চুপিচুপি ভালোবাসি পর্ব ১৯

0
832

#চুপিচুপি_ভালোবাসি (পর্ব ১৯)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
ক্লাসরুমে বসে নিলার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছি আমি। আর ও গালে হাত দিয়ে বসে সেই কখন থেকে কি যেন ভেবে চলেছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ বার জিজ্ঞেস করেছি কি হয়েছে? এভাবে বসে আছিস কেন? কিন্তু ওনার কোন রূপ উত্তর তো দূরের কথা আমার দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। এবার আমার রাগ লাগছে। একদম রক্তচক্ষু নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ওর কানের কাছে গিয়ে বেশ জোরেই বললাম,,

–“কিরে..!! কি হয়েছে তোরররর,,,?”

ও সাথে সাথে ও নিজের কান চেপে ধরলো। তারপর বলল,,
–“এরকম চেঁচাচ্ছিস কেন? কি হয়েছে?”

এতোক্ষণ ধরে ডেকেই চলেছি অথচ ওনার কোন সাড়াশব্দ নেই এখন আবার বলছে কি হয়েছে, এতো চেচাচ্ছি কেন? রাগে গজগজ করতে করতে বললাম,,

–“তোর কি হ‌ইসে তাই ক? এতোক্ষণ ধরে ডাকতাছি কিন্তু তুই তো শুনতাইছিস না? ঐ কার কথা ভাবতাছোস রে তুই?”

ও মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে বলল,,
–“দোস্ত আর কয়েকদিন পর সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা! আর জাহিদ স্যার বলছে, ৬০% এর কম পেলে নাকি বাসায় ফোন করে প্যারেন্টস ডাকা হবে। সেই চিন্তায় চরম চিন্তিত আমি। আমার তো মনে হয় টেনেটুনে ৫০% ও উঠবে না!”

আমি ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। বলে কি এই মেয়ে? যে কিনা সব পরীক্ষায় সবসময় ৮৫% এর উপরে পায় সে কিনা মাত্র ৬০% এর জন্য এতো চিন্তা করে যাচ্ছে। ভাবা যায় এইগ্লা! এটা নিঃসন্দেহে অসহ্যকর। মন তো চাইছে ওরে নর্দমায় চুবাই দি। আমি ওর মাথায় একটা গাট্টা মেরে বললাম,,

–“ঢং কমায় কর! ৯০% পাবি সেটা আমার জানা আছে। আজাইরা ঢং না ক‌ইরা ক্যান্টিনে চল আমার ক্ষুধা লাগছে।”

ওকে আর একটা কথা বলারও সুযোগ না দিয়ে টেনে ক্যান্টিনে নিয়ে আসলাম। নাহলে আবার ওর ড্রামা শুরু হবে। প্রত্যেক পরীক্ষার আগে ওর প্যানপ্যানানি শুরু হয়। যেমন:- ‘দোস্ত আমার পাস মার্ক ও উঠবে না। টেনেটুনে পাস করবো!’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু রেজাল্ট এর সময় দেখা যায় হাইয়েস্ট নম্বর ওই পেয়েছে। তখন আবার শুরু হয় ড্রামা! এইসবের জন্য মাঝে মাঝে মনে হয় ওরে কলা গাছের সাথে উল্টো করে ঝুলিয়ে কলার মোচা দিয়ে পিটাই! ক্যান্টিনে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম আমরা। নুডুলস অর্ডার করে খেতে শুরু করলাম। কিন্তু নিলা মহারানী এখনও মুখ ভার করে বসে আছে। এবার আমি ওর চুল টেনে ধরলাম। ও রাগি চোখে তাকিয়েই ঈশারায় বললাম, ‘ খা নয়তো আরো খারাপ হয়ে যাবে।’ আমার চোখ রাঙানি তে কাজ হলো। ও খেতে শুরু করলো। আমরা খাচ্ছি আর টুকটাক কথা বলছি। ঠিক তখনই কোথা থেকে ঝড়ের গতিতে আমাদের টেবিলের সামনে এসে উদয় হলেন নির্ভীক। তারপর ঠাস করে পাশের চেয়ারে বসে পরলেন। এক সেকেন্ডের জন্য তো আত্না বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিল আমার। কেউ এমন হুটহাট এসে ঠুস ঠাস বসে পড়লে এমন তো হবেই! নিজেকে স্বাভাবিক রেখে উনার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করলাম। কিন্তু সেটাও বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। নিলা আর উনার গা জ্বালানো কথা বার্তা শুনে মুহূর্তেই খাওয়া উঠে গেল আমার। আর নিলাকেও দেখো এতোক্ষণ ধরে মুখটা বাংলার পাঁচের মতো বানিয়ে রেখেছিলো আর এখন নির্ভীক কে দেখেই মুখে কি সুন্দর হাসি ফুটেছে। হেসে হেসে উনার সাথে কথা বলে চলেছে এই মেয়ে। এখানে যে আমি নামক কোন মানুষ ও উপস্থিত আছি সেটা উনাদের চোখেই পড়ছে না। কেন রে! আমার সাথে তো কখনো এমন ভাবে কথা বলিস না? দুজনের দিকেই অগ্নীদৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। কিন্তু কারোর কোন হিলদোল হলো না। কিছুক্ষণ পর নির্ভীক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,

–“জানো! আয়াত আর মারুফার বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে গিয়েছে! মারুফাদের ফার্স্ট ইয়ারের এক্সাম শেষ হ‌ওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই ওদের বিয়ে। কাল মেজো চাচ্চু বললো। আয়াত তো এক্সাইটমেন্টের ঠ্যালায় কাল ঘুমাতেই পারেনি। আর এই এক্সাইটমেন্ট লুকাতে না পেরে মারুফাকে এই কথা নেচে নেচে বলে দিয়েছে। বিনিময়ে ঝাড়িও খেয়েছে।”

উনার কথা শুনে চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো আমার। মুখে ইয়া বড় একটা হাসি ফুটে উঠল। বেস্টুর বিয়ে খাবো ভাবতেই অন্যরকম আনন্দ লাগছে! কিন্তু মারুফার উপর রাগ ও লাগছে কুত্তী আমাকে কিছু জানালো না! সে যাই হোক আমি তো ব্যাপক খুশি। ইচ্ছা করছে উরাধুরা ড্যান্স দেই। নিলা বিষ্ময় নিয়ে বলল,,,

–“ভাইয়া একটা প্রশ্ন ছিলো? কিছু মনে করবেন না, আমি যতদূর জানি আপনি আয়াত ভাইয়ার বড়! তাহলে উনি আগে বিয়ে করছে আর আপনি,, না মানে আপনি তাহলে কবে বিয়ে করবেন?”

নিলার কথা শুনে হাসলেন উনি। বললেন,,
–“আমার বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে নিলা।”

নিলা আবাক চোখে তাকালো তারপর বিষ্ময় নিয়ে বলল,,

–“সত্যিই! তা কে সেই মেয়ে? আর কেউ কিছু জানে না আপনার বিয়ের ব্যাপারে? না মানে কেউ তো কিছু বলল না? আর কতদিন হলো বিয়ে করেছেন?”

নিলার কথায় চুপসে গেলাম আমি। নির্ভীকের দিকে আড় চোখে তাকাতেই দেখলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসছেন। উনার মতিগতি ভালো ঠেকছে না আমার। আমি কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললাম। এবার কি হবে? উনি নিলাকে বলে দেবেন না তো যে আমি উনার ব‌উ! এটা নিলা জানলে আমাকে খবর করে ছেড়ে দিবে। এতো গুলো মানুষের সামনে কি ভাবে রিয়্যাক্ট করবে কে জানে? এসব ভাবছি আর টেবিলে থাকা আচারের বয়াম থেকে আচার পেটে চালান করছি। আমার দৃষ্টি অস্থির। একবার নিলার দিকে তাকাচ্ছি তো আরেকবার নির্ভীকের দিকে। আজ আমার কপালে রাহু, কেতু, শনি সব আছে! নির্ভীক বললেন,,

–“এইতো ৫ মাস হবে! আসলে হুট করেই বিয়েটা হয়ে গিয়েছে তাই কাউকে জানানো হয়নি আরকি।”

–“তো কে সেই মেয়ে?”

আমার তো রীতিমত কাপাকাপি অবস্থা। টেনশনের ঠ্যালায় আচার খেয়েই চলেছি। নিলা আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,,

–“কিরে এতো আচার খাচ্ছিস কেন? পেট ব্যাথা করবে তো?”

আমি কিছু বলার আগেই নির্ভীক বললেন,,
–“এই অবস্থায় এমনই হয়।”

আমি উনার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকালাম। কি বলতে চাইছেন উনি? নিলা বলল,,

–“মানে?”

নির্ভীক দায়সারা ভাবে বললেন,,
–“মানে হচ্ছে ও প্রেগন্যান্ট!”

উনার কথা শুনে আমার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। এই ছেলেটা বলে কি? এতো বড় মিথ্যাচার! নিলা রীতিমত অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর কড়া গলায় নিলা বলল,,

–“কি বলছেন কি ভাইয়া? ওর কি বিয়ে হয়েছে নাকি যে ও,, ও বিয়ের আগেই,, নো নো!! এটা হতেই পারে না।আপনি মজা করছেন?”

নির্ভীক আর চোখে আমার দিকে তাকালো তারপর সোজা হয়ে বসে নিলাকে বলল,,

–“আমি কখন বললাম যে ওর বিয়ে হয় নি। ওর তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাও ৫ মাস আগে এবং আমার সাথে। ও আমার ব‌উ! তাইনা ব‌উ?” (আমার দিকে তাকিয়ে ইনোসেন্ট ফেস করে বললেন)

আমি অসহায় ভাবে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। নিলার দিকে তাকাতেই দেখলাম ও রাগে ফুঁসছে। আমি ওকে কিছু বলবো তার আগেই ও উঠে দাঁড়িয়ে জোরে সোরে ঝাড়ি মারলো আমায়। ওর ঝাড়ি শুনে আশেপাশের সবাই আমাদের দিকে তাকালো। ও কিছু বলতেই যাচ্ছিলো তখনই একবার আশেপাশে তাকালো। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

–“হোস্টেলে আয় তোর মজা বোঝাচ্ছি!”

আমি অসহায় ভাবে ওর দিকে তাকালাম। কিন্তু ও কোনোরুপ ভ্রক্ষেপ না করে গটগট করে ওখান থেকে চলে গেলো। কিছুক্ষণ রোবটের মতো বসে থেকে আমিও ওর পেছন পেছন দৌড় লাগালাম। কিন্তু ধরতে পারলাম না। ও একটা রিক্সা নিয়ে চলে গেল। আমি গেইটের বাইরে এসেও ধরতে পারলাম না। যাহ এবার কি করবো আমি? তখনই অনুভব করলাম কেউ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে ঘুরতেই দেখি নির্ভীক হাসিমুখে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। উনাকে দেখেই আমার রাগ উঠে গেলো। কিন্তু এতে উনার কোন ভাবান্তর হলো বলে মনে হলো না। উনি উল্টো আমার হাত ধরে টেনে উনার বাইকের সামনে দাড় করালেন। বাইকে উঠতে বললেন। কিন্তু আমি উঠলাম না। এবার উনি জোর করে বাইকে বসিয়ে বাইক স্টার্ট দিলেন। সোজা সেই দিনের নদীর পারে নিয়ে এলেন। আমি গাল ফুলিয়ে গিয়ে নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে বসে পড়লাম। একমনে পানির দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি নিলাকে কি ভাবে বোঝাবো? বেশ কিছুক্ষণ পর উনি আমার পাশে বসলেন। উনার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনার দুই হাতে দুটো তালপাতার প্লেটভর্তি ভেলপুরি। ভেলপুরি দেখেই সব চিন্তা ভাবনা গায়েব হয়ে গেলো। উনার হাত থেকে একটা প্লেট কেড়ে নিয়ে নিলাম। বেশ আয়েশ করে খাচ্ছি। রাজশাহীর ভেলপুরি যাস্ট অসাধারণ খেতে। প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই আমি আর নিলা ভেলপুরি খেতে বের হ‌ই। মাঝে মাঝে মারুফা ও যায় আমাদের সাথে।

–“তুমি একাই খেয়ে যাচ্ছো? আমার দিকে একবার দেখছোও না?”

উনার আওয়াজ শুনে উনার দিকে তাকালাম। উনি গাল ফুলিয়ে বসে আছেন। বেশ কিউট লাগছে দেখতে। আকাশি শার্ট, ব্ল্যাক প্যান্ট, এলোমেলো চুল পুরাই বাচ্চা ছেলের মতন লাগছে। উনি ছোট বাচ্চাদের মতো করে বললেন,,

–“খাইয়ে দাও!”

এতো কিউট করে বললে কে না খাইয়ে দিবে? কিন্তু এই মুহূর্তে আমি উনার উপর রেগে আছি। তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। উনি আবার বললেন,,

–“কি হলো দিবে না।”

–“না”

–“কেন?”

–“আমি আপনার উপর রেগে আছি। আপনি নিলাকে মিথ্যা কেন বললেন?”

–“ক‌ই মিথ্যা বলেছি? আমাদের তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে এটা তো সত্যি!”

–“সেটা না। আপনি বলেছেন আমি প্রেগন্যান্ট! এটা কেন বললেন? আমি কি প্রেগন্যান্ট নাকি যে আপনি বললেন?”

–“ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার! এই জন্য আমার মিষ্টি ব‌উটি গাল ফুলিয়ে বসে আছে? তো ম্যাডাম আপনি কি জানেন গাল ফুলিয়ে বসে থাকলে আপনাকে অনেক বেশি কিউট লাগে!”

উনি কি আমাকে কিউট বলে কথা ঘুরাতে চাইছেন নাকি? হতেও পারে। আমি উনার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। যার অর্থ, ‘এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়।’ উনি হেসে দিয়ে বললেন,,

–“তুমি তখন যেভাবে আচার খাচ্ছিলে তাতে তো তাই মনে হচ্ছিল যে তুমি প্রেগন্যান্ট। ডোন্ট ওয়ারি এই মিথ্যা টাকে সত্যি বানানোর দায়িত্ব আমার। প্রেগন্যান্ট ন‌ও তো কি হয়েছে কিছুদিন পর হয়ে যাবে!”

উনার কথা শুনে আমি কি রিয়্যাকশন দিবো? চোখ বড়বড় করে উনার দিকে তাকাতেই উনি শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন। রীতিমত হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছেন উনি। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম উনার দিকে। উনি হাসি থামিয়ে বললেন,,

–“তুমি এমনভাবে রিয়্যাক্ট করছো যেন,,

–“কি?”

–“থাক বললাম না। এখন খাইয়ে দাও তো ব‌উ!” (ইনোসেন্ট লুক নিয়ে)

আমি উনার এমন ইনোসেন্ট ফেস দেখে আর কিছু বলতে পারলাম না। উনাকে খাওয়াতে লাগলাম। এই মুহূর্তে নিলা যে আমার উপর রেগে আছে সেটা ভূলেই গিয়েছি আমি।
·
·
·
চলবে………………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here