#চুপিচুপি_ভালোবাসি
(পর্ব ১৭+১৮)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
সকাল ১০ টা,,
উঠোনে বেশ কয়েকটি চেয়ার পাতা হয়েছে। সেই চেয়ার গুলোতে বসেছে বাড়ির বড়রা। আমি বাইরের সিড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছি। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন নির্ভীক। উনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যাপক অস্বস্তিতে আছেন উনি। এতোক্ষণ ঠিক ছিলাম কিন্তু উনার অস্বস্তি দেখে এবার আমার অস্বস্তি লাগা শুরু হয়েছে। আর তার সাথে যোগ হলো রাজ্যের বিরক্তি। আমার অপরদিকে দাঁড়িয়ে মারুফা কেমনভাবে যেন বড় জেঠিমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর পাশেই আয়াত ভাইয়া রাগে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। জেঠিমার প্রধান আগ্রহের বিষয় হলো আয়াত ভাইয়া আর নির্ভীক। কিছুক্ষণ আগে যখন নির্ভীক আমার চুল মুছে দিচ্ছিলেন ঠিক তখনই জেঠিমা আমাদের দেখে নিয়েছেন। ব্যাস তার পর থেকেই শুরু হয়েছে প্রশ্নের ঝুড়ি। উনার এমন বাজখাঁই গলা শুনে সবাই এসে জড়ো হয়েছে। সেই কখন থেকে জেঠিমা একই কথা বলে যাচ্ছেন, ‘এই ছেলেগুলো কে?’ ‘আব্বু আমাকে আর মারুফা কে এদের সাথে যেতে বললো কেনো?’ ‘কিছুক্ষণ আগে উনি আমার চুলে হাত দিয়েছিলেন কেন?’ ‘মারুফা আর আয়াত ভাইয়াই বা অন্য রুমে বসে কথা বলছিলো কেন?’ ‘আমি নাকি বখে যাচ্ছি!’ উফ!! এসব শুনে জিহাদ ভাইয়া তো রেখে বোম। যখন তখন ব্লাস্ট হয়ে বড় জেঠিমাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। নির্ভীকের দিকে তাকাতেই দেখলাম উনার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। ভাগ্যিস এই মুহূর্তে বাইরের কেউ নেই! নাহলে আজ যে কি হতো? এই মুহূর্তে বিরক্তিতে হাত পা রিরি করছে আমার। এরা কি কুরবানী করা বাদ দিয়ে এখন আমাদের নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করবে? রাগ ও হচ্ছে ব্যাপক। কিছুক্ষণ পর আব্বু স্থির দৃষ্টিতে জেঠিমার দিকে তাকিয়ে একদম শীতল কন্ঠে বললেন,,
–“কি শুরু করেছেন কি ভাবি? ছেলেটা আসতে না আসতেই এমন কটু কথা বলছেন? আর আমার মেয়ে সম্পর্কে এমন কিছু বলার সাহস কি করে হয় আপনার? না জেনে কারো সম্পর্কে এমন কিছু বলা উচিত নয়।”
জেঠিমা হয়তো বিষাক্ত কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু আব্বুর এমন শীতল ও গম্ভীর কন্ঠে কিছুটা দমে গেলেন। বললেন,,
–“কেন মেয়ে যা করেছে তাই তো বলবো? ঐ ছেলে তোমার মেয়ের ঘরে কি করছিলো সেটা জিজ্ঞেস করো না তোমার মেয়েকে? স্বাধীনতা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছো মেয়েকে। তুমি আমার মুখ বন্ধ করতে পারো কিন্তু অন্যদের মুখ কি করে বন্ধ করবে।”
এবার জিহাদ ভাইয়া শান্ত কন্ঠে বললো,,
–“আচ্ছা জেঠিমনি! তুমি যদি তোমার দেখতে তোমার ছেলে তোমার বউমার মাথার চুল মুছে দিচ্ছে কিংবা তোমার ছেলে তার হবু বউয়ের সাথে আলাদাভাবে কথা বলছে তাহলে কি তুমি ঠিক এইভাবেই রিয়্যাক্ট করতে? নিশ্চয়ই করতে না! তাহলে এখন এমন রিয়্যাক্ট কেন করছো? একটা ছেলে তার বউয়ের সাথে কথা বলছে বা যত্ন করে তার চুল মুছে দিচ্ছে এতে দোষের কি আছে জেঠিমনি? আচ্ছা শর্মির সাথে আমাকে দেখলেও কি তুমি এমন কথা বলতে? ভাই বোনের সম্পর্ক কেও কি এমন বাজে ভাবেই তুলে ধরতে?”
–“মানে? কি বলতে চাইছিস তুই?”
জেঠিমার কথার উত্তরে আব্বু বললেন,,
–“মানে হলো নির্ভীক শর্মির বর আর এ বাড়ির জামাই! আর আয়াত হলো নির্ভীকের ভাই আর মারুফার হবু বর। এইজন্যই বলছিলাম না জেনে কারোর সম্পর্কে কিছু বলা উচিত নয়।”
আব্বু কিছুক্ষণ থেমে আবার বললেন,,
–“বাবা নির্ভীক! আয়াত! আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। তোমাদের আমি আসতে বলেছিলাম। আর এসেই এইভাবে অপমানিত হতে হলো তার জন্য ক্ষমা করে দিও বাবারা। আমি জানতাম না ভাবি এইভাবে ব্যাপারটাকে ঘুরাবে।”
নির্ভীক কে দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি রেগে আছেন। বললেন,,
–“ছি ছি আঙ্কেল এইভাবে বলবেন না প্লিজ। আপনি এইভাবে বললে আমার খারাপ লাগবে।”
–“হুম!” (আয়াত)
আব্বু দৃঢ় কন্ঠে বললেন,,
–“এই বিষয় নিয়ে আর কোন কথা হবে না। সবাই চলো অনেক কাজ বাকি আছে। তাড়াতাড়ি চলো। ঈদের একটা দিন তাও অশান্তি লেগেই আছে।”
আব্বুর করা গলা শুনে বাড়ির ছেলেরা হন্তদন্ত হয়ে দা, ছুরি, কাঁচি, গোটা কয়েক গামলা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। ভাইয়া যাওয়ার আগে আমাকে মাথায় হাত রাখলেন। আমি ছলছল চোখে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া ঈশারায় সব ঠিক হবে বলে চলে গেলো। আমার খারাপ লাগছে খুব। কষ্ট হচ্ছে না কারণ জেঠিমার এই ব্যবহারে আমি অভ্যস্ত কিন্তু কোথাও একটা খারাপ লাগা থেকেই যাচ্ছে। নির্ভীক, আয়াত ভাইয়া, মারুফা ওদের কতো কথা শুনতে হলো আজ। এসব ভাবতেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা নোনা জল। ঠিক তখনই নির্ভীক বললেন,,
–“ভূল মানুষদের জন্য নিজের চোখের পানি গুলো নষ্ট করিস না। ওগুলো অনেক মূল্যবান শর্মি। আর তোর ঐ চোখ থেকে ঝড়া পানি গুলো শুধু তোর মন খারাপের চিহ্ন নয় আরো অনেকের মন খারাপ করার কারণ ও বটে। তাই চোখের পানি মুছে ফেল। আজ আমি আসছি। একাই যাচ্ছি! কিন্তু এর পরের বার আমি একা যাবো না। তোকে নিজের সাথে নিয়ে যাবো।”
আমি উনার দিকে তাকানোর আগেই উনি চলে গেলেন। আয়াত ভাইয়াও গেলেন। তখনই মারুফা এসে আমার হাত শক্ত করে ধরে ফেললো। আমি ওর দিকে তাকাতেই ও আমার চোখের পানি মুছে দিলো। কাল আব্বু যে কথাগুলো বলেছিলো সেইগুলো ঠিক কতটা সত্যি আজ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি আমি। যদি নিজের বাড়ির লোকই এমন কথা বলতে পারে তাহলে বাইরের লোকজন আরো কত কি বলতো? নিজেকে সামলে নিয়ে ঘরে চলে এলাম। মারুফাও নিজের বাড়ি ফিরে গেল। এখন আমার কানে একটা কথাই বাড়ি খাচ্ছে, ‘একাই যাচ্ছি! কিন্তু পরের বার একা যাবো না তোকে নিজের সাথে নিয়ে যাবো।”🤗
🍁
বাসস্টপে এসে ওয়েটিং রুমে বসে আছি আমি আর মারুফা। ১০ টার বাসে রাজশাহী তে ফিরবো আমরা। আর এখন ৯টা ৩৯ বাজে। এখন ও পুরো ২১ মিনিট বাকি। কিন্তু এটা সমস্যা নয় সমস্যা হলো আমাদের সিট নিয়ে। কারণ আমাদের দুইজনের সিট একসাথে হয়নি। মারুফার সিট ডানদিকের মাঝখানে আর আমার টা বা দিকের মাঝখানে। এই মুহূর্তে টিকিট কাউন্টারে থাকা টাকলা ব্যাটার মাথা ফাটাইতে মন চাচ্ছে আমার। কালকে বার বার করে বলে দিয়েছিলাম যেন আমাদের দুইজনের সিট একসাথে হয় কিন্তু নাহ ঐ টাকলার নাকি খেয়ালই ছিলো না। আমার পাশে কে বসবে কে জানে? আমি তো ভেবেই নিয়েছি পাশে যেই বসুক না কেন তাকে সরিয়ে মারুফাকে বসিয়ে দিবো হুহ। এসব ভাবতে ভাবতেই বাস এসে গেলো। ব্যাগ হাতে নিয়ে দুইজনেই বাসে উঠে পড়লাম। জানালার পাশে বসে মারুফাকে এখানে আসতে বলবো তার আগেই কেউ ঝড়ের গতিতে এসে আমার পাশে বসে পড়লো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম আমি। প্রায় ১০ সেকেন্ড পর পাশে তাকাতেই আমার পাশে নির্ভীককে আবিষ্কার করলাম। কচুপাতা রঙের টি শার্ট, কালো থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের, কানে হেডফোন লাগিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে কি যেন করছেন। উনার সামনে দিয়ে উঁকি দিতেই দেখলাম মারুফার পাশের সিটে আয়াত ভাইয়া বসে আছেন। নাও হয়ে গেল। কিসের কি ভেবেছিলাম পাশের জনকে সরিয়ে মারুফাকে এখানে নিয়ে আসবো। কিন্তু তা আর হলো কই! আয়াত ভাইয়াকে তো আর ওর কাছ থেকে সরাতে পারবো না আর না নির্ভীক নিজের জায়গা ছেড়ে উঠবে। কিন্তু উনারা!! ওহ আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার! আমাদের সিট পাল্টে দেওয়ার ব্যাপারটা তাহলে এরাই ঘটিয়েছে। আমি যখন এমন আকাশ পাতাল ভাবতে ব্যাস্ত ঠিক তখনই নির্ভীক বললেন,,
–“কি এতো ভাবছো আমার একমাত্র বাবার একমাত্র বৌমা?” (কান থেকে হেডফোন সরাতে সরাতে)
–“ভাবছি আপনাকে কিভাবে এখান থেকে সড়ানো যায়।”
–“তা আমাকে সড়িয়ে কাকে নিয়ে আসবে তুমি?”
–“আমার বেস্টুকে।”
–“আর আমি বুঝি তোমার কেউ নই?”
–“আপনি তো আমার একমাত্র ননদের একমাত্র ভাই।”
–“বাহ আমার কথা আমাকেই রিটার্ন করা হচ্ছে! বেশ ভালো নকল করতে পারো তো তুমি?”
হঠাৎ করে আমার খেয়াল হলো উনি আমাকে তুমি করে বলছেন। ব্যাপারটা বুঝতেই আমি উনার দিকে গোল গোল চোখ করে তাকালাম। উনি কি সত্যিই আমাকে তুমি করে বললেন? নাকি আমি ভূল ভাল ভাবছি? উনি আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আবার ফোনের মধ্যে মনোযোগ দিলেন। তারপর বললেন,,
–“ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন? মনে হচ্ছে এলিয়েন দেখে নিয়েছো?”
আমি তো রীতিমত হা হয়ে গিয়েছি। উনি সত্যিই আমাকে তুমি করে বলছেন? আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,,
–“আ,,আপনি আমায় তুমি করে বলছেন?”
–“হুম তো?”
–“না মানে আপনি তো কখনো তুমি করে বলেন নি তাই আর কি আপনার মুখে তুমি শুনে আপনাকে আমার এলিয়েনই মনে হচ্ছে।”😅
উনি এবার আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। উনার এমন দৃষ্টি দেখে আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম। উনি সরু চোখ তাকিয়ে বললেন,,
–“নিজের এই ফালতু চিন্তাভাবনা নিজের কাছেই রাখুন ম্যাম! আমি কোন এলিয়েন টেলিয়েন নই। আই আ’ম নির্ভীক চৌধুরী! আর আমার পাশে যে বসে আছে তিনি হলেন মিসেস নির্ভীক। তাই তাকে আমি তুমি করেই বললো। কখনো শুনেছো কোন বর তার বউকে তুই করে বলে?”
–“বলে না কিন্তু আপনি তো বলতেন। এখন হুট করে তুমি শুনতে কেমন জানি লাগছে আমার!”
কেন জানি না অস্বস্তি লাগছে খুব। উনার বলা ‘তুমি’ শুনে ব্লাশিং হচ্ছি আমি। ইচ্ছে করছে এই জানলা দিয়ে পালিয়ে যাই। হুট করে উনি বললেন,,
–“এভাবে ব্লাশিং হচ্ছো কেন? এই মুহূর্তে তোমার গাল দুটো লাল হয়ে গিয়েছে। আমার সামনে এমনভাবে লজ্জা পেয়োনা বলা তো যায় না কখন তোমায় টমেটো ভেবে খেয়ে ফেলি।”
এই মুহূর্তে আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। তাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। আজ আর উনার চোখের দিকে তাকানো হবে না আমার। আচ্ছা এই লোকটা আমাকে এমন অস্বস্তিতে ফেলে কি আনন্দ পায় কে জানে। উনি কি আমার অবস্থাটা বুঝতে পারেন না। নাকি ইচ্ছে করেই এমন করেন উনি। ধুর! ভাল্লাগে না।।
·
·
·
চলবে………………………..
#চপিচুপি_ভালোবাসি (পর্ব ১৮)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
বাস রাজশাহীতে পৌছাতেই আমরা চার জন নেমে গেলাম। মারুফার হোস্টেল আমাদের হোস্টেলের ঠিক উল্টো রাস্তায় এবং বেশ দূরেই। এখন কথা হলো গিয়ে আয়াত ভাইয়া কিছুতেই মারুফা কে এত খানি রাস্তা একা যেতে দিবে না। উনার এক কথা উনি মারুফাকে পৌছে দিয়ে আসবেন। কিন্তু মারুফা উনার সাথে যাবে না কারণ এতে করে উনার বসায় পৌঁছাতে দেরি হবে। এই নিয়ে বেশ অনেক্ষণ ধরে ওরা ঝগড়া করে চলেছে। আমি আর নির্ভীক হা করে ওদের ঝগড়া দেখে যাচ্ছি। এরা এতো ঝগড়া কি করে করে কে জানে? আমি এতো অবাক হচ্ছি কারণ মারুফা এতো ঝগড়ুটে নয় কিন্তু আয়াত ভাইয়ার সাথে কেন যে এতো ঝগড়া! বিষয়টা প্রায় ই ভাবায় আমায়। ঝগড়ার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে দেখে আমি আর নির্ভীক প্রায় একসাথেই ‘থামো’ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। দুইজন একসাথে বলায় আওয়াজ টা বেশ জোরেই হলো। এতে করে মারুফা আর আয়াত ভাইয়া সহ আশেপাশের আরো অনেকেই আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। নির্ভীক ভাইয়া এবার আশেপাশের লোকজন দিকে তাকালেন তারপর গলা ঝেড়ে বললেন,,
–“এখানে কি সিনেমা চলছে? আপনাদের কোন কাজ নেই?”
নির্ভীকের কথা শুনে সবাই আবার নিজেদের কাজে মন দিলো। এবার উনি আয়াত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,,
–“দিন দিন কি ছোট হয়ে যাচ্ছিস নাকি? এইভাবে রাস্তায় দাড়িয়ে ঝগড়া করে যাচ্ছিস। আর মারুফা তোমাকে একা যেতে হবে না। আয়াত তোমাকে পৌছে দিবে। আর এই নিয়ে আর একটাও কথা নয়।”
মারুফা কিছু বলতে গিয়েও পারলো না। কিছু একটা ভেবে আয়াত ভাইয়ার সাথে চলে গেল। ওরা যাওয়ার পর আমরাও চলে এলাম। নির্ভীক আমাকে পৌঁছে দিয়েই চলে গেলেন। আমি নিজের রুমে এসে দেখলাম রুম লক করা। তারমানে নিলা এখনো আসে নি। রাতে আসবে মনে হয়। আমার কাছে থাকা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলতে খুলতে নিলাকে ফোন লাগালাম। ভেতরে এসে দড়জা লক করতেই ও ফোন রিসিভ করলো।
–“কিরে কখন আসবি তুই? কাল কে বললাম আমাদের সাথে আসতে কিন্তু তুই বললি কি না কি কাজ আছে? আগেই চলে আসবি? তো এখনও তো আসার নাম নেই।”
ওপাশ থেকে চিন্তিত কন্ঠে নিলা বলল,,
–“দোস্ত প্রবলেমে পরে গিয়েছিলাম রে। আজ সকালে ভাবি আর মায়ের মধ্যে প্রচুর ঝামেলা হইছে। আজ আর আসতে পারবো না রে। এখন বেরোলেও রাত হয়ে যাবে অনেক। আর ভাইয়াও ছারবে না। আমি কাল বিকালে চলে আসবো।”
–“আচ্ছা ঠিক আছে।”
ফোন কেটে বিছানার উপর রেখে বসে পরলাম। আজ একা থাকতে হবে ভাবতেই কেমন লাগছে। কিছু একটা ভেবে আব্বুকে কল করে পৌছে গেছি জানিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলাম। এই মুহূর্তে একটু ঘুমানো দরকার। এতোক্ষণ জার্নি করে এসে বসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না আর। কিন্তু তার আগে শাওয়ার নিতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। শাওয়ার নিয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। ঘুম ভাঙলো ফোনের রিংটোন এর শব্দে। চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না মোটেও। এমনকি ফোনটা ধরতেও ইচ্ছে করছে না। ফোনকে ফোনের জায়গায় রেখে আবার ও ঘুম। কিছুক্ষণ পর আবার ও তুমুল শব্দে বেজে উঠলেন আমার ফোন মহাশয়। কিন্তু আমিও আলসেমি ভাব বজায় রেখে চোখ বন্ধ করেই আছি। কিন্তু ফোন মহাশয় বেজেই চলেছে। শেষে বিরক্তি নিয়ে উঠে বসলাম। এতোক্ষণ এ কল টা কেটে গিয়েছে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম রাত ৯ টা বাজে। টাইম দেখেই চোখ কপালে উঠলো আমার। আমি এতোক্ষণ ঘুমিয়েছি! আবার ও ফোন বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে বেশ সুন্দর করে লেখা, ‘Nirvik’s calling” বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলেন,,,
–“কোথায় ছিলে তুমি? কতবার কল করেছি তার হিসেব আছে? ফোন তুলছিলে না কেন বেয়াদব মেয়ে?”
আমি একটা হাই তুলে উত্তর দিলাম,,
–“এই একদম রাগ দেখাবেন না আমায়? একে তো এই অসময়ে ফোন করে আমার এতো আরামের ঘুম টাকে নষ্ট করেছেন তার উপর আবার মেজাজ দেখাচ্ছেন। এসব বাদ দিয়ে কি জন্য ফোন দিয়েছেন সেটা বলুন।”
এই রে কি সব বলে দিলাম। এখন নিশ্চয়ই এই রাক্ষস টা আমাকে কথা শোনাবে। নিশ্চয়ই আচ্ছামতো বকে দিবে আমায়। শর্মি তুই কি যে করিস না? এখন এই রাক্ষসটার লম্বা চওড়া ভাষণ শুনতে হবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে নরম স্বরে উনি বললেন,,
–“তুমি ঘুমাচ্ছিলে? তারমানে নিশ্চয়ই খাওয়া হয়নি তোমার? সকালেও তো খাওনি মনে হয়?
আমি তো রীতিমত অবাক! আমি তো ভেবেছিলাম উনি আমাকে বকা দিবেন কিন্তু উনি তো মিষ্টি করে কথা বলছেন। আমার কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে উনি আবার বললেন,,
–“কি হলো বলো!”
–“আপনি এইটা জানার জন্য কল করেছিলেন?”
–“জি না। এটা বলার জন্য কল করিনি। ২ দিন পর তোমাদের একটা এক্সাম আছে সেটা মনে করাতে কল করেছিলাম। মনে আছে নিশ্চয়ই?”
উনার কথা শুনে আমার চেহারার রঙ উড়ে গেলো। আমি তো মনেই ছিলো না যে দুদিন পর একটা এক্সাম আছে। উনি না বললে তো মনেও পড়তো না। আর আমি তো কিছুই পড়িনি! এবার কি হবে? আমি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললাম,,
–“একদম মনে নেই! আমি তো কিছুই পড়িনি এবার আমি কি করবো? আপনি ঠিক ই বলতেন আমি একটা স্টুপিড! নিজের এক্সামের কথাও মনে রাখতে পারি না।”
–“নিলা ফিরেছে?”
আমি মরি আমার জ্বালায় আর ইনি নিলার খবর নিচ্ছে। বাহ্! খুব ভালো।
–“কে, কেন বলুন তো? নিলাকে দিয়ে কি হবে?”
–“পাল্টা প্রশ্ন না করে যা বলেছি তার উত্তর দে। নিলা ফিরেছে?”
–“না”
–“কখন ফিরবে?”
–“কাল বিকেলে”
–“ওকে”
ওকে বলেই ঠাস করে ফোন কেটে দিলেন উনি। আরে আজব লোক তো? আমাকে টেনশনে ফেলে দিয়ে এখন উনি নিলাকে নিয়ে পড়েছেন। এবার আমি কি করবো? নখ কামরে এসব ভাবছি আর পুরো ঘর চক্কর কাটছি। আমার এই এক সমস্যা, ছোট খাটো বিষয়েই প্যানিক হয়ে যাই। যেমন এই মুহূর্তে এমন চক্কর না কেটে পড়তে বসলে তাও পড়াটা শেষ হতো। কিন্তু আমার সেটা মাথাতেও আসছে না। আমি তো চিন্তা নামক কোন বিষয় নিয়ে ব্যাস্ত। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ৯ টা ৩০ বাজে। চিন্তা করতে গিয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। জগেও পানি নেই। তাই জগ নিয়ে বাইরে এলাম পানি নিতে। সবাই নিজেদের মতো পড়াশোনায় ব্যাস্ত। আর আমি কিনা পায়চারী করে সময় নষ্ট করছি। নাহ ঘরে গিয়েই পড়তে বসতে হবে। পানি নিয়ে ঘরে আসতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। আমার বেডের উপর নির্ভীক বসে আছেন। উনি এখানে কি করে এলেন? আর উনাকে কেউ দেখেনি তো আমার ঘরে আসতে? কেউ দেখলে তো! এসব ভেবে আমি বেশ জোরেই বলে উঠলাম,,
–“আপনি এখানে,,
আর কিছু বলতে পারলাম না। উনি ঝড়ের গতিতে এসে আমার মুখ চেপে ধরে দড়জা লাগিয়ে দিলেন। তারপর দড়জার সাথে চেপে ধরে বললেন,,
–“হুস্ এভাবে চেচাচ্ছো কেন? কেউ শুনে ফেলবে তো?”
আমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বললেন,,
–“কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”
–“পানি আনতে। কিন্তু আপনি এখানে কিভাবে এলেন?আর এতো রাতে গার্লস হোস্টেলে এসে বসে আছেন কেউ দেখেনি তো আপনাকে?”
উনি বাঁকা হেসে বললেন,,
–“এই নির্ভীক কোন কাঁচা কাজ করে না মাই ডিয়ার ওয়াইফি! আমি তোমার বারান্দা দিয়ে এসেছি। আর কেউ দেখে নি। অনেক কষ্টে ও দারোয়ান ব্যাটার চোখ ফাঁকি দিয়ে এসেছি।”
–“কেন আসতে গেলেন? কেউ যদি জানতে পারে যে আপনি এখানে কি হবে ভাবতে পারছেন।”
উনি হাসলেন। আমার হাত থেকে জগটা নিয়ে টেবিলে রেখে আমার হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। নিজে খাটের উপর বসে একটা প্যাকেট খুলতে খুলতে বললেন,,,
–“কি আর করবো বলো আমার বউটা যে টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার উপর আজ সারাদিন এক দানাও মুখে তোলে নি সেটা দেখেও না এসে পারি কি করে। এখন বেশি কথা না বলে খেয়ে নাও তো।” (আমার মুখের সামনে খাবার ধরে)
আমিও বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিলাম। চোখ ভিজে আসছে বারবার। এই ছেলেটা আমার এতো খেয়াল কেন রাখছে? উনার এই ছোট খাটো কেয়ার গুলো যে আমার অভ্যাস নষ্ট করে দিচ্ছে। এই কেয়ারগুলো দেখে বড্ডো ভয় লাগছে আমার যদি কখনও এসব হাড়িয়ে যায় তখন কি করবো আমি? খাওয়ানো শেষ করে বই খুলে পড়াতে লাগলেন আমায়। ভূল হলেই উনার রাগী চোখ গুলো দেখতে হচ্ছে আমায়। এতোক্ষণে বুঝলাম নিলার কথা কেন জিজ্ঞেস করছিলেন উনি? কিন্তু কেন জানি না পড়াগুলোও খুব সুন্দর ভাবে মাথায় গেঁথে যাচ্ছে। আগেও এমনই হতো। মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার আগেও এভাবেই পড়াতেন আমায়। তখন একটা ভূল করলেই কান ধরে উঠবস করতে হতো আমায়? কথায় কথায় মারার হুমকি দিতেন। তখন যদি জানতাম আমাকে মারতে উনার হাত কাঁপে তাহলে সত্যি বলছি দুষ্টুমি করে উনাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিতাম আমি।
🍁
বিকাল ৫ টা,
পরীক্ষা শেষ। হলের বাইরে দাঁড়িয়ে নিলার জন্য অপেক্ষা করছি। যতটা ভেবেছিলাম ততটা খারাপ হয়নি আজকের এক্সাম। এই দুইদিন একটানা পড়িয়েছেন আমায়। সেদিন পুরো রাত জেগে পড়িয়ে ভোর ৪ টার দিকে ফিরে গিয়েছিলেন উনি। আর একটুর জন্য দারোয়ানের হাতে ধরা পরেন নি। পরের দুই দিন কলেজে আসার পর থেকেই উনার মাস্টারগিরি শুরু। কিছুক্ষণের জন্য ভেবেই নিয়েছিলাম উনাকে ডক্টর কম প্রফেসর বেশি। এসব ভাবতেই সেখানে এসে উপস্থিত হলেন তিনি মানে আমার ডাক্তার বর। উনার কি সারাদিন কোন কাজ টাজ নেই? সবসময় আমার সামনেই কি করে পরে যায় কে জানে? উনি তাড়া দিয়ে বললেন,,
–“চল তাড়াতাড়ি আমরা এক জায়গায় যাবো।”
বলা নেই কওয়া নেই হুট করে এসে বলছে চল তাড়াতাড়ি। আমরা কোথাও যাবো। আরে আমাকে কি কাঠের পুতুল পেয়েছে নাকি? আমি বললাম,,
–“আমি এখন বাসায় যাবো।”
উনি সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,,
–“ঠিক আছে আমি মারুফাকে বলে দিচ্ছি যে তার বান্ধবী তার সাথে কফি খেতে চায় না।”
–“মারুফাকে বলবেন মানে? সেও আসবে নাকি?”
–“হুম। মারুফা, আয়াত দুজনেই আসবে। তুমি তো যাবে না। তাহলে থাকো আমি একাই যাচ্ছি।”
এইরে এবার কি করি? মারুফা নির্ঘাত আমার আমার জান নিয়ে নিবে। কিন্তু নিলাকে একা রেখে কি করে যাবো! এদিকে নির্ভীক ও চলে যাচ্ছে। উনাকে পেছন থেকে ডেকে বললাম,,
–“আমি যাবো কিন্তু নিলা!”
–“ওকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ওকে আয়াশ সামলে নিবে। এখন চলো।”
আয়াশ! ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আয়াশের কথা। তারপর আমাকে নিয়ে নির্ভীক পাশের একটা ক্যাফেতে নিয়ে এলেন। মারুফা আর আয়াত ভাইয়া আগে থেকেই সেখানে ছিলো। আমরা গিয়ে সেখানে বসলাম। সবাই কথা বলছে আর কোল্ড কফি পান করছে কিন্তু আমার কেন জানি না এখন কফি পান করতে ইচ্ছে করছে না। তাই আর খেলাম না। সবাই একসাথে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে সেখান থেকে বাইরে এলাম। এখন সন্ধ্যা ৬ টা বেজে ১০ মিনিট। কিছুক্ষণ পরই অন্ধকার হয়ে যাবে চারপাশ। আয়াত ভাইয়া মারুফাকে হোস্টেলে ছাড়তে গেলেন।আর যাই হোক এখন একটা মেয়েকে কিছুতেই একা ছাড়া যায় না। মারুফা প্রথমে না বললেও পরে রাজি হয়ে যায়। এখন আমি নির্ভীকের বাইকে। উনি আপন মনে বাইক চালাচ্ছেন। হঠাৎ ই রাস্তার পাশে একটা জায়গায় বাইক থামালেন উনি। আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর হাতে দুই কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম কফি নিয়ে ফিরে এলেন। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি। উনি একটা কাপ আমাকে দিলেন আর একটা নিজে নিয়ে বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। আমাকেও উনার পাশে বসিয়ে দিলেন। আমি এখনও হা করে তাকিয়ে আছি। উনি বললেন,,
–“তখন যে তুই কফি একটুও মুখে দিস নি সেটা দেখেছি আমি। কিন্তু এখন এটা খেয়ে নে। এখানকার পরিবেশ টাও বেশ সুন্দর। তোর ভালো লাগবে।”
আমি মুচকি হেসে কফিতে চুমুক দিলাম। সাথে টুকটাক কথা বলছি। আসলেই এখন পরিবেশ টাও অনেক ভালো। সূর্য ডুবছে চারপাশে লাল আভা ছড়িয়ে গিয়েছে।সেই লাল আলো উনার মুখে এসে পড়ছে। অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছে তাকে। উনার এই ছোক খাটো কেয়ার গুলো খুব বেশি টানে আমায়। উনি আগেও তো এমন করতেন। কই তখন তো এমন হয়নি। তাহলে এখন কেন এমন অনুভূতি হচ্ছে আমার। আচ্ছা এই অদ্ভুত অনুভূতির নাম কি? এটা কি ভালোবাসা? নাকি পবিত্র সম্পর্কের টান। হয়তো দুটোই।
·
·
·
চলবে…………………….