#চুপিচুপি_ভালোবাসি (পর্ব ২১)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
হঠাৎ মনে হলো আমরা দুইজন শুধু আমাদের রুমটাই নয় অন্য রুমগুলোরও বারোটা বাজিয়ে এসেছি। ভাগ্যিস আপুরা কেউ নেই এখন। সবাই এখনও ফেরে নি। কিন্তু ফিরতেও বেশি সময় বাকি নেই। আপুরা ফেরার আগেই সব ঠিক ঠাক করতে হবে নাহলে আমাদের কি অবস্থা করবে কে জানে। একে তো এখানকার বেশিরভাগ ই আমাদের সিনিয়র মুখের ওপর কথাও বলতে পারবো না। তার থেকে যা যা বিগ্রেছি সব ঠিক করাই ভালো। নিলাকে একটা গুঁতো মেরে বললাম,,,
–“ঐ এখন এইভাবে বসে থাকা যাবে না। সবার রুম তো পুরা আওলাই ফালাইছিস সেইগুলা তো ঠিক করা লাগবে নাকি? সবাই ফিরে যথি দেখে তাদের রুমের উপর দিয়ে ভূমিকম্প হয়ে গেছে তাহলে আমাদের উপর দিয়ে নির্ঘাত সুনামি বইয়ে দিবে। চল চল তাড়াতাড়ি সব ঠিক ঠাক করে দি হাতে বেশি সময় নেই। কুত্তি তুই জিনিসপত্র ছুড়বি ভালো কথা আমাদের রুমের গুলা ছোর অন্যদের গুলা কেন ছুড়লি? এবার সব আমাদের ই করতে হবে। আলগা ঝামেলা সব।”
আমার কথা শুনে জ্বিভ কাটলো নিলা। মুখ কাচুমাচু করে বলল,,
–“সরি সরি। এখন চল সব ঠিক করি। আমাকে পরেও বকতে পারবি।”
তারপর দুইজন মিলে সব গুছিয়ে ফেললাম। একদম ঝকঝকে তকতকে করে সব রুম গুছিয়েছি। সব কাজ শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা ৬ টা বেজে গেল। গোছানো শেষ হতে না হতেই আপুরা সবাই চলে এলো। আমরা একদম গুড গার্ল হয়ে নিজেদের রুমে বসে পড়াশোনা করছি। আমরা তো লক্ষী মেয়ে আপুদের রুমে তো আমরা যাই ই নি। পড়তে পড়তে রাত ৯ টা বেজে গিয়েছে। তখনই নিলা মহারানীর ফোন বেজে উঠল। ওর ভাইয়া কল করেছে। ও ফোন ধরে বারান্দায় চলে গেলো। আমিও ফোন হাতে নিয়ে আমার বেডের জানালার পাশে বসলাম। জানালা দিয়ে বাইরে চোখ যেতেই দেখলাম দূরে আমগাছের সাথে হেলান দিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কি ব্যাপার এতো রাতে ওখানে কে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? কে সেটা বোঝার জন্য আরেকবার তাকাতেই আমি অবাক। উমা এখন কেউ নেই তো? কোথায় গেল? আমি তো স্পষ্ট দেখলাম কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেল! এর মাঝেই আমার ফোন মহাশয় কাঁপতে লাগলেন। মারুফা কল করছে। ফোন ভাইব্রেশনে থাকায় কাঁপুনি দিয়েই বোঝাচ্ছেন আমাকে তোলো আর কানে লাগাও। ফোনটা কি রিসিভ করবো? নাহ থাক রিসিভ করবো না। এখটু বুঝুক কেমন লাগে? ওর বিয়ের খবর আমাকে জানালো না এর জন্য এই শাস্তিটাই বেষ্ট। কিন্তু আমিও তো বলিনি আমার বিয়ের কথা? তাতে কি! আমার ব্যাপারটা আলাদা ছিলো। ওর তো আর আমার মতো হুট করে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না যে ও আমাকে জানাতে পারবে না। ধরবো না তোর ফোন। এই ভেবে ফোনটাকে সাইলেন্ট করে রাখলাম। এখন যত খুশি কল করো কিন্তু আমি রিসিভ করবো না। ফোন সাইলেন্ট করে বিছানা থেকে নামতেই বারান্দা থেকে নিলা চলে এলো। দুইজন মিলে ডাইনিং এ গিয়ে নিজেদের খাবার খেয়ে নিলাম। কিন্তু আমার মাথায় একটা কথাই ঘুরছে গাছের নিচে কে ছিলো?
🍁
সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে হোস্টেল থেকে বের হচ্ছি আমি আর নিলা। দেখতে দেখতে পরীক্ষা গুলো শেষ হয়ে গেলো। আজ আমরা সবাই বাড়ি ফিরছি। আর ৩ দিন পর মারুফা আর আয়াত ভাইয়ার বিয়ে। সেই জন্যেই যাওয়া। কলেজ থেকে মাত্র ৭ দিনের ছুটি পেয়েছি আমি আর নিলা। আয়াত ভাইয়া আর মারুফা ২ দিন আগেই বাড়ি ফিরে গিয়েছে। আজ আমি নিলা আর নির্ভীক যাবো। নির্ভীক ২ দিন আগেও যেতে পারতো কিন্তু যায়নি। উনার এক কথা বউকে একা ফেলে কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না। তাই আর কি সবাই একসাথেই ফিরছি। রিক্সা করে বাস স্টপ এ চলে এলাম আমি আর নিলা। বাসের কাছে এসে দাড়াতেই নির্ভীক কে দেখতে পেলাম। উনার সাথে একটা ছেলেও আছে। দূর থেকে ঠিক বুঝতে পারছি না ছেলেটা কে। কিছুক্ষণ পর চেহারা স্পষ্ট হলো। ইনি আর কেউ নন আয়াশ। ওকে দেখেই নিলার মুখে হাসি ফুটলো। কি প্রেম প্রেম নজরে তাকিয়ে আছে আয়াশের দিকে। আমি অবাক চোখে নিলাকে দেখছি। হায়রে কি প্রেম! খালি আমিই আজ পর্যন্ত পারলাম না। দেখতে দেখতেই সবাই বাসে উঠলাম। এখন সমস্যা হলো বসা নিয়ে। নিলা তো আয়াশ ভাইয়া ছারা বসবে না। দুই দিনের প্রেমে আমাকে ভুলে গেছে। কি আর করা অগত্যা নির্ভীকের পাশেই বসতে হলো আমায়। উনার পাশে বসতেই উনি বললেন,,
–“তুমি মেয়ে পক্ষ নাকি ছেলে পক্ষ হুম! আমার মতে তুমি কিন্তু ছেলেপক্ষ। আফটার অল আয়াত তোমার দেবর বলে কথা!”
বললেই হলো নাকি? আমার দুইমাত্র বেস্টুর একজনের বিয়ে আর আমি নাকি ওর সাইডে না থেকে এনার সাইডে থাকবো? আমার কতদিনের শখ মারুফার বিয়েতে কত কিছু করবো। ওকে জ্বালাবো ওর বরের পকেট থেকে এতো গুলা টাকা বের করবো আর উনি এসে আমাকে পাত্রপক্ষ হতে বলছেন? মোটেও না। কিন্তু আয়াত ভাইয়ার ব্যাপারটাও তো ফেলে দেওয়া যায় না। তাই একটা ডিসিশন নিয়ে ফেললাম। আমি নিজের সুবিধা অনুযায়ী দুইপক্ষেই থাকবো। এই যেমন হলুদ থেকে বিয়ে পর্যন্ত আমি মেয়ে পক্ষ আর বিয়ের পর থেকে ছেলে পক্ষ! ওয়াহ কেয়া আইডিয়া হ্যায়! ইউ আর টু গুড শর্মি।
–“কি হলো কিছু বলছো না যে?”
উনার কথায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। তারপর বললাম,,
–“আমি তো দুইপক্ষেই আছি।”
–“বললেই হলো! এটা তো ঠিক নয়। যেকোনো একটা সাইড নিতে হবে।”
–“হুহ😒
এরপর আর কোন কথা নেই। এর মধ্যে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি খেয়াল নেই। বাসের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। চোখ খুলে দেখি আমি নির্ভীকের বুকের উপর মাথা রেখে আছি। এটা দেখেই হুরমুর করে সরে গেলাম আমি। উনি কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমি নিজেই নিজেকে বকছি। ধুর কখন যে উনার বুকের উপর ঘুমিয়েছি কে জানে? আমি একটা গাধী! প্রায় ৪ ঘন্টা পর শাহজাদপুর এ পৌঁছালাম আমরা। এখন কথা হলো গিয়ে নিলা আমার সাথে যাবে না। ও আগে নিজের বাড়ি যাবে তারপর মারুফার হলুদের দিন বিকালে আমাদের ওখানে যাবে। আমিও আর বেশি কিছু বললাম না। যাক বাড়ি গিয়ে বাবা মায়ের সাথে দেখা করুক। আয়াশের বাসাও নির্ভীকদের বাসায় ঐদিকেই। আমাকে একাই যেতে হবে! বাস থেকে নেমেই দেখলাম আমার শ্রোদ্ধেও শশুর মশাই আর আয়াত ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। উনাদের কথা শুনে বুঝলাম আমাকে ঐ বাড়িতে নিয়ে যাবেন বলেই এসেছেন। কিন্তু আমি তো যেতে চাই না এখন। আবার বাবার মুখের উপর কিছু বলতেও পারছি না। ঠিক তখনই আমার প্রবলেম সল্ভ করতে আমার আব্বু সেখানে এসে হাজির হলেন। খুব সুন্দর ভাবে বাবাকে বোঝালেন যে,
–“মেয়েটা এতোদিন পর এলো ওর ছোট বোন ওকে দেখবে বলে কান্না জুড়ে দিয়েছে। আর তো কিছু দিনই থাকবে আমাদের কাছে তারপর তো তোর বাড়ির আমানত তুই নিয়েই যাবি আদভিক। এই কদিন আমার কাছেই থাকনা আমার মেয়েটা।”
আব্বুর কথা শুনে খুব কান্না পাচ্ছে আমার। কতটা আকুতি আছে এই কথাগুলোর মধ্যে। কোনমতে নিজের কান্না আটকে রেখে বাবার দিকে তাকালাম। উনিও মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন,,
–“ঠিক আছে নিয়ে যা মেয়েকে! আমার ও তো মেয়ে আছে তাকে ছাড়া যে কিভাবে থাকবো সেটা ভাবলেই তো,, যাজ্ঞে এসব ছাড়। আম্মু (আমার দিকে তাকিয়ে) তুমি তোমার আব্বুর সাথে যাও এখন আমাদের বাড়িতে নাহয় বিয়ের আগের দিন,,”
বাবাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ইতোস্থত গলায় বললাম,,
–“বাবা! মারুফা তো আমার বান্ধবী সম্পর্কে আমার চাচাতো বোন ও। আমি বিয়ে পর্যন্ত ওর সাথে থাকলে আপনি কি কিছু মনে করবেন? আর মামনি কি রাগ করবে আমার উপর! আসলে আমি চাইছিলাম ওর সাথে থাকতে।”
এতটুকু বলেই মাথা নিচু করে ফেললাম আমি। কেমন একটা লাগছে। ওনাকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি। আচ্ছা আমি কি ভূল কোন আবদার করলাম? বাবা কি রেগে যাবেন এখন? কিছুক্ষণ পর কেউ আমার মাথায় হাত রাখলেন। চোখ তুলে দেখি বাবা! আমি আবাক চোখে ওনার দিকে তাকালাম। উনি মুখে হাসি টেনে নিয়ে বললেন,,
–“কেউ কিছু মনে করবে না আম্মু! তুমি এক কাজ করো, বিয়ের দিন মারুফা কে নিয়ে আসার সময় ওদের সাথে তুমিও চলে এসো কেমন? তাহলেই তো হলো! আর তোমার মামনিকে আমি বলে দিবো।”
আমি মুখে হাসি নিয়ে বাবাকে থ্যাংকস বললাম। সত্যি আব্বুর পরে এই লোকটাকেই এতো ভালো লাগে আমার। সবসময় ওনার মুখে হাসি টা লেগেই থাকে। তারপর সবাইকে বিদায় জানিয়ে আব্বুর সাথে হাঁটা ধরলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম নির্ভীক আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। বিনিময়ে একটা হাসি উপহার দিয়ে চলে এলাম আমি। অনেকদিন পর আব্বুর সাথে হাঁটছি। বেশ ভালো লাগছে আমার।
___________________
রাত ১০ টা বেজে ৫৪ মিনিট। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে এতোক্ষণে। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। কেন যেন ঘুম আসছে না। হয়তো বাসে ঘুমিয়ে ছিলাম বলে। তাই ছাদে চলে এলাম। ছাদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার নিচেই আমার রুম। নিচে থাকা লিচু গাছটার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ কাউকে দেখলাম বলে মনে হলো। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম লিচু গাছের পাশে থাকা সিঁড়ির উপর কেউ বসে আছে। মুখটা বুঝতে পারছি না। এটা আবার কে? আর এতো রাতে এখানেই বা কি করছে? কোন চোর টোর নয়তো? কিন্তু চোর হলে নিশ্চয়ই এইভাবে বসে থাকতো না! কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে এই ব্যাক্তির! এসব ভেবে নিচে তাকাতেই দেখলাম কেউ নেই! আজব তো এক্ষুনি তো এখানেই ছিলো। আচ্ছা সত্যিই কেউ ছিলো তো, নাকি আমার কল্পনা? ধুর! বলে পেছনে ঘুরতেই কারো সাথে ধাক্কা খেলাম। মাথা তুলে সামনের ব্যক্তির দিকে তাকাতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম আমি। এতো রাতে,,,,
·
·
·
চলবে………………………..