#চুপিচুপি_ভালোবাসি (পর্ব ০২)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
আমি চোখ বন্ধ করে দোয়া দরুদ পড়ছি। যদি কোনভাবে বেঁচে যাই। হঠাৎ ই হাসির শব্দ কানে এলো আমার। আমি হালকা করে এক চোখ খুলে দেখলাম নির্ভীক ভাইয়া থুরি নির্ভীক হাসছেন। শুধু হাসছেন বললে ভূল হবে রীতিমতো গড়াগড়ি খেয়ে হাসছেন। ওনার হঠাৎ এরকম হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো আমার। আশ্চর্য! এরকম পাগলের মত হাসার কি আছে? কি এমন হয়েছে যে উনি হেসেই খুন হচ্ছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে যে ওনাকে দেখতে অমাইক সুন্দর লাগছে এই কথাটা কিছুতেই অস্বীকার করত পারবো না আমি। কি সুন্দর করে হাসতে পারেন উনি। কিন্তু ওনার হাঁসির কারণ টা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না আমার। আমি ওনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি হাঁসি থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,
–“জাস্ট লুক এ্যাট ইউ! তোর চেহারা টা একদম দেখার মতো ছিলো। ভয়ে একেবারে ভেজা বেড়াল হয়ে গিয়েছিলি তুই! তুই যে এতো ভয় পাস সেটা আগে বলিস নি তো! তুই কি ভাবলি আমি সত্যি সত্যি তোর সাথে ঐসব,,,,😂”
বলেই আবার হাসতে শুরু করলেন উনি। এখন আমার এই ছেলেটাকে নর্দমায় চুবাইতে ইচ্ছা করছে। মন তো চাচ্ছে আচ্ছামত কিছু গালি দিতে। কিন্তু কোন গালিই এই মুহূর্তে মাথায় আসছে না। কিন্তু এইভাবে আমাকে বিয়ে কেন করলেন উনি? শুধু একটা বাজি জিতার জন্য!এটাকে কি পুতুল খেলা পেয়েছেন নাকি? এবার আমার কান্না পাচ্ছে খুব। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,,
–“বিয়েটা কি পুতুল খেলা মনে হয় আপনার কাছে? শুধু মাত্র একটা চ্যালেঞ্জ জেতার জন্য আপনি আমায় বিয়ে করলেন? আমার জীবন টা এইভাবে নষ্ট কেন করলেন আপনি? আমাকে কি রিমোট কন্ট্রোল খেলনা ভেবেছেন আপনি? আজ চ্যালেঞ্জ জেতার জন্য বিয়ে করলেন আবার কাল ইচ্ছে হলেই ছুড়ে ফেলে দিবেন।”
এতটুকু বলে উনার দিকে তাকাতেই আতকে উঠলাম। উনার চোখ দুটো লাল বর্ণ ধারণ করেছে। চোখে মুখে রাগের ছাপ। আমি কি ভুল কিছু বলে ফেললাম নাকি? নাহলে হঠাৎ করে এত রেগে যাওয়ার কারণ কি? আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই উনি আমাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে পাশের দেয়ালের সাথে চেপে ধরলেন। আমার হাতটা এতোটাই জড়ে ধরে আছেন যে আমি হাতে প্রচন্ড ব্যথা পাচ্ছি। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই আরও জোরে চেপে ধরলেন। আমি নিজের চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারলাম না। চোখ থেকে অঝোরে পানি পরছে। কিন্তু ওনার সেদিকে কোন খেয়াল ই নেই। অশ্রুসিক্ত নয়নে উনার দিকে তাকাতেই দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,,
–“তুই কি আমাকে এতোটাই খারাপ মনে করিস শর্মি! তোকে আমি ছুড়ে ফেলে দিবো এটা তুই ভাবলি কি কর? একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ তোকে ছাড়ার জন্য বিয়ে করিনি ড্যাম ইট!! তোকে কোনদিন ও ছাড়বো না আমি, তুই চাইলেও না বুঝেছিস তুই!!” (জোরে চেঁচিয়ে)
উনার চিল্লানোয় কেঁপে উঠলাম। হঠাৎ আমার দিকে খেয়াল করে মুহূর্তেই হাতটা ছেড়ে দিলেন। তারপর আমাকে টেনে বিছানায় নিয়ে বসিয়ে আমার পায়ে বসে পড়লেন। অপরাধী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,,
–“খুব বেশি ব্যাথা লেগেছে তাইনা। আ’ম সরি! আমার জন্য তোর এতো ব্যাথা লেগেছে। আমি এমন কেন বলতো? আ’ম রিয়েলি ভেরি সরি! কিন্তু তুই কেন আমাকে রাগিয়ে দিস বলতো!”
উনার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। চোখ দুটো দিয়ে শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। এই মানুষটাকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না। এই রেগে আঘাত করছেন আবার একটু পরে নিজেই কেয়ার করছেন, নিজে কষ্ট পাচ্ছেন!! কিন্তু কেন এমন করছেন উনি। যতবারই এই প্রশ্নটা করেছি ততবারই খুব সুক্ষ্ম ভাবে এরিয়ে গিয়েছেন উনি। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। কিন্তু আজ ওনাকে বলতেই হবে। তাই ওনার দিকে তাকিয়ে কিছু বলবো তার আগেই ঘরে ঢুকলো নূপুর মানে নির্ভীকের বোন। নূপুরকে দেখেই উঠে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন উনি। গুটি গুটি পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো নূপুর। একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আবার নির্ভীকের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। নির্ভীক ভ্রু জোড়া কুঁচকে নূপুরের দিকেই তাকিয়ে আছে। নূপুর এবার নির্ভীক এর দিকে এগিয়ে গিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,,
–“ভাই!! তুমি আপুর ঘরে ওহ সরি আমার ভাবীর ঘরে কি করছো? তোমার তো এখানে থাকার কথা নয়। পাপা তোমাকে কি বলেছে ভুলে গিয়েছো নাকি? পাপা কিন্তু বলেছিলো তুমি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ভাবীর সাথে থাকতে পারবে না। তাহলে এখানে কি করছো?”
উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,,
–“বউয়ের সাথে কথা বলতে এসেছিলাম। কেন রে!! এর জন্যেও কি তোর পারমিশন নিতে হবে নাকি?”
–“এই নানা তা কেন হবে? আমি কি সেটা বলেছি নাকি? আমি তো যাস্ট তোমাকে পাপার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম হিহি। তোমার তো কথা বলা শেষ তাইনা!!
— “হু”
–“তো এখনও এখানে দাড়িয়ে আছো কেন? যাও বাইরে যাও। আমরা ঘুমাবো।”
নির্ভীক নূপুর এর মাথায় গাট্টা মেরে চলে গেলেন আর নূপুর আমার সাথে কথা বলে ঘুমিয়ে পরলো। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। আজ যে আমার ঘুম হবে না সেটা খুব ভালোই বুঝতে পারছি আমি। তাই বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় চলে এলাম। আজ চাঁদটা অনেক সুন্দর লাগছে। অন্যসব দিনের তুলনায় একটু বেশি ঝলমল করছে। কি আজব আজ রাতের পরিবেশ টাও কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে সমস্ত গাছপালাও নরে চরে উঠছে। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছি সেই দিনের কথা যেদিন নির্ভীকের সাথে প্রথমবার দেখা হয়েছিলো।
————————–
তখন আমি সবে এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছি। আর নির্ভীক ভাইয়া মেডিক্যাল এ ২য় বর্ষে। সেদিন নির্ভীক ভাইয়ার বাড়িতে দাওয়াত ছিলো। উপলক্ষ্য ওনার চাচ্চুর বিয়ে। এর আগে তাকে যখন দেখেছিলাম তখন আমি নার্সারিতে পড়ি। এরপর আর কোনদিনই ওনার সাথে দেখা হয় নি আমার। কাকতালীয় ভাবে হলেও আর কখনোই কোনভাবেই দেখা হয়নি। শুধু জানতাম আদভিক আঙ্কেলের একটা ছেলে আছে যে নাকি অনেক বেশি ট্যালেন্টেড। সে যাই হোক, তো আদভিক আঙ্কেলের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমার। ওখানে পৌছাতেই আন্টি আমাদের সাদরে আপ্যায়ন করলেন। আন্টির সাথে আমার ভাব ছিলো একটু বেশি। আমি সোফায় বসে আন্টির সাথে কথা বলছি ঠিক তখনই একজন আন্টিকে, ‘মা’ বলে ডেকে উঠলো। আমি চোখ তুলে তাকাতেই দেখলাম প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দড়জার সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে একটা ছেলে। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। ছেলেটাও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আচ্ছা! ছেলেটাকি সত্যিই এতোটা সুন্দর নাকি আমার কাছেই এতো বেশি সুন্দর লাগছে। আমার থেকে কয়েক শেড বেশি ফর্সা। ছেলেরা আবার এতো ফর্সা হয় নাকি ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এটা ঠিকই বুঝলাম আজ ১৬ বছরের রেকর্ড ভেঙে আমিও কারোর উপর ক্রাশড। তো আমি যখন ওনাকে দেখছি তখন ই আন্টি বলে উঠলেন,
–“কি ব্যাপার নির্ভীক! কিছু বলবি বাবা?”
তারমানে ইনিই আঙ্কেলের ছেলে! সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলাম। সেইদিন ই মনে প্রাণে নিজেকে এইটাই বিশ্বাস করিয়েছিলাম যে উনি আমার ভাইয়া। শুধুই আমার ভাইয়া! আর কিছু ভাবা যাবে না উনাকে।
আন্টির কথা শুনে উনি বললেন,,
–“হ্যাঁ মা পাপা তোমাকে ডাকছে। কিছু একটা খুঁজে পাচ্ছে না।”
এতটুকু বলেই উনি ওখান থেকে চলে গেলেন। আর আন্টি যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। দড়জার কাছে গিয়ে কি মনে করে আবার ঘুরে তাকালেন। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,
–“আম্মু! ছাদের উপর কয়েকটা ফুলের মালা সহ ঝুড়ি রয়েছে। ঘর সাজানোর জন্য আনা হয়েছিল। আমি নিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছি। তুই একটু নিয়ে আসবি প্লিজ!”
–“এভাবে বলছো কেন আন্টি! আমি নিয়ে আসছি।
আন্টি মিষ্টি হেসে চলে গেলেন। আমিও ছাদের দিকে পা বাড়ালাম। ছাদের দড়জা খুলে ফুলের ঝুড়ির কাছে গিয়ে ফুলগুলো তুলবো তখনই পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,,
–“এখানে কি করছো!”
কন্ঠটা শুনে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম নির্ভীক ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। আমি মাথা নিচু করে উত্তর দিলাম,,
–“ফুল নিতে এসেছি।”
–“তো নাম কি তোমার? আর আমাদের বাড়িতে কি করছো?”
ওনার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে এলো আমার। এইটা কেমন প্রশ্ন। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হলো উনি তো আমাকে চিনেন না। আর চেনার কথাও নয়। তাই আমি বললাম,,
–“আমার নাম শর্মি!”
উনি আবাক চোখে তাকালেন। তারপর বললেন,,
–“তুই শর্মি!! ঐ পিচ্চিটা! ওহ মাই গড!! ছোটবেলায় ও পেত্নী ছিলিস আর এখন ও পেত্নীই আছিস।”
আর এক মিনিট ও না দাঁড়িয়ে ফুলের ঝুড়িটি নিয়ে নিচে চলে আসলাম। এই মুহূর্তে ওনার সামনে থাকার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই আমার। উনার সামনে থাকলে নির্ঘাত মুখ থেকে উল্টা পাল্টা কিছু বেড়িয়ে যাবে। যেটা আমি একদমই চাই না। একদমই না!!
·
·
·
চলবে……………………….