#চুপিচুপি_ভালোবাসি (পর্ব ২৩)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
মারুফাদের বাড়ির উঠোনের এক কোনায় স্টেজ করা হয়েছে। চারিদিকে হলুদ শাড়ি আর হলুদ পাঞ্জাবী পরিহিত ছেলে-মেয়েদের সমাহার। ওবাড়ি থেকেও লোকজন চলে এসেছে। জানালা দিয়ে এইসব দেখছি আমি। আর মারুফা ঘরময় পায়চারী করে বেরাচ্ছে। ইতিমধ্যেই মারুফাকে স্টেজে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডাক পড়েছে। এর মধ্যেই মারুফার ফোন বেজে উঠলো। ফোনে ‘আয়রার আব্বু’ নামটা দেখে চোখ বড়বড় হয়ে গেল আমার। এরা তো দেখি বাচ্চার নামটাও ঠিক করে ফেলেছে। বলতেই হচ্ছে দে আর ভেরি ফাস্ট। মারুফার হাত থেকে ছো মেরে ফোনটা নিয়ে নিলাম। তারপর রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আয়াত ভাইয়া বললেন,,
–“হেই ক্যাটবেরি কি করছো?”
আমি দাঁত কেলিয়ে হেসে বললাম,,
–“আপনার হবু বউকে রেডি করছি। বাব্বাহ ভাইয়া! এতো অধৈর্য হলে কি চলে বলুন তো।”
আমিতো ভেবেছিলাম ভাইয়া অপ্রস্তুত হয়ে পড়বেন। হয়তো বলবেন, ‘অন্যের ফোন ধরা ব্যাড ম্যানার্স।’ কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আয়াত ভাইয়া স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,,
–“ভাবি তুমি! আমি তো ভেবেছিলাম তোমার বান্ধবী! সে যাই হোক ভালো হয়েছে তুমি ফোন ধরছো। আমার তোমার সাথেই কথা ছিলো। তোমার ফোনে কল করে করে টায়ার্ড হয়ে ওকে কল দিয়েছি।”
আমি রীতিমত টাস্কি খেয়ে আছি। হলুদের দিন হবু বউকে কল করে বলছে আমার সাথে কথা বলার জন্য কল করেছে। তাড়াহুড়ো করে বিছনার কাছে গিয়ে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি আয়াত ভাইয়ার ১২ টা মিসড কল। আর ফোন মহাশয় সাইলেন্ট মুডে চলে গিয়েছেন। একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললিম,,
–“আর বলবেন না ভাইয়া। এতো মেয়ের হুরোহুরিতে চাপ লেগে কখন যে ফোনটা সাইলেন্ট হয়ে গিয়েছে। সে যাই হোক আজকের দিনে বউ বাদে আমার সাথে কি কথা!”
ওপাশ থেকে আয়াত ভাইয়া বললেন,,
–“হেল্প চাই ভাবি! হেল্প চাই! তোমার বান্ধবী কে বললে তো শুনবে না। হয় ফোন কেটে দিবে নাহয় কয়েকটা ঝাড়ি মেরে চুপ করিয়ে দিবে। তাই তোমাকেই বলবো বলে ঠিক করেছি। হেল্প করো একটু প্লিজ!”
–“কি হেল্প চাই আপনার? কি মতলব?”
–“তেমন কিছুই না আবার অনেক কিছুই। ওর হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলে ওকে কোনভাবে ওদের বাড়ির পেছনের বড় গাছটার কাছে পাঠাবে প্লিজ! আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি। আমি ওকে হলুদ লাগাবো।”
আমি অনেকটা বিষ্ময় নিয়ে একটু জোরেই বললাম,,
–“আপনি এখানে?”
–“আরে আস্তে ভাবী আস্তে! কেউ জানলে একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পরতে হবে তো। এই হেল্পটা করে দাও না ভাবী! তোমার দেবরকে এইটুকু হেল্প তো করতেই পারো।”
আমি একটু শয়তানি করে বললাম,,
–“আপনি হয়তো ভূলে যাচ্ছেন ভাইয়া এই মুহূর্তে আমি আপনার ভাবী নয় শ্যালিকার রোল প্লে করছি। আর শ্যালিকারা তো আজকের দুলাভাইকে হেল্প করে না!”
–“এটা ঠিক নয় ভাবিজান! ভাবি হিসেবে আমার প্রতিও তো আপনার কিছু দায়িত্ব আছে! প্লিজ ভাবি প্লিজ!”
–“দেখি কি করা যায়! ততক্ষন আপনি ওখানে বসে মশার কামড় খান ওকে।”
ওনাকে আর কিছু বলতে না দিয়েই ফোন কেটে দিলাম। বিয়েটা কোন ম্যারেজ হলে হলে এমন সিচুয়েশন হতোই না। কিন্তু বিয়েটা তো বাড়িতে হচ্ছে। আর হলুদের দিন তো বরকে আসতে নেই। আকাশ কুসুম ভেবে মারুফা কে নিয়ে বাইরে এলাম। মারুফাকে স্টেজে বসিয়ে স্টেজ থেকে নেমে এলাম। আপাতত এখানে আমার কাজ শেষ। ওকে সবার আগে হলুদ আমিই লাগিয়েছি। ওকে হলুদ লাগিয়ে একটু দূরে এসে দাঁড়ালাম। ওতো ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে এখানে দাঁড়ানোটা শ্রেয় বলে মনে হলো। সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে। এতো এতো কাজে সবার অবস্থা মোটামুটি শোচনীয়। কাকিমা কে দেখলাম কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্টেজের দিকে তাকাচ্ছেন। আমি গিয়ে ওনাকে এক প্রকার টেনেই নিয়ে এলাম। তারপর সবাইকে সাইডে সরে যেতে বলে কাকিমা কে স্টেজের সামনে দাড় করিয়ে হলুদের বাটি টা এগিয়ে দিলাম। কাকি ছলছল চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি ওনাকে বললাম,,
–” কাকি! আপনি ওর মা। মেয়েকে হলুদ লাগানোর অধিকার সবার আগে আপনার আর আপনি কিনা দূর থেকে দেখছেন? নিন এখন ওকে হলুদ লাগান।”
কাকি মারুফা কে হলুদ লাগিয়ে দিলো। মারুফা কে দেখলাম প্রায় কেঁদেই দিবে। আমি ওখান থেকে দূরে এসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। বলতে গেলে কাউকে খুঁজছি। সবাই তো এসেছে এমনকি আয়াত ভাইয়াও এসেছে কিন্তু উনাকে তো দেখছি না। আসেন নি নাকি? এসব ভাবনার মাঝেই কেউ বলে উঠলো,,
–“কাউকে খুঁজছো?”
পেছন ঘুরে দেখি সান ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। উনাকে দেখে একটু বিরক্ত হলাম আমি। উফ্ এই লোকটা এখানে কি করছে? আবার এসে বলছে কাউকে খুঁজছি কিনা? আসলেই বিরক্তিকর। আচ্ছা এই লোকটার সাথে দেখা হলেই কি সবসময় আমার আগে পিছে ঘুড়তে হবে নাকি? ইচ্ছে তো করছে ব্যাটার মাথা ফাটিয়ে দিই। কিন্তু বর্তমান এই ইচ্ছেটা কে সাইডে রেখে মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বললাম,,,
–“হুম আমি নির্ভীককে খুঁজছিলাম। আপনি দেখেছেন উনাকে?”
উনি বেক্কেল মার্কা হাসি দিয়ে বললেন,,
–“নির্ভীক তো তোমার বড় তাহলে নাম ধরে ডাকছো কেন? ও তোমার ভাই হয় তাইনা?”
মেজাজ পুরো ১২০° আঙ্গেলে ঘুরে গেল। আমার বরকে আমি নাম ধরে ডাকবো নাকি অন্যকিছু বলে ডাকবো সেটা আমার ব্যপার। তুই কোথাকার কে যে বর কে ভাই ডাকতে বলছিস। ইচ্ছে করছে আচ্ছামত কিছু গালি দিতে। কিন্তু এতো লোকের মধ্যে তা সম্ভব নয়। আমি আড়চোখে সান ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি একটা হাসি দিয়ে বললেন,,
–“বাই দ্য ওয়ে তুমি অনেক কিউট! আজ আরো বেশি কিউট লাগছে।”
আমি হেসে দিয়ে বললাম,,
–“তাই না! আমার বরও তাই বলে এ্যাকচুয়ালি!”
উনি হকচকিয়ে বললেন,,
–“বর মানে?”
–“বর মানে বর। আমার বর প্রায়ই বলে এই কথাটা।”
উনি জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বললেন,,
–“হেহ তুমি বেশ ভালো মজা করতে পারো! অবশ্য তোমার মতো বাচ্চা মেয়েদের এরকম টাইপ মজা ভালোই সুট করে।”
ঠিক তখনই পেছন থেকে নির্ভীক বললেন,,
–“শর্মি! তুমি ওখানে কি করছো? এদিকে মারুফা তো তোমাকে খুঁজছে।”
আমি সচকিত চোখে ওনার দিকে তাকালাম। হলুদ পাঞ্জাবী তে বেশ দেখতে লাগছে মানুষটাকে। অবশ্য উনাকে সব রঙেই মানায়। আমি একগাল হেসে বললাম,,
–“আপনাকেই খুঁজছিলাম।”
তার পর উনার বাম হাত ধরে টেনে সান ভাইয়ার সামনে দাঁড় করালাম। উনি চোখ ছোট ছোট করে তাকালেন। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সান ভাইয়া কে বললাম,,
–“এনাকে চিনেন নিশ্চয়ই! (সান ভাইয়া উপর নিচে মাথা নাড়ালেন) আজ আবার নতুন করে চিনবেন। ইনি হলেন নির্ভীক চৌধুরী! আমার ওয়ান এন্ড অনলি হাসব্যান্ড! কিউট না?”
এসব বলেই নির্ভীকের দিকে তাকালাম। উনি কিছুটা অবাক তাকিয়ে ছিলেন মনে হয়। উনার চাহুনী দেখে তো তাই মনে হলো। কিন্তু মুহূর্তেই একগাল হেসে সান ভাইয়ের দিকে তাকালেন। আমিও তাকালাম। সান ভাইয়া একদম চুপসে গিয়েছে। উনি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম,,
–“আমি কিন্তু মজা করছি না ভাইয়া। সেদিন তো দেখেছিলেনই যে আমি নির্ভীক দের বাড়িতে ছিলাম। যাই হোক আমি আসছি! মারুফা ডাকছে।”
আমি ওখান থেকে চলে এলাম। যাক ঝামেলা থেকে মুক্তি! মারুফার কাছে যেতেই বলল,,
–“কই গেছিলি তুই? কখন থেকে খুজতেছি। পরে নির্ভীক ভাইয়াকে দেখে বললাম।”
–“বাদ দে কিসের জন্য খুজতাছিলি তাই ক।”
–“ঘোমটা টা ঠিক করে দে বারবার খুলে যাচ্ছে।”
তারপর আমি ওর ঘোমটা ঠিক করে দিলাম। হঠাৎ ই আয়াত ভাইয়ার কথা মনে পড়লো। এখন মহারানী কে নিয়ে তার মহারাজের কাছে যেতে হবে। কিন্তু মারুফাকে বলা যাবে না। বললে সাফ মানা করে দিবে। তারপর সুযোগ বুঝে ওকে বাইরে নিয়ে এলাম। এইটুকু রাস্তা আসতেই মারুফা বারবার বলছে কই নিয়া যাস আমারে!এক ধমক দিয়ে চুপ করাইছি মাইয়ারে। বড় গাছটার ওখানে গিয়ে দেখি আয়াত ভাই গাছের শেকড়ের উপর বসে আছে আর মশা মারছেন। মারুফা আমার দিকে অবাক চোখে তাকালো। আমি ওর দিকে পাত্তা না দিয়ে আয়াত ভাইয়াকে বললাম,,
–“নিন দেবরজি! আপনার মল্লিকাকে নিয়ে এলাম। কিন্তু আপনার হাতে বেশি সময় নেই। যা কাজ তাড়াতাড়ি সাড়ুন আমি বরং দেখি কেউ যেন এদিকে না আসে।”
আয়াত ভাইয়া হেসে দিয়ে বললেন,,
–“থ্যাংকস ভাবি!”
বিনিময়ে মুচকি হেসে ওখান থেকে চলে এলাম। বাড়ির পেছন দিকে একটা গলি আছে সেটা পার হয়েই বাইরে আসতে হয়। আমি ঐ গলির কাছে আসতেই কেউ হ্যাঁচকা টানে দেওয়ালের সাথে আটকে ধরলো আমায়। পারফিউম এর গন্ধে বুঝেই গিয়েছি এটা নির্ভীক। আমি উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে বললাম,,
–“কিচ্ছে! এইভাবে টেনে আনলেন কেন? হুটহাট এমন করে টেনে আনার মানে কি?”
–“হুস! চুপ আর একটাও কথা না।”
আমি চুপ করতেই উনি আমার গালে আর কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন,,
–“তুমি ঠিক আছো তো? না কাল থেকে যে বিহেভ গুলো করছো তাতে তো আমার মনে হচ্ছে না তুমি ঠিক আছো? তোমার কি শরীর খারাপ? অসুস্থ তুমি?”
আমি কোনা চোখে ওনার দিকে তাকালাম। কপাল কুঁচকে বললাম,,
–“আপনার কেন মনে হচ্ছে আমি অসুস্থ? আর সান ভাইয়ার কথার উত্তরে আমার যেটা ঠিক মনে হয়েছে সেটা বলেছি।”
উনি বললেন,,
–“বুঝলাম। বাই দ্য ওয়ে তোমাকে পেত্নীর মতো লাগছে।”
–“😒”
আমি কিছুক্ষণ উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর হেসে দিলাম। কারণ আমি জানি উনি কখনো ভালোভাবে আমার প্রশংসা করবে না। তারপর উনি বললেন,,
–“সত্যি। কিন্তু কিছু একটি মিসিং!”
–“কি”
উনি পকেট থেকে একটা বেলি ফুলের মালা বের করে সেটা আমার খোঁপায় লাগিয়ে দিয়ে বললেন,,
–“নাও পারফেক্ট! আমার প্রাণনাশিনী!”
আমি ওনাকে ঠেলে ওখান থেকে চলে এলাম। আসার সময় কানে এলো উনার হাসির ঝংকার। দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে হাসির আওয়াজ ও মিলিয়ে গেল অতলে। বাড়ির ভেতর সবাই নাচগান নিয়ে ব্যাস্ত। আর আমি ব্যাস্ত নিজের সবার ব্যস্ততা দেখতে। কিছুক্ষণ পরেই মারুফা এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। গাল দুটো লাল হয়ে আছে আর মুখে লাজুক হাসি। এই প্রেমও কি মারাত্মক জিনিস!
মারুফার বিয়ের সব কাজ শেষ। এখন বিদায়ের পালা। মারুফা তো সেই কখন থেকে কেঁদেই চলেছে। কাকি ওর সামনে না কাঁদলেও আড়ালে গিয়ে ঠিকই কান্না করছেন। ওদের কান্না দেখে এখন আমার ই কান্না পেয়ে যাচ্ছে। আয়াত ভাইয়া অসহায় ভাবে মারুফার দিকে তাকিয়ে আছেন। বিদায়ের সব কাজ শেষ করে ওকে গাড়িতে তোলা হলো। নির্ভীকদের বাড়িতে পৌঁছাতেই বড় কাকিমনি (আয়াত ভাইয়ার মা) নিজে আয়াত ভাইয়াদে বরণ করে ঘরে তুললেন। আয়াত ভাইয়ার রুমটা রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। মারুফাকে ভেতরে আনার পরই সবাই মিলে ঘিরে বসলো। আয়াত ভাইয়া মনে হয় ওনার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যাস্ত। এই রুমে মারুফার সাথে হাসি তামাশা করছে নূপুর আর দিশা। ওদের এই কাজ কারবার ভালো নাগছে না আমার। তাই আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। সবাই নিজেদের কাজে ব্যাস্ত। ঠিক তখনই মাথায় এলো আমি কোন রুমে থাকবো? বাড়ি ভর্তি মেহমান। সব রুমে নিশ্চয়ই গাদাগাদি করে থাকবে সবাই কিন্তু আমি তো এতো লোকজনের মধ্যে থাকতে পারি না। কেমন জানি দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। ধুর এসব ভাবার থেকে ভালো মামনিকে কাজে হেল্প করি। এই ভেবে রান্নাঘরের দিকে যেতেই কিছু কথা কানে এলো। একটু কাছে গিয়ে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলাম ওখানে মামনি, কাকিমনি সহ আরো কয়েকজন মহিলা রয়েছেন। একজন বলছে,,
–“বড় ভাবী! আয়াতের বিয়ে তো হয়ে গেল এবার তোমার নির্ভীকের বিয়ে কবে দিবে? ওরা দুইজন তো সমবয়সী তাহলে আর দেরি করে কি লাভ বলো! এবার নির্ভীকের জন্য পাত্রী দেখো।”
ওনার কথার রেশ ধরে আরেকজন বললেন,,
–“নির্ভীক বড়ই ভালো ছেলে। দেখতে শুনতে তো বেশ ভালো ওর জন্য তো সুন্দরী মেয়ে ঘরে আনতে হবে তাইনা। আমি বলি কি আমার বোনের একটা মেয়ে আছে। বড় ভালো মেয়ে বুঝলে, একদম ফর্সা গায়ের রং। নির্ভীকের সাথে মানাবে ভালো।”
কাকিমনি বললেন,,
–“নির্ভীকের বিয়ে নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না ভাবী। আমাদের ছেলে আমরা বুঝে নিবো।”
উনাদের কথা আর শুনতে ইচ্ছা করছেনা। মন খারাপ হয়ে গিয়েছে। ধুর! কেন যে আসতে গেলাম। না আসলেই ভালো হতো। আচ্ছা এনারা নির্ভীকের পাশে আমাকে দেখে কেমন রিয়্যাক্ট করবে? তার হাসি মুখে মানবে নাকি কি কটুক্তি করবে? এসব ভেবে ঘুরতেই দেখি নির্ভীক দাঁড়িয়ে আছেন। আজব মানুষ পেছনে এসে এমন খাম্বার মতোন দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয়? আবার কেমন রাগী লুক নিয়ে তাকিয়ে আছে? এমন রেগে যাওয়ার কারণ কি? আমি উনাকে কিছু বলবো তার আগেই উনি আমার ডানহাত টেনে আমার সামনে ধরে জোর গলায় বললেন,,,
–“এটা কি করে হলো? আর কাটা হাত নিয়ে এরকম এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমার কি কোন বুদ্ধি শুদ্ধি নেই নাকি?”
উনার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। কাটা হাত মানে? হঠাৎ হাতের দিকে চোখ পড়তেই মুখ হাঁ হয়ে গেল আমার। আমার হাত কেটে রক্ত বের হচ্ছে। আরে হাত কখন কাটলো? আর কিভাবেই বা কাটলো? এতোক্ষণ তো বুঝতেই পারিনি কিন্তু এখন হাত জ্বালা করছে। আমি অসহায় মুখ করে উনার দিকে তাকালাম। উনি এখনো রাগী চোখেই তাকিয়ে আছেন।
–“কি হলো বলো!”
আমি এখন কি বলবো? আমি নিজেই তো জানিনা এটা কি করে হলো? কখন হলো তাহলে উনাকে কি বলবো? উনি বললেন,,
–“এখন এটা বলো না যে তুমি জানোই না যে তোমার হাত কেটে গিয়েছে।”
আমি উপর নিচে মাথা নাড়ালাম। অর্থ আমি সত্যিই জানি না। উনি মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড়িয়ে বললেন,,
–“এ কাকে বিয়ে করেছি আমি?”
–“কি!”
–“চুপ! ঐ কোন খেয়ালে থাকো তুমি।”
তারপর উনি চিৎকার করে মামনি কে ডাকলেন।মামনি এসে আমার হাতের দিকে তাকাতেই আতকে উঠলেন। তাড়াতাড়ি করে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এলেন। নির্ভীক মামনির হাত থেকে বক্সটা নিয়ে এ্যান্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিলেন। মামনি জিজ্ঞেস করছে,,
–” এসব হলো কি করে?”
নির্ভীক বললেন,,
–“উনি জানলে তো বোলবে। ওকে খুঁজতে খুঁজতে দেখি রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ ওর হাতের দিকে নজর যেতেই দেখি রক্ত! ওকে জিজ্ঞেস করতেই কি বলল জানো? বললো ও নাকি জানেই না কখন ওর হাত কেটে গিয়েছে? তাহলে বলো কত বড় কেয়ারলেস এই মেয়ে! নিজের একফোঁটাও খেয়াল রাখে না। সারাদিন এখানে ওখানে ছুটে বেড়ায় আর হাত পা কেটে বসে থাকে। খাওয়া-দাওয়ার ও ঠিক ঠিকানা নেই। এক বেলা খায় কি তিন বেলা খায় না। কলেজে গেলেও ওকে জোর করে ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে হয় আর যেদিন একটু পেশেন্ট দের নিয়ে ব্যাস্ত থাকি সেদিন তো কথাই নেই! আল্লাহর নামে সেদিন দুপুরে না খেয়েই থেকে যাবে। তুমিই বলো ও কি বাচ্চা নাকি? ওকে সব কাজ বলে বলে করাতে হবে? নিজের যত্ন ও কি ঠিকঠাক মতো করতে পারে না? বেয়াদব মেয়ে! সবসময় আমাকেই বলে দিতে হবে শর্মি এটা করো না, এখন খেয়ে নাও, নিজের খেয়াল রাখো? তাতে নাকি আবার ডক্টর হবে। নিজের খেয়াল রাখতে পারে না সে নাকি অন্যের চিকিৎসা করবে! আচ্ছা মা তুমিই বলো আমি সব কাজ ফেলে ওর পেছনে ছুটবো নাকি?
উনার এতো এতো কথার ঝারে নিজেকে এখন সত্যি সত্যি বাচ্চা মেয়ে মনে হচ্ছে। এতো কথা শুনানোর কি আছে? নাহয় একটু হাত ই কেটেছে কিসের কি মলম লাগাবে তা না ঝাড়ি মেরে চলেছে? আমি মামনির দিকে কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকালাম। উনি মুখ টিপে হাসছেন।
–“মামনিইই!!”
–“এই ছেলে থাম তো! আমার মেয়েটাকে এভাবে বকছিস কেন? একদম বকবি না বলে দিলাম। বাচ্চা মেয়ে তো!”
উনি বললেন,,
–“এ্যহ্ বাচ্চা মেয়ে দুদিন পর বাচ্চার মা হবে আর এখন ও উনি বাচ্চাই আছেন। মা আমার কথাও তো একটু ভাবো! আমি আমার বাচ্চাদের পেলে বড় করবো নাকি তাদের মাকে! বাচ্চার মা ই যদি বাচ্চাদের মতো বিহ্যাভ করে তাহলে,,,”
মাঝখান থেকে কাকিমা বললেন,,
–“আরে থাম নির্ভীক থাম! অনেক হয়েছে। ওকে নিয়ে ঘরে যা আমি তোদের খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
নির্ভীক ও আর কিছু বললেন না কিন্তু পাশে থাকা মহিলাদের কথা কানে এলো। উনারা একে অপরকে বলছেন,,
–“কে এই মেয়ে? আর নির্ভীক এসব বলছে কেন? ছেলে কি তবে ভূল রাস্তায় চলে গেল।”
আরেকজন বললেন,,
–“আর মেয়েটাও বা কেমন?”
নির্ভীকও হয়তো শুনেছেন। উনি বললেন,,
–“আরে আন্টি! আপনাদের তো দেখছি আমাকে নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল। তো আপনাদের কৌতুহল টা দূর করে দিচ্ছি। এইযে এই মেয়েটাকে দেখছেন (আমাকে দেখিয়ে)
এ হচ্ছে আমার বউ! বিয়ে করা বউ। আর আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছে।”
এতটুকু বলেই উনি আমাকে টেনে নিয়ে এলেন ওখান থেকে। আসার আগে মামনির হাসি মুখটা চোখে পড়লো আমার। উনার হাসি দেখে আমিও একটা হাসি উপহার দিলাম।
_________________________
রাত ২ টো।
নির্ভীকের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। রুম খালি না থাকায় আমাকে এখানেই থাকতে বলেছেন মামনি। হাতে ফোন নিয়ে বারবার মারুফার ফোনে কল করছি। এ পর্যন্ত ৭ বার দিয়েছি আরো ৩ বার দিবো। প্রত্যক বার ফোন ধরে ঝাড়ি মারছে আমায়। আমিও উল্টো ঝাড়ি মেরে ফোন কেটে দিচ্ছ। ওকে বলেছিলাম ওর বাসর রাতে গুনে গুনে ১০ বার কল করবো। আহা এখন ওকে জ্বালানোর মজাই আলাদা। সেই কাজটিই করে চলেছি আমি। কারোর পায়ের আওয়াজ এ সচকিত হলাম। কেউ একজন এদিকেই এগিয়ে আসছে। ডানদিকে তাকাতেই দেখলাম নির্ভীক। উনার চোখের দিকে তাকিয়ে গলা শুকিয়ে গেল আমার। ভয়ে রীতিমত কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছে। কেমন নেশাক্ত চাহুনী উনার! আমি কয়েক কদম পিছিয়ে গেলাম। উনি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। হঠাৎ কিছু একটা লক্ষ্য করে থেমে গেলাম আমি। চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম উনার দিকে। দুহাত সামনে এনে ভাঁজ করে দাঁড়ালাম । উনি কিছুটা এগিয়ে এসে আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে থেমে গেলেন। আমি চোখে মুখে ঘোর লাগা ভাব এনে উনার দিকে এগোতে লাগলাম। উনি হয়ত এমন কিছু আশা করেননি। এবার আমি এগোচ্ছি আর উনি পেছাচ্ছেন। আমি বললাম,,
–“কি হলো! পিছিয়ে যাচ্ছেন কেন?”
–“তুমি এগোচ্ছো কে,কেন?”
–“একটু আগে তো আপনি এগোচ্ছিলেন তাই না?”
উনি রেলিং এর সাথে আটকে গিয়েছেন। আমি ওনার একদম কাছে গিয়ে দাড়াতেই উনি স্টিল দাঁড়িয়ে গেলেন।
একটু উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।
–“আপনি মেয়েদের মতো বিহ্যাভ করছেন কেন?”
–“কারণ তুমি ছেলেদের মতো বিহ্যাব করছো?” (চোখ মুখ খিচে ধরে)
উনার এমন কান্ড দেখে শব্দ করে হেসে ফেললাম আমি। আসছিলো আমাকে ভয় দেখাতে হুহ। আমিও কি কম নাকি। ওনার ট্রিকস উনার উপরই অ্যাপ্লাই করলাম। আমার হাসির শব্দে নিচতলা থেকে নিহাল চাচ্চু বলে উঠলেন,,
–“কি ব্যাপার আম্মু? এতো হাসছো কেন?”
নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম,,
–“কেউ একজন আমাকে ভয় দেখাতে এসেছিলো এখন সে নিজেই টাস্কি খেয়ে আছে। তাই এতো হাসছি।”
–“এটা কিভাবে করলে?”
–“সেটা বলা যাবে না চাচাজান! সিক্রেট!”
বলে পেছনে ঘুরতেই পুরো জমে গেলাম আমি। উনি আমার দুপাশে রেলিং এ হাত দিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন। নড়াচড়ার জন্য এক ইঞ্চি জায়গাও খালি নেই। আমি ভয়ে ভয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনি ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,,
–“আমার সাথে মজা করার শাস্তি তো তোমাকে পেতে হবে বউ। তখন না হয় ভয় দেখানোর জন্য আসছিলাম। কিন্তু এখন কি করবে তুমি? কিভাবে বাঁচাবে নিজেকেই?”
আমি কয়েকটা শুকনো ঢোঁক গিলে উনার দিকে তাকালাম। এবার কি করবো আমি!
·
·
·
চলবে………………………