#চিত্তবৃত্তি
#পর্ব_১২+১৩
#জান্নাতুল_নাঈমা
ইমন বাড়িতে নেই। মোজাম্মেল চৌধুরী এ সুযোগটাই কাজে লাগালেন৷ সাতসকালে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। উপস্থিত হলেন ভার্সিটির সামনে। অপেক্ষা করতে লাগলেন মুসকানের জন্য। ঘড়িতে সময় যখন নয়টা পঞ্চাশ। তাখন বান্ধবী লিয়ার সঙ্গে ভার্সিটিতে ঢুকছিল মুসকান৷ দেখতে পেয়েই মোজাম্মেল চৌধুরী ত্বরিত পিছু ডাকলেন,
– মুসকান।
চমকাল মুসকান৷ ঘুরে দাঁড়াল সহসা। ইমনের বাবাকে দেখে হকচকিয়ে গেল সে। বুকের ভেতর জমল কিঞ্চিৎ ভয়। ধিকিধিকি বুকে ঢোক গিলল বারকয়েক। মোজাম্মেল চৌধুরী ইশারায় কাছে ডাকলেন। ফলে ধাতস্থ হয়ে নিজেকে সামলে নিল সে৷ লিয়াকে গেটের একপাশে দাঁড় করিয়ে সৌজন্যতার সঙ্গে এগিয়ে এলো। গুটিগুটি পায়ে। মোজাম্মেল চৌধুরী আপাদমস্তক তীক্ষ্ণ চোখে দেখলেন মেয়েটাকে। হলুদরঙে সূতি ফ্রকের সঙ্গে গোলাপি রঙা চুড়িদার পাজামা পরনে। পা জোড়ায় খুব সাধারণ বাটা জুতা। মাথায় গোলাপি রঙের ওড়নার সাহায্যে যত্ন সহকারে ঘোমটা দেয়া। ডান কাঁধে অত্যন্ত সাবলীল ভাবে কাপড়ের ব্যাগ পড়ে আছে৷ সর্বাঙ্গে সুনিপুণ যত্নে ছাপ। যা যে কারো চোখকেই প্রশান্ত করে তুলবে। মোজাম্মেল চৌধুরীর চোখদুটোও প্রশান্ত হলো। শ্যামলাটে বর্ণের ঐ পবিত্র, মায়াবি মুখশ্রীতে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সে। ছেলের পছন্দকে এতটা তুচ্ছ সে করতে পারল না। তবুও বংশমর্যাদার কথা স্মরণ করে দমে গেল। তার ঘোর কাটল মুসকানের সালাম পেয়ে।
– আসসালামু আলাইকুম বড়ো বাবা।
সালাম ফেরাল সে। বেশ জড়তার সঙ্গে বলল,
– তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। গাড়িতে ওঠে বসো।
বক্ষগহ্বরে ধুকপুক করে ওঠল৷ বড়ো বাবার কথা অমান্য করার কথা ভাবতেও পারে না সে৷ তাই ঘাড় ফিরিয়ে বান্ধবীর দিকে শান্ত চোখে তাকাল। নম্র স্বরে বলল,
– লিয়া, তুই ক্লাসে চলে যা।
লিয়া চলে গেল। মোজাম্মেল চৌধুরী এগিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে৷ পিছু নিল মুসকান। গাড়িতে ওঠে বসল সে। মোজাম্মেল চৌধুরী ড্রাইভিং সিটে। তার পাশের সিটেই মুসকান বসা। দু’মিনিট ড্রাইভ করে একটি কফিশপের সামনে এসে থামলেন তিনি। মুসকানকে বললেন,
– ভেতরে গিয়ে বসো। আমি আসছি।
দুরুদুরু বুকে কফিশপের ভেতরে চলে গেল মুসকান। বুদ্ধিমতী সে নিজেকে যথাসম্ভব প্রস্তুত করে নিল। বড়োবাবা যদি আজ তাকে ইমনের জীবন থেকে সরে যেতে বলে। সে মাথা উঁচু করে, সাহস করে প্রতিবাদ করবে। একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে সে দু’জন এডাল্ট ছেলেমেয়ের জীবনে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সরাসরি এ কথাও বলবে। এতে বড়োবাবা তাকে বেয়াদব ভাবলে ভাবুক। পরোয়া করবে না সে। কোনোমতেই, কোনো কিছুর বিনিময়েই ইমনকে সে হারাতে চায় না। হারাতে পারবে না। হারাতে দেবে না।
গাড়ির ভেতর চুপচাপ বসে আছেন মোজাম্মেল চৌধুরী। ওদিকে তার অপেক্ষায় কফিশপের ভেতরে বসে মুসকান। একজন আইনজীবী সে। তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা মুসকান সম্পর্কে বেশ অবগত। সে জানে মুসকান বুদ্ধিমতী, জ্ঞানী। সেই সঙ্গে মানসিক দিক দিয়ে প্রচণ্ড শক্তিশালী। যেই শক্তিকে নড়বড়ে করার জন্য কঠিন কিছুর সাহায্য প্রয়োজন। ঠিক কী ভাবে কী বলে মুসকানকে দুর্বল করা যায়? ভাবতে লাগলেন তিনি। সহজভাবে ইমনের থেকে সরে যেতে বললে যদি না যায়? হাতজোড় করলেও যদি কাজ না হয়। শেষে ধমকি-ধামকি দিয়েও যদি বৃথা হয়৷ নাহ এসব নয় অন্যকিছু। বুড়ো আঙুলে কপাল ঘষতে শুরু করলেন তিনি৷ সহসা তার মাথায় খেলে গেল মুসকানের জন্মসূত্রের কিছু কথা। যে মেয়েটি অনাথ। যে মেয়েটি জানে না তার পিতৃ পরিচয়। সেই মেয়েটির সবচেয়ে দুর্বল জায়গা ঠিক কী হতে পারে ধরে ফেললেন তিনি। আর সময় নষ্ট করলেন না। ধীরেসুস্থে গাড়ি লক করে ভেতরে গেলেন৷ দু’টো কফি অর্ডার দিয়ে মুসকানের মুখোমুখি বসলেন।
মুসকান সোজা হয়ে মাথা কিঞ্চিৎ নত করে বসে। অপেক্ষায় আছে বড়ো বাবার থেকে জরুরি কথা শোনার৷ বড়ো বাবা সময় নিলেন না৷ আর না করলেন কোনো ভণিতা। সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন,
– ইমন তোমাকে বিয়ে করতে চায়।
এক পলকে তাকিয়ে মাথা নত করে ফেলল মুসকান। বড়ো বাবা পুনরায় বললেন,
– কিন্তু আমি ইরাবতীর স্বপ্নকে ধ্বংস করতে চাই না।
চমকে ওঠল মুসকান। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল সে। চোখজুড়ে প্রশ্ন, কীভাবে বড়ো মায়ের স্বপ্ন ধ্বংস হবে? জবাব বড়ো বাবাই দিলেন,
– ইরার স্বপ্ন ছিল ইমন তার বাবা, দাদুর মতোই প্রতিষ্ঠিত হবে। তার জ্ঞান চর্চা শুধু এই দেশে নয় বিদেশেও হবে। অথচ দেখো, মাস্টার্স শেষ করে ছেলেটা পড়াশোনাই বাদ দিয়ে দিল। যে জীবনটা ও কাটাচ্ছে এরচেয়েও ব্যাটার জীবন ডিজার্ভ করে ও। যেটা ওর মা স্বপ্ন দেখেছিল।
মুসকান অবাক হয়ে চেয়ে। সে ঠিক বুঝতে পারছে না এসব তাকে কেন বলা হচ্ছে। বাবা হিসেবে এগুলো সে তার ছেলেকেই বলতে পারত। তবুও যখন তাকে বলা হচ্ছে সে নিশ্চয়ই ইমনকে জানাবে। বোঝাবে। মুসকানের এহেন চিন্তার মাঝেই মোজাম্মেল চৌধুরী বলে ওঠলেন,
– ইমনের ক্যারিয়ারটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর জন্য দায়ী শুধুমাত্র তুমি!
সহসা কেঁপে ওঠল মুসকান। বিস্মিত হয়ে তাকাল সে। বড়োবাবা বলতেই থাকলেন,
– আজ যদি ও তোমার প্রতি আসক্ত হয়ে না পড়ত। তাহলে জীবনটাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না মা। শুধু আমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে কথা গুলো বোঝার চেষ্টা করো। সব বাবা মায়েরই একটি স্বপ্ন থাকে। তার ছেলেমেয়েরা বড়ো হবে। উচ্চশিক্ষিত হবে। ভালো ঘরে বিয়ে করাবে। আমিও এর ঊর্ধ্বে নই। আমিও চাই ইমন আরো ভালো স্থানে পৌঁছাক। ওর জীবনে একজন ভালো জীবনসঙ্গী আসুক৷ তুমি নিঃসন্দেহে খুব ভালো একটি মেয়ে। কিন্তু মা গো তোমার বয়স কম। তুমি তো আমাদের সমস্যা গুলো বুঝবে না। বড়ো পরিবারে সমস্যা গুলোও হয় বড়ো বড়ো। আমরা ঝট করেই যে কোনো কিছুর সঙ্গে নিজেদেরকে জড়াতে পারি না।
মুসকানের মুখটা থমথমে হয়ে আছে। সে জানত তাকে এভাবে এখানে নিয়ে আসার কারণ। তবুও কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছে না। কিন্তু এরপর বড়ো বাবা যা বলতে শুরু করলেন তার গোটা দুনিয়াটাই যেন ঘুরতে শুরু করল। মোজাম্মেল চৌধুরী বললেন,
– মুসকান, তুমি হয়তো তোমার একটি কঠিন সত্যি জানো না। আজও যদি সত্যিটা তোমাকে না জানানো হয় তাহলে খুব অন্যায় হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা তুমি না বুঝে এক বাবার প্রতি ভুল ধারণা মনে পুষবে৷ আমাকে সারাজীবন দোষী ভাববে।
একটু থামলেন মোজাম্মেল চৌধুরী। ততক্ষণে কফি এসে গেল। কিন্তু দু’জনের কেউই কফি পান করল না। মুসকান জানল তার জীবনের কঠিন সব সত্যিকে,
– বহু বছর আগে, আমার নানি মারা যায়। হাসপাতাল থেকে তার মৃতদেহ আনতে আব্বা আর আম্মাও যান। আম্মার বিবৃতি অনুযায়ী সদ্য জন্মানো এক শিশু হাসপাতালের পাশ দিয়ে যাওয়া ড্রেনে ভেসে যাচ্ছিল। ছোট্ট খাঁচার ভেতর কাপড়ে ঢাকা ছিল বাচ্চাটি। যার ক্রন্দনধ্বনি শুনে আম্মাই প্রথম ছুটে যায়। একটা লাঠি দিয়ে খাঁচা টেনে ধরে। হাঁকডাক শুনে লোকজন জড়ো হয়৷ কিন্তু কেউ সাহস করে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়নি। আম্মাই প্রথম কোলে তুলে নেয়। শরীরে থাকা রক্তের দাগ তখনও পরিষ্কার করা হয়নি। আম্মা নিজ হাতে পরিষ্কার করে। নার্সের সাহায্যে যতটুকু সেবা দেয়া যায় দিয়ে। তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী দুধ কিনে এনে খাওয়ায়। বলা যায় মৃত প্রায় শিশুটিকে প্রাণ দান করে আম্মা৷ এরপর খোঁজ খবর নেয়া হয়৷ কিন্তু কার বাচ্চাটি সেই হদিস মেলে না। কেউ বাচ্চার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসে না। শেষে ভীষণ মায়ায় পড়ে আম্মাই দায়িত্ব নেয় তার। সেই বাচ্চাটি আর কেউ নয় আমার সামনে বসে থাকা তুমি মুসকান!
সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে ওঠল মুসকানের। বুক ফেটে চিৎকার বেরোতে চাইল তার। অসহনীয় হয়ে একহাত চেপে ধরল বুকে৷ সেই ভয়াবহ দিনের কথা চিন্তা করতেই গা শিউরে ওঠল। দু-চোখে অদ্ভুত অসহায়ত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠল মেয়েটার। নীরস হওয়া গলাটা এক ঢোক গিলে ভিজিয়ে নিল। কাঁপতে থাকা হাত দুটো একে অপরকে সামলাতে ব্যস্ত।মোজাম্মেল চৌধুরী থামলেন না। বলতেই থাকলেন,
– তোমার জন্ম পরিচয় আমরা কেউ জানি না৷ চিত্তবৃত্তি আশ্রমে থাকা বাচ্চাদের দায়িত্ব যেভাবে নেয়া হয়েছে। তোমার দায়িত্বও সেভাবে নিয়েছেন বাবা। আচ্ছা মুসকান, আমার একমাত্র ছেলে ইমন পরিচয়হীন কোনো মেয়েকে জীবনসঙ্গী করুক। বাবা হিসেবে এটা কি আমি মেনে নিতে পারি?
ধীরেধীরে মুসকানের চোখদুটো রক্তিম হয়ে ওঠল। মোজাম্মেল চৌধুরী টের পাচ্ছিলেন তার অস্বাভাবিকতা৷ কিন্তু নিজ উদ্দেশ্যে সফল হলেন কিনা বুঝতে না পেরে শক্ত একটি আঘাত করে বসলেন,
– আমি অনাথ শিশুদের স্নেহ করি। তোমাকেও স্নেহ করি৷ তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু মা বাস্তবতা অনেক কঠিন৷ কঠিন এই বাস্তবতায় পাপ পূণ্য বিচার করতেও হয় কঠিন দক্ষতায়। আল্লাহ না করুক, যদি তুমি কোনো পাপের ফল হয়ে থাকো? আমি আমার ছেলেকে কী করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেই বলো? ইমন হয়তো এখন বুঝতে পারছে না৷ একটা ভ্রম, একটা মোহে আটকে আছে সে। যেদিন ভ্রম ভাঙবে, মোহ কাটবে সেদিন কী হবে জানো? তোমার থেকে ওর মন ওঠে যাবে৷ বিচ্ছেদে রূপান্তরিত হবে এই সম্পর্ক। পরে আফসোস করার চেয়ে আগেই বিবেচনা করে কাজ করা উচিৎ। তোমরা ছেলেমানুষ। এখন তোমরা বিবেক নয় আবেগকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছ। কিন্তু পরিস্থিতি সবসময় একরকম থাকবে না মা।
আর শোনার শক্তি পেল মুসকান। দু’হাতে কান চেপে ধরল সে৷ মোজাম্মেল চৌধুরী চুপ হয়ে গেলেন। মুসকান বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিতে শুরু করল। দুচোখ দিয়ে নোনাপানির স্রোত নামল তার। মোজাম্মেল চৌধুরী দু-হাত জোর করে ক্ষীণ স্বরে বললেন,
– মা গো আমি তোমার কাছে আমার ছেলের ভবিষ্যত ভিক্ষা চাই। সেই সঙ্গে চাই ভবিষ্যতে আফসোস করার চেয়ে এখনি তোমরা একে অপরের থেকে দূরে সরে যাও।
অসহায় চোখে তাকাল মুসকান। তার ভেতরটা ভেঙে চুড়ে দিল লোকটা। সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার করে দিয়ে হাতজোড় করে আর কী চাইছে?
– তুমি সরে যাও মা। সময় গড়ালে ইমন সয়ে যাবে। যে ভুল সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে এই ভুলটা তাকে করতে দিও না। এক সময় এরজন্যই ইমন তোমাকে ধন্যবাদ জানাবে।
সহসা ওঠে দাঁড়াল মুসকান। বুকে পাথর চেপে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
– আপনার কথা আমি রাখব।
এ পর্যন্ত বলেই সে এক ছুটে কফিশপ থেকে বেরিয়ে গেল। লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওঠে দাঁড়ালেন মোজাম্মেল চৌধুরী। দু-হাত ঝাড়া দিয়ে বাঁকা হাসলেন। যতটুকু করার করে ফেলেছে। এবার শুধু মুসকানকে কৌশলে আশ্রম থেকে উহুম শুধু আশ্রম নয় এ শহর থেকেই সরিয়ে ফেলার অপেক্ষা। ভেবেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল করলেন ইভানকে। বললেন,
– ইভান, কাজ অনেকটাই হয়ে গেছে। অম্লানকে ফোন কর।
ইভান ফোন কেটে অম্লানকে কল করল। বলল,
– অম্লান, কাজ হয়ে গেছে। তৈরি থাক৷ ওহ হ্যাঁ মনে রাখিস, বউ তোর হলেও ফার্স্ট বাসর করব আমি৷ ইভান চৌধুরী।
.
.
চিন্তিত বদনে বসে দাদুভাই৷ সুমা দুপুরের খাবার খেতে ডাকল। দাদুভাই হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে পথের দিকে তাকালেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুমার সঙ্গে চলে গেলেন খেতে। বাচ্চাদের নিয়ে একসঙ্গে খেয়ে ওঠলেন। এরপর চিন্তা করতে লাগলেন, মুসকান মোবাইল ফোন নিয়ে যায়নি আজ। এতটা সময় গড়িয়ে গেল তবুও আশ্রমে ফিরল না। তার এত হাসফাস লাগছে কেন? কেন মন কু ডাকছে? ব্যাকুল হয়ে ওঠলেন দাদুভাই। দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল ঘনাল। হৃৎপিণ্ড লাফাতে শুরু করল তার। গতকাল থেকেই মুসকানের মাঝে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন তিনি। মুসকান গতকাল দুপুরে খায়নি। রাতে বেশ ডাকাডাকি করার পর খেতে এসেছে। চোখমুখে স্পষ্ট হয়েছিল তীব্র অসহায়ত্ব। বার বার কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেছে। শেষ পর্যন্ত কিছু বলতে পারেনি। দাদুভাইও তাকে একাকী ছেড়েছে। ভেবেছে হয়তো মনে কিছু একটা চলছে। মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই তাকে বলবে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। মুসকান এখনো আশ্রমে ফিরে আসেনি। সে কোথায় রয়েছে? ইমন বেড়াতে গেছে। এ মুহুর্তে মেয়েটা আশ্রমে না ফিরলে ভীষণ মুশকিল হয়ে যাবে। দাদুভাই বাড়িতে ফোন করলেন। ইয়াশফার সঙ্গে কথা বলে লিয়ার নাম্বার চাইলেন। সে জানে মুসকানের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী একমাত্র লিয়াই। ইয়াশফার কাছে নাম্বার ছিল না। সে ফেসবুকে এড ছিল বলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই নাম্বার সংগ্রহ করে দাদুভাইকে দিল। ইয়াশফা বার বার জিজ্ঞেস করল কিছু হয়েছে কিনা? কেন লিয়ার নাম্বার চাচ্ছে? দাদুভাই কোনো জবাব দিলেন না। ফোন কেটে লিয়াকে কল করলেন। সবচেয়ে বড়ো আশঙ্কা জন্মাল লিয়াকে ফোন করার পরই। লিয়া জানাল, আজ মুসকান ভার্সিটিতেই আসেনি! এ কথা শোনামাত্রই দাদুভাই বসে পড়লেন। ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেল তার।
.
.
গতকাল কফিশপ থেকে বেরিয়ে আশ্রমে ফিরে আসে মুসকান৷ নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখে দীর্ঘক্ষণ। নিজের অস্তিত্বের প্রতি ঘৃণায় বার বার মূর্ছিত হয় সে। বার বার মনে হতে থাকে এই পৃথিবীতে সে একজন আগাছার মতোন। স্মরণ করে বড়োবাবার কথাগুলো। দেহ কেঁপে ওঠে মুহুর্তেই। গা গুলিয়ে বমি পায়। সে কারো নোংরামির ফল! সে কারো পাপের ফল? অসহনীয় চিত্তে নিজেকে আঘাত করতে উদ্যত হয় সে। এতদিন জানত সে অনাথ। তার বাবা নেই, মা নেই। বংশ পরিচয় নেই। কিন্তু আজ কেউ একজন সরাসরি তাকে বুঝিয়ে দিল, আসলে তার জায়গাটা ঠিক কোথায়? তার অস্তিত্ব পৃথিবীর মানুষদের কাছে ঠিক কেমন? তিক্ত হলেও সত্যি সে কারো পাপের ফল। আর পাঁচটা সন্তানের মতো সে নয়। তাই তো জন্মের পর তাকে হাসিমুখে তার জন্মদাত্রী গ্রহণ করেনি। বরং লোকলজ্জার ভয়ে ময়লা, আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলেছে। দু-হাতে মাথার চুল খামচে ধরে মুসকান। তার মন তীব্র ক্ষোভে অভিযোগ তুলে দাদির ওপর। কেন সে সেদিন তাকে বাঁচিয়েছিল? কেন বুকে আগলে নিয়েছিল? তার জন্মদাত্রী যদি তাকে ছুঁড়ে ফেলতে পারে তাহলে দাদির কিসের এত দরদ? যেখানে মা প্রসব বেদনা সহ্য করে তাকে ছুঁড়ে ফেলেছে সেখানে দাদি কেন তাকে বুকে তুলে নিল? সেদিন যদি দাদি এ কাজ না করত আজ তাহলে বিষাক্ত এই যন্ত্রণায় ভুগত না সে। সেই শিশুকালেই বা হয় পৃথিবী ছেড়ে আল্লাহর নিকট চলে যেত। বুকের ভেতর হওয়া তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছিল মুসকান। বদ্ধ উন্মাদের মতো নিজের শরীরে নিজেই আঘাত করতে শুরু করেছিল। পৃথিবী, পৃথিবীর মানুষ এবং নিজের প্রতি সমস্ত আসক্তি যেন মলিন হয়ে গেছে তার। বিধ্বস্ত সেই মুহুর্তেই তার ফোনে কল আসে। মোজাম্মেল চৌধুরীর সেই কল রিসিভ করে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ছাড়ে মুসকান। মোজাম্মেল চৌধুরী অত্যন্ত স্নেহীশীল কণ্ঠে বলেন,
– মা গো। আমার নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে মা। আমি কি তোমাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলছি। পুত্র চিন্তায় আমি ঐ চরম সত্যি কথাগুলো বলে একদম ঠিক করিনি মা৷
মুসকান ডুকরে ওঠল। থেমে থেমে বলল,
– আপনি আমাকে কষ্ট দেননি। বরং সত্যিটা জানিয়ে আমার ভেতরের কৌতূহল মিটিয়েছেন। এই পৃথিবীতে প্রতিটি সন্তানেরই নিজের জন্ম পরিচয় জানার অধিকার আছে। আমার যে সত্যিই জন্ম পরিচয় নেই৷ এটা জেনেও আমি শান্তিতে আছি৷ ছোট্টবেলা থেকে মনের ভিতর কৌতূহল ছিল। আমি কে? আমার বাবা, মা কে? তারা কোথায় আছে? সব সময় ভাবতাম আমি হয়তো কোনো গরিব ঘরের সন্তান। যারা আমাকে মানুষ করতে পারেনি। যারা আমাকে লালন-পালন করতে অপারগ ছিল। এসব ভেবে মনের ভিতর আকাঙ্ক্ষা জমাতাম। একদিন বড়ো হবো। নিজের পায়ে দাঁড়াব। তারপর নিজের বাবা, মা’কে খুঁজে বের করব। বাবা, মা হিসেবে তারা আমার দায়িত্ব পালনে অপারগ ছিল। কিন্তু সন্তান হিসেবে আমি তাদের দায়িত্ব পালনে অপারগ নই। যে বাড়ির আশ্রয়ে বড়ো হয়েছি৷ তারা ঠিক আমার সুনিশ্চিত ভবিষ্যতে দান করেছেন। আমার সেই আকাঙ্ক্ষা, আমার সেই চিত্তবৃত্তি কোনোদিন পূরণ হবার নয়। কারণ আমি যে পরিচয়হীনা। আমি যে কারো বৈধ সন্তান নই। আমি কারো পাপের ফল!
শেষ বাক্যগুলো তীব্র লজ্জা, কষ্ট বুকে চেপে, কম্পিত কণ্ঠে বলল মুসকান। মোজাম্মেল চৌধুরী বললেন,
– মুসকান মা, আমি তোমার ভবিষ্যত নষ্ট করতে চাই না৷ আমার ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে সম্ভব না। তাতে কী হয়েছে আমরা তো তোমাকে অন্যত্র বিয়ে দিতেই পারি।
এ কথা শুনে মুসকানের বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নিভে গেল সে। তার জীবনের সমস্ত আকাঙ্ক্ষারই ধ্বংস ঘটেছে আজ। এ জীবনে আর কোনো চাওয়া নেই। পাওয়ার অভিলাষ নেই। তাই বলল,
– আমার এসব কিছুই চাই না।
মোজাম্মেল চৌধুরী ভীত হলেন। অনুনয় করে বললেন,
– আমি চাই তুমি ইমনের থেকে দূরে থাকো। এই দূরত্ব এতটাই হোক যেন ইমন তোমাকে ভুলতে বাধ্য হয়।
দুচোখে নিঃশব্দে অশ্রুপাত ঘটাল মুসকান। মোজাম্মেল চৌধুরী বললেন,
– কাল আমি তোমার জন্য বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করব মা। তুমি ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে এসো। বাকি কথা না হয় সামনাসামনিই বলব। কথা দিচ্ছি মা, তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। আমি নিজ হাতে তোমার ভবিষ্যত গড়ে দিব।
তাচ্ছিল্য সহকারে হাসল মুসকান। ফোন কানে রেখেই ঘাড় বাঁকা করল। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইল সম্মুখের দেয়ালে। মনে মনে বলল,
– আর কোনো ক্ষতি হওয়ার বাকি নেই বড়ো বাবা। আমার বিরাট বড়ো ক্ষতিটা তো হয়েই গেছে। আমার জীবনে কোনো ক্ষতি নেই। আর কোনো সর্বনাশ নেই।
মুখে বলল,
– আমি আসব।
.
গতকালের সেই কথা অনুযায়ী মুসকান সত্যিই চলে যায়। মোজাম্মেল চৌধুরীও তাকে নিয়ে শহরের বাইরে বেরিয়ে যায়৷ বুদ্ধিভ্রষ্ট? তীব্র আঘাত? নাকি কিছু নিষ্ঠুর মানুষের প্রতি প্রকট অভিমান? ঠিক কী কারণে মুসকানের মতো বুদ্ধিমতী, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেয়ে নিজের চরম সর্বনাশ ঘটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল? সে কী জানে এই নির্বুদ্ধিতার চরম মূল্য দিতে হবে তাকে? কারো থেকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে? খুব বেশিদিন তো নয়। এই তো কিছুদিন আগেরই কথা। কাগজে-কলমে না হোক। মনে মনেই নিজেকে অন্যকারো নামে লিখে দিয়েছে সে। মুখে ঘটা করে হয়তো বলেনি। তবুও সেই মানুষটা যে ঠিক বুঝে নিয়েছে তার মনো কথা। সেই মনো কথার রেশ কতটা সাংঘাতিক এবার হারে হারে টের পাবে মুসকান সহ চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি সদস্য!
চলবে…