#চুপিচুপি_ভালোবাসি (পর্ব ২২)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
রাত ১১টা বেজে ৫০ মিনিট
রেলিং এ ঠেস দিয়ে বসে আছি আমি। চারিদিকে ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বইছে। বাতাসের সাথে হাসনাহেনা ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে লাগছে। প্রাণভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে পাশে থাকা ব্যাক্তিটির দিকে তাকালাম। চাঁদের আলোয় উনার মুখটা স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছি আমি। আকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নির্ভীক। আমি বুঝি না এতো রাতে এনার এখানে কি কাজ থাকতে পারে? প্রায় এক ঘন্টা ধরে এভাবেই বসে আছেন। কিন্তু কিছু বলছেন ও না। আর উনি এখানে এলেনই বা কি করে! সব গেইট তো বন্ধ। তাহলে কিভাবে?
–“এতো ভাবতে হবে না। তোমার এই ছোট মস্তিষ্কে এতো চাপ না নেওয়াই ভালো। আমি ঐ যে ঐ গাছ বেয়ে উঠেছি।”
এক প্রকার অবাক ই হলাম। উনি কিভাবে বুঝলেন আমি কি ভাবছি? অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়। উনি প্রায় ই বুঝে যান। তাই নিজের বিষ্ময় টাকে নিজের মধ্যে দমন করে পাশের মেহেগোনি গাছটির দিকে তাকালাম। গাছটা ছাদ ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে। উনি তাহলে এই গাছটা দিয়েই এসেছেন। কিন্তু কেন এসেছেন?
–“আপনি এতো রাতে এখানে কেন আসলেন? আর নিচেই বা বসে ছিলেন কেন?”
উনি মুচকি হেসে বললেন,,
–“আর বলো না এই বাড়িতে একটা পেত্নী থাকে। মারাত্মক রকমের পাজি সেই পেত্নীটা। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কিন্তু উনি আমার স্বপ্নে এসে বললো, ‘এক্ষুনি আমার কাছে চলে আয় নাহলে তোর ঘার মটকে দিবো।’ আমিও তার ভয়ংকর রুমে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আর যাই হোক যদি আমার ঘাড় মটকে দেয় তাহলে আমার ফিউচার বাচ্চা কাচ্চা গুলো এতিম হয়ে যাবে। আর আমি কি সেটা হতে দিতে পারি! নোপ কখনই পারিনা। তাই তো এই মাঝরাতেও চলে এলাম।
বাই দ্যা ওয়ে! মধ্যরাতের তুমি এখানে কি করছো? এতো রাতে একটা মেয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে এটা তো ভালো কথা নয়! (এক ভ্রু উঁচিয়ে)
উনার কথা শুনে শশব্দ হেসে ফেললাম আমি। কি বলছে এই মানুষটা! ওনার দিকে নজর যেতেই দেখলাম উনি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তাকাতেই চোখ সড়িয়ে বিড়বিড় করে বললেন,,
–“মারডালা! ইয়ে স্মাইল কাতিলানা হ্যায়!”
–“কিছু বললেন?”
উনি আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন,,
–“এতো রাতে এখানে কেন এসেছো?”
–“ঘুম আসছিলো না তাই হাওয়া খেতে চলে এলাম।”
উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,,
–“হাওয়া খাওয়া যায় নাকি?”
–“কেন নয়!”
উনি নিঃশব্দে হাসলেন। আমি বললাম,,
–“আপনি যে এখানে এসেছেন সেটা বাবা- মামনি জানে?”
–“নাহ! আর আমি একা আসিনি। আয়াত ও এসেছে। ও যে কতক্ষণে ফিরবে কে জানে?”
আয়াত ভাইয়াও এসেছে। বাপরে! এরা দুই ভাই তো দেখছি খুব ডেঞ্জারাস। ভাবছি এখন মারুফা কি করছে। ও কি বাইরে বেরোতে পেরেছে নাকি আয়াত ভাইয়াকে আচ্ছামত ঝাড়ছে এতো রাতে আসার জন্য।ওর কি ভয় লাগছে যে কেউ দেখলে কি ভাববে নাকি প্রিয় মানুষটার সাথে সময় কাটানোর জন্য সব ভয় উরে গিয়েছে? যাই হোক এসব সাইডে রেখে বললাম,,
–“কফি খাবেন?”
উনি বিষ্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। উনার এমন দৃষ্টিতে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম আমি। আরে এভাবে তাকানোর কি আছে? উনি বিষ্ময় নিয়ে বললেন,,
–“তুমি এই কথা বলছো? তুমিই!”
–“আরছ আজব! এইভাবে রিয়্যাক্ট করছেন কেন আপনি? আমি কি অবাস্তব কিছু বলেছি? বলেছি কফি খাবেন? আমার খেতে ইচ্ছা করছে তাই জিজ্ঞেস করলাম। ঠিক আছে আপনার যখন এতোই বিষ্ময় তাহলে থাক!”
–“না থাকবে কেন? আমি খাবো।”
–“ঠিক আছে। আমি বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
তারপর আমি রান্নাঘরে চলে এলাম। চুলায় দুধ বসিয়ে একবার আম্মু আব্বুর রুমের দিকে উঁকি দিলাম। নাহ কেউ টের পায়নি। কফি বানিয়ে ছাদে ছাদে চলে এলাম আমি। এক কাপ উনাকে দিলাম আর এক কাপ আমি নিলাম। উনি কফি খাচ্ছেন আর আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। কি মানুষ রে এইটা একবার বলছেও না কেমন হয়েছে? মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালাম।
–“এখন থেকে রেগুলার আসতে হবে মনে হচ্ছে। রেগুলার রুটিনে তোমার হাতের কফি অ্যাড করে নিলাম আজ থেকে।”
এমন কথা শুনে উনার দিকে ফিরে তাকালাম আমি। অবাক চোখেই দেখছি উনাকে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,,
–“আমার বউয়ের দেখি অনেক গুন।”
তারপর আবার নিরবতা। এখনো বাতাস বইছে। অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে। রাত বারোটার সময় ছাদে বসে উনার সাথে কফি! মনে হচ্ছে এভাবেই থেকে যাই সারাজীবন। সময়টা এখানেই থেমে যাক। কিন্তু সেটা কি আদোতেও সম্ভব? নিশ্চয়ই না। তাই তো আমার এই চিন্তাভাবনা কে ভেস্তে দিয়ে উনার ফোন বেজে উঠলো। উনি ফোনটা ধরে কারোর সাথে কথা বললেন। তারপর ফোন কেটে আমাকে বললেন,,
–“এবার আমাকে যেতে হবে।”
উনার মুখ থেকে “যেতে হবে” শুনে কেমন বিষন্নতা ছেয়ে গেল আমার। কেন যেতে হবে? এখানে থাকলে কি হবে হ্যাঁ! এমন হুট করে এসে ফুট করে চলে গেলেই হলো নাকি? এটা তো মানা যায় না। আরে আমার ইচ্ছারও তো দাম আছে নাকি? আমি কোনরকম ভনিতা না করে বললাম,,
–“যাবেন মানে? আপনি যাবেন না। আজ এখানেই থাকবেন আমার সাথে।”
উনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। হয়তো আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ ওভাবে থেকে আমার কপালে হাত রেখে বললেন,,
–“তুমি ঠিক আছো তো?”
আমি আমার কপাল থেকে উনার হাত সরিয়ে দিলাম। তারপর দুহাতে ওনার বামহাত জড়িয়ে ধরে উনার কাঁধে মাথা রেখে বললাম,,
–“আমি একদম ঠিক আছি। আপনি যাবেন না মানে যাবেন না। আয়াত ভাইয়া কে চলে যেতে বলুন। আপনি ভোর বেলা যাবেন।”
উনার মুখের দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। উনি উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। উনির দাঁড়ানো দেখে আমিও পাশে থাকা টুলের উপর দাঁড়িয়ে গেলাম। উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,,
–“তুমি পাগল হয়ে গিয়েছো। আমি যাচ্ছি।”
–“যাচ্ছি বললেই হলো নাকি? আপনি যাবেন না ব্যাস।”
–“বুঝে বলছো তো! আমি থাকলে কিন্তু পরিস্থিতি টা তোমার জন্য খারাপ হয়ে যেতে পারে।”
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। তারপর বললাম,,
–“মানে?”
উনি গম্ভীর মুখে বললেন,,
–“লুক তুমি এই মুহূর্তে নিজের মধ্যে নেই। তুমি একটা মেয়ে আর আমি একটা ছেলে তারওপর তুমি আমার জন্য হালাল! যদি কিছু,,,”
একটু চুপ থেকে একটা বড় নিঃশ্বাস নিলেন তারপর বললেন,,
–“নিজের ঘরে যাও।”
উনি যেতে নিলেই হাত টেনে ধরলাম আমি। উনি হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। উনি ছোট ছোট চোখে তাকালেন। এবার ই করে বসলাম বিশাল সাহসের কাজ। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুই যেন আমার মাথায় ঢুকছে না। উনাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে উনার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,,
–“আমার বরটা কত্ত কিউট। দেখলেই মনে হয় খেয়ে ফেলি!”
উনি বিষ্ময়ে হতোবিহ্বল। আমার থেকে একটু দূরে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন উনি। আমি উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি। আচ্ছা আমি কি এতোটাও বিষ্মিত হওয়ার মতো কিছু করেছি? এরকম রিয়্যাকশনের কারণ টা কি? উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,
–“সত্যিই তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। কেন এমন পাগল করছো আমায়? আমি এমনিতেই পাগল হয়ে আছি আর পাগল করো না প্লিজ। এখন চুপচাপ ঘরে যাও।”
আমি তো নাছোড়বান্দা। যাবো না মানে যাবো না। আমার কোন হিলদোল না দেখে উনিই উঠে চলে গেলেন।আমি শুধু উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।
🍁
আজ মারুফার হলুদ। নিলা আর আমি ওর খাটের উপর বসে পা দোলাচ্ছি আর আপেল খাচ্ছি। ও আমার দিকে অসহায়ের মতো করে তাকিয়ে আছে। আমি ডোন্ড কেয়ার ভাব নিয়ে বাকি সবার দিকে তাকালাম। মিতু, রুবি, জান্নাত, মিমসহ বাকিরা সাজতে ব্যাস্ত। ওদের দেখে মনে হচ্ছে আজ ওদের ই হলুদ। আর এদিকে মারুফা কে দেখো! নরমাল ড্রেস আপে বসে আছে। সবাই সাজতে বলছে কিন্তু উনার গায়েই লাগছে না। এদিকে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। এক্ষুনি ঐ বাড়ির লোকজন চলে আসবে। এবার আন্টি এসে ওকে তাড়া দিতে লাগলো। কিন্তু ম্যাডামজি এখনো সেভাবেই বসে আছে। অবশেষে আমি ওকে দিলাম এক ধমক। তারপর বললাম,,,
–“কি সমস্যা? এভাবে হুতুম পেঁচার মতো বসে আছিস কেন?”
ও মিনমিনিয়ে উত্তর দিলো,,
–“দোস্ত টেনশন হচ্ছে খুব। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।”
–“এমন ভাব করছিস যেন আজই তোর বিয়ে? আরে বইন এসব টেনশন আপাতত সাইডে রাখ আর চুপচাপ রেডি হয়ে নে।”
–“বললেই কি টেনশনকে দূরে রাখা যায়?”
–“রিল্যাক্স বেবি চিল মার। বিয়ে আর এমন কি ব্যাপার? হুট করে কবুল বলে ঠুস করে বাসর ঘরে ঢুকে ঠাস করে দড়জা লাগিয়ে দিবি। ব্যাস!”
–“তুই জীবনে শোধরাবি না! আচ্ছা তোর বিয়ের সময় ও কি সেইম জিনিস করেছিলি? হুট করে কবুল বলে,,,”
ওকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বললাম,,
–“আমার বিয়েটাই তো হুট করে হয়ে গেছে। কিন্তু তোর তো এমন নয় তাইনা? এখন চুপ! গাইস অনেক সময় ওয়েস্ট হয়েছে অনেক সেজেছো তোমরা। এখন কনেকে সাজাও তাড়াতাড়ি। দেরি হলে সমস্যা!”
তারপর মারুফাকে আর একটা কথাও বলতে না দিয়ে ওকে সাজানো শুরু করলাম আমি। ও অন্য কাউকেই তার ধারে কাছেও ঘেষতে দিচ্ছে না। ভাবটা এমন যেন আমি ছাড়া বাকি সবাই ওকে জংলি বিড়াল সাজিয়ে দিবে! আমি আর নিলা মিলে ওকে হলুদ শাড়ি পড়িয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলাম। তারপর রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুলের গয়না পরানো হলো ওকে। যদিও গাঁদা ফুলের গয়না পরানো হয় হলুদে কিন্তু আমার ফ্রেন্ড বলে কথা! একটু ইউনিক তো হতেই হবে তাইনা!
·
·
·
চলবে………………………….