#চিত্তবৃত্তি
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২১
জীবনের সব জটিলতা গুলো হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে যেতে পারে না? উড়ে যেতে পারে না শিমুল তুলোর মতো?
শেষ বিকেল। ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে মুসকান। বৃষ্টির পর মুহুর্তে প্রকৃতি বিলাস করতে ভালোবাসে সে। দুপুর থেকে ঝুম বৃষ্টি ছিল। যতক্ষণ বৃষ্টি পড়ছিল ঠিক ততক্ষণ সময়ই বসে ছিল রুমে। জানালার পাশে। আকাশ চিড়ে বৃষ্টি ফোঁটাদের মৃত্তিকা ভেজানো দৃশ্য দেখেছে মন ভরে। বৃষ্টি থামতেই ছুটে চলে এসেছে ছাদে। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ দেখতে। বিষণ্ন হৃদয় থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। হিসেবনিকেশ করল জীবনের জটিলতা। সবকিছু হঠাৎই কেমন বদলে গেল। চেনা ঘরটা হলো আরো চেনা। চেনা মানুষ গুলো হয়ে ওঠল আপন থেকেও বড়ো বেশি আপন। তার নিঃসঙ্গ পৃথিবীটায় আজ সঙ্গের অভাব নেই। গতকাল সন্ধ্যায় ইমনের বাবা। তার বড়ো চাচা মোজাম্মেল চৌধুরী এসেছেন। স্ত্রী, কন্যা সহ। বাড়ির গৃহপরিচারিকাকে ছেলের বউ করতে ঘোর আপত্তি থাকলেও ছোটো ভাইয়ের মেয়েকে ছেলের বউ করতে আপত্তি নেই বড়ো চাচার। যেখানে তার একমাত্র পুত্র ভালোবাসে মুসকানকে৷ সেখানে আর আপত্তি করে লাভ নেই। যা নিয়ে আপত্তি ছিল তা মিটে গেছে এখন৷ ইমন চৌধুরীর বউ হওয়া নিয়ে এ বাড়ির কারোরি আর আপত্তি নেই। এ বাড়ির মেয়ে হিসেবে তাকে মেনে নিতে পারছে না শুধু ইয়াশফা আর মেজো কাকিই। ভাই দু’জন এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি৷ মেজো কাকি এখনো বাপের বাড়ি থেকে আসেনি। ইয়াশফা সেই যে ঘরমুখো হয়েছে। প্রয়োজন ব্যতীত না বের হচ্ছে আর না কথা বলছে কারো সাথে। মুসকানের মুখ দর্শনও করেনি সে। অথচ এতকাল অন্যান্যদের চেয়ে ইয়াশফাই তাকে বেশি ভালোবাসত। আকস্মিক ধাক্কাটা সামলাতে সময় লাগবে। জানে মুসকান। তাই কারো প্রতিক্রিয়াতেই তার খারাপ লাগছে না। এই যে সবাই তাকে বাড়ির মেয়ে বলে এত খাতির যত্ন শুরু করেছে। এ ব্যাপারটা নিয়েও মনে মনে অস্বস্তিতে ভুগছে। ইভান, ছোটো চাচি, দাদুভাই সবাই তাকে নিচতলা থেকে উপরতলার ঘরে ওঠতে বলেছিল। সে রাজি হয়নি। ইমন নিষেধ করেছিল কারণ টা আসলে এমন নয়৷ এত বছর যে ঘরে থেকেছে। সে ঘরকে অসম্মান করতে পারেনি। ত্যাগ করতে পারেনি বহু বছরের মায়া। সেই সাথে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে বিলাসবহুল রুমের প্রতি তার কোনো লোভ নেই। সে আগে যেমন সাধারণ জীবনযাপন করেছে এখনো ঠিক তাই করবে৷
গতকাল রাতে বাড়ির তিন ছেলে আর দাদুভাই বৈঠক করেছেন। সেখানে ইমনও উপস্থিত ছিল৷ মুসকানের সাথে তার বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা এগিয়েছে। এখন পর্যন্ত মুসকানের সাথে এ বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলেনি৷ কিন্তু মুসকান অপেক্ষা করছে কেউ তার সঙ্গে কথা বলুক। অন্তত দাদুভাই। এতে নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে সুবিধা হবে। সবার মতো ইমনও হয়তো ভাবছে মুসকান এবার তাকে স্বচ্ছন্দে বিয়ে করতে রাজি হবে। তার ভাবনাটা ভুল। মুসকান রাজি হবে না। ইমনের ভুলটা সে ভাঙাতে চায়। জানাতে চায়, বোঝাতে চায় বিয়েতে রাজি হওয়ার মতো কোনো ঘটনাই ঘটেনি। সে এ বাড়ির মেয়ে। এই সত্যিটা প্রকাশের সঙ্গে তাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা চৌধুরী বাড়ির মেয়ের পরিচয় কারো যোগ্যতা হতে পারে না৷ এই সত্যিটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে সবাইকে। রুদ্ধশ্বাস ফেলল মুসকান। পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘ আমি খুব দুঃখীত ছোটো সাহেব। ‘
***
‘ মুসকান আপু, তোমাকে ডাকছে। ‘
ইমার কথায় রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এলো মুসকান। দেখতে পেল, দাদুভাই, ইমন আর বড়ো চাচা বসে আছেন। সে উপস্থিত হতেই দাদুভাই পাশে বসতে বলল। মুসকান নিঃশব্দে বসলে মোজাম্মেল চৌধুরী সরাসরি বললেন,
‘ পুরোনো দিনে যা কিছু ঘটে গেছে তা মনে রেখে লাভ নেই। অতীতকে আঁকড়ে থাকলে সামনে আগানো যায় না। তুমি আমার ভাইয়ের মেয়ে। এ বাড়িরই অংশ। ইমনের ব্যাপারে নতুন করে বলার নেই। তোমাদের মধ্যে বোঝাপড়া আছে তাই বেশি কিছু ভেঙেও বলতে হবে না। আমরা তোমাদের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে চাই৷ তোমার নিশ্চয়ই আপত্তি নেই? ‘
নড়েচড়ে বসল মুসকান। আড়চোখে একবার দেখে ইমনের দীপ্তিমান চোখদুটোতে। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ছটফট করতে থাকা হৃৎপিণ্ড চেপে ধরে শ্বাস রোধ করে বলল,
‘ আপত্তি আছে। ‘
বিস্মিত হলো মোজাম্মেল চৌধুরী। হতভম্ব হলো ইমন। দাদুভাই নির্লিপ্ত। মুসকান সকলের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে দম ছাড়ল। ঢোক গিলে বলল,
‘ আমি এখন বিয়ে করতে চাই না৷ শুধুমাত্র এ বাড়ির পরিচয় নিয়ে আমি কারো জীবনে প্রবেশ করতে চাই না। ‘
দাদুভাই, বাবা দু’জনকে উপেক্ষা করে ইমন সরাসরি দৃষ্টিতে মুসকানের দিকে তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টির কবলে পড়ে মুসকানের হৃৎস্পন্দনে কম্পন শুরু হলো। তবু দমে রইল না। স্পষ্ট গলায় বলল,
‘ ছোটো সাহেবের যোগ্য না হয়ে তাকে স্বামী রূপে গ্রহণ করতে পারব না আমি। ‘
‘ তুমি কি পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করতে চাইছ? ‘
মাথা ঝাঁকাল মুসকান। বলল,
‘ নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে কারো জীবনে ঢুকতে চাইছি না। ‘
কেন যেন মুসকানের সিদ্ধান্ত মনে ধরল মোজাম্মেল চৌধুরীর। এবার তার সত্যি সত্যি মনে হলো মুসকান তাদেরই বংশধর। দম আছে মেয়েটার। চোখ দু’টোতে আগুন আছে৷ ঠিক তার মায়ের মতো আগুন৷ যে আগুনে জ্বলেপুড়ে তারা দু’ভাই খাঁটি হয়েছে। দূর্ভাগ্যবশত একজন হতে পারেনি। সে হতে পারেনি বলেই আজ মুসকান তাদের বংশের অংশ হয়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মোজাম্মেল চৌধুরী। বলল,
‘ এমন একটি সিদ্ধান্ত তুমি নেবে অভাবনীয় ছিল। আমরা সব সময় তোমার পাশে আছি। ক্যারিয়ারে ফোকাস করো। ‘
মোজাম্মেল চৌধুরী কথাগুলো বলে ইমনের দিকে তাকাল৷ দাদুভাইও ইমনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ইমনের দৃঢ় চাউনি তখনো মুসকানের দিকে স্থির। মুসকান লক্ষ্য করল ঠিকি কিন্তু বুঝতে দিল না কাউকেই। মোজাম্মেল চৌধুরী তখন ছেলেকে বললেন,
‘ওর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো উচিত। এছাড়া আমার মনে হয় তোমারো নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করা উচিত। যা করছ এটাই শেষ নয় বরং শুরু। আমি তোমাকে আরো বড়ো পর্যায়ে দেখতে চাই। তুমি আমার গোল্ড চাইল্ড ইমন। তোমাকে আমি কাপরাম হিসেবে দেখতে চাই না। ‘
ইমন একই স্থানে একই রূপে বসে। মোজাম্মেল চৌধুরী কথা শেষ করে ওঠে দাঁড়ালেন। বলা যায় স্পেস দিলেন ছেলেকে। বাবাকে ইশারায় বললেন, ওদেরকে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে দেয়া উচিত। বাবা, ছেলে কয়েক পল সময়ের মধ্যেই ড্রয়িং রুম থেকে সরে গেল। জগতের সকল অস্বস্তি জাপ্টে ধরল মুসকানকে। ইমনের দৃঢ় দৃষ্টি তার বুকের ভেতর অজানা ভয়ের জন্ম দিল। বুকের ভেতর বাজনা বাজল দ্রিমদ্রিম। ওঠে চলে যাবে নাকি বসেই থাকবে? ইমন কি কিছু বলবে তাকে? বিপাকে পড়ল খুব৷ এক সময় মনস্থির করল ওঠেই যাবে। ঠিক সেই মুহুর্তেই ইমন বলল,
‘ আমি শুধু তোমাকেই চেয়েছিলাম। তোমার পরিচয়, যোগ্যতা কোনো কিছু নয়। যদি পরিচয়, যোগ্যতাই ম্যাটার করত তাহলে বহু অপশন ছিল। তুমি সবার কথা ভাবলে এক আমি ছাড়া। তুমি সবাইকে গুরুত্ব দিলে শুধু আমি ছাড়া। কতটা ভেলুলেস আমি তোমার কাছে হাহ! ‘
কণ্ঠে দুঃখ, কষ্ট, অভিমান নাকি তীব্র রাগ? বুঝতে পারল না মুসকান। শুধু বুকের ভেতর চিনচিনে এক ব্যথা সৃষ্টি করল ইমনের কণ্ঠে বলা একেকটা বাক্য। কয়েক মুহুর্ত নীরবতায় কাটল ওদের। মুসকান থমথমে মুখে তাকাল ইমনের দিকে৷ ইমন ওর চোখে আর চোখ রাখল না। দৃষ্টি ঘুরিয়ে মেঝেতে স্থির রাখল। আকস্মিক ফিচেল হাসল সে। যে হাসি দেখে মুসকানের বুক ধক করে ওঠল। ইমন একই ভঙ্গিতে আসক্তিহীন গলায় বলল,
‘ ভালোবাসা শব্দটার গভীরতা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই মুসকান। আর যার মাঝে ভালোবাসা নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। সে আমার জন্য নয়। তুমি আমাকে ভালোবাসোনি। আমি ভুল। ইয়েস আই এম রং, ইউ ডিডেন্ট লাভ মি মুসকান। ইউ ডিডেন্ট লাভ মি! ‘
সহসা ওঠে দাঁড়াল ইমন। ঝড়ের গতিতে চলে গেল মুসকানের সামনে থেকে। শেষ বাক্যটি শুনে বুক কেঁপে ওঠল মুসকানের। ইমনের বলা প্রতিটি কথা মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে লাগল। ধীরে ধীরে বুক ভার হয়ে ওঠল তার। হাত, পায়ে শুরু হলো মৃদু কম্পন। না চাইতেও চোখের কার্ণিশ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ল দুফোঁটা অশ্রুজল। মনে মনে বলল,
‘ আমি কি সত্যি আপনাকে ভালোবাসিনি? ‘
ইমন বিশ্বাস করে দু’জন মানুষ যদি সমানভাবে দু’জনকে চায় তাহলেই দু’জন এক হওয়া সম্ভব। সে মুসকানকে যেভাবে ভালোবাসে, যেমন করে চায়। মুসকান সেভাবে চায়নি কখনো। মুসকানের প্রতি তার অনুভূতির যে গভীরতা। সেই গভীরতা তার প্রতি মুসকানের নেই। বুকের ভেতরটা আজ বড়ো হাহাকার করছে ইমনের। তবে কি এক তরফা ভালোবাসা ছিল? এক তরফা ভালোবাসা এতটাই পীড়াদায়ক?
নিজের ঘরে ছটফট করছে ইমন। ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে স্থির হলো যে, সে যতদ্রুত সম্ভব চাকরিতে রিজাইন দেবে। এরপর চলে যাবে এ বাড়ি থেকে। মুসকানের থেকে দূরে। যাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য এত গুলো বছর ধরে ছটফট করছে। আজ শেষ সময়ে এসে এত চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া হবে না৷ মেনে নিতে পারল না সে৷ মুসকানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মানে আরো কয়েকটা বছর অপেক্ষা করা। কিন্তু এই অপেক্ষার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিল? মুসকান কি পারত না তার বউ হয়ে ক্যারিয়ার তৈরি করতে? ওর বউ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হলে কি মান সম্মান চলে যেত? এই বাড়ির ওপর থাকা অভিমান গুলো সে তার ওপর ঝাড়ল। একবারো তার ভালোবাসার মর্যাদা দিল না? ক্রোধে, জেদে জর্জরিত হয়ে মুসকানকে একটি ম্যাসেজ করল ইমন।
‘ সম্মানে ভালোবাসা তরল, উপেক্ষায় দূরহ। ‘
ম্যাসেজটি সেন্ট করে ফোন ছুঁড়ে মারল বিছানায়৷ গোছাতে শুরু করল নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজ মনে বলল,
‘ সর্ব মহলে কঠিন, দাপুটে আমার উচিত হয়নি তোমার কাছে নত স্বীকার করা। প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছিলাম আমি। ভালোবাসায় উন্মাদ। পুরুষের অতিরিক্ত ভালোবাসা নারী সহ্য করতে পারে না। তোমাকে আর সহ্য করতে হবেও না। আমার ভালোবাসা যে সইতে পারেনি সে আমার কাঠিন্যতা কীভাবে সহ্য করে তাই দেখব। ‘
সাতসকালে ইমনের জন্য কফি করে এনেছে মুসকান। ইমন তখন ঘুমে ছিল। ভিতর থেকে দরজা আটকানো। বিষয়টা খুব অবাক করল মুসকানকে। বুঝে নিল তার সাহেবের রাগের মাত্রাটুকু৷ একবার ভাবল ফিরে যাবে। আবার ভাবল রোজ সকাল বিকাল তার হাতের কফি খাওয়ার স্বভাব ইমনের৷ এমনিতেই অনেক কিছু সহ্য করছে। অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটুকু থেকে নাই বা করল বঞ্চিত। ভেবে নিয়ে দরজায় টোকা দিল। বারকয়েক টোকা দিতেই ভিতর থেকে গমগমে কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
‘ কে বিরক্ত করছে কে? ‘
বুক ধক করে ওঠল মুসকানের। যে মানুষটা তার জন্যই দরজা আটকে ঘুমায়নি কখনো। সে মানুষটা আজ দরজা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। নক করলে আবার এভাবে ধমকও দিচ্ছে। যারপরনাই অবাক হলো সে। ঢোক গিলে নরম গলায় বলল,
‘ আমি কফি এনেছি। ‘
পাক্কা এক মিনিট পর কপাল কুঁচকে দরজা খুলল ইমন৷ মুসকান ধীর পায়ে ভিতরে ঢুকে ডেব সাইট টেবিলে কফির মগ রাখল। ইমন চোখ ডলতে ডলতে এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে। মুসকান তার অগোছালো বিছানা গুছাতে উদ্যত হলে ইমন ওয়াশরুমের দরজা আটকানোর পূর্বে বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ তোমার এসব করার প্রয়োজন নেই। আগামী সাতদিন আশিকা খালাকে বলবে আমার কফি করে দিতে। ‘
আগামী সাতদিন? মুসকান অবাক চোখে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে ইমন বেশ শব্দ করে বাথরুমের দরজা আটকে দিল৷ আকস্মিক কাণ্ড চোখ খিঁচে ফেলল মুসকান। মুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ঢোক গিলে বিছানা ঠিকঠাক করে নেমে দাঁড়াতেই চোখ পড়ল,
রুমের এক কোণায় বড়ো বড়ো দু’টো লাগেজের দিকে। হৃৎপিণ্ডটা তড়াক করে লাফিয়ে ওঠল ওর। আগামী সাতদিন আবার দু’টো লাগেজ। অজানা আশঙ্কায় বুকে কাঁপন ধরল তার। নিঃশব্দে চুপচাপ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল ইমন বের না হওয়া পর্যন্ত। তোয়ালে ঝুলিয়ে যখন ইমন বের হলো দেখতে পেল মুসকান চিন্তান্বিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি তার লাগেজের দিকে স্থির। বুকের ভেতর অসহ্য ক্রোধ, অভিমান টগবগিয়ে ফুটল তার। ইচ্ছে করল নিজের সমস্ত ক্রোধ এই মেয়েটার ওপর ঢেলে দিতে৷ গাল দু’টো চেপে ধরে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল, কেন তার ভালোবাসাকে এতটা মূল্যহীন করে ফেলল সে? যে তৃষ্ণায় বুক চৌচির তার। সেই তৃষ্ণা কেন ওর হৃদয়ে নেই? ইচ্ছে গুলো মাটিচাপা রইল। ধপাধপ্ পা ফেলে কাভার্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। কপাট খুলে নিজের সবচেয়ে অপছন্দীয় পোশাক বের করে ছুঁড়ে ফেলল বিছানায়। কেঁপে ওঠল মুসকান। ভয়ে মনের কৌতূহল মুখে বেরিয়ে এলো৷
‘ এই লাগেজ গুলো কীসের? আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন? ‘
‘ তোমায় কেন বলব? কে তুমি? ‘
প্রথম প্রশ্নটি শান্ত গলায় বললেও শেষ প্রশ্নটা তপ্ত মেজাজে বেরিয়ে গেল। কে তুমি? প্রশ্নটিতে ভেতরটা নড়ে ওঠল মুসকানের। আচমকা চোখ দু’টো ছলছল হয়ে ওঠল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘আমি শুধু সময় নিয়েছি। আপনি বোধহয় ভুল বুঝছেন আমাকে। ‘
‘ আই আন্ডারস্ট্যান্ড পারফেক্টলি মুসকান। ‘
ঠাণ্ডা স্বরে কথাটা বললেও মুসকানের ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল ঐ স্বরে। ইমন পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর পানে তাকিয়ে আরো বলল,
‘ তুমি কি ভেবেছ তুমি সময় নিবে। আর আমি খুশিতে নৃত্য করতে করতে তোমার সাথে প্রেম লীলা চালাব? কী মনে হয় তোমার আমাকে? আমার মেরুদণ্ড নেই? তুমি যা বলবে যা সিদ্ধান্ত নেবে সব মানতে হবে আমাকে? ইমন চৌধুরীকে এতটাই সস্তা ভাবো তুমি এতটাই? ‘
চ্যাঁচানো স্বরে কথাগুলো বলায় মুসকান তো কেঁপে ওঠলই। পুরো রুমটাও থমথমে হয়ে রইল। ওর উচ্চস্বরে ধমক শুনে পাশের ঘর গুলো থেকে ইভান, ইমা সহ সবাই বেরিয়ে এলো। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ভাবতে লাগল ভেতরে আসলে হচ্ছে টা কী?
এদিকে জীবনে প্রথমবারের মতো ইমনের এমন আচরণের সম্মুখীন হয়ে মাথা ঘুরতে লাগল মুসকানের। দম আঁটকে এলো। সর্বাঙ্গ কাঁপতে শুরু করল থরথর করে। এই ইমনকে সে চেনে না৷ এই ইমন সম্পূর্ণ অন্য একটা মানুষ। আর সহ্য করতে পারল না সে। ওড়নার আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না আঁটকে এক ছুটে বেরিয়ে গেল। গলায় ঝুলানো তোয়ালেটা একটানে খুলে ফেলল ইমন। অতিরিক্ত রাগে শরীর কাঁপছে তার৷ কপালের রগ ফুলে ফেঁপে ওঠেছে। রাগ নিয়ন্ত্রণে নিজেকেই গালাগাল করল। সত্যি বলতে মুসকানকে কষ্ট দিয়ে সে নিজেই ঠিক থাকতে পারল না। আবার ভেতরে থাকা রাগ, অভিমান গুলোও ফুঁসে ওঠল। দু-হাত কোমরের দুই পাশে রেখে ঘরজুড়ে ঘুরপাক খেতে শুরু করল। শ্বাস নিল বড়ো বড়ো করে। তার পেশি বহুল বুকটা ঘনঘন ওঠা-নামা করছে। হঠাৎ বুকের বা পাশে দৃষ্টি স্থির হলো তার৷ ওপাশটায় চিনচিন করছে। ওপাশে সযত্নে থাকা রানিটা যে এখন কাঁদছে। অনুভব করল সে। বিড়বিড় করে বলল,
‘ বিয়ে করবে না৷ অথচ বউয়ের মতো ট্রিট করবে। এবার দেখো বিয়ে না করে বউয়ের মতো ট্রিট করার দহন কতটা তীব্র হয়। ‘
চলবে…
ব্যস্ততায় তাড়াহুড়ো করে যতটুকু পারি লিখে দিলাম। রিচেক করিনি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।