#চিরেকুটের_শব্দ (পর্ব ২)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
ঈষিতাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই বুকটা কেঁপে উঠলো অর্ণবের । বিয়েতে প্রাক্তন প্রেমিকার সিনক্রিয়েট। এমনটা হলে আজ মান ইজ্জতের এক ফোটাও বেচে থাকবে না।
যেভাবেই হোক ঈষিতাকে আপাততো কিছু একটা বুঝিয়ে হলেও এখান থেকে সরাতে হবে।
আর এক মুহুর্ত দেড়ি না করে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় অর্ণব। দরজার কাছ অব্দি আসতেই খেয়াল হয় পড়নে একটা শর্ট পেন্ট। নিচে অনেক মানুষ চলাচল করছে এদের সামনে দিয়ে অন্তত সর্ট পেন্ট পরে তো আর যাওয়া যায় না। মুখ দিয়ে মুহুর্তেই একটা বিরক্তিকর শব্দ উচ্চারিত হয়। প্রবাদ টা মনে হয় এই জন্যই তৈরি হয়েছিলো, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধা হয়।
অর্ণব দ্রুত একটা ট্রাউজার পড়ে দৌড়ে নিচে চলে গেলো। এদিকে ঘুম ভেঙে গেলো অর্থির। মিঠি মিঠি চোখে তাকাতেই দেখে অর্ণব পাশে নেই।
বিছানা থেকে নেমে বেলকনিতে আসতেই দেখে অর্ণব বাইরে একটা মেয়েকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে কি যেন বুঝাচ্ছে। মেয়েটা কি রেগে আছে না কাঁদছে দুর থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারছে না অর্থি। তাদের মাঝে কি কথা হচ্ছে ওটাও বুঝতে পারছেনা সে।
– দেখো অর্ণব আমি কিন্তু এখানে চিৎকার করে সবাইকে বলে দিবো যে তোমার সাথে আমার কি কি ছিলো। তুমি আমাকে বিয়ে করবে বলে আমার সব কেড়ে নিলে, আর এখন কিভাবে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নিলে তুমি? কি ভেবেছো, আমাকে এভাবে ঠকিয়ে তুমি সংসার পাতবে আর আমি কিছুই বলবোনা? নিজের ভালোবাসা আরেকজনের হাতে তুলে দেওয়ার মতো এতোটাও উদার আমি নই। আমি এখানে সবাইকে বলে দিবো, সুইসাড করবো আমি। আর সুইসাইড নোটে তোমার নাম লিখে যাবো। আমার মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ি।
কপালে এক হাত রেখে বিরক্তি প্রকাশ করলো অর্ণব। কিছুতেই এই মেয়েকে বুঝাতে পারছে না আজ। বিরক্তি কনট্রোল করে বললো,
– ঈষিতা প্লিজ, আমার কথাটা একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমি তোমাকে সব বলবো। আমি একটা ঝামেলার মাঝে আছি। তোমার সাথে আমি বিকেলে দেখা করবো এই প্রমিস। আর শুনো, আমি তোমাকে ঠকাবো না, ভালো আমি তোমাকেই বাসি ঈষিতা।
ঈষিতা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। আর বললো,
– এটা ভালোবাসা? ভালোবাসা হলে ওই মেয়েকে কেন বিয়ে করলে? সত্যি বলতে ভায় পাচ্ছো যে, আমি তোমার প্রয়োজন ছিলাম, প্রিয়জন না।
– বিকেলে তোমাকে আমি সব বলবো, এর পর তোমার যা ইচ্ছে তা বলবে আমি নিষেধ করবো না।
এর মাঝেই অর্ণবের বাবা দুর থেকে ডাক দিলো তাকে। অর্ণবের বাবার নাম ফয়েজ আহমেদ। খুব রাগি একজন মানুষ, তার মুখের উপর কথা বলার সাহস এই বাড়িতে কারো নেই। অর্ণবেরও না। বিয়ের কয়েকদিন আগেও অর্ণবকে চড় থাপ্পর মেরেছে। বাড়ির সবাই জমের মতো ভয় পায় এই লোকটাকে।
– কে এই মেয়ে?
অর্ণব একটু আমতা আমতা করে হুট করেই বললো,
– আমার ফ্রেন্ড। ভার্সিটিতে একসাথে পড়েছিলাম। ওভাবেই পরিচয়।
অর্ণবের আমতা আমতা শুনে ফয়েজ আহমেদ একটু সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কিন্তু তা পূনরায় হাসির আড়ালে লুকি বললো,
– তো ফ্রেন্ড হলে এখানে দাড় করিয়ে রেখেছিস কেন? ঘরে নিয়ে যা।
– না বাবা ও একটা কাজে এখানে এসেছিলো তাই আমার সাথে দেখে করে যাচ্ছে। এখনি চলে যাবে।
ফয়েজ আহমেদ আর কিছু না বলে ওখান থেকে প্রস্থান করলো।
ঈষিতার হাত ধরে টেনে গেটের বাইরে আসে অর্ণব।
– আমি সব ঝামেলা মিটিয়ে বিকেলেই তোমার সাথে দেখা করছি। বের হওয়ার আগে তোমাকে ফোন দিবো আমি। এখন এখান থেকে যাও।
ঈষিতা কিছুক্ষন অর্ণবের দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে। খুব ভয়ঙ্কর চাহুনি। মনে হচ্ছে সে তার চাওয়াকে না পেলে সব উলোট পালট করে ফেলবে।
এর পর একটা রিক্সা ডেকে উঠে চলে গেলো সে। বুকে হাত দিয়ে একটা নিশ্বাস নিলো অর্ণব। কিছুক্ষন বাইরে দাড়িয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো সে। দেখে কাজ কামের ব্যস্ততা বেড়েছে আগের থেকে।
অর্ণবের ছোট বোন অর্ণি সকলকে চা দিয়ে অর্ণবের দিকে এগিয়ে আসলো।
– কিরে ভাইয়া এতো সকালে কোথায় গিয়েছিলি তুই? ওদিকে মা তোকে সারা বাড়ি খুজছে।
– মা এখন কোথায়?
– ভাবির রুমে গেছে।
অর্ণব রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। দরজার সামনে এসে দেখে তার মা বেড়িয়ে আসছে রুম থেকে। অর্ণবের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। কোনো কথা বললো না।
বিষয় টা এতো গুরুত্ব না দিয়ে রুমে প্রবেশ করলো অর্ণব। দেখে একটা গোলাপি কালার শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে অর্থি। ঠোঁট দুটিও গোলাপি তবে ভয় লজ্জা দুটুই মিশে আছে। অর্থির কাছে এগিয়ে গেলো অর্ণব। এমন একটা রুপবতি মেয়েকে কেন আল্লাহ্ এই শক্তিটা থেকে বঞ্চিত রাখলো। সে তো এমন একটা মেয়েকেই চাইতো সব সময়। পেয়েও গেলো তার স্বপ্নের রাজকুমারির মতো একটা মেয়ে। কিন্তু কখনো কন্ঠস্বর শুনতে পাবে না এটা ভাবতেই সবকিছু যেন পানসে লাগে তার কাছে। অর্থির মাঝে তো নিজেকে তখনই হারিয়ে ফেলেছিলো যখন সে অর্থিকে প্রথম দেখেছিলো।
সে চুপচাপ অর্থির সামনে এগিয়ে গিয়ে হাটু ভেঙে ফ্লোরে বসে পরে। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা অর্থি এবার একটু অবাক হয়ে অর্ণবের দিকে তাকায়। তার নিশ্বাস ভাড়ি হয়ে আসে। কি করবে এই লোক টা?
মুহুর্তেই অর্থিকে অবাক করে দিয়ে তার ফর্সা পেটে ঠোঁট ছুইয়ে দেয় অর্ণব।
অর্থি দুই হাতে শাড়িটা খামছে ধরে চোখ বুজে নেয়। জীবনে প্রথম কারো কাছে আসা, প্রথম কারো স্পর্শ তারা সমস্ত শরির জুড়ে শীতল শিহরণ বয়ে যায় মুহুর্তেই। হাতের আঙুল গুলো কাঁপছে তার। এক মুহুর্তের জন্য হলেও মনে হচ্ছে যে তার সমস্ত শক্তি কোথায় হারিয়ে গেছে এই স্পর্শতেই।
অর্থির এমন কাপুনি অনুভব করে উঠে দাড়ায় অর্ণব। অর্ণবের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না অর্থি। অদ্ভুত এক জড়তা কাজ করছে তার মাঝে। কাঁপা হাতে একটা কাগজ এগিয়ে দেয় অর্ণবের দিকে।
অর্ণব কাগজটা হাতে নিয়ে দেখে ছোট্ট একটা লেখা, শেষে একটা রাগি ইমোজি আঁকা।
‘মেয়েটা কে?’?
কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেলো অর্ণব। অর্ণবের হাবভাব বুঝতে না পেরে অর্থি চুপচাপ দাড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষন পর আশে পাশের বাড়ির মহিলারা আসলো নতুন বৌ দেখতে। এসেই দেখে বৌ নয় যেন ফুটফুটে একটা পরী বসে আছে তাদের সামনে। যার মুখশ্রি পুরোটাই যেন অদ্ভুত এক মাধুর্যতায় মোড়ানো।
কিন্তু যখনি শুনলো অর্থি কথা বলতে পারে না তখনি হাভভাব বদলে যায় তাদের।
কেউ বলে উঠে,
– ফয়েজ আহমেদ তো ছেলের জন্য দেখি একেবারে ফুটফুটে একটা পরী নিয়ে এসেছে রে।
পাশ থেকে আবার কেউ মুখ বাকিয়ে বললো,
– পরী আনলে কি হবে? একমাত্র বৌ হয়ে কারো সাথে কথা বলার যোগ্যতাটাও তো নেই তার। দেশে কি মেয়ের অভাব ছিলো? এতো ভালো ভালো মেয়ে থাকতে ফয়েজ আহমেদ কিভাবে ছেলের গলায় একটা বোবা মেয়ে চাপিয়ে দিলো? শুধু সুন্দর হলেই কি সব হলো নাকি?
আশে পাশের মানুষদের মুখে এমন কুটক্তি শুনে কাঁন্না যেন আসতে গিয়েও দলা পাকিয়ে আটকে যায় অর্থির গলায়। ছোট থেকেই কেউ যখন তার দুর্বলতা নিয়ে খোচা দেয় তখন খুব কষ্ট হয় তার। আর এই কষ্ট গুলো কারো সাথে শেয়ার না করতে পারলেও যেন আরো দ্বিগুন কষ্ট বুকের ভেতর চাপা থাকে। নিরবে বসে কেঁদে কেঁদে সেই কষ্ট গুলোকে অভিযোগ বানিয়ে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। আর তখন কষ্টগুলো অশ্রু হয়ে গাল বেয়ে নিচে আছড়ে পরে।
অর্থির বাড়ি থেকে লোকজন এসেছিলো আজ। তাদের দেখে যেন অর্থির অশ্রু শিক্ত চক্ষুজুগল আনন্দে নেচে উঠেছিলো।
যাওয়ার আগে তার মা তাকে কয়েকটা উপদেশ দিয়ে গেলো।
– শুন এটাই এখন থেকে তোর বাড়ি। আমরা মা বাবা হলেও এখন তোর পর। তোর শশুর শাশুরি’ই এখন তোর বাবা মা। অর্ণব ই তোর গার্ডিয়ান। সুন্দর ভাবে চলবি এখানে। অনেক কষ্টে তোকে বিয়ে দিয়েছি। এখানেই নিজেকে মনিয়ে নে। হাজার কষ্ট পেলেও কখনো উহ্ শব্দ করবি না। চুপচাপ মেনে নিবি সব সময়। ধৈর্য ধরে থাকবি। ২০ বছর ধরে তোকে বড় করেছি আমাদের দায়িত্ব এখন শেষ।
সবাই চলে যাওয়ার সময় অর্থি ছল ছল দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিভাবে দায়িত্ব শেষ বলে পর বানিয়ে চলে গেলো তাকে। বিয়ের আগেও অনেক কথা শুনতো অর্থি। বার বার পাত্রপক্ষ এসে তাকে দেখে পছন্দ করলেও পরে রিজেক্ট করে দিতো। অর্থির মা তো তাকে বলেই দিয়েছিলো যে, বিষ খেয়ে মরে তাদের মুক্তি দিতে। অর্থি চুপচাপ সব শুনতো। নিরবে বসে বসে কাদঁতো। অথচ তার ভাইয়া ও তার ছোট বোন ছিলো তার বাবা মায়ের খুব আদরের। তাদের কাছে তো অর্থি ভোজাই ছিলো এতো দিন। এখন তারা মুক্ত।
কিন্তু ডিবোর্সের পর কোথায় যাবে সে? আর ডিবোর্সের কথাটা মা’কে বললে তো তো এতোক্ষনে চর থাপ্পর দিয়ে তার গাল লাল করে দিতো। মা তো তাকে বলেই দিয়েছে, ধৈর্য ধরে থাকতে। যত কষ্টই হোক না কেন, কখনো উহ্ শব্দ না করতে।
To be continue,,,,,,