#চোরাবালি_১১
রেশমা আক্তার
লানার তন্দ্রা ভাঙল জোহার আর ডক্টর পার্থর কথোপকথনে। সে চোখ বন্ধ করেই শুনতে পেল তাদের গলার স্বর। শরীরে একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি এলো লানার, যা এর আগে কখনই হয়নি। ভয় আর শঙ্কায় চোখ খুলবে কিনা ভাবছে সে। সে কি তবে আবার ফিরতে পেরেছে বাংলোতে?
কীভাবে….?
জোহার বলছে
– ডক্টর, সোহা আজকাল নিজের ঘরের ভেতরই যেন সবসময় থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে ।
নিঃশ্বব্দে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে অন্ধকারে।
ডক্টর পার্থ সমবেদনার কন্ঠে বললেন
– আহা জোহার, ক’টা দিন পুলিশ এসে যে হুজ্জোত শুরু করেছিল, তাতে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা। সোহা তো মেন্টালি এমনিতেও আনস্টেবল।
– হুম, রুমকির অমন অস্বাভাবিক মৃত্যু পর, পুলিশ তদন্ত করবে এটাইতো স্বাভাবিক, ডক্টর
– অস্বাভাবিক মৃত্যু কাকে বলছ জোহার? রুমকিকে সাপে কেটেছিল। শরীরে বিষধর সাপের বিষ শনাক্ত হয়েছে। এটা খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। এতে তো কারও কোন হাত ছিল না। তার জন্য তুমি ওর পরিবারকে অঢেল টাকা দিয়েছ, স্বান্তনা জানিয়েছ ব্যস, সব ডিসমিস্
– আপনি কি বুঝতে পারছে না ডক্টর, নাকি বুঝতে চাইছেন না ? পুলিশ, রুমকির মৃত্যুটা একটা এ্যাকসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিলেও, আমি পারিনি
– ব্যাপারটা একটা এ্যাকসিডেন্ট ছাড়া আর কি হতে পারে জোহার?
– ডক্টর, এই বাংলোতে এটাই প্রথম সাপে কাটা মৃত্যু নয়। এর আগেও অনেকগুলো অপমৃত্যু ঘটেছে। সাপের বিষে এর আগেও একজন মারা গেছে। অথচ সচরাচর এখানে তেমন সাপের উপদ্রপ নেই বললেই চলে।
– তুমি ঠিক কি বলতে চাইছ, খুলে বলবে জোহার?
জোহার একটু ছটফট করল। যেন কিছু বলতে চেয়েও কথা খুঁজে না পাওয়া। দোনোমনা করে বলল
– সোহা আজকাল অন্ধকারে বসে থাকে ডক্টর। দেয়ালে নানান আঁকিবুঁকি করে। মনে হয়, মনে হয় কিছু ধ্যান করছে…। ব্যাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না। টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি তে দাঁড়িয়ে এমন উদ্ভট আচরণ কি মেনে নেয়া যায়, আপনিই বলুন?
– মেনে না নেবার কি আছে জোহার? মেডিটেশন, ধ্যান, প্যারাসাইকলজি এখন উন্নত বিশ্বেও রীতিমত চর্চার বিষয় ওয়ে উঠেছে। খোদ আমেরিকানরাও এর দারুণ ভক্ত। চিকিৎসাবিদ্যায় প্রাচীন চীন জাপানের শৈল্যবিদরাও এর অন্ধ অনুসারী ছিলেন। এটাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার কিছু নেই।
– সোহার ক্ষেত্রে কি এসব মানায় ডক্টর? আপনি ওর বাবার খুব কাছের মানুষ, ওদের পারিবারিক ডাক্তার বলেই ভরসা করে কথাটা আজ বলতে পারলাম। আপনিই কি ওকে এসব সাজেস্ট করেছেন? সত্যি কথা বলতে, আজকাল আমার আপনাকেও কেমন রহস্যময় লাগে। আপনি কি সত্যিই সোহার ডাক্তার?
হো হো করে হেসে উঠলেন ডক্টর পার্থ। বললেন
– তুমি কিন্তু রীতিমত ডিটেকটিভ হয়ে উঠেছ জোহার… হা হা হা..
জোহারও হাসল। বলল
– ব্যাপারটা যদি আপনার মত এভাবে হেসে উড়িয়ে দিতে পারতাম ডক্টর। পিহুর মৃত্যুর পর সোহার সমস্ত পরিবর্তনকে আপনি বললেন, মেন্টাল শক। আপনিই তো বরাবর চিকিৎসা করেছেন ওর, কিন্তু ভালো হবার বদলে দিনদিন স্বাভাবিক জীবন থেকে ও তো আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
ডক্টর পার্থ গম্ভীর হলেন। বললেন
– আমার চিকিৎসায় কি কোন স্বন্দেহ আছে তোমার, জোহার?
জোহার স্পষ্ট চোখে তাকাল পার্থর দিকে।
– ডক্টর আমি তা বোঝাতে চাইনি। শুরু থেকে ভাবুন ডক্টর, সোহাদের পারিবারিক ইতিহাস, এই বাংলো, সোহার বেড়ে ওঠা…
ডক্টর পার্থ অধৈর্য্য গলায় বললেন
– কি বলতে চাইছ জোহার? স্পষ্ট করে বল…
জোহার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝুঁকে দাঁড়াল টেবিলে দুহাতে ভর দিয়ে। একটুক্ষণ ভাবল কিছু। তারপর বলল
– আমি জানি না ডক্টর। আমি কিছুই বলতে চাইছি না। শুধু মনে হচ্ছে কিছু আছে অস্বাভাবিক। কিন্তু সেটা কি, ধরতে পারছি না। আমি ভাবছি সোহার বাবা, আই মিন আঙ্কেলের সাথে একটু কথা বলব। কোম্পানীর অবস্থা ভালো নয় ডক্টর। একসাথে দুটো প্রবলেম আমি আর হ্যান্ডেল করতে পারছি না। এদিকে ইউ এস এ তে আমাদের ভিসার মেয়াদও কমে এসেছে। আমাদের একবার যেতে হতে পারে। আঙ্কেলের সাথে কথা বলা দরকার
ডক্টর পার্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– সেই ভালো…। আমি আজ চলি। আজ বারো’ই মার্চ দুই হাজার একুশ। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে আমার স্ত্রী মারা গিয়েছিল এই দিনে। নেহায়েত সোহার শরীর খারাপের কথা শুনেই আসা। এ দিনে আমি বাড়ি থেকে বের হই না, তুমি জানো। আমি সন্ধ্যা নাগাদ আসব আবার।
লানা পিটপিট চোখে দেখল, ডক্টর পার্থ আর জোহার বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। লাফ দিয়ে উঠে বসল লানা। এতক্ষণ মনযোগ দিয়ে যে কথাগুলো শুনল সে, তাতে কয়েকটা তথ্য অগুরুত্বপূর্ণ
এক, সাপের দংশনে মারা গেছে রুমকি।
দুই, সোহা অন্ধকারে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা।
তিন, সোহার ব্যাপারে প্রশ্ন জেগেছে জোহারের মনে। রুমকির মৃত্যুটা সাধারণ সাপে কাটার মৃত্যু বলে মনে হয়নি জোহারের।
চার, আজ বারোই মার্চ, একুশ সাল। অর্থাৎ সময় সামনে এগিয়ে গেছে।
গতকাল লানা যখন ইমাদকে নিয়ে বাংলোর সামনে এসেছিল, তখন ছিল ৫ই সেপ্টেম্বর, বাইশ সাল। অর্থাৎ জোহাররা এখনও আমেরিকায় যায়নি। জোহার কেবল আমেরিকায় যাওয়ার কথা ভাবছে। লানাকে আজ সব খুলে বলতে হবে জোহারকে।
লানা বিছানা থেকে নামল। আয়নায় দেখল নিজেকে। সোহা দিনদিন আরও বেশি আকর্ষণীয় ও কমনীয় হয়ে উঠেছে যেন।
লানা কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলো বাইরে। দেখল মুনকে নিয়ে তৈরি হয়ে জোহার যাচ্ছে কোথাও। লানাকে দেখে খুব অবাক চোখে তাকিয়ে আছে জোহার। লানার চোখ চিকচিক করছে। প্রত্যাশা, জোহার যদি চিনতে পারত তাকে।
মুন জোহারের হাত ছাড়িয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল লানাকে। মুন কি তার মম্ কে অনেকদিন পর কাছে পেল?
লানা গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরেছে মুনকে। জোহার দ্বিধান্বিত চোখে চেয়ে বলল
– তুমি এ সময়ে, বাইরে?
লানা মুনকে আলগা করে দিয়ে বলল
– কেন, আমি কি বাইরে আসি না?
লানা উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে।
জোহারের কপালে আরো ভাজ পড়ল। পড়ুক, জোহার বুঝুক সোহা আর লানা আলাদা। তারা দুজন এক নয়।
জোহার প্রসঙ্গ পাল্টাল। বলল
– আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে মুন, এসো….
লানা ছেড়ে দিল মুনকে। মুন আবার দৌড়ে তার ড্যাডের কাছে ফিরে গেল।
লানা জানতে চাইল
– কোথায় যাচ্ছ তোমরা?
– মুনকে নিয়ে একটু শপিং এ যাচ্ছি। খুব দরকারি কিছু জিনিসও ফুরিয়ে গেছে।
লানা খুব দ্বিধা আর আশা নিয়ে জানতে চাইল
– আমাকে সাথে নেবে? আমিও যাব…
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জোহার। বলল
– নিজের ঘরে যাও সোহা, ডক্টর বলেছেন, তোমার অনেক বিশ্রাম দরকার…
জোহার আর তাকাল না সোহার দিকে। মুনকে নিয়ে চলে গেল বাইরে। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল লানার। জোহারের চোখে সেই প্রসন্ন, ভালোবাসার দৃষ্টিটা আর নেই। কোথায় যেন জমে আছে জমাট কিছু মেঘ।
লানা বাঁধা দিল না। বরং সময় নিল, জোহারের বেরিয়ে যাওয়ার। তাকে আজ স্টাডির সেই গোপন কক্ষে ঢুকতে হবে। সোহা সম্বন্ধে জানতে হবে অনেক কিছু।
লানা, জোহারের বেরিয়ে যাওয়া নিশ্চিত জেনে
ধীরে ধীরে ঢুকে গেল স্টাডিতে। আগের চাইতে আরও বেশি ধূলো জমেছে। ঘুপচি ঘরটার ভেতর ঢুকে লানা দেখতে পেল, নিচে রাখা বাক্স দুটোতে মোটা ধূলোর আস্তরণ। লানা ধীরে ধীরে গিয়ে বসল আগের জায়গায় হাঁটু মুড়ে।
বাক্সের পাল্লা সরিয়ে বের করে আনল সেই নোট বুকটা। তবে টর্চটা আর জ্বলছে না। এত কম আলোতে পড়তে সময় লাগছে। তবু পড়তে হবে, এখানে বসেই। ঘুলঘুলির আলো যেখানে বেশি, লানা সেদিকে একটা পুরোনো বাক্সের ওপর বসল। নিজেকে ধাতস্থ করে লানা আবার চোখ রাখল নোটবুকে, আগে থেমে গিয়েছিল যেখানে।
০৪-০৮-০৮
রিতিশা আহমেদ ( ছবিটা আমার মমের হলেও আমি তাকে মারব না। মারব তার পেটে আমার শত্রুটাকে)
পেছনে নোট:
তিহামের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই সুখবরটা জানলাম। আমার নাকি আবার একটা ভাই আসছে। খবরটা শোনা অবধি মমের ওপর রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। কি চায় এই মহিলা? আমাকে কি সে নিজের মেয়ে মনে করে না? তার এত বাচ্চার দরকারটা কি? আবার বাচ্চা নেয়ার মজাটা বের করব আমি। রাতে তার দুধের মধ্যে অনেকগুলো জানা, অজানা ট্যাবলেট মিশিয়ে রাখলাম। পরদিন সকালেই মজা শুরু হল। মমকে নিয়ে যাওয়া হল নার্সিংহোমে। চারদিন পর মম ফিরল ফ্যাকাশে মুখে। আর দুঃসংবাদটাও পেলাম। পেটের শত্রুটা মরেছে।
১২-৪-১০
প্রতীক, বয়স ২৩, বয়ফ্রেন্ড
( দুর্ঘটনায় থেতলে যাওয়া একটি যুবকের ছবি)
পরের পৃষ্ঠায় নোট:
প্রতীককে ভালোবাসতাম আমি। মম্ ড্যাড আমাকে রেখে চলে যাবার পর, ওকে খুঁজে পেয়েছি । কলেজের সবকয়টা ছেলেদের মধ্য হ্যান্ডসাম আর রিচ প্রতীক। কিন্তু ইদানিং ওর আচরণ বদলে যাচ্ছে। মউ নামের আরেকটি সুন্দরী মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সারাক্ষণ। সেদিন আমার সাথে দেখা করার কথা বলে এলো না। কাকতালীয়ভাবে একটা রেস্টুরেন্টে খাবার কিনতে গিয়ে দেখি মউয়ের হাতে হাত রেখে এক কোণায় বসে ডেট করছে দুজনে। মাথাটা জ্বলে উঠল। আমার সাথে চিট করার শাস্তিটা তখনই ভেবে নিলাম। ওর গাড়িতে রাখা ড্রিংকসে মিশিয়ে দিলাম বিষধর সাপের বিষ। রোড এক্সিডেন্টে ওর মৃত্যুর খবরটা পেয়েই ছুটে গিয়েছিলাম দেখতে। আহা বেচারী মউ, খুব কাঁদছে। আমিও কাঁদলাম কিছুক্ষণ।
৫-৭-১৪
ঝরনা বেগম, বয়স ৬২, (জ্ঞাতি ফুপু)
মম্ – ড্যাড চলে যাবার সময় আমাকে ঝরনা ফুপুর কাছে রেখে গিয়েছিল। এই বাংলো বাড়িতে একজন কাজের লোক আর ঝরনা ফুপুর তত্বাবধানে থাকি আমি। ঝরনা ফুপু ইদানিং ইউ এস এ তে ড্যাডের কাছে আমার ব্যাপারে অনেক নালিশ জানিয়েছে। গত সপ্তাহে ফোনে ড্যাড আমাকে অনেক শাসন করলেন এবং জানালেন তিনি আমার জন্য পাত্র ঠিক করে ফেলেছেন বিয়ে দেবার জন্য। আমি হিসেব করে ফেললাম, ঝরনা ফুপুকে আমার আর দরকার নেই। বিয়েটা হয়ে যাক, তারপরেই ঝরনা ফুপু খালাস। আমার বিয়ের রাতেই সাপে কাটল ঝরনা ফুপুকে। তার ঘরে আমি কখন ঢুকলাম কেউ টের পেল না।
০৬-০৪-১৬
পিহু, বয়স: তিন ( জোহারের বাচ্চা)
(একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে বাচ্চার রক্তাক্ত শরীরের ছবি)
শরীর ভারী হয়ে আসছে লানার। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, বমিভাব হচ্ছে উত্তেজনায়।
কাঁপা হাতে ছবির পেছনের পৃষ্ঠার নোটে চোখ রাখল লানা।
নোট: জোহারের সাথে আমার বিয়েটা জোরপূর্বক। আমার প্রথম সন্তান ধারণও আমার অনিচ্ছায়। তাই পিহু আমার নয় বরং জোহারের একার বাচ্চা। ওদের দিকে তাকালেই মনে হয়, আমার ওপর চাপিয়ে দেয়া কোন ভার। এ ভার থেকে আমি মুক্তি চাই। আমি স্বাধীন হতে চাই। জোহারকে এই মুহূর্তে সরানো সম্ভব নয়।তাই পিহুকেই আগে সরালাম। তিনতলার ওপর থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছি। একটুও হাত কাঁপেনি।
লানা টপ করে বন্ধ করে ফেলল পাতাটা। কষ্টে, ঘৃনায় ছুড়ে ফেলল নোটবুকটা। কিছুক্ষণ দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর স্থির হয়ে আবার উঠে এসে নোটবুকটা তুলে নিল। এটা পড়ে শেষ করতে হবেই।
এরপর অনেকগুলো পাতা ফাঁকা। কোন ছবি নেই। তবে ছোট ছোট নোট আছে কয়েক পৃষ্ঠা পরপর
নোট-১:
রুমকি, বয়স তের/ চৌদ্দ। মুনের আয়া।
মুনকে সেকরিফাইস না করলে আমি আমার সাধনায় এগিয়ে যেতে পারছি না। কিন্তু জোহারের জন্য পারছি না সেটা। ইদানিং আবার রুমকি নামের একটি মেয়েকে রেখেছে ওর দেখাশোনার জন্য। অনেক ভেবে দেখলাম। আগে রুমকিকেই সরাতে হবে। কাজটা খুব সহজ।
নোট- ২:
শাহের: লানার বন্ধু। নতুন ট্রান্সফর্মে আমি লানা নামের একটি মেয়ের শরীর পেলাম। খারাপ না, সময়টা যদিও একটু এগিয়ে, তবু মজা পেলাম। নতুন সময় আর স্থানটা সইয়ে নিতে সময় লাগল কিছুটা। প্রথম টার্গেট ছিল ইমাদ। কিন্তু দেখে ফেলল শাহের। সুতরাং ওকেই সরাতে হল আগে। পাহারের খাদে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম।
আশা করছি ও শেষ।
নোট-৩:
ইমাদ: আমার নতুন প্রেমিক। ক’দিন ওর সাথে বেশ ফুর্তি করলাম। দারুণ একটা ছেলে। অর্থ, ক্ষমতা, প্রেম সব একসাথে পেলাম ওর ভেতর। ভাবছি ওকে এত তাড়াতাড়ি মারব না। ওকে দিয়ে অনেক কাজ হবে আমার।
নোট-৪:
ডক্টর পার্থ: ডক্টর পার্থকে আর দরকার নেই আমার। খুব দ্রুত একটা প্ল্যান করতে হবে, ওকে সরাবার।
নোট- ৫:
মুন : মুনকে সরানো সবচেয়ে সহজ। মুন পানি পছন্দ করে। বাথটাবে দীর্ঘসময় পানি দিয়ে খেলে ও। সুযোগমত গিয়ে মাথাটা চেপে ধরতে হবে বাথটাবে। শুধু সুযোগের অপেক্ষা।
জোহার : জোহারকে সরানোর সময় এসে গেছে। জোহারকে সরাতে পারলেই আমি স্বাধীন। আমার শক্তি আর ক্ষমতা পরিপূর্ণতা লাভ করতে যাচ্ছে। আমি অন্য কোন সময়ে গিয়ে, অন্য কারো শরীরে দখল নিব। আর এভাবেই অমরত্ব লাভ করব।
নোট-৬:
লানা: আমার নতুন রপান্তরিত শরীর। আর এজন্য, লানাকে মরতেই হবে। আমি স্থানান্তরিত হব লানার শরীরে। লানার শরীরে বাঁচতে হলে আমার নিজের শরীরটাকে মারতে হবে। কিন্তু সেই মোক্ষম সময়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাকে। সময়টা আমি আমার ইচ্ছে মত কমাতে পারছি না। তবে ধীরে ধীরে আমি এগিয়ে যাচ্ছি ভবিষ্যতে। যেদিন আমার এ রুপান্তর সঠিক দিন আর সময়কে ছুঁতে পারবে, সেদিনই আমি স্থায়িত্ব লাভ করতে পারবো লানার শরীরে। আমার শরীর আর লানার অস্তিত্ব মরবে। বেঁচে থাকবে আমার অস্তিত্ব, লানার শরীরে।
নোটবুকের লেখা এখানেই শেষ। লানা ঘামছে। এটাতো মাস্টারপ্ল্যান। নিখুঁত পরিকল্পনা যাকে বলে। মুন, জোহার, ডক্টর পার্থ, এমনকি লানা, কেউ বাকি নেই। সবাইকে মারার প্ল্যান করে রেখেছে সোহা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কথা হলো, সোহা মুন আর জোহারকেও ছেড়ে দেবে না। আচ্ছা লানা কি জোহারকে সমস্ত ব্যাপারটা বলবে খুলে? কি লাভ হবে? জোহার তো তাকে বিশ্বাসই করবে না। সে তো মানতেই চাইবে না যে, সোহা ইচ্ছে করলেই অন্য কারো শরীরে রুপান্তরিত হতে পারে। বিশ্বাস করবে না, সে আসলে সোহা নয়, লানা।
আচ্ছা, ডক্টর পার্থকে বললে কেমন হয়?
লানা নোট বুকটা জায়গামত রাখল এবং অন্যান্য ডায়েরী, এ্যালবামগুলোও খুটিয়ে খুটিয়ে দেখল।
বাইরে এসে সে নিজের জন্য কড়া করে এক কাপ কফি তৈরি করল। বাসার ল্যান্ড লাইন দিয়ে সে প্রথমে ইমাদকে ফোন দেয়ার চেষ্টা করল। জানাল, এই মুহূর্তে নাম্বারটি ব্যবহৃত হচ্ছে না। এরপর সে ঢাকায়, একের পর এক নিজের বাড়িতে, নীলকে, পরিচিতজনদের নাম্বারে ট্রাই করতে থাকল। কোন নাম্বারই এ্যাক্টিভ পেল না। এখান থেকে যে এই যোগাযোগটা অসম্ভব, আগেই ধারণা করেছিল সে। তবুও বুঝে নিল বিষয়টা। সময়ের এই ব্যবধানটা তাদের যোগাযোগকে দুটি ভিন্ন প্রবাহে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
জোহার এলো মুনকে নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে। মুন এসে দৌড়ে জড়িয়ে ধরল লানাকে। লানাও বুকে জড়িয়ে ধরল মুনকে। কপালে চুমু খেয়ে বলল
কেমন আছ মুন, বেবি… সুইটহার্ট…!
জোহার অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সে কিছুটা গম্ভীর গলায় বলল
– মুন, তুমি উপরে চলে যাও।
মুন, লানার হাত ছাড়িয়ে নিল।
লানা পরিবর্তনটা দেখল। খারাপ লাগছে তবে ভালও লাগছে। জোহার কি সোহাকে ভয় পাচ্ছে? এটা তো ভালো। আচ্ছা লানা কি সোহার গোপন ডায়েরী আর নোটবুকটা দেখাবে জোহারকে। বিশ্বাস না করুক তবু দেখলে হয়ত সতর্ক হবে। কিন্তু তাহলে সেওতো ফেঁসে যাবে। যতক্ষণ সে সোহার শরীরে থাকবে, সোহার সমস্ত কর্মকান্ডের দায়ভার তো তাকেই নিতে হবে।
জোহার প্রতিদিনকার মত খাবার তৈরি করে টেবিলে দিয়ে ডাকল লানাকে। বলল
– আমি আর মুন খেয়ে এসেছি বাইরে। তুমিও খেয়ে নাও।
লানা লক্ষী মেয়ের মত টেবিলে এসে বসল। জোহার চলে গেল উপরে। লানার কেমন একা লাগছে। জোহার কি তার ওপর রেগে আছে? নাকি সে সোহাকে স্বন্দেহ করতে শুরু করেছে? কিন্তু যতই স্বন্দেহ করুক, জোহার হয়ত কল্পনাও করতে পারছে না যে, সোহা তাকে আর মুনকে মারার প্ল্যান করতে পারে।
সন্ধ্যা নাগাদ এলেন ডক্টর পার্থ। লানা নিজের ঘরেই ছিল। ডক্টর পার্থ গলায় শব্দ করে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলেন। লানা বলল
– আসুন ডক্টর…
ভেতরে ঢুকে বিস্মিত ডক্টর পার্থ তাকালেন সোহার মুখের দিকে। সোহা সাধারণত তাকে আঙ্কেল সম্বোধন করে।
– কেমন বোধ করছ এখন মামনি?
লানা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে।
ডক্টর পার্থ তার ব্যাগ খুললেন। কিছু একটা বের করতে করতে বললেন
– পায়ের জখমটার কি অবস্থা দেখাওতো?
লানা গলা পরিষ্কার করল। বলল
– ডক্টর, আমি সোহা নই।
পার্থ ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন সোহাকে, তারপর মুচকি হেসে বললেন,
– হুম তাইতো, আমার সোহা মামনি তো এটা নয়। তাহলে এটা কে বসে আছে আমার সামনে?
– ডক্টর, আমার নাম লানা। আমি ঢাকার এক বিখ্যাত ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের মেয়ে। ‘সায়হাম গ্রুপ অব কোম্পানী’র নাম নিশ্চই শুনে থাকবেন। ওটা আমার বাবা, মায়ের। কোন এক অদ্ভূত উপায়ে সোহা আমার শরীরে এবং আমি সোহার শরীরে চলে আসছি। কিন্তু সেটা যাই হোক, এখন আমি আপনাকে একটা কথা বলব, আপনি মন দিয়ে শুনবেন। সোহা আপনাকে মারতে চায়। আপনি সতর্ক থাকবেন। সে আপনাকে মারার সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলেছে।
ডক্টর পার্থ প্রথমে থ হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর গম্ভীর মুখে বললেন
– সোহা, আমাকে ভয় দেখাচ্ছ কেন বলতো? আমি তো সবকিছু তোমার কথা মতই করছি। এখন পর্যন্ত তুমি যা যা করছ সব কিছুর বৈধ সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছি আমি। মানসিকভাবে অর্ধেক ভারসাম্যহীন দেখিয়ে পুলিশ, পরিবার পরিজন সবার কাছে তুমি ছাড় পেয়ে চলেছ দিনের পর দিন। তবুও আমাকে ভয় দেখাবে?
লানা অদ্ভূত চোখে তাকিয়ে আছে। বলল
– আপনি কি সোহার ব্যাপারটা জানেন ডক্টর পার্থ?
– তোমার কোন ব্যাপারটা আমার অজানা সোহা? সেই ছোট্টবেলা থেকে তোমাকে দেখে আসছি। কতটুকুই বা ছিলে, যখন রিজভি আর রাখি তোমাকে নিয়ে ফিরল দেশে। এই আট কি নয়? তোমার কিছু অস্বাভাবিকতা শুরুতে ছেলেমানুষি ভেবে উড়িয়ে দিয়ছিল তোমার বাবা মা। কিন্তু ধীরে ধীরে সে অস্বাভাবিকতা বাড়তেই থাকল। তোমার বাবা তখন আমার ওপর ভার দিলেন তোমার। তোমাকে শুরুতে আর পাঁচটা বাচ্চাদের মতই ভেবেছিলাম। কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারলাম, তুমি সাধারণ নও। একের পর এক জীব হত্যা করে তুমি যে আনন্দ পেতে, সেটাই ছিল বরং তোমার অসুখের একটা লক্ষণ।
তোমার বাবা খুব আপসেট হয়ে পড়েছিলেন। আমি কথা দিয়েছিলাম, আমি তোমার চিকিৎসা করব।
একমাস টানা আমি পর্যায়ক্রমে তোমার সাথে কথা বললাম। দেখলাম সত্যিই তুমি একটা মানসিক বিকারে ভূগছ। শুরু হল চিকিৎসা। আমিও উঠেপড়ে লাগলাম। একদিন হঠাৎ, আমি তোমাকে রাতে স্বপ্নে দেখলাম। দেখলাম, রাগে কটমট করে তাকিয়ে আছ তুমি। আমাকে এসব করতে বারণ করছ। বলছ, আমার পথ থেকে সরে যান নইলে… নইলে ক্ষতি করে দেব।’ পরপর তিনদিন একই স্বপ্ন দেখলাম। এরপর যেদিন তোমাদের বাংলোতে এলাম, দেখলাম দূর থেকে মিটমিট করে হাসছ তুমি। আমার মনের মেঘ কেটে গেল।
ভাবলাম, মিছেমিছিই দুশ্চিন্তা করেছি। সেদিন তোমার বাবার ঘর থেকে বের হয়ে ওই লম্বা সিঁড়ি দিয়ে নামতে হঠাৎ যেন কিছুতে ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেলাম। মারত্মক আঘাত পেলাম। পা ভেঙে বিছানায় পড়ে রইলাম এক মাস। আর তখন একদিন আবার স্বপ্নে তোমাকে দেখলাম। বেনী দুলিয়ে খিলখিল করে হাসছ তুমি। বলছ,’ বলেছিলাম না, ক্ষতি করে দিব। এখন কেমন মজা? আমার কথা না শুনলে আরও সাজা দিব।’
আমি বুঝলাম, তুমি কোন সাধারণ মেয়ে নও। কিছু একটা আছে তোমার মাঝে।
(চলবে)