চিত্তবৃত্তি শেষ পর্ব

0
816

#চিত্তবৃত্তি
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৮ ( শেষ পর্ব )

প্রকৃতিতে ঝড়ো হাওয়া বইছে। হয়তো কিছু সময়ের ব্যবধানে ঝরঝর করে বৃষ্টি নামবে। বন্ধুদের থেকে ছাড় পেয়েছে ইমন৷ ঢুকেছে বাসরঘরে। মুসকান বিছানার এক কোণে গুটিশুটি মেরে বসে। হাসফাস করছে। তার চিত্তের চঞ্চলতা টের পায় ইমন। এক চিলতে হাসি ফুটে অধর কোণে। ধীরপায়ে হেঁটে চলে আসে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর কাছাকাছি। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে পাশাপাশি বসে। একদম গা ঘেঁষে। মুসকানের হৃৎস্পন্দন থমকে যায়। থরথর করে কেঁপে ওঠে দেহখানি৷ ভুলে যায় শ্বাস নিতে। ভুলে যায় চোখের পলক ফেলতেও। শরীরের সমস্ত শক্তি ক্ষীণ হতে শুরু করে৷ একটুখানি নড়ার শক্তিও পায় না৷ লাল টুকটুকে বউয়ের এমনই অবস্থায় সহসা কানের কাছে মুখ নিয়ে মোহগ্রস্ত কণ্ঠে ইমন ডেকে ওঠে,
‘বৌমিকা…’

সমস্ত ভয়, উত্তেজনা ভুলে গিয়ে চোখ দু’টো বুজে ফেলে মুসকান। নিঃশ্বাস ফেলে ভারিক্কি। মৃদুস্বরে জবাব দেয়,
‘হুহ?’

ইমন হাসে। আড়চোখে তাকালে মুসকান দেখতে পায় সে হাসি। চকচকে দাঁত গুলো দেখে বিস্মিত হয়। লজ্জা পায়। বুকে কাঁপন ধরে। মানুষটা তো কখনো এভাবে হাসেনি। যার স্মিত হাসি দেখে তার অভ্যেস। বিয়ের প্রথম রাতে তার দাঁত বেরোনো হাসি দেখলে মনে বিস্ময় চাপা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

‘অবশেষে বধূ রূপে পেয়েই গেলাম। আজ থেকে প্রতিটা ক্ষণ তোমায় বৌমিকা রূপে পাব।’

কথাগুলো বলতে বলতে মুসকানের ডান হাত নিজের মুঠোতে নিয়ে নিল ইমন। মেহেদি রাঙা হাতের উল্টোপিঠে চুমু খেল শব্দহীন তবে গাঢ়। হাতের নড়াচড়ায় কব্জিতে থাকা চুড়ি রিনিঝিনি শব্দে মুখরিত হলো। মুসকান অনুভব করল তার হৃদয় ঘরেও রিনিকঝিনিক নৃত্য চলছে। লজ্জায় লজ্জাবতী লতার মতো জড়িয়ে যাচ্ছিল মুসকান৷ ইমন তার লজ্জা দেখতে হাত ছেড়ে কিঞ্চিৎ দূরে সরে বসল৷ এরপর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল নববধূর লজ্জা মিশ্রিত মুখপানে। ইমনের এহেন কাণ্ড দেখে তীব্র অস্বস্তি ঘিরে ধরল মুসকানকে৷ সে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারল না। চট করে ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আপনি পোশাক পাল্টে নিন। আমার শাওয়ার নিতে হবে।’

ইমন মনে মনে বলল,
‘এবার পালাবে কোথায়? পালানোর সব রাস্তা বন্ধ। আজ থেকে শুধু জব্দ করার পালা। আমার অসহিষ্ণু ভালোবাসায় সহিষ্ণু করে তোলার পালা।’

শরীর ঝাঁকিয়ে ওঠে দাঁড়াল ইমন। মনের কথাগুলো মনে চেপে রেখে মুসকানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘তোমার একাউন্টে দেনমোহরের সব টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। মোবাইল কোথায়? চেক করো।’

আচমকা ইমনের দিকে তাকায় মুসকান। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আজ ইমনকে। পরিপূর্ণতা মুহুর্তেই মানুষের মাঝে দ্বিগুণ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। ইমনেরও ঠিক যেন তাই৷ হঠাৎ আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখতে ইচ্ছে করল। কিন্তু অতি লজ্জায় তা আর সম্ভব হলো না৷ ইমন তাকিয়ে আছে। উত্তর পাবার আশায়৷ মুসকান দৃষ্টি সরিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘চেক করার প্রয়োজন নেই। আপনি বলেছেন এতেই হয়েছে।’

ইমন মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ওকে। তুমি শাওয়ার নিয়ে নাও৷ আমি রুমেই চেঞ্জ করছি।’

ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে চলে গেল মুসকান। এক এক করে সমস্ত জুয়েলারি খুলে ফেলল। শুধু ইমনের পরিয়ে দেয়া ডায়মন্ডের নোজপিন, বা’হাতে ডায়মন্ড রিং আর গলায় ডায়মন্ড পেনডেন্ট চেইন এই তিনটে খুলল না। কবুল বলার পর এক ঘর লোকের সামনে বউকে এসব উপহার দিয়েছে ইমন। পরিয়ে দিয়েছে নিজহাতে। আয়নাতে নিজেকে দেখতে দেখতে ইমনের দেয়া উপহারও ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগল। সায়রী বলেছে, এই গয়না গুলোর মতো আজ ইমনকেও তার সর্বাঙ্গে ধারণ করতে হবে৷ সে কথা মনে পড়তেই শিউরে ওঠল মুসকান৷ গাল দু’টো রক্তিম হয়ে ওঠল আবারো। একপেশে তাকিয়ে দেখল ইমন ফোন ঘাটছে। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিল সে। এরপর শাড়িতে লাগানো পিন গুলোও খুলতে শুরু করল। কাঁধে লাগানো পিন খুলতে গিয়ে ঘা খেল আচমকা। মৃদু আর্তনাদ করে ওঠলে ছুটে এলো ইমন। বিচলিত কণ্ঠে শুধাল,
‘কোথায় লাগল দেখি… ‘

ব্যস্ত ভঙ্গিতে মুসকানের হাত সরিয়ে নিজেই পিন খুলার চেষ্টা করল৷ ইমন মন দিয়ে পিন খুলছে আর মুসকান তীব্র জ্বলুনিতে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ পিন খোলা শেষে সরে যেতে চাইলেও ইমন সরতে পারল না৷ বা কাঁধে ঠিক যেখানটায় পিন লাগানো ছিল সেখানে চামড়া ভেদ করে পিনের সুচালো মাথা ঢুকে গিয়েছিল৷ ফলশ্রুতিতে নরম ত্বক কেটে রক্ত এসেছে অল্প। আজকের দিনও মেয়েটা এভাবে আঘাত পেল? বুড়ো আঙুলে আঘাত পাওয়া জায়গায় স্পর্শ করল ইমন৷ মুসকান নিঃশ্বাস আটকে সরে যেতে চেষ্টা করল। ইমন চোখ তুলে আয়নায় দেখতে পেল মুসকানের ব্যথিত মুখ। এমন ব্যথাতুর মুখ দেখে বুকের গভীরে সেও সুক্ষ্ম এক ব্যথা অনুভব করল৷ হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে আঘাত পাওয়া স্থানে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল সে। কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ নামাল। পুরুষালি পুরো ঠোঁটজোড়ায় আদর মিশিয়ে স্পর্শ করল কেটে যাওয়া স্থানে। শরীর জুড়ে তীব্র ঝংকার খেলে গেল মুসকানের। নিঃশ্বাস আঁটকে সরে গেল কিঞ্চিৎ। সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কাঁপতে থাকল তার। কাঁপন ধরল পাতলা মসৃণ ঠোঁটজোড়ায়ও। যা দেখে
ইমনের দৃষ্টি থমকে গেল। উলোটপালোট হয়ে গেল মস্তিষ্ক। বুকের ভেতর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের গর্জন ওঠল। মুসকান আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না৷ একছুটে পালিয়ে গেল বাথরুমে। কিন্তু এই পালানো কতক্ষণ? বড়োজোর একঘন্টা। এর বেশি কি? কত আর বেশি? সবশেষে আজ যে ধরা দিতেই হবে।
____

প্রকৃতি জুড়ে শুরু হওয়া দীর্ঘ বর্ষণ থেমেছে অনেকক্ষণ। চারিদিকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। এলোমেলো শাড়িতে পরিচিত বুকে অপরিচিত সুখে বিভোর মুসকান৷ শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অদ্ভুত যন্ত্রণা, বিস্ময়কর সুখ। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ইমন৷ একটু পর পর কপালে এঁটে দিচ্ছে গভীর চুম্বন। একেকটা ভারি নিঃশ্বাসে মিলছে তৃষ্ণা নিবৃত্তি। মনে মনে লাজুক হাসে মুসকান৷ একবারটি তাকাতে ইচ্ছে করে। চোখভরে দেখতে ইচ্ছে করে প্রিয়তমের প্রাপ্তি। ভালোবাসার মানুষকে সম্পূর্ণ নিজের করে পাওয়ার সুখ। কিন্তু তাকাতে পারে না৷ ভয়াবহ লজ্জায় নেতিয়ে পড়ে থাকে উন্মুক্ত বলিষ্ঠ বুকটায়। ইমনের চোখ বন্ধ, বন্ধ তার চোখও। কিন্তু ঘুম কারো চোখে ধরা দেয়নি। আকস্মিক ইমন বলে ওঠে,
‘ মুসকান, ওঠতে হবে। একসাথে নামাজ পড়ব।’

মুসকান তক্ষুনি নড়েচড়ে ওঠে। চোখ মেলে তাকায়। নিমিষে চোখ বুজে ফেলে আবার৷ ইমন যে তারপানেই তাকিয়ে। মনে পড়ে যায় সেই দুর্ধর্ষ মুহুর্তের কথা। আর চুপ থাকতে পারে না, ছটফটিয়ে ওঠে বসে। টের পায় তার অর্ধেক শাড়ি ইমনের শরীরে নিচে পড়ে আছে। লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে টানতে শুরু করে৷ ইমনের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি খেলা করে৷ মাথা ঝাঁকিয়ে ওঠে বসে সেও। টেনেটুনে বউয়ের অর্ধেক শাড়ি বের করে দেয়৷ মুসকান সেটা ধরে চট করে, বলা যায় প্রায় দৌড়েই ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। লম্বা শাওয়ার নেয়া শেষে মনে পড়ে সে পরার জন্য একস্ট্রা শাড়ি, গা মোছার তোয়ালে কিছুই আনেনি। নিজের নির্বুদ্ধিতা দেখে কান্না পায় এবার৷ শাওয়ার বন্ধ করে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রয় চুপচাপ। এমনই সময় দরজায় টোকা দেয় ইমন৷ শান্ত গলায় ডেকে বলে,

‘তোয়ালে আর কাপড় গুলো নাও। দাঁড়িয়ে আছি আমি।’

দোনোমোনো করে করে প্রায় চার মিনিট পর ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে দরজা খুলে নিজেকে আড়ালে রেখে হাত বের করে মুসকান। কিন্তু ইমন কাপড় দেয় না৷ সুযোগ নিয়ে দরজা ঠেলে চট করে ঢুকে পড়ে ভেতরে। দেখতে পায় শাড়ি বিহীন শুধু ব্লাউজ, পেটিকোট পরা সদ্য স্নাতা রমণীকে। ভেজা চুল বেয়ে টপটপিয়ে পানি ঝরছে। আচমকা গলায় চোখ পড়তেই চমকে ওঠে। তার ঠোঁটের অজস্র লালচে চিহ্ন লেপে আছে সেখানটায়। যা পানির স্পর্শে আরো গাঢ় হয়ে ওঠেছে। দ্রুত তোয়ালে এগিয়ে দেয় ইমন৷ মুসকান জড়োসড়ো হয়ে গায়ে তোয়ালে জড়াতেই ইমনের রুমের দরজায় ঠকঠক শব্দ হতে শুরু করে। মেজো কাকার আতঙ্কিত ডাক শুনতে পায়।
________
ভোর রাতে সদর হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে। চৌধুরী বাড়ির বড়ো মেয়েকে ধ র্ষ ণ করা হয়েছে। খবর পেয়ে পারভিন জ্ঞান হারিয়েছে। রাত থেকে মেয়েকে তন্নতন্ন করে খুঁজছে সে। স্বামীকে জানানোর পর বাড়ির সকলেই জানতে পারে ইয়াশফা বাড়ির কোথাও নেই৷ মেয়েটা ভীষণ বুদ্ধিমতী। রাগ করে এদিক সেদিক চলে যাওয়ার মতো মেয়ে সে নয়। দাদুভাই ভেবেছিলেন মন খারাপ তাই কোনো বান্ধবীর বাড়ি গেছে৷ এত লোক সমাগমের ভেতরে কাউকে জানাতে পারেনি। রাতটা পারভিনের তীব্র চিন্তায় কাটে। ইয়াশফার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের থেকে খোঁজ নেয় দু’জন ফোন ধরে না৷ তাই ভাবে সকালে তাদের ফোন করবে। কিন্তু সকাল হওয়ার আগেই ভয়ানক খবরটি আসে। পরিকল্পনা ছিল এই পরিণতি ঘটবে মুসকানের। পার্লার থেকে ফেরার পথে ইভানের ঠিক করা বিদেশি কিছু কুকুর পিছু নেয় চৌধুরী বাড়ির গাড়িটির৷ সময়টা সন্ধ্যা। ভারি বর্ষণ তখনো। বাড়ির সামনের পথ পুরোটাই ফাঁকা ছিল। গাড়ি থেকে বউ সাজে দু’জন বেরোয়। ভাড়া করা কিডনাপাররা মুসকানের ছবি দেখলেও সামনাসামনি ইয়াশফা আর মুসকানকে দেখে গুলিয়ে ফেলে। তারা জানত বউকে কিডন্যাপ করতে হবে। ছবিতে যে মেয়ে দেখেছিল তার গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা ছিল৷ কিন্তু যে দু’জন বউ সাজে দেখছে তারা দু’জনই ধবধবে ফর্সা। অতিরিক্ত মেক-আপের ফলশ্রুতিতে মুসকানকে চিনতে পারেনি ওরা৷ তাই যাকে বেশি সুন্দর লাগছে তাকেই বউ ধারণা করে কিডন্যাপ করে। এরপর নিয়ে যায় তাদের গোপন আস্তানায়। একঘন্টা অজ্ঞান থাকলেও জ্ঞান ফিরলে ছটফট শুরু করে ইয়াশফা। ওরা ওর চোখ, মুখ বেঁধে ফোন করে ইভানকে। সময় খুবই অল্প। যা ঘটানোর দ্রুত ঘটিয়ে পালাতে হবে৷ তাই ইভান কাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে তা দেখার সময় নেয়নি৷ তার পূর্ণ বিশ্বাস এটা মুসকানই। বউদের মতোই পোশাক। লম্বাটে গড়ন, নরম শরীর হাত৷ রাতের আঁধারে বদ্ধ রুমে এরবেশি অনুভব করার সুযোগ পায়নি ইভান৷ কেবল নিজের সকল আক্রোশ মিটিয়েছে। ইমনের মুখের খাবার কেড়ে নিয়ে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলতে চেয়েছে। চূড়ান্ত সর্বনাশ করার পরই ইভান বেঁধে রাখা মুখের কাপড় খুলে। অন্ধকার রুমের বাতি জ্বালায়। বিধ্বস্ত ইয়াশফা ইভানের মুখ দেখে নৃশংস চিৎকার দেয়। ইভানও ছিটকে সরে গিয়ে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রয়।

কী হয়েছে, কীভাবে হয়েছে সেসব ভাবার সময় নেই। নিজেকে বাঁচাতে আর ইয়াশফাকে বাঁচাতে তক্ষুনি গাড়িতে তুলে হাসপাতালের সামনে ফেলে যায় ওকে। বলার মতো কোনো ভাষা থাকে না ইভানের৷ আর ইয়াশফা? সে তো জ্ঞান হারিয়েছে ইভানের মুখ দেখার পরপরই।

প্রথমে পুরো এলাকা, সমাজের মানুষজন তারপর পুরো শহর জুড়ে ছেয়ে গেল, নিজের মা এবং চাচাত ভাইয়ের করা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ধ র্ষিত হয়েছে চাচাত বোন। ধর্ষক চাচাত ভাই নিজেই। এত বড়ো বাড়ির মেয়ে হয়ে এত সিকিউরিটি থাকা সত্বেও ধ র্ষণের মতো জঘন্য ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। নিজ চাচাত ভাই আর মায়ের করা ষড়যন্ত্রে! পাড়া – প্রতিবেশী সহ পুরো শহরের লোক যেখানে চৌধুরী বাড়ির কাজের লোক দেখেও ভয়ে থাকে চোখ তুলে কথা বলার সাহস পর্যন্ত দেখায় না কখনো সেখানে তাদের বাড়ির মেয়ের সাথে এমন জঘন্য ঘটনা ঘটে গেল। নিজের লোকেই ছুড়ির আঘাত দিল বুকে।
চৌধুরী বাড়ির সদস্য বলেই বোধহয় এমন নির্মম ঘটনা ঘটাতে পেরেছে। সব দিক খেয়াল করে বিচার বিশ্লেষণ করে কারো আর বুঝতে বাকি রইলো না কি থেকে ঠিক কি ঘটে গেছে। চোরের মতো দেশের বাইরে থেকে কুকুড়-বিড়াল ধরে এনেছিলো অন্যের ক্ষতি করার জন্য৷ শেষে নিজেরই চরম ক্ষতি হয়ে গেল। বলা যায় নিজের হাতেই এক নারী নিজ কন্যাকে ধ র্ষনের মুখে ঠেলে দিয়েছে। চেয়েছিল সতীনের মেয়ের সম্মানে আঘাত করতে। কলঙ্কিত করতে। নিয়তি বোধহয় সেটা সহ্য করতে পারেনি।
তাই যে জঘন্য ঘটনা ঘটাতে গিয়েছিলো অন্যের প্রিয়জনকে নিয়ে সেই ঘটনাটাই ঘটে গেল তারই প্রিয় কন্যার সাথে। মানুষের দ্বারা সংগঠিত জঘন্য অপরাধগুলোর মধ্যে জঘন্যতম হলো ধ র্ষণ। আর সেই ঘটনার স্বীকার যখন নিজ কন্যা, নিজের কলিজার টুকরোর সাথে ঘটে যায় সে কি ঠিক থাকতে পারে?

চৌধুরী পরিবারের সবাই মর্মাহত। পারভিন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে। মোতালেব চৌধুরী সব ঘটনার সম্মুখীন হয়ে বুকে হাত চেপে বসে পড়েছেন। বর্তমানে উনিও চিকিৎসাধীন রয়েছে। ইমন যন্ত্রণায় ছটফট করছে শারিরীক আঘাতে নয়। আদরের ছোটো বোন ইয়াশফার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা সহ্য করতে না পেরে। পুলিশ সহ মিডিয়ার লোকজন হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সকলেই বাকরুদ্ধ। এমন ঘটনা দুনিয়ার বুকে বোধহয় এই প্রথম ঘটল। সকলের মাঝে মুসকানও উপস্থিত রয়েছে। আকস্মিক তার দিকে তেড়ে এলো পারভিন। সবার সম্মুখে মুসকানের গলা টিপে ধরে বলল,

‘কালমুখী! তোর জন্য আজ আমার মেয়ের এই পরিণতি। আজ তোকে মেরেই ফেলব।’

সকলে হতভম্ব হয়ে গেলেও ইমন ক্রোধে ফেটে পড়ল। মেজো কাকির থেকে নিজের বউকে ছাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নিল। আঙুল তুলে গলা উঁচিয়ে বলল,

‘খবরদার! ওকে স্পর্শ করা তো দূরের কথা চোখ তুলে তাকাবারও সাহস করবেন না। ফারদার যদি এই অসভ্যতামো দেখি চাচার বউ বলে ছেড়ে দিব না।’

মেজো কাকিকে কথাগুলো বলেই মুসকানকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলো ইমন। কী ঘটেছে বুঝতে আর বাকি নেই। ইতিমধ্যেই ইয়াশফার জবানবন্দি নেয়া হয়ে গেছে। আর এখানে থাকার প্রয়োজন নেই তার। নিজের হাতে নিজের মেয়ের এতবড়ো সর্বনাশ করতে পারে কোনো মা? বিশ্বাস হচ্ছে না ইমনের৷ বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এই ঘটনা ঘটাতে চেয়েছিল মুসকানের সাথে! মেজো কাকির আহাজারিতে অনেক কিছুই স্পষ্ট। আজকের পর হয়তো মেজো কাকা আর কাকির সাথে সংসার করবে না৷ ইয়াশফা নিজের মাকে কখনো মা বলে ডাকবে না৷ বড়ো দুই ভাইও মাকে ঘৃণা করে কাটিয়ে দেবে সারাজীবন। সতীনের মেয়ের প্রতি হিংসা থেকে কোনো নারী এতটা নিচে নামতে পারে পারভিনকে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারত না ইমন। পুরো রাস্তা ইমনের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়েছে মুসকান। মেয়েটার মন খুব নরম। ইয়াশফাকেও সে ভীষণ ভালোবাসে। তাছাড়া যখন থেকে জানতে পারল এই ভয়ানক ষড়যন্ত্রের শিকার তার বদলে ইয়াশফা হয়েছে। তখন থেকেই পাগলের মতো ছটফট করছে। মেনে নিতে পারছে না কোনোভাবেই।

দিন পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে এলো। সারাদিন কারো পেটেই দানাপানি পড়েনি। ইয়াশফা মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হচ্ছে। পুরো বাড়িতে ইমন, মুসকান, দিহান, সায়রী আর ছোটো কাকির মেয়ে ইমা ছাড়া কেউ নেই। বাকি সবাই ইয়াশফার কাছে। ইমার কাছে সায়রী আছে। মুসকান নিজ ঘরে চুপচাপ শুয়ে ছিল৷ ইমন দিহানের সঙ্গে নিচে বসেছিল। সায়রী হালকা খাবার তৈরি করে ইমনকে বলল উপরে গিয়ে দু’জন খেয়ে নিতে। ইমন আর না করল না। সকাল থেকে না খাওয়া তারা। সে না খেয়ে শক্ত থাকলেও মুসকান পারবে না৷ তাছাড়া সারাদিনে একবারো ওর খোঁজ নেয়া হয়নি। এবার কাছে যাওয়া উচিত। দিনশেষে যা কিছু হয়েছে এরজন্য তো আসলে তারা দায়ী নয়। সবটাই করুণ নিয়তি।

নিরবে অশ্রু ঝাড়াচ্ছিল মুসকান৷ ইমন পাশে বসে বলল,
‘মুসকান, ওঠে ফ্রেশ হয়ে আসো৷ একসাথে খাব।’

মুসকানের কান্নার বেগ বাড়ল। চোখ মুছে বলল,
‘আমার খিদে নেই। আপনি খেয়ে নিন।’

হঠাৎই ভীষণ রাগ হলো ইমনের। রূঢ়ভাবে বলল,
‘এত কথা ভালো লাগছে না। আমি তোমাকে ওঠতে বলেছি৷’

বুক কেঁপে ওঠল মুসকানের। তবে কি ইমনও এইসবের জন্য তার ওপর রেগে গেল? বুক ফেটে কান্না এলো তার৷ ওঠে বসল নির্বিকার ভাবে। ইমন ওর বিধ্বস্ত মুখে তাকিয়ে চমকে ওঠল। হাত বাড়িয়ে গালে আলতো স্পর্শ করে বলল,

‘মুসকান এভাবে ভেঙে পড়ো না। আমরা যদি এভাবে ভেঙে পড়ি ইয়াশফাকে সামলাব কীভাবে?’

মুসকান ত্বরিত ওঠে ওয়াশরুম চলে গেল। দীর্ঘসময় পর চোখে মুখে পানি দিয়ে বের হলে ইমন টের পেল সে প্রচণ্ড কান্নাকাটি করে বেরিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইমন। মুসকানকে পাশে বসিয়ে নিজহাতে খাইয়ে দিতে দিতে বলল,

‘অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে সেই গর্তে নিজেকেই পড়তে হয় মুসকান।’

‘ইয়াশফা আপুর কী দোষ?’

মুসকানের ভাঙা কণ্ঠ। ইমন দৃঢ় স্বরে জবাব দিল,

‘অনেক সময় বাবা, মায়ের কর্মফল সন্তানকেও ভোগ করতে হয়।’

আর কথা বাড়াল না কেউই। মুসকানের মন, শরীর কোনোটাই ভালো ঠেকছে না টের পেল ইমন৷ তাই জোর করে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। এরপর কল করল ছোটো কাকাকে, ছোটো কাকা জানালো , মেজো কাকা সর্ব সম্মুখে মেয়েকে ছুঁয়ে তিন তালাক দিয়েছে মেজো কাকিকে। এর কয়েক সেকেন্ড পরই স্ট্রোক করেছে মেজো কাকি। দুই ছেলে এখন তাকে নিয়ে ছুটেছে ময়মনসিংহে। মাথা ধরে বসে পড়ল ইমন৷ হঠাৎ কী হয়ে গেল এসব? নিয়তি নিষ্ঠুর হয় নাকি মানুষ? আজ যা সব ঘটছে তা তো মানুষই ঘটিয়েছে। ‘যারা অন্যের ভালো চায় না, ক্ষতি চায় সবসময়, দিন শেষে তাদেরই চরম ক্ষতি হয়ে যায়। যদি তোমার মন অপরের ভালোতে না হাসে তবু কেঁদো না ভুলক্রমে৷ কারণ প্রকৃতি এবং নিয়তি ভালোর পিঠে মন্দ দানে আবারো কাঁদাবে তোমায়। চোখের পানি খুবই মূল্যবান৷ অন্যের সুখে তা ব্যয় না করে নিজের সুখের জন্য জমিয়ে রাখাই বুদ্ধিমত্তা। ‘ মেজো কাকি যদি অন্যের ক্ষতি না চেয়ে ভালো চাইত আজ কি তাকে এত বড়ো ক্ষতির মুখে পড়তে হতো? মুসকানের পিছনে না লেগে নিজেদের মতো কি ভালো থাকতে পারত না? যেচে এসে কেন বিপদ ঘটাতে গেল? আর ইভান! সেই বা কোথায়? কাকির ভাষ্যমতে কি সত্যি ইভান দেশ ছেড়েছে?

ইমন যখন নানারকম দুঃশ্চিন্তায় বিভোর। তখন ঘুমের ঘোরে ডুকরে ওঠে মুসকান৷ চমকে ওঠে ইমন। ত্বরিত কাছে গিয়ে মুসকানকে বুকে টেনে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে, কপালে চুম্বন এঁটে বলে,

‘ভয় পেয়ো না মুসকান, তুমি আমার বুকের ভেতর রয়েছ একদম ভয় পেয়ো না।’

ধীরেধীরে শান্ত হয়ে যায় মেয়েটা। ইমন আরো গভীরভাবে জড়িয়ে নেয় ওকে। কপালে, গালে এঁটে দেয় আদুরে স্পর্শ। বিড়বিড় করে বলে,
‘ভাগ্যের লিখন খন্ডানো যায় না। আমাদের মাঝে কক্ষনো কেউ আসতে পারবে না। আর না কেউ আমার থেকে তোমাকে আলাদা করতে পারবে। ওরা তোমায় কলঙ্কিত করতে চেয়েছিল মুসকান। চাঁদের ও কলঙ্ক থাকে কিন্তু তোমাকে কেউ কলঙ্কিত করতে পারেনি, আর পারবেও না। আমার থেকে তোমাকে যারা ছিন্ন করতে চাইবে দিনশেষে তারাই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। আমার তোমাকে যারা কলঙ্কিত করতে চাইবে দিনশেষে তারাই কলঙ্কের বোঝা বুকে ধারণ করবে৷ আমাদের যারা নিঃশ্ব করতে চাইবে সবশেষে তারাই নিঃশ্ব হয়ে যাবে। ওরা জানে না মুসকান তুমি আমার কে? ওরা জানে না ওরা আমার কোথায় আঘাত করতে চেয়েছিল কিন্তু সৃষ্টিকর্তা ঠিক জানতেন। তাই তো আমার এখানটায় আঘাত করতে পারেনি।’

নিজের বুকে ইশারা করে শেষ বাক্যটি আওড়াল ইমন।

| সমাপ্ত |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here