#চোরাবালি_১
রেশমা আক্তার
সমুদ্রের তীর ঘেঁষে পানিতে পা ডুবিয়ে হাঁটছে লানা। যতদূর চোখ যায়, কুয়াশাচ্ছন্ন, মেঘ মেঘ। চারিদিকে পানির ছলছল শব্দ। লানা কতক্ষণ এভাবে হাঁটছে জানে না। কোথাও কিছু দেখাও যাচ্ছে না। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তার। অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, পা দুটো কেমন ভারী হয়ে আসছে। নিচে তাকিয়ে দেখল, চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে সে। লানা টেনে তুলতে পারছে না নিজেকে। সে প্রাণপণ নড়তে চাচ্ছে, কিন্তু কোন শক্তিই যেন নেই নড়ার। লানা ভয়ে চিৎকার করছে, কিন্তু কোন শব্দ বের হচ্ছে না গলা থেকে। তীব্র আতঙ্কে দিশেহারা হল লানা।
ঝনঝন শব্দে কিছু ভাঙার শব্দ। লানা চারিদিকে তাকাল, তীব্র আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল তার। সে তাকাতে পারছে না। তবে এখন সে নড়তে পারছে, হাত চাঁপা দিয়েছে চোখে। আলোটা চোখ সওয়া হতে না হতেই আবার প্রচন্ড শব্দে কিছু ভাঙার আওয়াজ।
লানা চোখ খুলতে পারল। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল। নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল, পা’গুলো এখনও কেমন আড়ষ্ট। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়েছে বিছানায়। ইদানিং স্বপ্নগুলো একদম বাস্তবের মত। স্বপ্ন না বলে অবশ্য দুঃস্বপ্ন বলাই ভালো। লানা ইদানিং এমন সব ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে, ঘুম ভেঙে গেলেও যার রেশ থেকে যায় অনেক্ষণ।
নিচে একটার পর একটা কাচের জিনিস ভাঙার শব্দ আসছে। মম্ নিশ্চই বাড়ির জিনিসপত্র আজ একটাও আস্ত রখবে না। বন্ধ দরজার ভেতর থেকেও নিচে তার মম্ আর ড্যাডের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছে সে ।
লানা কানে বালিশ চাঁপা দিয়ে আবারও শুয়ে পড়ল এবং অদ্ভূতভাবে ঠিক তখনই ঘুমে তলিয়ে গেল। সে আবারও ফিরে গেল ওই ভয়ঙ্কর স্বপ্নদৃশ্যে।
লানার কোমর পর্যন্ত পানি মিশ্রিত ঘোলা অতলান্ত বালিতে ডুবে গেছে। পানির ছলছল শব্দটা আছে এখনও অথচ সে চারপাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তবে উপরে আকাশ দেখা যাচ্ছে। কালো থমথমে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। লানা উপরে তাকিয়ে থাকল, দেখল বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নেমে আসছে মাথার ওপরে। লানার বুক পর্যন্ত ডুবে গেছে চোরাবালিতে। সে একটুও নড়তে পারছে না। আতঙ্কে দিশেহারা লানা, তার মুখ বাঁধা। হাতও পেছনে বাঁধা।
পোঁ..পোঁ শব্দ হচ্ছে দূরে কোথাও। কানে হাত চাঁপা দিল লানা। ঠিক সেই মুহূর্তে জেগে উঠল সে এবং চোখ খুলে দেখল, বিছানায় কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে, ঘেমে গেছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। ধাতস্থ হতে সময় নিল কিছুটা। হাত বাড়িয়ে বেডের পাশে ইন্টারকমের রিসিভারটা নিল, বলল
– একটু ব্ল্যাক কফি দিও তো জেসি..
– ইয়েস ম্যাম
– ভাইয়া কি বাড়িতে আছে? নাকি বেরিয়ে গেছে?
– নিজের ঘরেই আছেন
লানা রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।
প্রায় একটু পরেই একটি ষোল সতের বছরের মেইড কফি নিয়ে ঢুকল। মেয়েটির নাম জোছনা। সে লানার ব্যাক্তিগত পরিচারিকা। লানা তাকে জেসি বলে ডাকে। জেসির সাথে সাথে ঢুকল লানার পোষা পাপ্পি, ডোনা। লানা হাতে কফির মগটা নিল এবং ডোনাকে এক হাতে কোলে নিয়ে, রাতের পোশাকেই স্লিপার পায়ে গলিয়ে বাইরে এলো।
টানা লনের ডানদিকে ঘোরানো সিঁড়িটা সোজা নেমে গেছে ড্রয়িংরুমে। লানা উঁকি দিয়ে দেখল, সেখানে অনেক জিনিসপত্র পড়ে আছে এলোমেলো। মেঝেতে ছড়ানো কাঁচের অসংখ্য টুকরো। কিন্তু মম্ আর ড্যাডকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। একটা লাগেজ পড়ে আছে কোণায়। আজ কি কারো কোন ফরেন ট্রিপ ছিল?
নীল হয়তো নিজের ঘরেই বসে আছে ঘাপটি মেরে। মম্ ড্যাডের ঝগড়াটা সে কিভাবে সহ্য করছে, জানা দরকার। নীল সদ্য আমেরিকা ফেরত, লানার বড় ভাই। তার বয়স ত্রিশ। এসব পরিস্থিতি নিশ্চই তার কাছে বিস্ময়কর, দুঃখজনক। তবে, খুব অল্প বয়সে নীলকে বিদেশে পড়তে পাঠিয়ে এই একটা বিচক্ষণতার কাজ করেছিলেন তার বাবা মা। অন্তত ছোটবেলা থেকে এমন অস্বাস্থ্যকর কর্মকান্ড দেখতে হয়নি তাকে। লানা কফির মগে চুমুক দিয়ে এগিয়ে গেল।
এখন বেলা এগারোটা। এ বাড়িতে সকালটা একটু দেরীতেই আসে রোজ। ডাইনিং টেবিল এখন ফাঁকা। অসমাপ্ত ব্রেকফাস্ট পড়ে আছে টেবিলে। মম্ ড্যাড নিশ্চই তাদের যার যার ঘরে আত্মগোপন করেছে।
টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে সে নীলের জন্য কফি ঢালল এবং ডোনাকে নিচে নামিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে এগোল নীলের ঘরের দিকে। বেচারা নীল। সে নিশ্চই বাড়ির এ দৃশ্য দেখে খুব আপসেট? লানার কথা ভেবে তার দেশে ফেরার সিদ্ধান্তটা যে কতটা বোকামী ছিল বুঝুক এবার।
নীল তার খোলা বারান্দায় রেলিঙে দুহাতে ভর দিয়ে তাকিয়ে ছিল বাইরে, উদাস চোখে।
শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে লানার উপস্থিতি দেখল। লানাকে থ্যাংকস জানিয়ে কফির কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিল।
লানা জিজ্ঞেস করল
– ফিরছ কবে?
– কোথায়?
– ইউ এস এ তে
– মানে?
– না মানে, এরপরও তোমার এখানে থাকার ইচ্ছেটা আছে বলছ?
হাসল নীল। হাসলে নীলকে সুন্দর লাগে। নীলের পুরো নাম স্বপ্নীল আহমেদ। সে দেখতে একদম লানার মত নয়। নীল ফর্সা আর লানা শ্যামবর্ণের।
– লানা, আমি ড্যাড আর মমের ঝগড়া দেখতে আসিনি। ওসবে আমার কোন ইন্টারেস্টও নেই। আমি এসেছি শুধু তোর জন্য, তুই জানিস।
লানা যেন এড়াতে চাইল প্রসঙ্গটা। সরে গিয়ে ঘরের মাঝ বরাবর হাঁটল খানিক। নীলও ভেতরে এলো। লানা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল
– আজ সন্ধ্যায় যাচ্ছ তো?
– কোথায়?
– আজ ফার্স্ট আগস্ট, ভুলে গেলে? ইনভিটেশন পাওনি?
একটু ভাবল নীল। হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় বলল
– ও, রাইসুলের পার্টিতে? সে তো অনেকটা দূরে, ঢাকার বাইরে
– দূরে আর কই, ওই তো মাইমেনসিং রোডে, একটা রিসোর্টে। আমি এর আগেও গিয়েছিলাম
নীল গম্ভীর হল। বলল
– হ্যা জানি, আর এজন্যই আমি চাই না তুই ওখানে আবার যাস
– কেন?
– কেনোটা খুব ভালো করে জানিস তুই লানা। আমি চাই না তোর আবার পুরনো সার্কেলের সাথে কনটাক হোক।
বিদ্রুপ হাসল লানা
– কা’মন ব্রো, তুমি ঠিক করবে, আমি কোথায় যাব আর যাব না? এটা হয়? এতদিন আমেরিকায় থেকে তুমি এই শিক্ষা পেলে?
তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে নীল। গম্ভীর স্বরে বলল
– লানা, তুই আজ রাইসুলের পার্টিতে যাবি না, এটাই আমার শেষ কথা…
– এক’শ বার যাব…
নীল মনে হয় রেগে যাচ্ছে। তার নাকের ডগা লাল হয়ে উঠছে। রাগলে তার এমন হয়।
– অনেক বেয়াড়া হয়ে গেছিস। মম্ আর ড্যাডের পাগলামোর সুযোগ নিয়ে জীবনটাকে নিয়ে যা খুশি তাই করছিস। আর নয়, এবার আমি এসে গেছি।
লানা হঠাৎ হেসে ফেলল হি হি হি করে। তারপর হাসি থামিয়ে বলল
– লানা নিজেই নিজের খেয়াল রাখতে পারে। তার জীবনে সে অন্য কারো নাক গলানো পছন্দ করে না।
নীল উত্তেজিত
– হ্যা, কি খেয়াল যে রেখেছিস তাতো রিহ্যাবে গিয়ে প্রমান করে এসেছিস। অনেক কষ্টে তোর ট্রিটমেন্ট হয়েছে লানা, আর না। আমি আর কিছুতেই তোকে ওদের সংস্পর্শে যেতে দিব না।
মুখটা পাথরের মত থমথমে হয়ে গেল লানার, মুহুর্তেই। নীল যেন নিজের ভুলটা বুঝতে পারল। রিহ্যাবের নামটা না তুললেই হত। লানার দুর্বল জায়গায় ঘা লেগেছে।
লানা মুহুর্তেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। এতটা দ্রুত গেল যে, নীল তাকে সরি বলার সুযোগটাও পেল না। নীল পেছনে পেছনে ছুটতে থাকল লানার। লানা প্রায় দৌড়ে উঠে যাচ্ছে উপরে। নীলও ছুটছে আর ডাকছে,
– লানা, থাম বলছি, শোন আমার কথা.. লানা.. লানা…?
লানা নিজের ঘরের ভেতর ঢুকে বিছানায় বসে হাঁপাল কিছুক্ষণ। নীল তার দরজায় ধাক্কাচ্ছে।
লানা উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবলের ড্রয়ার হাতালো , কয়েক জায়গায় খুঁজে খুঁজে একটা কৌটো পেল। মুখ খুলে কয়েকটা ট্যাবলেট গলায় ছুড়ে মেরে বোতল দিয়ে পানি খেল ঢকঢক করে
– লানা, আ’ম সরি। প্লিজ ওপেন দ্য ডোর, প্লিজ…
দরজার ওপাশে নীল ডেকে যাচ্ছে বারবার। লানা ধাতস্থ হল। চোখ মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল এবং ধীরে ধীরে এসে দরজা খুলে দিল। লানাকে দেখে নীল তার একটা হাত তুলে নিল নিজের হাতে
– আ’ম সো সরি, প্রিন্সেস। আমি… আমি… আসলে…
– ইটস ওকে…
– নো, ইটস নট ওকে…। আমার ভুল হয়ে গেছে… ফরগিভ মি…
– বললামতো, ইটস ওকে….
– আচ্ছা ঠিক আছে চল, আমরা দুজনেই যাব আজ রাইসুলের পার্টিতে…
লানা, নীলকে এই মুহূর্তে এড়াতেই বলল
– ঠিক আছে, যাও…
নীল চলে গেলে দরজা লাগিয়ে দিল লানা। লানা জানে, পৃথিবীতে একমাত্র নীলই তার একটু কেয়ার করে। নিজের বিছানায় এসে ঝাপিয়ে পড়ল সে। চোখের কোণে জমতে থাকল কয়েক ফোঁটা মেঘ। ফেলে আসা, নষ্ট হয়ে যাওয়া কয়েকটা বছর। কলেজ জীবনের একটা অপরিপক্ক, ভাঙ্গা সম্পর্ক। কিছু অপমান, কষ্ট, অতঃপর সেই কষ্টের হাত থেকে রাতারাতি মুক্তির পথ খুঁজে পাওয়া। নেশায় বুদ হয়ে জীবিতাবস্থায় মৃতের মত কাটিয়ে দেয়া জীবনের অনেকটা সময়।
ভাবতে ভাবতেই ঔষধের প্রকোপে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল লানা।
লানার সামনে বাথটাব ভর্তি পানি। বাথটাবে বসে আছে এক, দেড় বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে। মেয়েটি হাসছে আর দুর্বোধ্য অস্পষ্ট কিছু শব্দ বলার চেষ্টা করছে। ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে সে বাথটাবের পানিতে ছলছল শব্দ করছে। লানা আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, এমন কি নিজেকেও না। তার সামনে বাথটাব আর একটা ছোট্ট শিশু। হঠাৎ তার দুটি হাত এগিয়ে গেল বাচ্চাটাকে ধরতে। নিটোল, সুন্দর, ফর্সা দুটি হাত এগিয়ে যাচ্ছে । লানার প্রসারিত হাতদুটি ক্রমশ চেপে ধরছে বাচ্চাটাকে পানির মধ্যে। বাচ্চাটা ডুবে যাচ্ছে, ছটফট করছে বাথটাবে। লানা শক্ত হাতে ডুবিয়ে রাখছে তাকে। বাচ্চাটা হাত পা ছুড়ছে পানির মধ্যে। দমবন্ধ হয়ে আসছে বাচ্চাটার। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছে তার শরীর। আহ, কি অসহ্য! কি অসহ্য দৃশ্য!
প্রচন্ড উত্তেজনায় ঘুম ভাঙল লানার। সে চারিদিকে তাকাল। এ কেমন দুঃস্বপ্ন? সে একটা শিশু বাচ্চাকে বাথটাবে ডুবিয়ে মারছে? উফ..!
দুহাতে মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকল লানা । ঘরে আলো জ্বলেনি। দেয়াল ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা…। তার মানে সেই তখন থেকে ঘুমাচ্ছে সে। হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল অসংখ্য মিসড কল।
লানা লাফ দিয়ে নামল বিছানা থেকে। আলো জ্বেলে হাই ভলিউম মিউজিক অন করে দিয়ে ঢুকে গেল ওয়াশরুমে। নীল নিশ্চই ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে ফিরে গেছে। পরবর্তী বিশ মিনিটে তৈরি হয়ে গেল লানা। জমকালো ওয়েস্টার্নে অপূর্ব সেজেছে সে। প্রায় উড়ে নামল সিঁড়ি দিয়ে।
এ বাড়িতে লানার কোথাও বের হয়ে যেতে কারো অনুমতির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু গেটের বাইরে এসে মন্থর হল গতি। নীল দাঁড়িয়ে আছে নতুন একটা গাড়িতে হেলান দিয়ে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে ইমাদ, নীলের বন্ধু।
একে এখানে কে ডাকলো? নিশ্চই নীল। নীলের ওপরকার সকাল বেলার বিরক্তিটা ফিরে আসছে আবার। এই ইমাদ ছেলেটাকে কদিন থেকে ভেড়ানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে নীল । ইমাদও তেমনি, লানাকে ইমপ্রেস করতে কোন সুযোগই হাতছাড়া করছে না আজকাল।
কাছাকাছি গিয়ে সৌজন্য হাসল লানা।
– হাই লানা…! ইউ লুক এমেইজিং..
– থ্যাংকস…
লানা আড়ালে কুটিল তাকালো নীলের দিকে। নীল হাসছে।
গাড়িটা ইমাদের। নিউলি ইমপোর্টেড।
নীল বলল
– আমি ড্রাইভ করব…
চালাকি বুঝল লানা। নীল উঠে বসতেই লানা তার পাশের আসনটি দখল করল। অগত্যা ইমাদ একাই পেছনে।
গাড়ি ছুটছে শাঁ শাঁ করে..
পেছনে ইমাদ একা একা বকবক করে যাচ্ছে। লানা হাসছে মিটমিট করে। নীলের মুখে হতাশা।
পার্টি এরেঞ্জ হয়েছে একটা রিসর্টে। সন্ধ্যে নাগাদ পৌঁছে গেল তারা। রাইসুলের উষ্ণ অভ্যর্থনায় এগিয়ে গেল তারা মূল পার্টি হলে। রাত হতে হতে জমে উঠল উদ্দাম পার্টি হল। খাওয়াদাওয়া, ডিজে, ডান্স
আর বার কাউন্টারের ভিড়ে নীল আর লানা যে যার গ্রুপে আলাদা হয়ে গেল।
একটু পরে ইমাদ খুঁজে খুঁজে ঠিক বের করে ফেলল লানাকে। লানা তার পরিচিত কয়েকজনের সাথে গ্লাস হাতে বসেছিল অন্ধকার মত একটা জায়গায়। ইমাদ বলল
– লানা, তোমার গ্রুপে আমাকেও সামিল করে নাও প্লিজ। ওই ইন্টেলেকচুয়ালদের দলে আমি একদম বোর হয়ে গেছি।
হাসল সবাই। লানা ইতস্তত তাকাল সবার দিকে। লানার গ্রুপে দুইটি মেয়ে, তিনটি ছেলে। তারা এতক্ষণ কথা বলছিল গোপন একটা ব্যাপার নিয়ে। বাবুন নামের একটি বন্ধু সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলছিল,
– গাইজ, তোমরা কি নতুন কিছু ট্রাই করতে চাও? ব্রান্ড নিউ, ইমপোর্টেড। আমি অবশ্য এখনও চেখে দেখিনি। তবে মনে হচ্ছে দারুণ হবে।
সবাই কৌতুহলী হয়েছিল। লানা কিছুটা দ্বিধান্বিত। বলেছিল
– এখানে? ধরা পড়ে যাব নাতো..?
বাবুন আস্বস্ত করেছিল
– ইটস লাইট, বাট ফিলস এমেইজিং। আমার কাজিন পাঠিয়ে বলেছে..। তবে জিনিসটা হুইস্কির সাথে নাকি বাইন্ডিং হয় ভালো।
বাবুনের পিছু পিছু বারের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল তারা। বাবুন দু’টো হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়েছিল কাউন্টারের ছেলেটিকে। ছেলেটা ছয়টা গ্লাস সাজালো। পুরিয়া বের হল বাবুনের পকেট থেকে। ছেলেটি নিপুন হাতে মিশিয়ে দিয়ে সার্ভ করল। গ্লাস নিয়ে কেবল তারা একটু আড়ালে এসেছে। এরই মধ্যে ইমাদ হাজির। তারা ইমাদকে বসার জায়গা দিল কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করেই গ্লাস উঁচিয়ে ধরল।
ইমাদ বলল
– এক মিনিট, আমিও একটা গ্লাস নিয়ে আসছি, ওয়েট..
ইমাদ ছুটে গিয়ে নিজের জন্য একটা গ্লাস নিয়ে এলো।
সমস্বরে চিৎকার করল সবাই
– চিয়ার্স…
ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে গলধকরণ করল সবাই।
বাবুন চিৎকার করল, তাহলে আর দেরী কেন, লেটস ডান্স..অল…
তারা সবাই হাত ধরাধরি করে চলে এলো ডান্স ফ্লোরের সামনে। শুরু হল উদ্দাম ডিজে ডান্স। লাউড স্পিকার, লাইটিং আর ডান্স, কতক্ষণ কেটে গেছে মনে নেই। লানার মাথার মধ্যে কিছু একটা হচ্ছে। চোখের সামনে প্রত্যেকটা জিনিস একাধিক বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। বিপদ টের পেল সে। ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো ডান্স ফ্লোর থেকে।
টলতে টলতে একটা টুলের ওপর এসে বসল লানা। বাবুন ও তার সাথীরা হয়তো খেয়াল করল বিষয়টা। তারাও দলছুট হয়ে চলে এলো লানার কাছে। বাবুন চিন্তিত গলায় বলল
– আর ইউ অল রাইট লানা?
লানা হাত তুলে জানাল, সে ঠিক আছে। ইতিমধ্যে ইমাদও এসে হাজির।
– হোয়াট হ্যাপেনড, ও মাই গড। লানা আর ইউ ওকে?
লানা নিজের আসল বিপদ টের পেল এখন। ইমাদ নিশ্চই এবার নীলকে খুঁজে বের করবে। নীল যদি জানতে পারে লানা ড্রাগস্ নিয়েছে, তাহলে তো কথাই নেই।
লানা হাত চেপে ধরল ইমাদের
– ইমাদ, ডোন্ট কল নীল, প্লিজ
– ওকে.. ওকে.. বাট হাউ আর ইউ ফিলিং নাউ?
লানা তার মেয়ে বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বলল
– গাইজ, আই থিংক আই নিড টু রেস্ট ফর আ হোয়াইল..
মেয়েরা সন্মতি সূচক মাথা নাড়ল। তারা দুদিক দিয়ে লানাকে তুলে নিল। যেহেতু এটা একটা রিসর্ট, আশেপাশে ফাঁকা কামরা পাওয়া গেল। ইমাদও ছিল সাথে।
ঠিক হল, লানা পার্টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানে রেস্ট নিবে। নীলকে ততক্ষণ ইমাদ বিজি রাখবে অন্যদিকে । নীল এ ব্যাপারে কিচ্ছুটি জানতে পারবে না।
এই প্রথম লানা কৃতজ্ঞতা বোধ করল ইমাদের প্রতি। লানা দরজা লক করল, ছিটকিনি তুলে দিল ওপরে। একটা নরম গদিতে ছেড়ে দিল নিজেকে।
মনে হল তার শরীর আর ওসব সাপোর্ট করছে না। জিনিসটা খুব লাইট ছিল, তার প্রমান দলের অন্যরা। ওদের তেমন কিছুই হয়নি, শুধু এই যা একটু হয় ড্রিংক করলে। কিন্তু লানা তো পুরোই ধরাশায়ী। নীল জানলে যে কি হবে…। আপাতত আর কিছু ভাবার অবস্থা রইল না লানার। চেতনা হারাল সে।
কারো ডাকে ঘুম ভাঙল লানার। সে শুয়ে আছে একটা নরম বিছানায়। বাইরে কেউ একজন ডেকে যাচ্ছে বারবার।
– সোহা…সোহা… প্লিজ ওঠো…। বেবি কাঁদছে…
একটা শিশুর কান্নাও ভেসে আসছে থেমে থেমে।
লানা চোখ খুলে চারপাশটা দেখল। চট করে কালকের রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল তার। সে কী সারারাত রিসর্টেই ছিল? অন্যরা সব কোথায়? নীল….নীল কোথায়? লাফ দিয়ে উঠে বসল সে বিছানায়। একদিকে ঝকঝকে গ্লাসের দেয়াল ভেদ করে তীব্র রোদের আলো। তার পেছনে ঘন গাছপালা। কাল রাতে রিসর্টের চারপাশটা অতটা বোঝা যায়নি। লানা বিছানা থেকে নিচে পা রাখল এবং অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করল তার শরীরে কালকের পোশাকটা নেই। তার গায়ে এখন একটা শর্ট নাইট গাউন। দুশ্চিন্তায় লানা চট করে দরজার দিকে তাকাল। না, দরজায় ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দেয়া। তাহলে তার পোশাক পাল্টাল কে? তার চাইতেও অদ্ভুত হল, লানা কাল যে ঘরটায় ঢুকেছিল এটা একদম সেটা নয়। মনে হচ্ছে কারো শোবার ঘর। এমন কি, যে নরম গদিটায় সে পড়েছিল সেটাও কোথাও নেই এখানে ।
তার মানে কি তাকে ওরা অন্য কোথাও নিয়ে এসেছিল? হয়ত চেতনা ছিল না লানার। হয়ত নীল জেনে গিয়েছিল। কিন্তু দরজা যে ভেতর থেকে লাগানো।
– সোহা… প্লিজ নিচে নেমে এসো, মুনের খাবার সময় হয়ে গেছে। বেবি কাঁদছে…
বাচ্চাটা বেশ জোরেসোরে কাঁদছে এখন। রিসর্টে বাচ্চা এলো কোত্থেকে? তাছাড়া কে যে কাকে অমন সোহা সোহা করে ডাকছে কে জানে।
লানা ভাবতে ভাবতেই এগোল। কিন্তু দেয়ালের পাশে একটা ড্রেসিং টেবিলের পাশ কাটাতেই থমকে গেল হঠাৎ। ঘুরে দাঁড়িয়ে সে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকল আয়নায়। কে ওই মেয়েটি? আচমকা পেছনদিকটা দেখে নিল লানা। নাহ, আর কেউ নেইতো এ ঘরে। তাহলে আয়নায় কাকে দেখছে সে? হাঁটু পর্যন্ত শর্ট নাইট গাউনে ধবধবে সাদা নগ্ন পা দুটো। ছোট ছোট করে কাটা চুল। তীক্ষ্ণ দুটি ভ্রুর নিচে সুন্দর বাদামী ঢলঢলে চোখের তারা। অর্ধনগ্ন ফর্সা সুডৌল বুকের ঢেউ।
লানা নিজের মুখে হাত বোলালো। আয়নায়ও সেই একই দৃশ্য দৃশ্যমান। এসব কি হচ্ছে? নিশ্চই এটা লানার কোন দুঃস্বপ্ন। সে নেশার ঘোরে রিসর্টের একটা ঘরে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। বাইরে জমকালো পার্টি আর লানা মনের সুখে ঘরের মধ্যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে। বরাবরের মত স্পষ্ট, জীবন্ত কোন স্বপ্ন।
তীব্র গলায় আবারও ডাকছে কেউ
– সোহা… সোহা প্লিজ দরজা খোল। আর কত ঘুমাবে তুমি? বেবি না খেয়ে আছে, সে তোমার কাছে যেতে চায়..
লানা ধীর পায়ে এগোচ্ছে দরজার দিকে…
কি করবে সে? কি দেখবে দরজা খুলে? নাকি দরজা খোলার আগেই ভেঙে যাবে ঘুম?
(চলবে)