চিত্তবৃত্তি পর্ব ৫

0
884

#চিত্তবৃত্তি : ৫
#জান্নাতুল_নাঈমা
ইভানের ঘর থেকে উন্মাদের মতো নিজের ঘরে ছুটে এলো মুসকান। দরজা বন্ধ করল সজোরে। জোরে জোরে শ্বাস নিল কতক্ষণ। এরপর আচমকা বসে পড়ল মেঝেতে৷ দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে ওঠল।
বদ্ধদ্বারে মাথা ঠেস দিয়ে হুহু করে কাঁদতে লাগল সে।
গাল বেয়ে ঝরল অজস্র নোনাজলের ধারা। ক্ষণে ক্ষণে বুকের গহীন থেকে আর্তনাদের নিঃশ্বাস বেরোলো। চিৎকার করে পৃথিবীর মানুষগুলোকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল, এই পৃথিবীতে পিতা-মাতাহীন, পরিবারহীন সন্তানদের কি সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নেই? আপনারা কেন এত নিষ্ঠুর বলতে পারেন?

ইমন এলো মিনিট পাঁচেক পরেই। কলিং বেলের শব্দে ঘোর কাটলো মেয়েটার। ওড়নায় চোখমুখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল সে। ধীরপায়ে বেরিয়ে সদর দরজা খুলতেই বলিষ্ঠ দেহের ক্লান্ত সেই মুখটির দেখা মিললো। ইমন মৃদু হেসে ভেতরে প্রবেশ করল। মুসকান দরজা আটকে ডাইনিং রুমে চলে গেল। মিনিট পাঁচেক পর ফ্রেশ হয়ে এলো ইমন। দেখল খাবার বেড়ে মুসকান বিষণ্ন বদনে তার জন্য অপেক্ষা করছে। এই বিষণ্নতার কারণ কী? বক্ষঃস্থলে এহেন প্রশ্নই উঁকি দিল তার। মুখ ফুটে সে প্রশ্ন করতে পারলো না। চুপচাপ বসে খাবার খেতে লাগল। খোঁজ নিল বাড়ির সবার। মুসকান মাথা নাড়িয়ে সেসব উত্তর দিলে সহসা ইমন তার চোখের দিকে তাকাল। থমকানো স্বরে প্রশ্ন করল,

– তুমি ঠিক আছো?

চমকে ওঠল মুসকান। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা হলো। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে কাঁদতে ইচ্ছে করল খুব। নালিশ জানাতে ইচ্ছে করল, ইভান নামক জা’নো’য়ারটার নামে। সেসব ইচ্ছেকে দীর্ঘশ্বাস করে বের করে দিল। টলমল চোখ দু’টি আড়াল করে ম্লান হাসলো সে। মাথা নেড়ে বলল,

– হ্যাঁ, ঠিক আছি।

ইমনের অবচেতন মন সে কথা বিশ্বাস করল না। এক মুহুর্ত অবিশ্বাস্যের চাহনি ছুঁড়ে খেতে মনোযোগ দিল। খাওয়া শেষ করে ওঠার সময় বলল,

– তুমি ঠিক নেই। তোমার চোখ বলছে তুমি ঠিক নেই।

মুসকানের হৃৎপিণ্ডে যেন মৌমাছি কামড়ে ধরল। তীব্র কষ্টে দিশেহারা হয়ে সে সবকিছু ত্বরিতবেগে গোছাতে লাগল। তার এই দ্রুত কাজ ইমনের সন্দেহ বাড়িয়ে দিল হাজার গুণ। তার পেশবহুল শরীরটা শক্ত হলো আচমকা। চোয়াল দ্বয় হলো কঠিন। বাড়িতে ইভানের উপস্থিতি মুসকানের জন্য শুভ নয়। এ বিষয়ে সে নিশ্চিত। এই যে মুসকানের বিধ্বস্ত রূপ এর পেছনে ইভান রয়েছে এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও অনেকাংশে নিশ্চিত। মুসকান সব গুছিয়ে ইমনের সামনে থেকে পালাতে উদ্যত হলো। কিছু তো ঘটেছে, মুসকান কিছু তো লুকোচ্ছে, এই ভাবনায় বিভোর হয়ে সহসা মুসকানের বাহু চেপে ধরল সে। আঁতকে ওঠল মুসকান। চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করে মুখ ফেরালো৷ দেখতে পেলো চোখ, মুখ শক্ত করে গুমোট নিঃশ্বাস ছাড়ছে ইমন। কর্ণে পৌঁছাল ভরাট কন্ঠের বলা বাক্যটি,

– তুমি ঠিক নেই মুসকান, একদম ঠিক নেই।

সহসা দুচোখে জল ভরে ওঠল। কিয়ৎকাল পর পড়তে শুরু করল গাল বেয়ে। ইমন কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে দৃষ্টি নড়চড় করতে গিয়ে খেয়াল করল সে শক্ত হাতে মুসকানের যে হাত ধরে রেখেছে তার কব্জিতে লালচে দাগ! আর এই দাগে দু’টো আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। এ দৃশ্য দেখে ইমনের চিত্ত চঞ্চল হলো। দৃষ্টিতে বাড়ল অস্থিরতা। কণ্ঠে ব্যগ্রতা। ধীরেধীরে তার হাত মুসকানের কব্জিতে স্পর্শ করল। লালচে দাগে বুড়ো আঙুলে ঘষা দিয়ে বলল,

– এই স্পর্শ কার মুসকান! ইভান?

ঝটকায় হাত সরিয়ে নিল মুসকান। ডুকরে ওঠে অনুরোধ করল,

– প্লিজ, আপনি উনাকে কিছু বলবেন না। আমাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোনো ঝামেলা করবেন না।

ইমনের সমস্ত শরীর ক্রোধে কাঁপতে শুরু করল। চোখ দুটো হলো রক্তিম। ক্রোধে রিরি করে বলল,

– বলব না মানে ওকে আমি একেবারে শেষ করে দিব। এমন হাল করব যে ফারদার, তোমার সঙ্গে বাজে আচরণ তো দূরে থাক চোখ তুলে তাকাবেও না!

মুসকান ভয়ে শিউরে ওঠল। হাতজোড় করে বলল,

– প্লিজ না।

– কেন না কেন? যাতে পরবর্তীতে এরচেয়েও ভয়ানক কিছু ঘটাবার সাহস পায়? তুমি ওকে কেন সুযোগ দিতে চাচ্ছ হুয়াই?

চিৎকার করে ওঠল ইমন৷ মুসকানের শরীর তীব্র আতঙ্ক কাঁপতে শুরু করল। অনুনয় করে ইমনকে বলল,

– না আমি উনাকে আর কোনো সুযোগ দিব না।
আমি আর এ বাড়িতে থাকতে চাই না ছোটোসাহেব।
আমি এ বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাব। না আমি থাকব এ বাড়িতে আর না ইভান ভাই কোনো সুযোগ পাবে!

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না ইমন। এমনভাবেই চমকাল সে। মুসকানের দিকে তাকাল দুচোখে বিস্ময় ভরে। মুসকান বলতেই থাকল,

– এই বাড়িতে আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে ছোটোসাহেব। আমি শুনেছি অনাথ আশ্রমেও এতিম বাচ্চাদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকতে দেয়া হয়। সে হিসেবে আমার সময় সত্যি শেষ। দাদুভাই, এ বাড়ির প্রত্যেকে অনেক করেছে আমার জন্য৷ এবার সময় এসেছে আমার চলে যাবার৷

– মুসকান!

– হ্যাঁ আমি যা বলছি সব ভেবেচিন্তে বলছি। একদিন না একদিন তো এটা হওয়ারই ছিল।

– না হওয়ার ছিল না।

ইমনের কণ্ঠে ক্রোধ স্পষ্ট। মুসকান প্রতিবাদ করে বলল,

– এটাই হওয়ার ছিল ছোটোসাহেব।

সহসা ইমন যেন নিভে গেল। এমন দৃষ্টিতে তাকাল। মুসকান সে দৃষ্টি খেয়াল করে ম্লান হেসে বলল,

– দাদুভাই আর আপনার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। এরজন্য চিরকৃতজ্ঞ থাকব। যদি কখনো সুযোগ, সামর্থ্য হয় এই ঋণ আমি শোধ করব।

– কোনটাকে ঋণ বলছ? এ বাড়ি থেকে যা কিছু পেয়েছ সবটাই তোমার পরিশ্রমের মূল্য। এটাকে ঋণ বলে না এটাকে তোমার ন্যায্য পাওনা বলে। আর যদি আমার আর দাদুভাইয়ের কথা বলো। তাহলে তোমার কাছে আমার প্রশ্ন ভালোবাসার ঋণ কি কখনো শোধ করা যায়?

বুকটা ধক করে ওঠল মুসকানের। ইমন তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে। হৃদয় চিড়ে আজ কথাটা বেরিয়েই এলো তার৷ কিন্তু মুসকান কি বুঝতে পারলো?

মুসকান বলল,

– সেই ঋণ কখনো শোধ করা যায় না। এরজন্য আপনারা দু’জন সব সময় আমার হৃদয়ে শ্রদ্ধা পাচ্ছেন, পাবেনও। কিন্তু কখনো কোনোদিন যদি আমাকে দিয়ে আপনাদের কোনো উপকার হয় নিশ্চয়ই করব।

আহত বদনে তাকিয়ে রইল ইমন৷ মুসকান ভাবলেশহীন হয়ে তার সম্মুখ থেকে প্রস্থান করল। ইমন নিজের সমস্ত ক্রোধ এবার উগড়ে দিল দেয়ালে। হাত মুঠো করে সজোর দেয়ালে আঘাত করল বারকয়েক!
.
.
নিজের কয়েকজন বান্ধবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে মুসকান। ছোটোখাটো যাই চাকরি হোক করতে চায় সে। থাকার মতো একটি নিরাপদ আশ্রয়ও লাগবে। এরজন্য আগে চাকরি প্রয়োজন। চাকরি ছাড়া, শূন্য হাতে থাকার জায়গা কে দেবে তাকে? তার ওপর একা মেয়ে মানুষ। পথটা খুব একটা সুগম হবে না। সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী তার অবস্থা বুঝে আশ্বাস দিল। সে যে করেই হোক সাহায্য করবে। প্রয়োজনে তার কাছে গিয়ে কিছুদিন থাকারও প্রস্তাব দিল৷ কারণ বান্ধবীটি বিবাহিত। রিলেশনের করে বিয়ে করেছে। হাজব্যান্ড পুলিশে জব করে। থাকে কুমিল্লা। আর সে তার বিধমা মাকে নিয়ে শান্তিমহলে দুই রুমের একটি বাসা ভাড়া করে থাকে। মুসকান সে প্রস্তাব পেয়ে ভীষণ আবেগি হয়ে পড়ে। জানায়, যদি প্রয়োজন পড়ে অবশ্যই যাবে। মুসকান রাতে যেই ভয়াবহ কথা জানিয়েছে। সেই কথা ইমনের ঘুম হারাম করার জন্য যথেষ্ট ছিল। তাই সে সাতসকালে চলে গেছে দাদুভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। সে জানতো ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতে এক দাদুভাইই তাকে সাহায্য করতে পারে। দাদুভাইয়ের কাছেই রয়েছে তার জীবনে বয়ে চলা সকল সমস্যার সমাধান। দাদুভাইয়ের থেকে সমাধান নিয়ে বাড়ি ফিরল ইমন৷ সিদ্ধান্ত নিল খুব তাড়াতাড়ি মুসকানকে দাদুভাইয়ের কথাটা জানাবে।
.
এরই মধ্যে নির্ভেজাল দু’দিন কেটে গেল। তৃতীয় দিন স্কুল ছুটির পর ইমন বাড়িতে এসে দেখে বাড়ির পরিবেশ বেশ থমথমে। ইয়াশফার মুখে কান্নার ছাপ স্পষ্ট। মেজো কাকি নিঃশব্দে ঘরের কাজ করছে। ছোটো কাকি আজ অসময়ে বাড়িতে। বসার ঘরে মেজো কাকাও উপস্থিত। এরূপ পরিবেশের অর্থ খুঁজে পেলো না ইমন। বড়ো ভাই অর্থাৎ, মেজো কালার বড়ো ছেলে ইমরান কিছুদিন আগে চাকরির সুবাদে ঢাকা চলে গেছে। ছোটো ছেলে আনিস পড়াশোনা করে বেকার জীবন পার করছে। মাঝেমধ্যে তাকে নিয়ে বাড়িতে গণ্ডগোল হয়। নেশাদ্রব্য পান করে বলে! আনিস ভাই কোনো গণ্ডগোল করল না তো? ইমনের মনে প্রশ্ন জাগে৷ তৎক্ষনাৎই মনে পড়ে বাড়িতে কিছু ঘটলে অভ্র তাকে জানায়। তাহলে আজ কেন জানালো না? ভ্রু কুঁচকে চুপচাপ নিজের ঘরে আসে সে। কল করে অভ্রকে। অভ্রর ফোন বন্ধ। সে এবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ছোটো হোন ইমাকে ডেকে পাঠায় উপরে। জিজ্ঞেস করে,

– কী হয়েছে বল তো?

– কী আর হবে মুসকান চলে গেছে! জানো কী করেছে ও? ইভান ভাইয়া এক গ্লাস পানি চেয়েছে বলে চড় মেরেছে। চড় খেয়ে রেগে ভাইয়াও ওকে চড় দিয়েছে। বাড়ির কেউ ওকে সাপোর্ট করেনি বলে দেমাগ দেখিয়ে বেরিয়ে গেল!

ইমার কথার ধরন সেই সঙ্গে মুসকানের চলে যাওয়ার কথা ইমনকে যেন কাঁচের টুকরোর ন্যায় ভেঙে চুরমার করে দিল। সে ধমকে ওঠল ইমাকে বলল,

– ইমা কথার ধরন ঠিক কর। বয়সে মুসকান তোর ঢেড় বড়ো।

ধমক খেয়ে ছুটে পালালো ইমা। ইমন দু’হাতে নিজের মাথার চুল খামচে ধরল। হন্যে হয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। নামল নিচে। দিকবিদিকশুন্য হয়ে চিৎকার করে বলল,

– ইভান কোথায়?

বাড়ির সবাই একসঙ্গে কেঁপে ওঠল। মেজো কাকা বলল,

– ইমন তুই সবটা শুনে রিয়াক্ট করবি।

– ব্যস আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। এতক্ষণ যখন কেউ কিছু বলোনি এখনও বলতে হবে না।

কথাটা বলেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। ইভান কোথায় এটা জানার থেকেও বেশি জরুরি মুসকান কোথায় এটা জানা। বুদ্ধিজ্ঞান সম্পন্ন ইমন চৌধুরীর খুব বেশি সময় লাগেনি। মুসকানের লোকেশন বের করতে। সে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে মুসকানের বান্ধবী লিয়ার বাসায়। মুসকান ইমনকে দেখে কিছুটা অবাক হয়েও নিজেকে সামলে নিয়েছে। নেভি ব্লু রঙের থ্রিপিস পরিহিত মুসকান। গাঢ় নিল রঙের সূতি ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দেয়া। বসে আছে লিয়ার বিছানার এক কোণে। ইমন লিয়ার অনুমতি নিয়েই বিছানার আরেক কোণে মুসকানের সম্মুখীন হয়ে বসল। লাল লাল দু’টো চোখ দিয়ে স্থবির হয়ে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। বলল,

– ও বাড়ি যেতে হবে না মুসকান। তুমি শুধু আমার সঙ্গে চলো।

চমকে ওঠল মুসকান। ইমনের ঐ দৃষ্টিতে চোখ রাখতে পারলো না সে। নত করে ফেলল মস্তক। বলল,

– আমার জীবনটাকে আমার মতো করে গুছিয়ে নিতে দিন। আপনি চলে যান। আপনাদের কারো দয়া নিয়ে আমি আর বাঁচতে চাই না।

– আমি তোমাকে দয়া করছি না মুসকান।

কিঞ্চিৎ দৃঢ়তার সঙ্গে কথাটা বলল ইমন। মুসকান নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইল। কিয়ৎক্ষণ পর ইমনের ফোনে কল এলো দাদুভাইয়ের। ইমন ফোন রিসিভ করেই বলল,

– দাদুভাই ওকে পেয়েছি প্লিজ তুমি বোঝাও।

কথাটা বলেই ফোন মুসকানের কাছে দিয়ে দিল। দাদুভাই! নিজেকে আর সংযত করতে পারলো না মুসকান। ফোনটা কানে ধরে কেঁদে ফেলল সে। মোতালেব চৌধুরী অতি দরদি কণ্ঠে বললেন,

– গিন্নি…

ফুপিয়ে ওঠল মুসকান। মোতালেব চৌধুরী পুনরায় ডাকলেন,

– ও গিন্নি কখন আসবেন আপনি? তাড়াতাড়ি আমার কাছে চলে আসুন তো। আপনি না এলে আজ চাল ফুটবে না। আমার পেটেও অন্ন পড়বে না। এই বুড়ো বয়সে না খেয়ে খেয়েই বুঝি অক্কা পাবো!

মুসকান কেঁদেই চলল। ইমন হাত বাড়িয়ে তার থেকে ফোনটা নিয়ে কেটে দিল। বলল,

– আমি অপেক্ষা করছি।

বেশ অনেকটা সময় পর নিজেকে সামলে নিয়ে বেরিয়ে এলো মুসকান। হাতের ব্যাগটা দৌড়ে এসে নিল দিহান। বলল,

– আরে মুসকান এমন পাগলামি কেউ করে? ও বাড়ি ছেড়েছ যখন আমার বাড়ি আসতে। কত দৌড়ঝাঁপ করালে বলো তো। ভাই থাকতে কেউ বান্ধবীর বাড়িতে আসে?

ইমন নিজের বাইকের পেছনে বসতে ইশারা করল মুসকানকে। মাঝপথে হঠাৎ বাইক থামিয়ে শুনশান এক রাস্তায় দাঁড়াল ইমন। কয়েক পল পর দিহানের বাইক এসেও থামল। ইমন মুসকানকে বলল নেমে দাঁড়াতে। ভ্রু কুঁচকে নেমে দাঁড়াল মুসকান। ইমন তার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে কল করল, বাবাকে। মোজাম্মেল চৌধুরী উৎকন্ঠিত চিত্তে প্রশ্ন করলেন,

– ইমন তুমি কোথায়? মুসকানকে পেয়েছ?

– হ্যাঁ বাবা।

সমস্ত উত্তেজনা কমে গেল মোজাম্মেল চৌধুরীর। ইমন টের পেয়ে মুসকানের দিকে তাকাল। মুসকান অবুঝ চোখে তার দিকেই তাকিয়ে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ওরা। পাশ দিয়ে যাচ্ছে একটা, দুটো, করে অগণিত গাড়ি। ইমন এক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে তার উত্তেজনা বাড়াতে সহসা বলে ওঠল,

– বাবা আমি মুসকানকে বিয়ে করতে চাই৷ মুসকান রাজি থাকলে শিঘ্রই ওকে আমি বিয়ে করব!

মোজাম্মেল চৌধুরীর অনুভূতি বুঝে বাঁকা হাসলো ইমন। এদিকে ইমনের মুখে এমন ভয়াবহ কথা শুনে মুসকানের হাঁটু কাঁপতে শুরু করেছে। দুই কান দিয়ে বেরুচ্ছে গরম হাওয়া। নিঃশ্বাসের বেগ বেড়ে অস্থির হয়ে পড়ল সে। ঘামতে শুরু করল তিরতির করে। ওদিকে মোজাম্মেল চৌধুরী তীব্র উত্তেজিত হয়ে বললেন,

– এটা কিভাবে সম্ভব ইমন মেয়েটার কোনো বংশ পরিচয় নেই। আমাদের বাড়ির সামান্য গৃহকর্মী।
তোমার মাথা ঠিক নেই ইমন একদম ঠিক নেই৷ তুমি সুস্থ মাথায় এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারো না।

– তুমি তো জানতে এইদিনটা আসবে। তাহলে আজ কেন মেনে নিতে পারছ না?

বাবা, ছেলের লুকোচুরি অবশেষে ধরা পড়েই গেল! ভেবেই দুচোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মোজাম্মেল চৌধুরী। তিনি আহত কণ্ঠে বললেন,

– এ হয়না ইমন। চৌধুরী বাড়ির মান সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। সমাজে আমরা মুখ দেখাতে পারব না৷ তুমি আমার একমাত্র ছেলে তুমি এমনটা করতে পারো না বাবা। তুমি এই কাজ করলে আমাকে অগণিত সমালোচনার মুখে পড়তে হবে।

– বাবা সমাজের মানুষদের কাজই তো সমালোচনা করা। তারা ভালো হলেও সমালোচনা করবে। মন্দ হলেও করবে। তাদের সমালোচনার ভয়ে আমি আমার নিয়ম, আমার ইচ্ছে, আমার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলতে পারিনা। ঐ বাড়িতে মুসকান সেভ নয়। তাই ও বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। কিন্তু বাবা ঐ বাড়িতে মুসকান ছাড়া আমার নিঃশ্বাস নেয়া অসম্ভব। তাই
যতো তারাতাড়ি সম্ভব বৈধ ভাবে ওকে ও বাড়িতে, নিজের কাছে রেখে দিতে চাই। এতে এই সমাজ পরিবারের লোক যাই ভাবুক না কেন যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি ঠিক খুশি হবেন। একটা এতিম মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করা অন্যায় বা ঘৃণার কাজ হতে পারে না।

– কিন্তু ওর পরিচয়? কে জানে ও কারো জার…।

বাকিটুকু শুনতে চাইল না ইমন। দুচোখ বন্ধ করে ফোনটা কেটে দিল। মুসকানের বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল সহসা। মুসকান বিস্ময়ান্বিত কণ্ঠে বলল,

– এটা হয় না ছোটোসাহেব। আপনি আমাকে বিয়ে অসম্ভব। এটা কেউ মানবে না কেউ মেনে নেবে না। তাছাড়া…

– তাছাড়া কি মুসকান? তুমি রাজি হবে না?

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল মুসকান। কী বলবে সে কী উত্তর দেবে? বুঝতে পারলো না। সবটা কেমন গুলিয়ে গেল তার। দিশেহারা হয়ে চারপাশে তাকাল। চারিদিকের ঘন অন্ধকার যেন জাপটে ধরল তাকে।

ইমন ক্ষীণ স্বরে হঠাৎ বলল,

– ভয় নেই মুসকানের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই হবে না।
যেদিন মুসকান চাইবে সেদিনই ইমন চৌধুরি তাকে বৈধ স্বীকৃতি দেবে!

– কিন্তু এই সমাজ আমার এত সুখ সহ্য করবে না ছোটোসাহেব!

কথাটা বলেই ক্লান্ত দেহে বসে পড়ল মুসকান। ইমন ওকে ধরতে গিয়েও ধরল না৷ নিঃশব্দে নিজেও বসে পড়ল পাশে। দিহান ওদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে দেখছে আকাশে তারার মেলা। বন্ধুর দিকে মনোযোগ না দিয়ে সে আকাশের তারাদের দিকে মনোযোগ দিল।

ইমন বলল,

– সমাজ কি চায় সেটা নিয়ে আমি ভাবি না মুসকান।
আমি ভাবি আমি কি চাই। সমাজ কি বলবে, আমার জীবনে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা সমাজের চোখে কেমন দেখাবে তা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। আমার জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে নিজের সব সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিয়েছি। নিজের জীবনের কিছু সিদ্ধান্ত অন্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে বুঝতে পেরেছি অন্যরা কখনো আমার জীবনের সিদ্ধান্ত ঠিক ভাবে নিতে পারবে না। কারন আমাকে আমার থেকে বেশি কেউ চেনে না, আমাকে আমার থেকে বেশি কেউ ভালোবাসেনা। পরিবার, সমাজ শুধু তাদের সিদ্ধান্ত মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের জন্য মানুষের জীবনে যখন কোন দূর্ঘটনা ঘটে যায় তখন তার দায়ভার তারা নিতে আসেনা বরং তারা আঙুল ওঠিয়ে প্রশ্ন করে এমনটা কেন হলো, প্রশ্ন করা ছিঃ ছিঃ করা ছারা তারা আর কিছুই করতে পারেনা। হ্যাঁ আরেকটা জিনিস বলতে পারে খুব সহজ ভাবেই ভাগ্যে ছিলো তাই হয়েছে। ভাগ্যে কেন থাকবে নিজের ভাগ্য কে নিজে তৈরি করে নিতে দেবে না কেনো এই সমাজ, এই পরিবার? কেন তাদের এতো বাড়াবাড়ি, কেনো তাদের এতো কৌতূহল মানুষের জীবন নিয়ে? উপরওয়ালা কি এই সমাজ, এই পরিবারের লোকদের নির্দেশ দিয়েছে অন্যের জীবনে নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার? সমাজের মানুষদের দায়িত্ব দিয়েছে অন্যের জীবনের ভালো-মন্দ নিয়ে রাতদুপুর সমালোচনা করার?
উপরওয়ালা যেটা আদেশ করেছে মানুষ সেটাই অমান্য করে আর যা নিষেধ করেছে মানুষ সেটাই করে বেড়ায়। কই কোনো অসহায় মানুষের পাশে গিয়ে তো কাউকে দাঁড়াতে দেখিনা বা বিপদগ্রস্ত মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে দেখিনা। অথচ কারো জীবনে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটা ঘটে গেলেই শুরু হয়ে যায় নানারকম নেগেটিভ সমালোচনা। এই সমাজের মানুষদের মাঝে কোন পজিটিভ ভাবনাই নেই। তারা সবসময় মানুষের দোষ, খুঁত ধরা নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাই আমি এই সমাজের মানুষদের কাছে, বা আমার নিজের পরিবারের কাছে কোন পজিটিভ ভাবনা আশা করিনা, তাদের থেকে কোন প্রকার সাপোর্ট আশা করিনা। হাজারো দুঃখ, কষ্টের মাঝে ডুবে থাকলেও কেউ এসে ভরসার হাত বাড়িয়ে দেয় না। কেউ দূর থেকে ইনজয় করে কেউ কাছ থেকে ইনজয় করে।
কখনো কখনো নিজের রক্তের সম্পর্কের মানুষ রাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ইউ আর ফিনিশড, ইউর এক্সজিসটেন্স ইজ ওভার। নিজের আপন লোকরাও হয়ে ওঠে পর,স্বার্থপর, বেইমান। আর কখনো কখনো পর হয়ে ওঠে আপন।

অন্ধকার রাত। থেকে থেকে দু একটা গাড়ি আসছে, যাচ্ছে। সেই আসা যাওয়া গাড়ির আলোতে মুসকান ইমনকে দেখছিল। মন দিয়ে শুনছিল তার প্রতিটা কথাই। আপনমনে প্রশ্ন জাগল, এই মুহুর্তটা কি সত্যি? তার জীবনে সত্যিই কি এমন কিছু ঘটছে? ছোটোসাহেব যাকে এতকাল দুচোখে শ্রদ্ধা ভরে দেখেছে। যে মানুষটা তার জীবনের প্রতিটা খারাপ সময়ে ঢাল হয়ে পাশে থেকেছে। ঐ মানুষটা, আল্লাহ দেয়ার অশেষ রহমত তাকে সারাজীবনের সঙ্গী করতে প্রস্তাব দিচ্ছে? কিন্তু কেন? এর পেছনের কারণটা কী? ভালোবাসা নাকি দয়া? সহসা মুসকান অনুভব করল একটি পুরুষালি অঢেল নিশ্চয়তা ভরে তাকে স্পর্শ করেছে। তার নরম হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ভরসা দিচ্ছে। ইমনের হাতের মুঠোয় থাকা নিজের হাতটা আলগোছে ছাড়িয়ে নিল সে। কিঞ্চিৎ সরে বসে ঢোক গিলল। নম্র স্বরে বলল,

– আমাকে সময় দিন ছোটোসাহেব।

ইমনের থেকে সময় নিল মুসকান। যে বাড়ির কাজের লোক পরিচয়ে সে বড়ো হয়েছে। সে বাড়ির বউ পরিচয় পাওয়ার পেছনের রহস্যটা কী? সে জানতে চায়। বুঝতে চায় ইমন চৌধুরী, ছোটোসাহেব তাকে অনাথ বলে দয়া করছে নাকি সত্যিই ভালোবাসা নামক অমূল্য রত্নটা তার কপালে আছে। ইমন বলল,

– মুসকান ও বাড়িতে কী হয়েছিল? অভ্রর ফোন কেন বন্ধ? সবটা আমি জানতে চাই। তার আগে আমাদের দাদুভাইয়ের কাছে যেতে হবে।

সহসা অভ্রর কথা মনে পড়ল মুসকানের। তার মতো করেই আজ অভ্র ভাইও বাড়ি ছেড়েছে। এ কথা কি ছোটোসাহেব জানে না?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here