#চিত্তবৃত্তি
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৩
বৈশাখ মাস। মানুষ ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে যাচ্ছে কর্মস্থলে। আর মুসকান কালবৈশাখী ঝড়কে বুকে চেপে উপস্থিত হয়েছে ইমনের ফ্লাটে। ভিজে জবজবে মুসকানকে দেখে আঁতকে ওঠল সায়রী। চ্যাঁচিয়ে বলল,
‘এ কী অবস্থা তোমার!’
মুসকান সে প্রশ্নের উত্তর দিল না। প্রচণ্ড অগোছালো লাগছে ওকে। ফোনে কথা বলার পর মাত্র দেড় ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। এরই মধ্যে হাজির মুসকান। বিস্ময়ে ভাষা হারিয়ে ফেলল সায়রী৷ হাঁক ছেড়ে ডাকল দিহানকে। ইমনের বেড রুম থেকে বেরিয়ে এলো দিহান৷ ড্রয়িং রুমে ভেজা শরীরে মুসকানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যারপরনাই অবাক হলো। সায়রী তাকে সব খুলে বললে অবিশ্বাস্য চোখে আপাদমস্তক মুসকানকে দেখতে লাগল সে। তার সে দেখা মুসকানকে ফেলল তীব্র অস্বস্তিতে। সায়রী বলল,
‘তুমি আমার সাথে এসো। আগে পোশাক পরিবর্তন করো।’
ওড়নায় কোণা দিয়ে মুখ মুছছিল মুসকান। সায়রীর কথায় হুঁশ ফিরল যেন। আকুল কণ্ঠে বলল,
‘উনি কেমন আছেন?’
দিহান ভড়কে গেল। সায়রীর দিকে তাকাল অবিশ্বাস্য চোখে। চোখে ইশারা করে জিজ্ঞেস করল,
‘কী খেল দেখিয়েছিস তুই? মন্ত্র তন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়েছিস নাকিরে?’
ঠোঁট টিপে হাসল সায়রী৷ দিহান হাসল মাথা দুলিয়ে। মুসকানকে বলল,
‘আগে পোশাক পাল্টে নাও। এরপর নিজের চোখেই দেখে এসো উনি কেমন আছে।’
আর এক মুহুর্ত দেরিও সহ্য হচ্ছিল না৷ কিন্তু দু’জন সিনিয়র আপু, ভাইয়ার সামনে এক ছুটে অসুস্থ প্রেমিকের কাছে যাওয়ার মতো লজ্জা জনক কাজটি করতেও সাহস হলো না৷ তাই বাধ্য মেয়ের মতো সায়রীর কথা শুনল। নিজের ভেজা কাপড় পাল্টে সায়রীর দেয়া গরম কাপড় পরে নিল ঝটপট। তার ফিনফিনে লম্বা দেহে বেশ ঢিলে আর শর্ট হলো সায়রীর কামিজ। সে সাধারণত এত খাটো জামা পরে না৷ তার পরনে সব সময় গাউন বা গোরালি ছুঁই ছুঁই লম্বা কামিজ থাকে। তাই এই খাটো কামিজ পরে বড্ড অস্বস্তি ঠেকল। সায়রীর থেকে লম্বা হওয়ার সুবাদে গোরালি থেকে বেশ উপরে ওঠে রইল পাজামাও। বাথরুম থেকে বের হলো প্রচণ্ড জড়তা নিয়ে। সায়রী মুচকি হেসে ওড়না এগিয়ে ধরে বলল,
‘লজ্জা পেয়ো না। খারাপ লাগছে না একদম। তোমার কাপড় গুলো আমি বেলকনিতে মেলে দিচ্ছি। শুকিয়ে গেলে পরে নিয়ো আবার।’
মুসকান মাথা কাত করল। সায়রী তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ইমনের রুমে। মাথায় কাপড় তুলে ঘোমটা দিল মুসকান৷ বিচলিত চিত্তে ইমনের ঘরে প্রবেশ করল সে। দেখতে পেল, বলিষ্ঠ দেহের নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকার দৃশ্য। গায়ে মোটাসোটা কম্বল জড়ানো। চিত হয়ে শুয়ে আছে। চোখ দু’টি বন্ধ। পেশিবহুল হাতজোড়া কম্বলের বাইরে। বুক থেকে গলা অবধি নগ্ন। বুঝতে পারল, উদাম শরীরে কম্বল জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে সে। বেডসাইড টেবিলে ভাত, তরকারি পড়ে আছে অবহেলায়। সায়রী নিচু কণ্ঠে বলল,
‘দিহান আর আমি মিলে খাওয়াতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না৷ ভেবেছিলাম ভাত খেলে একটা নাপা খাইয়ে দিব৷ এরপর যদি জ্বর না কমে তাহলে নিয়ে যাব ডক্টরের কাছে। বাট এই ত্যাড়া ছেলে তো ভাতই খাচ্ছে না।’
সায়রী কথার সমাপ্তি টানতেই মুসকান অস্থির কণ্ঠে বলল,
‘আমি চেষ্টা করি আপু। পারব আমি।’
সায়রী জানে মুসকান পারবে। তাই মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিয়ে বলল,
‘মুসকান দিহান আজ ঢাকা যাবে৷ আগামীকাল ইন্টারভিউ আছে ওর। জানো তো ও কেমন অগোছালো ছেলে। ভাবছি আমিও সঙ্গে যাব৷ কিন্তু হঠাৎ ইমনের এমন জ্বর হওয়াতে বিপদে পড়ে গেলাম। আমি ভাবতেও পারিনি তুমি এভাবে ছুটে আসবে। এসেছ যখন ভালোই হলো। খাইয়ে দাইয়ে ওর জ্বর একটু কমলে আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারব৷ তুমি পারবে না কাল পর্যন্ত এই অসুস্থ মানুষটার দায়িত্ব পালন করতে?’
আকস্মিক দু-চোখ পানিতে টলমল হয়ে গেল মুসকানের। ইমনের রুগ্ন, নিস্তেজ দেহে চোখ রাখতে পারল না সে। রুদ্ধশ্বাসে সায়রীকে শুধু জবাব দিল,
‘আমি পারব আপু৷ তুমি ভাইয়াকে নিয়ে নিশ্চিন্তে যেও।’
মুসকান জানে দিহানের একটা চাকরির খুব প্রয়োজন। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়ে সায়রী তার পাশে থাকুক চায় সে। ইমনের অসুস্থতার জন্য দিহানের এই চাওয়া অপূর্ণ থাকুক মুসকান চায় না৷ তাই ইমনের দায়িত্ব নিতে ভীত হলো না৷ সায়রীও ঝোপ বুঝে কো প দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আসলে দিহানের সঙ্গে তার যাওয়ার কথাই ছিল না৷ তবু যাবে সে৷ এই সুযোগে দিহানের সঙ্গে একটু ঘুরা হয়ে যাবে। আর ইমন, মুসকানকে আনা যাবে কাছাকাছি। ভাঙা যাবে তাদের মধ্যেকার সব অভিমান৷ যদিও মুসকানকে দেখে ইমনের প্রতিক্রিয়া কী হবে জানে না সায়রী৷ তবে মন বলছে প্রথমে রাগ, অভিমান করলেও শেষে ভালো কিছুই হবে৷ ইমন যতই কঠিন হোক এই একটা মানুষের কাছে প্রচণ্ড পরিমাণে দুর্বল।
মুসকানকে একা ছেড়ে বেরিয়ে গেল সায়রী। যাওয়ার আগে ফিসফিস করে বলে গেল কিছু কথা,
‘তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তোমাকে দেখে ও যাই রিয়াকশন দিক। রাগ না করে ঠাণ্ডা মাথায় ওকে শান্ত করবে আশা করি। আমি আর আমরা সবাই জানি তুমি চাপা স্বভাবের মেয়ে। কিন্তু বোন, ভালোবাসা তো চেপে রাখার জিনিস নয়। ভালোবাসা নিজের মানুষটিকে উজার করে দেয়ার জিনিস। তোমার ভুলটা ঠিক এখানেই। তুমি ভালোবাসা চেপে রেখেছ। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত গুলো নিচ্ছ একদম নিজ মর্জিতে। যেখানে ঐ ছেলেটা তার জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোমাকে জড়িয়ে। সেখানে তোমার সিদ্ধান্তের কোথাও ও নেই।’
সহসা কম্পিত কণ্ঠে মুসকান বলল,
‘আছে।’
সায়রী মৃদু হেসে স্পর্শ করল ওর এক গাল। বলল,
‘কোথায় কীভাবে ওকে জানাও, বোঝাও। কখনো কখনো বোঝাতে হয় মুসকান। পুরুষ মানুষ যে নারীকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসে। সে নারীর কাছেও আশা করে তার সবটা। ও তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। ধরে রাখো বোন এই ভালোবাসা। অনেক ভাগ্য করে জন্মাকে কোনো পুরুষ থেকে এমন ভালোবাসা পাওয়া যায়।’
সায়রীর কথায় মুসকানের সমস্ত সত্তা নড়ে ওঠে৷ বুকের ভেতরে থাকা হৃৎযন্ত্রে শুরু হয় কম্পন। অশ্রুসিক্ত চোখদুটো দু’হাতে পরিষ্কার করে নিয়ে তাকায় বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার পানে। কিয়ৎক্ষণ স্থির নয়নে তাকিয়ে থেকে ধুকপুক বুক নিয়ে এগোয় আস্তেধীরে।
চোখ বুজে শুয়ে ইমন। আধোঘুম আধো জাগা। সে যে পুরোপুরি ঘুমোয়নি বুঝতে পারেনি মুসকান৷ তাই পাশে বসে আলতো হাতে ছুঁয়েছে কপাল। সঙ্গে সঙ্গে দুর্বল চোখজোড়া মেলে তাকাল ইমন। বুক ধক করে ওঠল মুসকানের। ত্বরিত হাত সরিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
‘কেমন আছেন এখন?’
জ্বর শরীরে মৃদু ঝংকার খেলে গেল। স্থির নয়নে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ বুজল ইমন। রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে ভরাট কন্ঠে বলল,
‘তুমি এখানে কেন?’
বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠল মুসকানের। ভাঙা কণ্ঠে বলল,
‘আপনার জ্বর শুনে…’
বাকি কথা বলতে পারল না। তার আগেই ধমক খেল,
‘সো হোয়াট!’
তড়াক করে ওঠে বসল ইমন। উঁচু কণ্ঠে ডাকল সায়রীকে। সায়রী এলো না। তাই ডাকল দিহানকে। দিহানও এলো না। মুসকান ভয়ে ওঠে দাঁড়াল। ইমনের কঠিন দৃষ্টি, শক্ত চোয়াল, ভরাট কণ্ঠ তার সর্বাঙ্গে কম্পন তুলে দিল। বারকয়েক ডেকেই হাঁপাচ্ছে ইমন। মুসকান তার অবস্থা দেখে অনুনয় করে বলল,
‘আপনি শান্ত হন। প্লিজ রাগ করবেন না। আমি ডেকে আনছি আপু, ভাইয়াকে।’
মুসকানের ডান চোখ গলে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ না চাইতেও যা দেখে ফেলল ইমন। ক্রোধ এবার আকাশ ছোঁয়া হলো। মুসকান আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ছুটে গেল সায়রীকে ডাকতে। সত্যি বলতে খুব ভয় পেয়ে গেছে সে। এই ইমনকে সে চেনে না৷ একদমই চেনে না। এই ইমন সম্পূর্ণ অজানা একজন৷ ও চোখে ভালোবাসা নেই আছে শুধু সীমাহীন ক্রোধ। যে ক্রোধের আগুনে পুড়তে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। পুরো ফ্লাট খুঁজেও সায়রী বা দিহান কাউকে খুঁজে পেল না মুসকান। এদিকে জ্বরে আক্রান্ত দুর্বল শরীর নিয়ে ওঠে দাঁড়িয়েছে ইমন। মুসকান ওদের খুঁজে না পেয়ে ফিরে এলে দেখল ইমন নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতে না পরে বিছানায় ধপ করে বসেছে। বুকের ভেতর চিড়িক দিয়ে ওঠল তার। মুহুর্তেই সব ভয় কাটিয়ে কাছে এসে বলল,
‘ওরা কেউ বাসায় নেই। মেইন দরজা বাইরে থেকে লক। আপনি শান্ত হয়ে বসুন প্লিজ।’
ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলল ইমন। আশপাশে তাকিয়ে মোবাইল খুঁজল নিজের৷ বুঝতে পেরে বিছানার পাশের টেবিল থেকে মোবাইলটা এনে দিল মুসকান। ইমন তাকাল না ওর দিকে। মুখ ফিরিয়ে মোবাইল নিল শুধু৷ লক ছাড়াতেই দেখতে পেল সায়রীর কয়েকটা ম্যাসেজ,
‘দোস্ত কাল দিহানের ইন্টারভিউ আছে জানিস তো। তাই একটু কেনাকাটা করতে এলাম। আর শোন, তোকে বলা হয়নি সকালে মুসকানের সাথে আমার কথা হয়েছে। শুধু বলেছিলাম, তোর হঠাৎ জ্বর এসেছে। বিশ্বাস কর ফোন কেটে দিয়ে মেয়েটা যে এমন ভেঙেচুড়ে, ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে চলে আসবে বুঝতে পারিনি। কী আর করার এসেছে যখন রাগ ঝাঁক দূরে রাখিস। কাক ভেজা হয়ে এসেছে রে। সঙ্গে ছোট্ট পার্স আর মোবাইলটা ছাড়া কিছুই আনেনি। খুব মায়া হলো। জ্বর-টর এসে যাবে এই ভয়ে তাড়াতাড়ি আমার একটি জামা বের করে দিয়েছি পরার জন্য।’
লম্বা ম্যাসেজটি পড়তে পড়তে সহসা মুসকানের পানে তাকাল ইমন। আপাদমস্তক দেখে নিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল ফোনের স্ক্রিনে। মুসকান অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। সায়রীর ফোন এলো তক্ষুনি। ইমন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে চটপটে গলায় বলল
‘দোস্ত ম্যাসেজ গুলো দেখেছিস। একটু কষ্ট করে দেখে নে। আর শোন এসেছে যখন ধরে রাখ বিয়ের জন্য হ্যাঁ না করা অবধি ছাড়বি না।’
গমগমে কণ্ঠে ইমন জবাব দিল,
‘ইমন চৌধুরী এতটা ব্যক্তিত্বহীন নয়। যে আমাকে চায় না আত্মসম্মান খুইয়ে তার কাছে ভিখিরি হয়ে হাত পাতার ছেলে আমি না।’
কথাটা বলেই ফোন কেটে দিল ইমন। সে সায়রীর সমস্ত পরিকল্পনা ধরে ফেলেছে। এভাবে বাসা থেকে গায়েব হওয়ার পেছনের কারণটাও স্পষ্ট। এই মেয়েটা মানুষের ভালো করতে একশটা মিথ্যা অনায়াসে বলে দিতে পারে৷ জানে ইমন। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সে। শরীরে আর কুলোচ্ছে না। তাই শুয়ে পরার প্রস্তুতি নিল। এদিকে সায়রীকে বলা কথাটা শুনে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে দু-হাত কচলাচ্ছে মুসকান৷ ইমন শুয়ে পড়লে সে সম্বিৎ ফিরে পেল। বলল,
‘জলপট্টি দিয়ে দিই?’
চোখ তুলে তাকাল ইমন। একজোড়া সুগভীর দৃষ্টির কবলে পড়ে মুসকানের পাতলা, মসৃণ ঠোঁটজোড়া কাঁপতে লাগল। যা দেখে ইমন টিপ্পনী কেটে বলল,
‘যার সামনে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছ খুব কাছে এসে তার সেবা করবে কী করে?’
ক্ষীণ কণ্ঠে মুসকান বলল,
‘পারব।’
শক্ত কণ্ঠে ইমন শুধাল,
‘কেন এসেছ?’
আবারো বুক কেঁপে ওঠল মুসকানের। ইমন ফের প্রশ্ন করল,
‘আমি অসুস্থ শুনে তোমার ছুটে আসার কারণ কী?’
দুর্বলতায় ইমনের কণ্ঠ কেটে আসছিল। মুসকান বুঝতে পেরে নিজেকে শক্ত করে নিল। বলল,
‘সব প্রশ্নের উত্তর দিব। তার আগে জলপট্টি দিতে দিন।’
‘কোন অধিকারে এসেছ? কেনই বা সেবা করবে আমার?’
দৃষ্টি অন্যদিকে রেখে প্রশ্নটি করল ইমন। মুসকানের যেন জেদ চেপে গেল এবার৷ এত অসুস্থ কথা বলতে পারছে না৷ তবু রাগ দেখাচ্ছে। তীব্র জেদ নিয়ে তাই সে জবাব দিল,
‘কোন অধিকারে এসেছি এখনো আপনি বুঝতে পারছেন না?’
‘না।’
‘তাহলে বুঝতে হবেও না।’
কথাটা বলেই বেরিয়ে গেল রুম থেকে। খুঁজে খুঁজে ছোট্ট একটি বোলে পানি নিয়ে এলো। রুমাল বা গামছা জাতীয় কিছু না পেয়ে পরিহিত ওড়নার কোণা ভিজিয়েই জলপট্টি দিতে উদ্যত হলো। কিন্তু বাঁধা দিল ইমন। হাত বাড়িয়ে মুসকানের কব্জিতে শক্ত করে চেপে ধরে সরিয়ে দিল। বলল,
‘তোমার থেকে বিন্দু পরিমাণ আশাও আমি রাখি না৷’
বুকের ভেতরটা ধড়াস করে ওঠল মুসকানের। আকস্মিক দু-চোখ উপচে জল গড়াতে শুরু করল। খেয়াল করে দৃষ্টি সরিয়ে নিল ইমন৷ এই কান্না সব গণ্ডগোল করে দেবে তার। ভেবেই কম্বলের নিচে হাত দু’টো মুঠোবন্দি করে জিদ্দি গলায় বলল,
‘চলে যাও মুসকান। আমি দিহানকে ফোন করে দিচ্ছি। ও তোমায় গাড়িতে ওঠিয়ে দেবে।’
এবার যেন ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল মুসকানের। অবাধ্য হয়ে জোরপূর্বক ভেজানো ওড়না চিপে ইমনের কপালে চেপে ধরল। ধৈর্যহারা হলো আজ ইমনও। অধর কামড়ে দু-হাতে মুসকানের দুই বাহু আঁকড়ে ধরল শক্ত করে। আকস্মিক থাবায় মুখ থুবড়ে ইমনের গলায় পড়ল সে। মাথা ঠেকল ইমনের থুতনির কাছে। আতঙ্কিত হয়ে বড়ো বড়ো চোখে তাকাল মুসকান। ইমন যেন আজ তার ভেতরের সমস্ত কাঠিন্যতা উগ্রে দিল।
‘চাই না তোমার দয়া।’
ইমনের উত্তপ্ত শরীর আর উত্তপ্ত কণ্ঠে দেহ শিউরে ওঠল মুসকানের। নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করল না সে। বরং মাথা উঁচু করে পুরুষালি কঠিন চোখজোড়ায় দৃঢ় চাউনি নিক্ষেপ করে বলল,
‘আমি কাউকে দয়া দেখাতে আসিনি।’
‘কেন এসেছ?’
কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন ইমনের৷ মুসকান বলল,
‘ভালোবাসার টানে।’
তাচ্ছিল্য হেসে ইমন বলল,
‘লোক দেখানো টান আমার চাই না৷’
‘লোক কে দেখাচ্ছি না।’
বলতে বলতে কৌশলে ওড়নার ভেজা কোণা টুকু তুলে ইমনের কপালে চেপে ধরল। চোখ বুজে ইমন বলল,
‘চলে যাও মুসকান।’
‘যাব না।’
‘টিকতে পারবে?’
আকস্মিক চোখ খুলে প্রশ্নটি করল ইমন৷ বুক ধক করে ওঠলেও নির্ভয় দেখিয়ে মুসকান বলল,
‘আপনার থেকে পাওয়া সবকিছুতেই আমি টিকতে পারব।’
এহেন কথায় ওর দুই বাহু ছেড়ে দিল ইমন। মুসকান জলপট্টি দিতে দিতে বলল,
‘এই মুহুর্তে বিয়ে করতে চাইনি বলে আপনাকে আমি ছেড়ে দিয়েছি এমনটা নয় ছোটোসাহেব। আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।’
তাচ্ছিল্য হেসে মুখ ঘুরিয়ে রাখল ইমন। মুসকান দেখল সেই তাচ্ছিল্য হাসি। বলল,
‘বিয়েটা না হয় একটু দেরিতেই করতে চেয়েছি। তাই বলে আপনার ভালোবাসা এভাবে পালিয়ে যাবে? এ কেমন ভালোবাসা?’
মুসকানের এমন কথায় সহসা দু’হাতে ওর কোমর পেঁচিয়ে ধরল ইমন। আলগোছে উত্তপ্ত ঠোঁটজোড়া খুব আদুরে ভঙ্গিতে ছুঁইয়ে দিল পাতলা মসৃণ ঠোঁটজোড়ায়। শরীর জুড়ে তীব্র ঝাঁকুনি খেলে গেল মুসকানের। মুখ সরিয়ে দু-হাতে ইমনের মুখে বাঁধা দিয়ে বলল,
‘কী হচ্ছে?’
জ্বর শরীরে এমনিতেই মাতাল লাগছে নিজেকে। এরমধ্যে মুসকান তার এত কাছে। রাগ, জেদ, অভিমান, অসুস্থতা মিলেমিশে একাকার হয়ে পুরোপুরি মাতাল হয়ে গেল সে৷ কী হচ্ছে বোঝাতে দু’হাতে জাপ্টে ধরে কম্বলের নিচে নিয়ে নিল ওকে। কতক্ষণ ঠোঁটে উষ্ণ ঝড় তুলে গলায় মুখ ডুবাল। পেশি বহুল হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারল না মুসকান৷ আর না পারল ইমনের বলবান শরীরের নিচ থেকে নিজেকে সরাতে। ইমন নিজের মতো যতখুশি উত্তপ্ত স্পর্শে ভরিয়ে দিল ওর মুখ আর গলায়৷ একসময় অস্থির হয়ে রাগে, জেদে ইমনের অসুস্থ শরীরে আঁচড় দিল মুসকান৷ ‘আহ’ শব্দ করে ইমন থেমে গেলেও নিজের থেকে মুক্ত করল না মুসকানকে। ডান হাত উঁচিয়ে প্রিয়তমার গাল বেয়ে পড়া অশ্রু গুলো মুছতে মুছতে মাতাল গলায় বলল,
‘তুমি ভালোবাসার টানে কাছে আসতে পারো। আর আমি ভালোবাসার টানে আদর করলেই দোষ? ঘৃণায় মূর্ছা যেতে হবে, কেঁদে বুক ভাসাতে হবে?’
‘আমরা ম্যারেড নই। খুব বাড়াবাড়ি করেছেন আপনি। অসুস্থ না হলে সপাটে গালে দু’টো থাপ্পড় লাগিয়ে দিতাম।’
ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে কথাটা বলে বুক বরাবর ধাক্কা দিল মুসকান। ইমন ওর হাত চেপে ধরে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
‘একটা সুশীল ছেলেকে তুমি অশ্লীল করে দিলে মুসকান। আবার বেয়াদবিও করছ?’
‘মানে?’
‘বারো বছর ধরে যে মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি। যাকে বউ করার জন্য এতটা স্ট্রাগল করলাম। ঠুনকো কারণে সে আমায় এভাবে দূরে সরিয়ে রাখছে। আমি পুরুষ মুসকান। আমার কিছু নিডস আছে৷ এটা তোমাকে বুঝতে হবে। চোখের সামনে মনের নারী ঘুরঘুর করছে। অথচ তার জন্য আমার ফিলিংস আসবে না। তা কী করে হয়? আমার এই কথা গুলো শুনতে তোমার খারাপ লাগবে। আমার সম্পর্কে বাজে ধারণা তৈরি হবে৷ কিন্তু আমি সত্যি স্বীকার করতে কখনোই দ্বিধা করি না৷ আমি নিজেকে শুদ্ধ পুরুষ দাবি করতে পারি৷ কারণ আজ পর্যন্ত কোনোভাবে কোনো উপায়েই আমি আমার শারীরিক ক্ষুধা নিবারণ করিনি৷ চোখের সামনে তোমাকে দেখে কৈশোর পেরিয়েছি৷ তোমাকে ভালোবেসে যৌবন কাটাচ্ছি। কখনো কোনোদিন বাজে কোনো আকর্ষণ নিয়ে সামনে দাঁড়াইনি। নিজেকে কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ক্যারিয়ার গুছিয়েছি৷ যাতে খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে নিজের করে পাই৷ যেসব অবাধ্য ইচ্ছেরা মনের কোণে উঁকিঝুঁকি করে সেসবে বাধ্যতা দেয়ার চেষ্টা করেছি। বহু অপশন ছিল আমার কাছে। অনেক বন্ধুকে দেখেছি এরা ভালোবাসে একজনকে। কিন্তু নিজের পৌরুষ চাহিদা ভালোবাসার নারীকে দিয়ে মেটানোর উপায় নেই বলে অন্য নারীর কাছে যায়৷ কীভাবে যায় আশা করি ভেঙে বোঝাতে হবে না। আজ যখন কাঙ্ক্ষিত নারীকে হালাল ভাবে কাছে পেয়েছে তখন ওরা সম্পূর্ণ শুদ্ধ পুরুষ হয়ে ধরা দিতে পারেনি। আমি ওদের মতো নই মুসকান। তাই যেভাবেই হোক নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তোমাকে বউ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তা হতে দিলে না। তুমি প্রেমিকা হয়ে আরো কত বছর থাকতে চাইলে। প্রেমিকা হয়েই যদি থাকতে চাও আমিও তথাকথিত প্রেমিকের আচরণ দিব তোমায়। এতে তোমার খারাপ লাগুক। আমাকে নিয়ে বাজে ধারণা তৈরি হোক যায় আসে না৷ ঠিক এ কারণেই আমি দূরে সরে এসেছিলাম। তোমাকে দেখতাম না, কাছে পেতাম না। আর না অপবিত্র ইচ্ছেরা বাঁধনহারা হতো৷ ভুল করলে মুসকান মস্ত বড়ো ভুল।’
ইমনের মুখে অবিশ্বাস্য, বিস্ময়কর কথাগুলো শুনে
স্তব্ধ হয়ে গেল মুসকান৷ ভাষাহারা হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। কিয়ৎক্ষণ ওভাবে থেকে শেষে কণ্ঠ রোধ করে বলল,
‘ভালোবাসা শুধুই শরীর কেন্দ্রীক কেন হয় ছোটোসাহেব?’
‘মুসকান, আমার কিন্তু তোমাকেই চাই কেবল তোমাকে। আমার সামনে বিশ্বসেরা সুন্দরীরাও যদি নগ্ন দেহে শুয়ে থাকে তাদের প্রতি বিন্দু পরিমাণ ইন্টারেস্টও আসবে না। আমার সকল আকর্ষণ কেবল তোমাকে ঘিরে। এতগুলো বছর তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে পাওয়ার তৃষ্ণা, একটু ছোঁয়ার আকুলতা, আদর করার ইচ্ছেই যদি না জাগে তাহলে তো নিজের পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হয়৷ আমরা দু’জনই এডাল্ট মুসু৷ আর কীভাবে বোঝাব তোমায়? আমার তোমাকে চাই সম্পূর্ণ ভাবেই চাই। আমি তোমাকে আমার সব ভালোবাসা দিতে পারি না৷ আমাদের মাঝে কার এই দেয়াল আর সহ্য করতে পারি না৷ এই দেয়াল এই দূরত্ব আমার মাঝে হিংস্রতা এনে দিচ্ছে। আমি হিংস্র হয়ে যাচ্ছি। তাই দূরে সরে এসেছি৷ কারণ তোমার প্রতি ভালোবাসা ব্যাতীত আর কিছু প্রয়োগ করতে চাই না আমি৷ সেই সাধ্য নেই আমার।’
স্তম্ভিত মুখে তাকিয়ে রইল মুসকান৷ সেভাবেই বলল,
‘আমায় ছাড়ুন৷ আপনার শরীরের তাপে ঘেমে ওঠেছি আমি।’
চলবে..
রিচেক করা হয়নি। ভুল গুলোর জন্য দুঃখীত।