দায়িত্বই দেয়নি, তার সোমত্ত মেয়েটিকেও রেখে গেছে তোমার দায়িত্বে। অত লজ্জা পেলে সব হারাবে। সোহা দিনদিন কেমন উড়নচণ্ডী হয়ে উঠেছে। নানা বন্ধু বান্ধবের সাথে যখন তখন চলে যায়। তোমার উচিৎ তাকে দেখে শুনে রাখা। আমার কিন্তু তেমন ভাল ঠেকছে না বাবা।

জোহার মাথা হেলিয়ে সন্মতি জানিয়েছিল। তারপর একদিন হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল সোহার কলেজ ক্যাম্পাসে। সেখানে গিয়ে চোখের ওপর যা দেখল তাতে মন ভাঙলেও জোহার ভেঙে পড়ল না। ছেলেটির নাম প্রতীক, কলেজ ক্যাম্পাসের কাছেই নিরিবিলিতে, একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রতীক। তারই বাহুলগ্না হয়ে দাঁড়িয়েছিল সোহা।

জোহারকে দেখে একটুও বিচলিত হল না সে। বলল
– আপনি হঠাৎ এখানে?
– এলাম, তোমাকে দেখতে
– দেখা তো হয়েছে, এবার চলে যান

– সোহা, আমি তোমার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই।
– আমি চাই না
– প্লিজ চলো, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে
– বললাম তো, আপনি যান। আর কক্ষনো আমার কলেজে এসে এভাবে বিরক্ত করবেন না।
– আমি বিরক্ত করেছি?
– অবশ্যই বিরক্ত করেছেন। আর শুনুন, একটা কথা কখনই ভুলে যাবেন না, আপনি নিতান্ত আমাদের একজন কর্মচারী

জোহার কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকল। বুঝল, সে বেশ দেরী করে ফেলেছে। কিন্তু আর নয়। জোহার কিছুটা অপমানিতও বোধ করল। সে সোহার একটা হাত ধরল এবং শান্ত কন্ঠে বলল
– সোহা, চল আমার সাথে। যা বলার ওদিকে গিয়ে বলো।
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে সোহা হিসহিস করে বলল
– হাউ ডেয়ার ইউ, খবরদার আর কক্ষণও আমাকে টাচ করার সাহস করবে না। নইলে এমন শিক্ষা দিব যে, সারা জীবন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

জোহার মুচকি হাসল। সে তাৎক্ষণিক, নিজের ভুলটা বুঝতে পারল। তাইতো, সোহা একটা অপরিণত মেয়ে। এক কথায় তাদের কম্পানির একজন এমপ্লয়িকে সে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নেবে কেন? তার নিজস্ব একটা জগত থাকতে পারে, ভালোলাগা থাকতে পারে। আফটার অল সে রিজভি আহমেদের একমাত্র মেয়ে।

জোহার সরি বলে সেদিনকার মত চলে এসেছিল। সারাপথে সে নিজের আচরণের জন্য লজ্জিত হল। প্রথম দিনেই মেয়েটির মন বিষিয়ে দেয়া ঠিক হল না। তবু এমন রাগী, জেদী সোহার ভয়ঙ্কর লাল হয়ে যাওয়া মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল মানসপটে। জোহার বুঝল, সে সোহার প্রেমে পড়ে গেছে। সুন্দর, বাদামী চোখের রাগী মেয়েটা জোহারের হৃদয়ে যেন ভালোবাসার চাবুক মারতে থাকল বারবার।

মাথাটা ব্যাথায় টনটন করছে। জোহার নিজের ডেরায় ফিরল তীব্র মাথা ব্যাথা নিয়ে। ক্রমশ ব্যাথা সহ্য ক্ষমতা ছাড়াল। রিজভির বন্ধু ও তাদের পরিচিত ডাক্তার পার্থ এলেন জোহারকে দেখতে। তিনি ঔষধ দিলেন। কোন কাজ হল না। সারারাত অসহ্য ব্যাথায় ,ছটফট করে ভোরের দিকে নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল জোহার। ঘুমের মধ্যে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল সে। দেখল, রাগী থমথমে মুখে তাকিয়ে আছে সোহা তার দিকে। ঠোঁটে বিদ্রুপ ফুটিয়ে বলছে, আমার হাত ধরার সাহস হয় কি করে তোমার? এখন কেমন মজা, বোঝ।
সোহা খিলখিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে।
কি ভয়ঙ্কর সুন্দর হাসি মেয়েটার।
( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here