#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
ষষ্ঠ_পর্ব
~মিহি
সকাল হতেই আয়াশ সিদ্ধিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ তাড়াহুড়ো করছে। সিদ্ধিকে এখানে রেখে ও নিজে ঐ বাড়িতে থাকতে পারবে না। শোভা সিদ্ধির সাথে থাকতে চাইলেও সিদ্ধিকে এ বাড়িতে রাখতে চাচ্ছে না সে। শোভার থেকে বিদায় নিয়ে আয়াশ আর সিদ্ধি বেরিয়ে পড়লো। সায়ন সাহেব তখনো দরজা বন্ধ করে দিব্যি বসে আছেন। ভাবখানা এমন যেন রাগের চরম শিখরে তার অবস্থান। সিদ্ধির মনটা ঠিক নেই। মনের খবর সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। আয়াশ বাড়িতে কল দিল বেশ কয়েকবার। কেউ কল ধরছে না। অদ্ভুত ব্যপার! আপাতত বাড়িতে পৌঁছানোর আগ অবধি শান্তি নেই আয়াশের। সিদ্ধিকে অবশ্য বাড়িতে কেউ কল না ধরার কথাটা বললো না আয়াশ। মেয়েটা অযথাই দুশ্চিন্তা করবে। এই সময়ে ওর দুশ্চিন্তা না করাই ভালো।
আয়াশ-সিদ্ধি বেরিয়ে যাওয়ার পর দরজা খোলেন সায়ন সাহেব। এসেই শোভার চুলের মুঠি ধরে শোভাকে বিছানার উপর ফেলল। কোনরকম কথা ছাড়াই এলোপাতাড়িভাবে শোভার গায়ে হাত তুলতে থাকলো। শোভা চুপচাপ পড়ে আছে বিছানায়, কোন ভাবান্তর নেই তার মধ্যে। ইচ্ছে হশো চিৎকার করে ডাকতে,”শোয়েব! এমন প্রতারণা কেন করলে আমার সাথে?” শোভাকে ফেলে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বাইরে চলে গেলেন সায়ন সাহেব। শোভা চোখ বন্ধ করে অতীতের খেয়ালে ডুবলো।
_________________________
-“আমি তোমায় কখনো ছেড়ে যাবো না শোভা, কখনোই নাহ!”
-“সত্যি বলছো তো শোয়েব?”
-“মিথ্যে বললে কি আর তোমায় বিয়ে করে ঘরের রানী করে আনতাম?”
-“হুম বুঝলাম।”
শোভা বোঝেনি, শোয়েবের মনের কলুষতা সে আন্দাজ অবধি করতে পারেনি। শোয়েবের রগে রগে কেবল নববিবাহিতা স্ত্রীর প্রতি নামমাত্র ভালোবাসার বয়ে চলা ধরতে পারেনি শোভা। বিয়ের চারটা বছরে কেবল অত্যাচার আর নির্দয় আচরণগুলোর সাক্ষী হয়েছে সে। শোয়েব নামক মানুষটাকে ভালোবাসার ভুলটা তখন তিলে তিলে উপলব্ধি করে সে। তবে আর কোন পথ ছিল না ফেরার। বাবা-মা বলেছিলেন মানিয়ে নিতে। এই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাটা ছিল আরো বড়ো ভুল। শোয়েবের মনের সাথে সাথে তখন চরিত্রেও কলুষতার ঘনঘটা ছেঁয়ে গেছে। তখন আর শোভার রূপে মুগ্ধ হয়না শোয়েব। বাইরের নারী তখন তার উপভোগের বস্তু। বিয়ের সাত বছরেও যখন শোভার কোন বাচ্চা হলো না, তখন শোয়েব আর তার পরিবার শোভাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। শোভার বাবা-মা তখন নিরুপায়। শোভার একমাত্র বড় ভাইয়ের টাকায় তখন পুরো পরিবার চলছে। অনেক চেষ্টার পর শোভা চাকরি পেল। ভেবেছিল এবার বুঝি জীবনটা সুন্দর হবে। হলো না, কয়েকদিন পর থেকেই তীব্র মাথা ব্যথা আর অসুস্থতা ধরে বসলো তাকে। এমন অবস্থায় বড় ভাই কোথা থেকে যেন এক লোকের বিয়ের সম্বন্ধ আনলো। শোভা তখন জানতে পেরেছিল তার ব্রেইন টিউমার হয়েছে, মৃত্যু সন্নিকটে। এদিকে ভাইয়ের তাকে বিদায় করার তাড়া! ভাইয়ের আদেশে লোকটার সাথে কথা বললো শোভা। লোকটাই হলো সায়ন সাহেব। শোভার মুখে টিউমারের কথা শোনার পরও শোভাকে বিয়ে করতে রাজি হন সায়ন সাহেব। শোভা ভেবেছিল লোকটা এত ভালো কেন। কিন্তু বিয়ের পর জানলো তাকে বিয়ে করার জন্য লোকটা তার পরিবারের থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছে তাও এই শর্তে যে শোভা নিজের বাবা-মাকে কোনরকম আর্থিক সহযোগিতা করতে পারবে না। বিয়ের আগেরদিনই চাকরি ছেড়ে দেয় শোভা যার জন্য বিয়ের রাতেই সায়ন সাহেবের অত্যাচারের কবলে পড়তে হয় তাকে। কারণ একটাই সায়ন সাহেব নিজের টাকায় শোভাকে খাওয়াবেন না। শোভা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না আসলে সায়ন সাহেব তাকে বিয়েটা কি জন্য করেছে। ধীরে ধীরে শোভা বুঝে উঠলো সায়ন সাহেব কোন একটা অবৈধ কাজের সাথে জড়িত যার কারণে প্রতিনিয়ত এ বাড়িতে লুকিয়ে লোকজনের যাতায়াত চলে। সায়ন সাহেব নিজে রান্নাবান্না-কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলে কাজে ব্যাঘাত ঘটবে। এই ভেবেই তিনি শোভাকে এনেছেন এ বাড়িতে। টাকাও এলো, কাজের লোকও পাওয়া গেল তাও এমন লোক যে দুদিন বাদে মরবে তাই রহস্য উদঘাটনের ভয়ভীতি নেই।
_________________________
শোভা এজন্যই সিদ্ধিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাচ্ছিল কারণ সিদ্ধি যত সময় এ বাড়িতে থাকবে তত সময় সিদ্ধির বিপদ বাড়বে। সায়ন সাহেবের মতো স্বার্থপর লোক নিজের স্বার্থে কাছের মানুষদের ক্ষতি করতেও একটাবার ভাবে না। শোভা উঠে রান্নাঘরে গেল। রান্নার জন্য জিনিসপত্র হাতের কাছে আনতেই খেয়াল করলো ডাস্টবিনের কাছে একটা ওষুধের খালি পাতা পড়ে আছে। শোভা হাতে তুলে এপাশ-ওপাশ করে বোঝার চেষ্টা করলো কিসের ওষুধ। এ ঘরে তো কোন ওষুধ রাখা হয়না। শোভা ওষুধের নামটা আওড়াতে আওড়াতে গুগলে চেক করলো। গুগলের রেজাল্ট দেখে আঁতকে উঠলো শোভা। ওষুধটা স্ট্রেস বাড়ানোর স্লো ডোজ। একসাথে অনেকগুলো দিলে রোগীর স্মৃতিশক্তি ভোলারও তীব্র শঙ্কা রয়েছে। এই ওষুধ এ বাড়িতেই থাকার কথা না, সেখানে রান্নাঘরে ওষুধের খালি পাতা পড়ে আছে! এসবের মানে কী? কাল রাতে রান্নার সময়ও তো ওষুধের পাতাটা এখানে ছিল না। ভালো করে মনে করার চেষ্টা করে শোভা। কাল রাতে সব রান্না শেষ করে পায়েস বানাচ্ছিল সে। এমন সময় সায়ন সাহেব আসেন। শোভাকে বলেন তিনি নাকি তার মোবাইলটা খুঁজে পাচ্ছেন না, খুঁজে দিতে হবে। শোভা অদ্ভুতভাবে তাকালেও পরবর্তীতে মোবাইল খুঁজতে ঘরে গিয়েছিল। পাঁচ মিনিটের মাথায় মোবাইল নিয়ে ফেরতও এসেছিল। এটুকু সময় রান্নাঘরে সায়ন সাহেব একাই ছিলেন। তবে কি পায়েসে এই ওষুধটা সায়ন সাহেবই মিশিয়েছেন কিন্তু কেন? আর যদি তিনি নিজের মেয়েকে ঘৃণাই করে থাকবেন, তাহলে শোভা যখন সিদ্ধিকে চলে যেতে বললো তখন কেন তিনি শোভাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করলেন? সবকিছু কেমন যেন জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে। শোভার মাথাটা যন্ত্রণা করছে আবারো। ডাক্তার ওষুধ সাজেস্ট করেছেন কিন্তু সায়ন সাহেব কখনোই তাকে ওষুধ এনে দেননা। শোভাও জানে মৃত্যু নিশ্চিত। এ জগতের যন্ত্রণায় আর নিজেকে জ্যান্ত লাশ বানিয়ে রাখতে ভালো লাগছে না তার। তারও ইচ্ছে মৃত্যু যেন যত দ্রুত সম্ভব তাকে আলিঙ্গন করে। শোভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সায়ন নামক মানুষটা এমন রহস্যময় কেন? যেন ফিজিক্সের কোন সূত্র কিংবা রসায়নের কোন বিক্রিয়া যা বোঝা দায়।
__________________________
-“আচ্ছা তূর্য, তুই কোথায় এখন?”
-“এইতো বাড়িতেই তবে কাল দুপুরের দিকে তোর ক্লিনিকে যাবো একটু। তোর সাথে জরুরী কথা আছে।”
-“কি কথা? এখনি বল।”
-“না, ফোনে বলা সম্ভব না।”
-“আচ্ছা শোন, রুফাইদা মেয়েটার ঘটনা তো দেখলিই সেদিন। মেয়েটার নাড়ি-নক্ষত্রের খবর বের করতে হবে। পারবি?”
-“এতে আর বলার কি আছে? আমি তো এই এলাকার ব্যোমকেশ।”
-“আসছে রে ব্যোমকেশ আমার! জয় বাবা তূর্য বক্সী!”
-“আচ্ছা শোন, ভাবীর শরীর কেমন?”
-“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছে। ওর সবটুকু যত্ন আমি নিবো। আচ্ছা রাখছি।”
ড্রাইভার বেশ সাবলীল গতিতে ড্রাইভ করছে। কথা শেষ করে পাশে খেয়াল করতেই আয়াশ দেখলো সিদ্ধি ঘুমে ঢুলছে। আয়াশ মুখ টিপে হাসলো।
-“বাহ রে! সারারাত ঘুমিয়ে সকালবেলাও হাই তুলছো?”
-“কই ঘুমালাম? চাঁদ-তারা দেখতেই তো রাত শেষ। তার উপর তোমার বকবকানি।”
-“বকবকানি? কী সুন্দর করে কবি কবি ভাব নিয়ে জোৎস্নাবিলাস করাইলাম আর তুমি বলো বকবকানি? এরপর যদি আর এমন মুহূর্ত ক্রিয়েট করছি আমি! তারপর আবার বলবা তোমার বর আনরোমান্টিক।”
-“এই চুপ করো তো। এমনিতেই আমার মাথা যন্ত্রণা করছে কাল রাত থেকে।”
-“সেটা তুমি এখন বলছো আমায়? এক্ষুনি চলো তোমার গাইনীর আছে। তোমার মাইগ্রেন নাই, এতক্ষণ মাথা ব্যথা করবে কেন?”
-“আচ্ছা, আগে বাসায় যাই।”
সিদ্ধি আলতো করে আয়াশের কাঁধে মাথা রাখে। আয়াশ সিদ্ধির হাত নিজের মুঠোয় নেয়। সিদ্ধি হাতজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে আওড়াতে থাকে,
“একজোড়া হাত ভরসার,
একজোড়া হাত বিশ্বাসের,
তুমি এভাবেই থেকো পাশে,
বিকল্প হয়ে নিঃশ্বাসের।”
চলবে….
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং অনুগ্রহপূর্বক গল্প সম্পর্কে নিজের মতামত জানাবেন।]