চিলেকোঠায়_সমাপ্তি দ্বিতীয়_পর্ব

0
688

#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
দ্বিতীয়_পর্ব
~মিহি

রফিকউদ্দিন সাহেব আয়াশের গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে বললেন,”তোর লজ্জা করলো না ক্লাস ফোরের একটা বাচ্চা মেয়েকে উত্যক্ত করতে?” আয়াশ কিছুই বললো না। বলার মতো মুখ নেই তার। আসলেই তো সে ভুল করে ফেলেছে। তার উচিত ছিল ধৈর্য ধরে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করা।

______________________

“এই যে ভাড়াটিয়া সাহেব, শুনুন।” সিদ্ধির ডাকে ঘোর কাটলো আয়াশের। মুচকি হেসে বলে উঠলো,”জ্বী বলেন, মিস.বাড়িওয়ালি।” আয়াশের কথা শুনে সিদ্ধির ঠোঁটেও অকারণে হাসি ফুটে উঠলো।

-“কি জন্য ডাকছিলেন বলুন।”

-“আসলে আয়াশ সাহেব, আমি দুঃখিত। খাবারের ক্ষেত্রে বাছবিচার বিষয়টা আমার তেমন পছন্দ না তাই কাল একটু বেশিই রূঢ় ব্যবহার করে ফেলেছিলাম। স্যরি!”

-“হায় আল্লাহ্! এ কী দেখছি আমি? আমি কি স্বপ্ন দেখছি?

-“ঢঙ একটু কম করা যায় না?”

-“আরেকবার বলবেন প্লিজ। আমার না খুব খুশি খুশি লাগছে।”

আয়াশের মুখে বাক্যটা শুনে ভ্রু কুঁচকায় সিদ্ধি। মনে হয় বাক্যটা সে আগেও শুনেছে, খুব সম্ভবত আয়াশের মুখেই শুনেছে কিন্তু সেটা কিভাবে? আয়াশ তো এলোই মাত্র একমাস হলো আর এই একমাসে তো আয়াশ এমন কোন কথাই বলেনি সিদ্ধিকে। বিষয়টা বেশ ভাবাতে থাকে তাকে। সিদ্ধিকে অন্যমনস্ক দেখে আয়াশের মাথায় দুষ্টুমি ভর করে। সিদ্ধির চুল ধরে টান দেয় আয়াশ। সামান্য ব্যথা পেয়ে সিদ্ধির ঘোর কেটে যায়। আয়াশের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাতেই আয়াশ সিদ্ধিকে মনে করিয়ে দিল,”তুমি কিন্তু স্যরি বলতে এসেছো। তাই তোমার কিন্তু আবার রাগ করা যাবে না।” সিদ্ধি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় এ কথায়।

-“তাহলে তুমি আর আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করবে না?”

-“চেষ্টা তো চলবেই। তোমায় তিনমাসের মধ্যে আমি বাড়ি থেকে বের করেই ছাড়বো।”

-“বেট?”

-“জিতলে কী দিবেন?”

-“তুমি জিতলে আমি আর কোনদিন তোমায় মুখ দেখাবো না। আর আমি জিতলে?”

-“কি চান বলেন।”

-“একটা সন্ধ্যে, আমার সঙ্গে, এককাপ কফি উইথ সুগার।”

-“আমি কফি খাইনা।”

-“ট্রাই তো করতেই পারেন মিস.চাশমিশ।”

-“জিতে দেখান আগে।”

মুচকি হেসে চলে গেলে সিদ্ধি। আয়াশ আনমনে চুলে হাত ঘুরাতে ঘুরাতে হাসতে লাগলো। রাতের আকাশ, তারায় ভরপুর। সিদ্ধির পায়ের নূপুরের শব্দ ধীরে ধীরে মৃদু হচ্ছে। সে শব্দের মাদকতায় নিজেকে বিলীন হতে দেখছে আয়াশ। জীবনের সবটুকু প্রশান্তি বুঝি ঐ মেয়েটার বাহুডোরেই আবদ্ধ।

____________________

রফিকউদ্দিন সাহেব বিজ্ঞ স্কুলমাস্টার। তিনি জানেন চাইলেই আয়াশের মন থেকে এখন মেয়েটাকে বের করা সম্ভব না। উল্টো মেয়েটার জন্য আয়াশের ভবিষ্যতে প্রভাব পড়বে। এর চেয়ে না-হয় ওদের সম্পর্কটাকে হালাল করা হোক। তিনি মেয়ের বাবার সাথে কথা বলতে গেলেন। সায়ন সাহেব প্রথম প্রথম বেশ কটাক্ষভাবেই রফিকউদ্দিন সাহেবকে মানা করলেও রফিকউদ্দিন সাহেব তাদের বিষয়টা বোঝায়। অতঃপর সায়ন সাহেব এবং তার স্ত্রী সুবহা বেগম ঠিক করেন আয়াশের সাথেই সিদ্ধির বিয়ে দেওয়া হবে। রফিকউদ্দিন সাহেব কাবিন করিয়ে রাখতে চান কিন্তু ঐটুকু বয়সে একটা ফোরের বাচ্চা মেয়ের বিয়ের কাবিন করানো সহজ কথা নয়। বাল্যবিবাহের কেইস তো থাকেই। তাছাড়াও, গ্রামাঞ্চলে সায়ন সাহেবের শত্রুর অভাব নেই। ব্যবসার কারণে বেশ অনেকটাই শত্রু কামিয়ে ফেলেছেন তিনি। অবশেষে অনেকটা লুকিয়ে লুকিয়েই আয়াশ আর সিদ্ধির কাবিন করানো হয়। সিদ্ধি অবশ্য তখন কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝেছিল এই আয়াশ নামক ছেলেটা তাকে ভালোবাসে। বুঝতে বুঝতেই বাকি তিনটা মাস চলে গেল। আয়াশ পরীক্ষা দিল। এডমিশন হলো ঢাকার কলেজে। বাবার স্বপ্ন ছেলে ডাক্তার হবে, ঢাকার কলেজে তো পড়তেই হবে। সায়ন সাহেবও আর আপত্তি করেননি। বাঁধ সেধেছিল সিদ্ধি। প্রায় কান্নাই করে ফেলেছিল মেয়েটা। তার কথা একটাই আয়াশ যদি তাকে ভালোবাসে তাহলে কেন রেখে যাচ্ছে। আয়াশ বুঝিয়ে-সুঝিয়ে চুপ করায় সিদ্ধিকে। ফলাফলটা খুব সন্তোষজনক হয় না। পরবর্তী দিনগুলোতে হাসি-খুশি সিদ্ধি মূর্ছে যায় যেন সে একটা প্রিয় খেলার সঙ্গী হারিয়ে ফেলেছে। আয়াশ সময় পেলেই সিদ্ধির সাথে কথা বলে কিন্তু সামনে সিদ্ধিরও বোর্ড পরীক্ষা। পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কথাবার্তা কমিয়ে আনা হয়। দূরে বসে সিদ্ধির জন্য জমানো অনুভূতি আকাশের বুকে জড়িয়ে রাখে আয়াশ। আ এ প্রান্তে বসে বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোয় নিজের আর আয়াশের নামে ভরে ফেলে সিদ্ধি। যে মেয়েটা একবছর আগেও ভালোবাসার মানে বুঝতো না, সেও এখন একজনকে ভালোবাসে এবং যাকে ভালোবাসে সে ব্যক্তিটা একান্তই তার। ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠে সিদ্ধির গালদুটো।

______________________

আযানের ধ্বনি শুনতেই আয়াশ কল্পনা থেকে বাস্তবে ফেরে। সে এখনো ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে। অতীতের স্মৃতিচারণ করতে করতে ভোর হয়ে গেছে। একেবারে নামায পড়ে সামান্য পড়াশোনা করে ঘুমোতে যায় আয়াশ।

সকাল দশটা পেরোয়। আয়াশকে ঘর থেকে বেরোতে না দেখে ভ্রু কুঁচকায় সিদ্ধি। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে আয়াশকে বাড়ি থেকে বের করার বাজি ধরেছে সে। কী করা যায়, কী করা যায় ভাবতে ভাবতে সিদ্ধির মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি আসে। সিদ্ধি পাশের দোকান থেকে একটা কাঁচের বোতল নিয়ে আসে। বোতলের শেইপটা অনেকটা মদের বোতলের মতো। বোতলটা বাসায় এনে বোতলে শরবত ঢালে, তারপর বোলটাতে টাইগার ড্রিংক মেশায় স্মেল আনার জন্য। কিছুক্ষণ ঝাঁকানোর পর সিদ্ধির ঠোঁটে ফুটে উঠে শয়তানি হাসি। সায়ন সাহেব মদ জিনিসটা দু’চক্ষে সহ্য করতে পারেন না। একবার কলেজ ফাংশনে সায়ন সাহেবকে শরবতের গ্লাসে মদ মিশিয়ে খাওয়ানোর জন্য তিনি দীর্ঘ আট বছরের বন্ধুত্ব ভেঙেছেন। মদ জিনিসটা তিনি মাত্রাতিরিক্ত ঘৃণা করেন আর এবার যদি তিনি আয়াশের ঘরে মদের বোতল পান, তাহলে তিনি নিশ্চিতরূপে আয়াশকে বাড়ি থেকে বের করেই ছাড়বেন। কথাটা ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধির ঠোঁটে আবারো আগের শয়তানি হাসিটা ফুটে উঠে।

ঘুম ভাঙতেই আয়াশ লক্ষ করে বেলা হয়েছে অনেক। প্রায় বারোটা নাগাদ বাজে। ঘুম থেকে উঠে গোসল করে সিদ্ধিকে খুঁজতে থাকে সে। পরক্ষণে মনে পড়ে সিদ্ধি বোধহয় কলেজে। আয়াশের খুব ইচ্ছে করে সিদ্ধিকে একনজর দেখতে যাবে কিন্তু সাহস হয়ে উঠে না। মেয়েটা যে গুণ্ডী হয়ে উঠেছে এখন। আগে কী সুন্দর লজ্জা পেত, লজ্জায় লাল হত গালদুটো। আর এখন? এখন খালি দিনরাত গুণ্ডাগিরি, মারপিট আর রাগ? সে তো সারাটাক্ষণ নাকের ডগায়। আয়াশ বুঝে উঠতে পারেনা নম্র-ভদ্র-সরল মেয়েটার হঠাৎ এমন পরিবর্তন কী করে হলো? সায়ন সাহেব হয়তো প্রতিবাদী মনোভাবটা শিখিয়েছেন কিন্তু নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা যেন সিদ্ধির চরিত্রের বিপরীত।

______________________

কলেজে মন বসছে না সিদ্ধির। বাড়িতে আজ একটা বড়সড় ঝড় উঠবে ভাবতেই তার মধ্যে রোমাঞ্চ ভর করছে। একা একাই হাসছে সে। পাশ থেকে তানভী ফিসফিস করে বলে উঠলো,”এই কীরে! তুই হাসছিস কেন একা একা? জ্বীন ধরলো নাকি?” ব্যস! ঘটে গেল গণ্ডগোল। সিদ্ধিকে দুচোখে সহ্য করতে না পারা প্রফেসর রাহী চক ছুঁড়ে মারলো ওদের দিকে।

-“গেট লস্ট!”

-“কিন্তু ম্যাম আমরা গল্প করছিলাম না।”

-“তোমার পুরো গ্রুপটাকে নিয়ে ক্লাস ছেড়ে বের হও।”

অযথা তর্ক করে না সিদ্ধি। গ্রুপের সবাই বের হয় ক্লাস থেকে। অয়ন, তানভী, শ্রুতি, শ্রাবণ আর সিদ্ধি। গ্রুপে তিনজন মেয়ে, দুজন ছেলে। শ্রুতি মেয়েটা অনেকটা শান্ত স্বভাবের, তানভী চঞ্চল আর উশৃঙ্খলতা তার রগে রগে বিরাজমান। অয়ন পড়াশোনায় বেশ ভালো, সুদর্শনও। গ্রুপের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বান্দা হলো শ্রাবণ। তিনি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়েছেন কেবলমাত্র ভুল সময়ে ভুলভাল প্রবাদবাক্য ব্যবহারের কারণে অথচ তার স্বপ্ন কিনা ভবিষ্যতে তিনি এসব প্রবাদ ব্যাকরণে সংযুক্ত করবেন।

-“এই তানভীর বাচ্চার জন্য এখন এই রোদে বসে থাকা লাগবে।”

-“আমি কী করছি?”

-“কিছুই করো নাই তুমি, চুপ থাক শালা।”

সিদ্ধির রাগে গা জ্বলছে। এমন সময় শ্রাবণ বলে উঠলো,” আরে সমস্যা নাই তো। একে মিলে করি কাজ, দশে মিলে ভুলি লাজ।” সিদ্ধি রাগে কটমট করতে করতে শ্রাবণের দিকে তাকালো। ভয় পেয়ে বেচারা চুপ হয়ে গেল। আচমকা তানভীর চোখ পড়লো কলেজ গেটের দিকে। হা করে সেদিকে তাকিয়ে রইল সে। শ্রুতি আর সিদ্ধির সামনে হাত ইশারা করে বলল,”দেখ দেখ, ছেলেটা কী সুন্দর! আহা, আমার স্বপ্নের রাজকুমার পেয়ে গেছি। এই তোরা সর তো।” তানভীর ইশারা অনুযায়ী সামনে তাকাতেই গেটে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটাকে দেখে আঁতকে উঠে সিদ্ধি।

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here