#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
নবম_পর্ব
~মিহি
-“এক লোক ওনাকে পাঁচ লাখ টাকা দিছিল আপনার বাবা এবং ঐ ব্যবসায়ীরে সপরিবারে মারার লাইগা।
আমার স্বামীরে কোন জংলী পশু মারেনি। ঐ নরকের কীটটাই আমার স্বামীকে মেরে ফেলার লাইগা ঐ জঙ্গলে ফালাই আইছে।”
-“আপনি এত নিশ্চিত কীভাবে?”
-“আমার স্বামী জঙ্গলের খুটিনাটি রাস্তা চিনতো, বহুবার পুলিশের ভয়ে জঙ্গলে যাইয়া রইছে। জংলী পশুর থেকে বাঁচার সব মন্তর তার জানা। তাইলে ঐরম একটা মানুষ কেমনে পশুর আঘাতে মইরা যায় আমারে কন।”
কথাটুকু বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠে রমিজ আলীর স্ত্রী লতা। মেয়েটার উপর একটু-আধটু সন্দেহ হচ্ছে আয়াশের। একটু আগে মুখই খুললো না অথচ পাঁচ হাজার টাকার লোভে এখন সব গড়গড় করে বলছে আবার কাঁদছেও। এই মেকি কান্না ধরতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি তার তবে লতার বলা কথাগুলো যে পুরোপুরি মিথ্যা এমনটাও নয়। লতার কথার মধ্যে সততা আছে তবে কোন একটা বিষয় লুকোচ্ছে লতা যা তার মুখের রঙই বলে দিচ্ছে।
-“আপনার স্বামীকে এসব করতে আটকাননি কেন?”
-“তূর্য ভাইজান! আমার উনি এইসব ছাইড়া দিতে চাইছিল কিন্তু আপনার চাচাই কইছে এসব ছাড়লে তারে আর আমাগোরে গ্রামছাড়া করবো। আমরা হইলাম গিয়া গরিব মানুষ, গ্রাম ছাইড়া কই যাইতাম?”
-“পুলিশে জানাতেন বা আমাকেই বলতেন।”
-“তুমি যে তোমার চাচারে যাইয়া কইবা না তার গ্যারান্টি কী?”
তূর্য চুপ হয়ে যায়। লতার কথা যুক্তিযুক্ত। পরিবারের সদস্য যেহেতু লতা ভাবতেই পারে সেও খারাপ। তূর্যর কেন যেন আজ নিজের চাচার প্রতি অনেক বেশি ঘৃণা লাগছে। এতদিন চাচার সব খারাপ কাজের কথা জানলেও তাকে ঘৃণা করেনি সে কিন্তু আজ তার প্রতি ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসছে তূর্যর। আয়াশ চুপচাপ লতার সব কথা শুনলো তবুও তার মনে হচ্ছে লতা কিছু একটা লুকোচ্ছে। লতার সামনে তা স্বীকার করলো না সে। লতার হাতে পাঁচ হাজার টাকা গুঁজে দিতেই লতার চোখ চকচক করে উঠলো অথচ এতক্ষণ তার কান্নাই থামছিল না। হাসিমুখে দরজা লাগালো সে। লতা দরজা লাগাতেই আয়াশ তূর্যকে সাথে করে নিয়ে চুপিচুপি লতার ঘরের জানালার পাশে এককোণে দাঁড়ালো। আধখোলা জানালার ফাঁক দিয়ে ব্যতিব্যস্ত লতাকে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। বাটন ফোন হাতে নিয়ে কাকে যেন বারবার কল দিচ্ছে সে কিন্তু অপর পাশের ব্যক্তিটি কল রিসিভ না করায় লতা বারবারই বিরক্ত হচ্ছে। কিছু সময় পরপর আবার ঐ লোককে দু-চারটে অকথ্য ভাষায় গালিও দিচ্ছে। একটু পর ফোন ফেলে অন্য ঘরে চলে গেল লতা। আয়াশ আর তূর্য লতার জানালার কাছ থেকে সরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। তূর্যর সারা চেহারায় প্রশ্নবোধক চিহ্নের ন্যায় একটা ভাব ফুটে উঠেছে। তূর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল আয়াশ।
-“কিছু বুঝিসনি, তাই তো?”
-“হ্যাঁ! ঐ মহিলা কাকে কল দিচ্ছিল?”
-“ঐ লোকটাকে যে ওর স্বামীকে টাকা দিয়েছে।”
-“কিন্তু ও যে বললো ঐ লোকটাই ওর স্বামীকে খুন করেছে। তাহলে নিজের স্বামীর খুনীকে সে কেন কল করবে?”
-“সবকিছু প্রি-প্ল্যানড। ঐ খুনী জানতো আমি এখানে আসবো। তাই আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে।”
-“এখন কী করবি?”
-“খুনীকে ধরবো।”
-“কীভাবে?”
-“আমায় একটা ছোটখাটো পেন ক্যামেরার ব্যবস্থা করে দে।”
-“লতার ঘরে লাগাবি?”
-“হুম।”
আয়াশ ঠিক কী করতে চাচ্ছে তা এখনো বুঝে উঠতে পারছে না তূর্য তবে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে। তূর্যর মনে আপাতত নিজের চাচার প্রতি মারাত্মক বিদ্বেষ জন্মে গেছে। কোন এক অজ্ঞাত কারণে তার এখন এটাও ধারণা হচ্ছে যে আয়াশের বাবাকে যারা মারতে চেয়েছিল তাদের সাথে তার চাচার কোন না কোন প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ যোগসূত্র তো অবশ্যই রয়েছে। এর পেছনে অবশ্য একটা যুক্তিযুক্ত নোংরা কারণও আছে কিন্তু নিজের চাচার করা নোংরামির কথাটা আয়াশকে কীভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারছে না তূর্য।
______________________
বাসায় এসে দরজা খোলা দেখে ঘাবড়ে যায় সিদ্ধি। সে তো লক করে গিয়েছিল আর বাবারও এখন আসার কথা না। চটজলদি ঘরে ঢুকে আশপাশটা বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে সে। নাহ! বাবা তো আসেননি। তাহলে দরজা খোলা কীভাবে? সিদ্ধি কি তবে দরজা খোলা রেখেই চলে গিয়েছিল? নিজের মনভোলা কাজের জন্য নিজেকে তাচ্ছিল্য করে পানি খাওয়ার জন্য রান্নাঘরের দিকে এগোয় সিদ্ধি। রান্নাঘরে গ্যাস স্টোভের উপর পাতিল চড়ানো, পাতিলে চা পাতা। সিদ্ধির স্পষ্ট মনে আছে তার বাবা আটটার মধ্যে চা খেয়ে বেরিয়েছেন আর সে বেড়িয়েছে ন’টার পর। এই সময়ের মধ্যে চা তো বানায়নি সে। তাহলে চা কে বানালো? সিদ্ধির মাথা ঘুরছে। ফোনটা হাতে নিয়ে সায়ন সাহেবের নম্বর ডায়াল করতেই শুনতে পেল ড্রয়িংরুম থেকে শব্দটা আসছে। সেদিকে দৌড় দিল সে। দেখল সোফার এককোণে তার বাবার ফোনটা পড়ে আছে। সিদ্ধি কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা তুললো। ফোন হাতে নিয়ে কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। আচমকা হাতের চাপ লেগে একটা ভয়েস মেইল অন হলো। পুরুষালি গলায় কে যেন কথা বলছে,”দেখুন মিস! আপনার বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছেন। আমি ওনাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছি। আপনি তাড়াতাড়ি *** হসপিটালে চলে আসুন।”
কথাটা শোনামাত্র সিদ্ধির মনে হয় চারিপাশ শুণ্য আর এ শূন্যস্থানেই উদ্দেশ্যহীনের মতো ভাসছে সে। তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরোয় সিদ্ধি। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তার। রিকশা ডাকবে সেটুকু জোরও পাচ্ছে না। কোনমতে একটা রিকশা থামিয়ে অনেক কষ্টে হাসপাতালের নামটুকু বললো সিদ্ধি। সিদ্ধির কান্না থামছে না কিছুতেই। বাবা ছাড়া আর কে-ই বা আছে তার জীবনে? মায়ের চলে যাওয়ার পর আয়াশ নামের ছেলেটাও থো হারিয়ে গেল সিদ্ধির জীবন থেকে। এখন কি বাবাও আর তার কাছে থাকতে চাচ্ছেন না? কথাগুলো ভাবতেই আবারো কান্নায় নিঃশ্বাস আটকে আছে সিদ্ধির। সামান্য রাস্তাটুকুও যেন ফুরাচ্ছে না আজ। সিদ্ধির মাথা ঘুরছে, ইন্দ্রিয় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মনে একটাই চিন্তা, বাবার কিছু হবে না তো?
_____________________
শ্রাবণের খুব অস্থির লাগছে আজ। কেন লাগছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। সন্ধ্যের পার্টির জন্য সব ঠিকঠাক করে এসেছে সে। এখন শুধু নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে শ্রুতিকে নিজের মনের কথা বলার জন্য। শ্রাবণ যতবারই কথাটা ভাবছে ততবারই তার হাত-পা কাঁপা শুরু করছে। বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজই হলো বন্ধুকে ভালোবাসার কথা বলা, পাছে বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে। শ্রাবণের অস্থিরতা তাকে আরো অশান্ত, উগ্র করে তুলছে। কীভাবে কী করবে সব গুলিয়ে ফেলছে সে। কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল শ্রাবণ। ঢকঢক করে গ্লাসভর্তি পানি শেষ করলো। মনে মনে শপথ করলো,”হয় আজ শ্রুতিকে মনের কথা বলবে নয়তো এই শহরে আজই শেষ দিন তার।” শেষবারের মতো বাসাটা পর্যবেক্ষণ করলো। কলেজ লাইফের শুরুতে বাসাটা ভাড়া নিয়েছিল, নিজের মতো করে সাজিয়েছিল। আজ যেন সবকিছু ভেঙে-চুরে ছেড়ে যাচ্ছে সে।
আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের মুখটা পর্যবেক্ষণ করছে তানভী, ঠোঁটে শয়তানি হাসি। সুন্দর মুখটা আজ কেন যেন শয়তানি হাসিটার কারণে বিভৎস, ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। ড্রেসিং টেবিলে থাকা কাজলটুকু চোখে লাগায় তানভী, টকটকে লাল রঙে রঞ্জিত করে ঠোঁটদুটো। নীল পাড়ের সাদা শাড়ির সাথে এ সাজ বড্ড মানিয়েছে তাকে। ঘর থেকে বের হতেই তানভীকে জেরা করে তার মা।
-“কোথায় যাচ্ছিস তুই এই সন্ধ্যেবেলা?”
-“তোমার জামাই ডেকেছে দেখা করতে।”
-“ভালো যা! রাতে থাকতে বললে ও বাড়িতেই থাকিস।”
-“বিয়ে হয়নি মা আমাদের।”
-“তাতে কী? দুদিন পরেই তো বিয়ে!”
-“ছিঃ!”
আর কিছু বললো না তানভী। তার মা কেমন চরিত্রের মহিলা সে জানে। তার বাবার দ্বিতীয় পক্ষ হলো তার মা। জেনেশুনে একজন বিবাহিত পুরুষের গলায় ঝোলা মেয়ে আর যাই হোক, ভালো চিন্তার অধিকারী কখনোই হতে পারে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানভী। মনে মনে বলে,”আজ আমি যা যা করতে যাচ্ছি, তার জন্য হয়তো তিনটে জীবন উলট-পালট হবে। দুটো পরিবারের ইজ্জত ধূলিসাৎ হবে তবুও আমার এটা করতেই হবে। নিজেকে বাঁচাতে, নিজের স্বার্থে। আমি যা করতে যাচ্ছি এর পরে মাফ চাওয়ারও যোগ্যতা আর রাখিনা আমি।”
চলবে…
[আগামীকাল আমার টানা ইংরেজী, গণিত, ফিজিক্স পরীক্ষা। বেঁচে থাকলে শনিবারে গল্প দিবো ইনশাআল্লাহ।]