#চোরাবালি_১৩
রেশমা আক্তার
শাহের আজ ভোর পাঁচটার দিকে মারা গেছে। খবরটা পেয়ে লানারা ছুটে এসেছিল সবাই। শাহেরের বাবা, ভাই সবাই এখনও হাসপাতালের ভেতরে আছে। শাহেরের পোস্টমর্টেম হবে কিনা এখনও সিধ্বান্ত হয়নি। তবে মনে হয়, ওর পরিবার ওসব চায় না। শাহের তার বন্ধুদের সাথে বেড়াতে এসে একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। শাহেরের বাবা বহু বছর থেকে এই ছেলেমেয়েগুলোকে চেনে। এদের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আনবে সে? তাছাড়া এখানে অভিযোগ আনার মত কোন কারণ ঘটেওনি। যে চলে গেছে তার অহেতুক কাটাছেড়া করে লাভ কি?
লানা এখন দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালের সামনে। তার সাথে বাকিরাও ছিল
লানার মনে একটা ছোট্ট অস্বস্তি ছিল। যেহেতু ট্যুরে অনেকেই দেখেছে যে রাতে লানা, শাহেরকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, আর পরদিন সকালেই শাহেরকে পাওয়া গিয়েছিল খাদের নিচে। সুতরাং শাহেরের মৃত্যু হলে সবাই লানার দিকে আঙুল তুলবে সেটাই স্বাভাবিক।
এ কাজটা যে সোহা করেছে তাতে স্বন্দেহ ছিল না। প্রথমে ইমাদকে মারার প্ল্যান ছিল, শাহের দেখে ফেলায় তাকে আগে মরতে হয়েছে। তবে লানার অনুপস্থিতিতে সোহা নিজেকে বাঁচানোর কি প্রচেষ্টা চালায় সেটাও দেখার কৌতূহল ছিল লানার। ফেঁসে যাবার ভায়টা তাই উপেক্ষা করেছিল সে। তবে শাহের তার বন্ধু। শাহেরের জন্য কষ্ট হচ্ছে খুব।
শাহেরের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সকালবেলা তারা সবাই হাসপাতালে এলে, লানা জানতে পারল যে, লানা যে কাল সারারাত শাহেরের পরিজনদের সাথে হাসপাতালে ছিল, তার জন্য লানার প্রতি কৃতজ্ঞ তারা।
ডাক্তার কাল রাতে শাহেরের ব্যাপারে অনেক আশার কথা শোনালে ভোররাতের দিকে সবাই একটু নিশ্চিন্ত হয়েছিল। লানাও তখন ফিরেছিল নাকি হোটেলে। কিন্তু তার কিছুক্ষণের মধ্যেই নাকি শাহেরের অক্সিজেন ক্রাইসিস হয়। নার্স টের পেয়ে যতক্ষণে ডাক্তারকে খবর দিয়েছে ততক্ষণে শাহেরের মৃত্যু হয়ে গেছে।
এদিকে, লানা জেগে উঠেছিল ভোরেই হোটেলকক্ষে। ইমাদের আসা ফোনের রিংটোনে। ইমাদ জানালো, শাহেরের খবরটা। হাসপাতালে এসে বাবুনের ব্যবহারেও পরিবর্তন দেখতে পেল। বাবুনের চোখের স্বন্দেহটা আর নেই। বরং লানাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল শাহেরের জন্য। অনেক স্মৃতিচারণ করল শাহেরের। খানিকটা অদ্ভুত লাগলেও বুঝল লানা, সব ম্যানেজ করেছে সোহা। তবে হোটেল কক্ষ ছেড়ে একা এসে সারারাত হাসপাতালে থাকা আর ভোররাতে চলে যাবার পারপরই শাহেরের মৃত্যু অনেক হিসেব সহজ করে দেয়।
সিদ্ধান্ত হল আজই ঢাকা ফিরবে তারা সবাই। লানা ভারাক্রান্ত মুখে দাঁড়িয়ে ছিল একটা গাছের নিচে। ইমাদ কাছে এসে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল
– তুমি সারারাত হাসপাতালে ছিলে? কই আমাকে বলে আসলে নাতো? তুমি ডিস্টার্বড, তাই তোমাকে বিরক্ত করলাম না রাতে। মধ্যরাতে একা চলে এলে, তুমি আমাকে বলতে পারতে, আমিই নিয়ে আসতাম।
লানা, ইমাদের দিকে না তাকিয়েই বলল
– ইমাদ, কাল আমি ছিলাম না এখানে। কাল রাতে ঘুমের মধ্যে আমি আবার চলে গিয়েছিলাম জোহারের বাংলোতে। আমার ঘুম ভেঙেছে আজ সকালে, তোমার ফোন পেয়ে।
– লানা প্লিজ, বি সিরিয়াস। শাহের মারা গেছে। এ মৃত্যুতে সামান্য হলেও আমাদের সবারই একটা দায় আছে। এখন ওসব অবাস্তব গল্প কর নাতো।
– ইমাদ, কোন ব্যাপারই অবাস্তব নয়। তোমাকে কাল তার প্রমান দেখিয়ে এনেছি।
– হতে পারে ওটা তোমার পরিচিত কোন জায়গা। তুমি আগে থেকেই ঠিকানা জানতে, ওদেরকে চিনতে।
লানা আহত চোখে তাকিয়ে আছে ইমাদের দিকে। বলল
– এতটা অবিশ্বাস কর তুমি আমাকে?
ইমাদ নিজের ভুল শোধরানোর চেষ্টা করার আগেই হনহন করে হাঁটা দিয়েছে লানা। লানার পেছনে ছুটছে ইমাদ।
– রাগ কর না লানা প্লিজ, আমার মাথার ঠিক নেই। শাহেরটা চোখের ওপর চলে গেল। তার ওপর তোমার এই অদ্ভুত ব্যাপারটা, ঠিক মেলাতে পারছি না।
লানা নিরুত্তর, সে খুব দ্রুত হাঁটছে। ইমাদ তাল মেলাতে মেলাতে বলল
– কোথায় যাচ্ছ বলবে তো।
লানা হাঁটতে হাঁটতেই বলল
– আমি এখন যাব ‘ ব্লু সি বিচ’ এর সন্ধানে। দুপুর নাগাদ আমাদের ফ্লাইট। আমি দুপুরের আগেই হোটেলে ফিরে আসব, ডোন্ট ওরি
– ডোন্ট ওরি মানে? আমিও যাব তোমার সাথে..
লানা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ল ইমাদের। বলল
– যাকে বিশ্বাস কর না, তার পাগলামীতে শরীক হবার কোন দরকার নেই।
– প্লিজ লানা, আমাকে ভুল বুঝ না। চল, কোথায় যেতে চাও আমি নিয়ে যাচ্ছি।
লানা, ইমাদকে নিয়ে অনেক ঘুরে ফিরে ‘ ব্লু সি বিচ’ এর অফিস খুঁজে পেল। সিলগালা করা আছে। তবে আসেপাশে কেউ তেমন কোন তথ্য দিতে পারল না। লানা হতাশ হল। ফিরে গেল অফিসে। পথে অনেক কথা শেয়ার করল ইমাদকে। বলল
– ইমাদ শোন, পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার কোন ব্যাখ্যা নেই। কিংবা ব্যাখ্যা থাকলেও আমরা যে যার অবস্থান, জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার আলোকে সেগুলো বিচার করি। আমার সাথেও তেমন অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটেছে। তুমি শুনতে পার। তারপর তুমিও না হয় তোমার মত করে বিচার করবে।
এরপর সেই রাইসুলের পার্টি থেকে আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে ইমাদকে বুঝিয়ে বলল লানা।
ইমাদ মন দিয়েই শুনল। সবশেষে বলল,
– যদি এ সবকিছু সত্যি হয়, তাহলে তো সোহা আমাকেও মেরে ফেলবে।
লানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল
– আচ্ছা সব শুনে তোমার কি মনে হয়, সোহার এই যে সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার, এটা এতটাই পাওয়ারফুল যে, সে সময়কে নিয়ন্ত্রন করে অন্য একটা মানুষের শরীরে চলে যেতে পারছে?
কিছু একটা ভাবল ইমাদ। বলল
– ব্যাপারটা অদ্ভুত। তবে হ্যা, মানুষের ভেতর অদম্য শক্তি দিয়েছেন স্রষ্টা। কিছু শক্তি ঘুমন্ত, কিছু জাগ্রত। আবার কেউ কেউ তাদের ভেতরকার শক্তিকে জাগ্রত করে সাধনার মাধ্যমে। মেডিটেশন, ধ্যান, ব্ল্যাক ম্যাজিক, এগুলোর চর্চা চলছে বিশ্ব জুড়ে। আজকাল এগুলো উন্নত বিশ্বে বেশ জনপ্রিয় বিষয়। এমনকি আমিও কিছুদিন ছুটেছি এর পেছনে। তবে হ্যা, এটা মানুষ পজিটিভ বা নেগেটিভ দু’ ভাবেই ব্যবহার করতে পারে।
– হুম, ডক্টর পার্থ বলেছেন, সোহার ভেতর কিছু অস্বাভাবিক শক্তি শুরু থেকেই ছিল। তবে সম্প্রতি আমি ওর ঘরে আরও কিছু অদ্ভুত জিনিস দেখেছি, বললাম তো তোমাকে।
– হুম, তবে এই যে তোমাদের ট্রান্সফরমেশন, এখানে কিন্তু একটা ন্যাচারাল কো ইনসিডেন্ট আছে।
– মানে?
– মানে, দেখো লানা, তুমি দীর্ঘসময় ড্রাগ এ্যাডিক্টেড ছিলে। যদিও চিকিৎসার পর তুমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। তারপরও, সেদিন রাইসুলের পার্টিতে বাবুনের ড্রাগটা তোমাকে যতটা এ্যাটাক করেছিল, অন্য কাউকে কিন্তু অমন করেনি। তুমি চলে গিয়েছিলে একটা ডিপ হেলুসিনেশনে বা কি জানি হয়তো মস্তিষ্কের জাগ্রত কোন স্টেশনে। যেখানে সাধারণ অবস্থায় পৌঁছানো যায় না।
– তোমার কথাগুলো বুঝতে কষ্ট হলেও, একটা কেমন যেন লাইন খুঁজে পাচ্ছি। বলতে থাকো..
ইমাদ আবার বলতে থাকল,
– অন্যদিকে, সোহার নিজেরই কিছু ন্যাচারাল পাওয়ার আছে। তোমার বর্ণনা মতে, যদি সে ধ্যানট্যান করে থাকে তাহলে বুঝতে হবে তোমরা দুজনেই সে রাতে কোন সুপার ন্যাচারাল ওয়েভে একটা জায়গায় কানেক্ট হয়ে গিয়েছিলে। সময়ের একটা সার্কেলে, তুমি কিছুটা পেছনে আর সোহা কিছুটা সামনে চলে এসেছিল।
লানা ঘোরলাগা গলায় বলল
– গল্পের মত লাগছে ইমাদ, মনে হচ্ছে প্যারাসাইকলজিক্যাল কোন মুভি দেখছি, বাস্তবে…
– অদ্ভুত….!
দুজনেই এরপর চুপ হয়ে গিয়েছিল।
ঠিক হল, সংশ্লিস্ট ব্যাংক আর থানায় যোগাযোগ করে ব্লু সি বিচ সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করবে ইমাদ। ঢাকায় গিয়ে তাদের প্রধান কাজ হবে এটা।
আরও একটা ব্যাপারে তাদের কথা হলো। ইমাদ বলেছিল, সাজেকে এসে এই প্রথম আমি তোমার কাছ থেকে সাড়া পেয়ে বিভোর হয়েছিলাম লানা, কয়েকটা দিন আমাদের স্বপ্নের মত কেটেছিল।
লানা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। ভালোবাসা ব্যাপারটা এভাবে বলে কয়ে, কারো সাথে প্রস্তুতি নিয়ে শুরু হয়ে যাবে এটা কখনই ভাবেনি লানা। ইমাদের জন্য তাই কখনই কোন ভাবাবেগ তৈরি হয়নি তার মনে। কিন্তু নিজের অজান্তে, অনিচ্ছায়, একপ্রকার বানের জলের মত অপ্রতিরোধ্য হয়ে যেটা এসেছে জীবনে, সেটা হল জোহারের প্রতি তার একতরফা ভালোবাসা।
তার মনে আর কোন অনুভূতি নেই। চোখ বন্ধ করে ভাবছিল লানা।
ইমাদ বলল
– আমার কি হবে বলতো?
লানা না হেসে পারল না। বলল
– এসবের মধ্যেও তুমি ওসব ভাবছ ইমাদ? সোহা তোমার সাথে লানা সেজে ভালোবাসার অভিনয় করেছে। আমার মনে ওসব কখনও আসেনি। অল্প বয়সে বেশি আবেগের খেসারত দিয়েছি। একজনকে মন দিয়ে কষ্টও পেয়েছি। সেসব তো তুমি জানো। আর আজ এমন একজনকে ভালোবাসলাম যার জীবনে আমার কোন অস্তিত্বই নেই। আমার জীবনের সাথেও তার কোন সংযোগ নেই। মাঝখানে তুমি শুধু শুধু কষ্ট পেলে। আমাকে দিয়ে ওসব আর হবে না ইমাদ। আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে থাকব। আমাদের সামনে এখন ভয়াবহ বিপদ। সোহাকে থামাতে হবে। নইলে ওর তান্ডব থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। একবার ও এই ট্রান্সফরমেশন রপ্ত করতে পারলে একের পর এক রূপ পাল্টাবে।
ইমাদ তার ভারাক্রান্ত ভাবটা কাটিয়ে সিরিয়াস হল। বলল
– হুম, আমার জন্য বিষয়টা চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেল। আমি কি করে বুঝব বলতো, কে লানা, কে সোহা?
লানা গম্ভীর হল। বলল
– খুব সাবধান ইমাদ। তোমাকে খুব সাবধানে এটা হ্যান্ডেল করতে হবে। তবে আমার বা সোহার খুব কাছাকাছি যাবার দরকার নেই। আর আমাদের এসব গোপন আলোচনা আমি না তুললে, তুমি শুরু করবে না।
ইমাদকে এ বিষয়ে পাশে পেয়ে লানার খানিকটা স্বস্তি এলো। যাক এমন একটা মানুষতো পাওয়া গেল যে ব্যাপারটা বিশ্বাস করেছে এবং লানার পাশে আছে। কিন্তু এখন মূল কথা হল, ইমাদের না আবার কোন ক্ষতি হয়ে যায়। কারণ, সোহা জানে ইমাদ, লানাকে ভালোবাসে। সুযোগ পেয়ে সোহাও বেশ ভাব জমিয়েছিল ইমাদের সাথে। কিন্তু তাই বলে সোহা তো ছেড়ে দেবে না ইমাদকে। লিস্টেতো ইমাদের নামই ছিল আগে।
ইমাদকে নিয়ে তাই ভয় আছে কিছুটা।
বাড়ি ফিরে লানা যে সংবাদটা পেল সেটা ভালো নাকি মন্দ বুঝে উঠতে সময় লাগল। তার মম্ আর ড্যাডের মধ্যে সেপারেশন হয়ে গেছে। মম্ নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। আপাতত সে তার নিজের কেনা একটা ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছেন।
আর এদিকে নীল তাকে কোন কিছু না জানিয়ে ইউ এস এ তে চলে গেছে। লানার জন্য নোট রেকে গেছে
” খুব মজা করছিস বন্ধুদের নিয়ে, তাই ডিস্টার্ব করলাম না। খুব দরকারে যেতে হচ্ছে। যেটা তোকে বলি বলি করেও বলা হয়নি, ওখানে আমার সাথে একটি মেয়ের ভাব হয়েছে। ওর নাম এলা। ভাবছি এবার আমরা বিয়ে করব। এলার জন্যই যেতে হচ্ছে । কিছু জটিলতা আছে, সমাধান করতে পারলে ফিরে আসব। ভালো থাকিস। নিজের যত্ন নিস।
বি: দ্র: মম্ ড্যাড আলাদা হয়ে গেছে, এটাতে আমি খুশি। একটা অশান্তি দূর হল। তারা দুজন এখন নিজেদের মত করে বাঁচুক। তুই ইউ এস এ তে আসতে চাইলে আমাকে জানাস। আর যদি কাউকে বিয়ে করে বা সেপারেট থাকতে চাস, আমার পূর্ণ সমর্থন পাবি।”
এই চিঠিটা পেয়ে লানার ভীষণ রাগ হল, কান্নাও পেল। যদিও পারিবারিক কোন এ্যাটাচমেন্ট তাদের কোনকালেই ছিল না। ছোটবেলা থেকে তারা বড় হয়েছে আয়া বুয়াদের কাছে। মম্ চলে যাবার আগে তাকে একটা বারের জন্য ফোনও করেনি। হয়তো নীলের মত সেও ভেবেছে। তবু লানার মনটা কাঁদছে। ভীষণ একা লাগছে। এত বর বাড়িতে থেকেও নিজেকে বড্ড আশ্রয়হীন লাগছে আজ। লানা বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে রইল। সে কাঁদছে না, তবুও চোখ গড়িয়ে পানি ঝরছে নিঃশ্বব্দে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সোহা যদি সবার আগে তাকে মেরে ফেলত, ভালো হত। লানা চরিত্রটার এ দৃশ্যপট আর ভালো লাগছে না তার। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে অন্য কোথাও। যদিও কোথায় জায়গা নেই তার জন্য। সুতরাং মৃত্যুই শ্রেয়। হোক তা সোহার হাতেই।
কতক্ষণ কেটে গেছে মনে নেই। জেসি এসে ডিনারে ডাকল। লানা উঠে ফ্রেশ হল। নিচে গিয়ে আরও খারাপ লাগল। বাড়িটা ভুতুড়ে বাড়ি লাগছে। কেউ নেই কোথাও। ড্যাড দেশের বাইরে। লানার একটুও ফোন করতে ইচ্ছে করছে না মম্ কে। কিন্তু তাকে কথা বলতে হবে। মমের সাথে এই মুহূর্তে তার জরুরী কথা বলার আছে।
লানা রাতে ফোন দিল তার মমকে।
মম্ অভিমানী গলায় বলল
– ও, তুমি ফিরেছ? বাড়ি ফিরে শুনেছ নিশ্চই সব।
লানা অস্ফুট একটা শব্দ করল।
– হ্যা, ওই তো…
– দেখ লানা, নতুন করে আমার নিজের জন্য সাফাই গাইবার কিছু নেই। তুমি তো সবই জান। তোমার বাবার সাথে এক ছাদের নিচে আর থাকা সম্ভব নয়।
– মম্, আমি কিছুই জানি না আর জানতেও চাই না। তুমি যেখানে, যেভাবে ভালো থাকবে, তাই থাক। আর আমাদের বা আমাকে নিয়ে ভেব না। আমি আমার জীবনটা নিয়ে ভালো আছি।
– দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল।
– এবার কাজের কথা বলি মম্?
– কাজের কথা আবার কি?
– মম্, নীলতো ইউ এস এ তে সেটল্। তুমিও চলে গেলে। ড্যাড্ তো তার জীবন নিয়ে ছুটছে তার মত। এবার বলতো, আমার কি হবে?
– তোমার আবার কী হবে?
– মম্ আমি বিজনেস করতে চাই। দেখ, বিয়ে, ঘর সংসার আমাকে দিয়ে হবে না। সুতরাং আমর ফিউচারের জন্য তোমরা যা যা কিছু করতে চেয়েছ বা চাইছ তার বদলে আমাকে একটা বড় ফান্ড দাও, আমি বিজনেস করব
– কি করতে চাচ্ছ তুমি বলতো? কিসের বিজনেস? এই বয়সে তুমি কিসের বিজনেস করতে চাচ্ছ?
লানা একটু জড়তা কাটিয়ে বলল
– মম্ আমি ‘ ব্লু সি বিচ’ কম্পানীটা কিনে নিতে চাই।
– ‘ ব্লু সি বিচ’ ওটা তো ব্যাংকরাপটেড একটা কম্পানি।
– নো প্রবলেম, আমি ওটাই চাই
– বিজনেসটাতো ছেলেখেলা নয় লানা, তুমি বায়না করলেই যেকোন কিছু একটা তোমার হাতে তুলে দিতে পারব না।
– কম্পানিটা আমার চাই মম্, তুমি ব্যবস্থা কর
– অসম্ভব..! এটা কোন দামী খেলনা নয়।
লানা নিরুপায় বোধ করল, শেষ বারের মত চেষ্টা করল সে। বলল
– ঠিক আছে, আমার ভবিষ্যৎ টা তুমি তাহলে রিহ্যাবেই ঠিক করে দিও
– হোয়াট…?
লানা কট করে ফোন কেটে দিল।
মনে হয় এতেই কাজ হবে।
বিকেল নাগাদ ফোন করলেন একজন উকিল। উনি মূলত জোহারের হয়ে ব্লু সি বিচের পক্ষে লড়ছেন। তবে আপাতত সব শেষ। ব্যাংক তিনমাস সময় দিয়েছিল, তার মধ্যে দেড়মাস শেষ। লানা বর্তমানে জোহারের অবস্থান জানতে চাইল। যদিও সে জানে, জোহার এখন আমেরিকায়। তারপরও খুটিয়ে খুটিয়ে শুনল তার পরিবারের অবস্থা। লানা জানালো, সে টুয়েন্টি পার্সেন্ট প্রফিট দিয়ে ব্লু সি বিচ কিনে নিতে চায়। উকিল সাহেব যেন আকাশের চাঁদ পেলেন হাতে। লানা তাকে তার ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলে ব্যাংকের সাথে সমস্ত আইনী ঝামেলার একটা সুরাহা করে দিতে বলল উকিলকে। লানা তার ব্যাক্তিগত ফোন নাম্বারটাও দিল তাকে এবং প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে বলা হল।
পরের দু’একটা দিন উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগে কেটে গেল। ইউনিভার্সিটি, পড়াশুনা, আড্ডা, সবকিছুর মধ্যে একটা নিস্পৃহ একাকীত্ব জেকে বসে থাকল মনে। লানা বাসায় ফিরে আজ ল্যাপটপ নিয়ে বসল। ব্লু সি বিচের আদ্যোপান্ত ঘাটল। তারপর সন্ধ্যা নাগাদ ডোনাকে কোলে নিয়ে, কফির মগ নিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়াল। লানার একটা ফোন এলো ঠিক এই সময়ে।
জেসি এসে ফোনটা ধরিয়ে দিল হাতে।
– হ্যালো…
– হ্যালো…অ্যাম আই টকিং টু এ্যালানা অ্যাহমেড?
– ইয়েস…
– দিস ইজ জোহার
লানার দুটো কান যেন বধির হয়ে গেল…। নিজের কানদুটোকে বিশ্বাস হল না তার…
– হ্যালো… কে..? কে… বলছেন?
– দিস ইজ জোহার ফ্রম নিউ জার্সি, ইউ এস এ..
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো লানার
– জোহার…!
– হ্যা বলছি। আমার উকিল মিস্টার মমিনুল ফোন দিয়ে আপনার ব্যাপারে বলেছেন। আপনি নাকি টুয়েন্টি পার্সেন্ট প্রফিট দিয়ে আমার কম্পানিটা কিনতে ইচ্ছুক?
– জি ঠিক শুনেছেন…
ওপাশে খানিক নীরবতা
– ঠিক কি কারণে আপনি এমন একটা কম্পানি নিজের লস জেনেও কিনতে আগ্রহী হয়েছেন, জানতে পারি?
এবার এদিকেও খানিক নীরবতা।
– আসলে… কম্পানিটা সম্বন্ধে সব জেনেছি আমি। এক সময়কার এত প্রসিদ্ধ একটা প্রতিষ্ঠান কীভাবে এমন ভেঙ্গে পড়ল, কৌতূহল আমার। এমন মুখ থুবড়ে পড়া একটা যন্ত্রকে কীভাবে আবার সচল করতে হয়, আমি তারই একটা চ্যালেঞ্জ নিতে চাই ।
একটু চুপ থেকে জোহার বলল
– ইন্টারেস্টিং…. বাট আই ওয়ারন্ ইউ, ইট ক্যান বি টোটালি লস প্রজেক্ট ফর ইউ..
– আই ডোন্ট কেয়ার…। আপনার সাথে কি দেখা হতে পারে? সামনাসামনি আরও কিছু বিষয় জেনে বা বুঝে নেবার যদি সুযোগ হত…
– হুম…. নেক্সট উইকে আমি আসছি বাংলাদেশে।
– দ্যাটস নাইস অফ ইউ। বাই দ্য ওয়ে…ইউ ক্যান কল মি… লানা..
– লানা…?
লানার বুকের ভেতর তোলপাড়। জোহার কি চিনতে পারবে তাকে?
– ইয়েস জোহার, আ’ম লানা। ক্যান ইউ রিমেম্বর?
– নামটা মনে হয় আগে শুনেছি কোথাও।
– কোথায়…? কোথায় শুনেছেন জোহার… মনে করুন?
চোখদুটো বন্ধ করে কান পেতে আছে লানা। মনে মনে বলল, জোহার, আমি লানা। তোমাকে অনেকবার বলেছি, কে লানা…! প্লিজ মনে কর… প্লিজ…
জোহার খানিক ভাবল কিছু, তারপর বলল
– সরি, ঠিক মনে করতে পারছি না….
(চলবে)