#চুপিচুপি_ভালোবাসি (পর্ব ১০)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
পুরোনো কথাগুলো মনে করে আনমনেই হেঁসে উঠলাম আমি। কিভাবেই না জ্বালাতো আমাকে। এখনও জ্বালিয়েই চলেছে। উনি পড়াশোনা নিয়েও ব্যাপক প্যারা দিতো আমায়। সেদিনের পর থেকে আমার পড়াশোনা নিয়ে উনি আমার থেকেও বেশী সিরিয়াস ছিলেন। আমি তো নো চিন্তা ডু ফুর্তি নিয়ে পড়তাম। কিন্তু পড়াশোনা নিয়ে আমার এমন গা ছাড়া ভাব উনার একদম ই পছন্দ ছিলো না। আমাকে জোর করেই পড়াতেন উনি। দিন রাত এক করে আমার পেছনে লেগে থাকতেন। আমার আব্বু আম্মুও পড়াশোনার জন্য এতো চাপ দিতো না। এইচএসসি পরীক্ষার দুই মাস আগে থেকে মেডিক্যাল অ্যাডমিশন পর্যন্ত কিভাবেই যে পড়তে হয়েছে আমাকে সেটা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। নাওয়া খাওয়া ছাড়া পুরো সময়টাই বইয়ে মুখ গুজে থাকতে হয়েছে আমার। মাঝে মাঝে মনে হতো এই ব্যাটার মাথা ফাটিয়ে দিই! কেউ এতো পড়ে নাকি? কিন্তু আমার পড়াশোনা নিয়ে উনার এই কঠোরতার কারণেই যে আমি মেডিক্যালে চান্স পেয়েছি এটা কোন ভাবেই অস্বীকার করতে পারবো না আমি। রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এই পড়ছি আমি। উনিও সেখান থেকেই পড়াশোনা করেছেন। এখন ইন্টার্নশিপ কমপ্লিট করে ওখানেই প্র্যাকটিস করছেন। উনি একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই আমার সব কথা শুনতে বাধ্য! কেন জানিস? কারণ তোকে আমি আমার বউ বানাবো।’
সেদিন আমি উনাকে বলেছিলাম, উল্টাপাল্টা কথা বলারও একটা লিমিট থাকে ভাইয়া! আমাকে আপনার কথা শুনানোর জন্য এসব কথা বলছেন আপনি সেটা আমি জানি। আমি আপনার কোন কথাই শুনবো না!’
‘তোকে শুনতেই হবে কারণ তুই আমার বউ!’
আমি উনার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকালে উনি হুহা করে হেসে উঠেছিলেন। সেদিন উনার কথায় পাত্তা দেই নি আমি। সেদিনের পর থেকে উনি প্রায়ই বলতেন বউ তো তুই আমারই হবি। কিন্তু আমি সেদিকে ভ্রক্ষেপ ও করতাম না। কে জানতো সেদিন আমাকে বলা ‘তুই আমার বউ’ আজ সত্যি করে দেখাবেন উনি। ভাবতেও অবাক লাগছে এই ছেলেটা আমার বর! সত্যিই এই ছেলেটা আমার বর! শুধুই আমার বর! ইশ্ সবাই জানলে নিশ্চয়ই হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরবে। এসব ভেবে নিজেই চমকে উঠলাম আমি। এসব কি ভবছি আমি? আগে তো কখনো এমন ভাবনা আসেনি, তাহলে আজ এমন কেন ভাবছি। এক অলৌকিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি বলেই কি এমন অনুভূতি হচ্ছে! হতেও পারে! বেঘোরে ঘুমুচ্ছেন উনি। আর আমি উনার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে আছি। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যেও ভ্রু কুঁচকিচ্ছেন উনি। উনার এই অতি স্বাভাবিক কাজটাকেই মারাত্মক রকমের সুন্দর লাগছে আমার কাছে। আচ্ছা, আজ কেন এতো ভালো লাগছে উনাকে? আগে তো উনাকে দেখলেই প্রচুর রাগ হতো কিন্তু আজ কেন রাগ হচ্ছে না। শুধু কি উনার সাথে আমার জীবন জড়িয়ে গিয়েছে তাই? নাকি অন্য কোন ব্যাপার আছে? কে জানে?
🍁
কারো নড়াচড়ার কারণে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। পিটপিট করে চোখ খুলে দেখলাম নির্ভীক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কাল রেলিংয়ের সাথে মাথা ঠেকিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম নিজেই বুঝতে পারিনি। আমি চোখ কচলে উনার দিকে তাকতেই উনি শোয়া থেকে উঠে বসলেন। তারপর হাই তুলতে তুলতে বললেন,,
–“অনেকদিন পর শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছি। আচ্ছা তোর হাতে কি জাদু আছে নাকি রে? মাথায় হাত রাখতেই কেমন ঘুম পেয়ে যায়! দেখি তোর হাত!”
আমার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। উনার এরকম পর্যবেক্ষণ এর মানে বোধগম্য হচ্ছে না আমার। কিছুক্ষণ আমার হাত উল্টে পাল্টে দেখে উনি বললেন,,
–“কই তেমন কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না। আচ্ছা যাই হোক এবার নিচে চল। (হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে) এখন ৬ টা বাজে। এখন না গেলে নির্ঘাত বাবার হাতে ধরা খাবো। আর বাবা যদি জানতে পারে যে কাল সারারাত আমি আর তুই ছাদে বসে কাটিয়েছি তাহলে আমার অবস্থা খারাপ করে দিবে।”
উনি উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। তারপর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমাকেও উঠতে বললেন। একবার ভাবলাম যাবো না। আঙ্কেল ইচ্ছামতো বকবে উনাকে কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হলো এমন হলে সবার সামনে আমাকেই লজ্জায় পড়তে হবে। তাই উনার হাত ধরে উঠে পরলাম। কিন্তু সারারাত একই ভাবে বসে থাকার ফলে পায়ের গোরালি আর হাটুতে ব্যথা করছে। হাঁটতে গিয়েও পারছি না। মনে হচ্ছে পা দুটো আটকে গিয়েছে। তবুও কষ্ট করে কয়েক পা ফেললাম। এতোক্ষণে উনি কিছুটা এগিয়ে গিয়েছেন। আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর হুট করেই আমায় কোলে তুলে নিলেন। তারপর সিরি দিয়ে নামতে নামতে বললেন,,
–“কষ্ট হচ্ছে আগে বলতে কি হয়েছিল? যদি পড়ে যেতি তখন কি হতো?”
হুহ ঢং এর শেষ নাই। উনার জন্যেই তো হাটতে পারছি না আবার এখন আসছে ঢং দেখাতে। আমি পরে গেলে তোর কি? উনি আমাকে উনার ঘরে নিয়ে আসলেন। তারপর আমাকে খাটের উপর বসিয়ে ড্রয়ার থেকে মুভ স্প্রে নিয়ে এসে আমার পায়ের গোড়ালি তে স্প্রে করে দিলেন। তারপর বোতলটাকে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,,
–“বাকিটা নিজে করে নে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আর শোন পা ঠিক হলেই আমার রুম থেকে চলে যাবি। আমি চাইনা কেউ তোকে আমার রুমে দেখুক। এতে তুই আমি দুজনেই ঝামেলায় পড়ে যাবো।”
এতটুকু বলেই উনি ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আমি পায়ে স্প্রে করে উনার রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম। ব্যাথাটা একটু কমেছে এখন। আজ ই বাড়ি চলে যাবো আমি। এখানে কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে। কাল অবধিও ভাবিনি জীবনটা এই ভাবে বদলে যাবে।
___________________
হোস্টেলের বারান্দায় বসে আছি আমি। আজ দুদিন হলো রাজশাহীতে এসেছি। সামনেই নিলা বসে আছে। ওর দিকে ভাবান্তর না করে আকাশ দেখায় ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। নিলা এবার বলল,,
–“কি হয়েছে তোর!এমন মুখ কালো করে বসে আছিস কেন? ভাবটা এমন যেন তোর বাবা মা তোকে তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে কোন কানা খোঁড়া ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে? দুদিন ধরে লক্ষ্য করছি কেমন যেন অদ্ভুত ব্যাবহার করছিস? কি হয়েছে সেটা তো বল!”
আমি ওর দিকে তাকালাম না। কারণ ওর দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলতে পারবো না আমি। নিলাকেই বা আর কি বলবো! ও তো আর জানে না আমার জীবনে কি ঘটে গিয়েছে। কিন্তু এভাবে অস্বাভাবিক ভাবে থাকলে তো হবে না। আজ নিলা প্রশ্ন করছে কাল সবাই একি কথা জিজ্ঞেস করবে। নিজেই নিজেকে বোঝালাম বি স্ট্রং! এভাবে থাকা যাবে না। তোকে স্বাভাবিক থাকতে হবে। স্বাভাবিক ই থাক।
·
·
·
চলবে……………………..