#চন্দ্রাবতী
#৮ম_এবং_শেষ_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
বৃন্দাবন দাস তার ছেলে জয় দাসকে নিয়ে এসেছেন।জয় যতটা মেধাবী তার ততটা ছাপ চেহারায় নাই। এই অল্প বয়সেই তার অনেক বড় ভুঁড়ি।দেখতেও খুব যে ভালো লাগে তা না।চন্দ্রার চেহারার কাছে সে নস্যি মাত্র।
কিন্তু এই ছেলেকেই পছন্দ হয়ে গেল অমল আর ভূবনের।তারা যে করেই হোক মেয়েকে ঘর থেকে বের করতে চান।নয়তো অধর্ম করে ফেলবে পাপিষ্ঠা মেয়ে!
চন্দ্রার সাজগোজ করে জয়ের সামনে আসার কথা। কিন্তু সে আসতে চাইছে না। ভূবন এবারও ভীষণ রেগে গেলেন। চোখ মুখ লাল করে তার ডান হাতটা উপরে তুলে চড় বসিয়ে দিলেন চন্দ্রার গালে। চন্দ্রা ব্যথায় গালে হাত চেপে ধরে বসে পড়লো। তারপর বললো,’মেরে ফেললেও মাহমুদকে আমি ভুলতে পারবো না।’
কিন্তু ভূবন অত সহজ মহিলা নন। তিনি চন্দ্রা কে সাজিয়ে গুজিয়েই জয়ের সামনে নিয়ে হাজির করলেন।জয় ওকে দেখে পলক ফেলতে পারলো না।সে ভাবতেও পারছে না ভগবান তার জন্য এমন চাঁদ সুন্দর মেয়ে রেখেছেন!
জয় চন্দ্রার সাথে কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করলো না।সে বললো,’আমার বাবার পছন্দই আমার নিজের পছন্দ। চন্দ্রা কে আমার পছন্দ হয়েছে।’
বৃন্দাবন দাস খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন বিয়ের ডেট পাকা করা হোক। ভূবন তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,’দিন কাল খুঁজে বের করুন। আগামী সপ্তাহে বিয়ে।’
‘তাহলে এই কথাই সই।’
বলে মিষ্টিমুখ করে চলে গেলেন বৃন্দাবন দাস আর তার ছেলে জয়।
আর হতবাক হয়ে শুধু ঠাঁই বসে রইল চন্দ্রা। তার আজ মরে যেতে ইচ্ছে করছে। মাহমুদকে না পেলে সে সত্যি সত্যি মরে যাবে।
‘
চন্দ্রা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।কেউ তাকে খাওয়াতে পারে না। দু চারদিন না খেয়ে অনেকটাই দূর্বল হয়ে পড়েছে সে। ওর দুঃখ দেখে বারিষের বুকটা কেঁপে উঠে। চোখ ফেটে উঁকি মারে জলকণা। তাই সে তার মাকে বললো,’মা,একটা প্লেটে করে খাবার দাও। আমি গিয়ে চন্দ্রা কে খাইয়ে দিয়ে আসি।ও ঠিক আমার কথা মানবে।’
ভূবন ছেলের হাতে প্লেট ভর্তি ভাত আর সবজি দিলেন। সেই খাবার নিয়ে চন্দ্রার কাছে গেল বারিষ।চন্দ্রা খাবার দেখেই বললো,’খাবার নয় আমায় বিঁষ এনে দাও বারিষদা। আমি বিঁষ খেয়ে মরে যাবো।’
বলে কেঁদে উঠলো চন্দ্রা। কাঁদতে গিয়ে কাঁদতেও পারছে না ভালো করে সে।তার শরীর কেমন দূর্বল হয়ে এসেছে। চোখ কেমন নিভে যাচ্ছে।আর চোখের নিচে জমেছে গাঢ় কালি।
বারিষ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,’কাদিঁস না চন্দ্রা।সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কিচ্ছু ঠিক হবে না বারিষ দা। কিচ্ছু ঠিক হবে না।’
‘ঠিক হবে। কিন্তু ততদিনে তুই তো মরে ভূত হয়ে যাবি। মাহমুদকে পেতে হলে তো তোকে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে না থাকলে ওকে পাবি কী করে?’
চন্দ্রা আবার কেঁদে উঠলো বারিষের গলা জড়িয়ে ধরে।
বারিষ বললো,’কাঁদিস না।এই নে ভাত খা।’
বলে সামান্য সবজি দিয়ে ভাত মাখিয়ে একটা নলা তুলে ধরলো বারিষ চন্দ্রার মুখের কাছে।চন্দ্রা কী কষ্টে যে সেই নলা মুখে নিলো। তারপর আর খেতে চায় না সে। কিন্তু বারিষ জোর করে খাওয়ালো।
‘
এদিকে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেল। ভূবন খুব চতুর মহিলা। তিনি আগেই জানতেন যে চন্দ্রা পালানোর চেষ্টা করতে পারে।তাই তিনি বিয়ের ডেটটা আরো এগিয়ে নিয়ে আসলেন। এবং কোন আত্মীয় স্বজনকেও শুনালেন না পর্যন্ত। তারপর একদিন বিকাল বেলা হঠাৎ করে বললেন,’কাল তোর বিয়ে চন্দ্রা।’
চন্দ্রা কথাটা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। এখন কী করবে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।সে মোটেও ভাবেনি যে এতো দ্রুত সবকিছু শেষ হয়ে যাবে তার।সে মনে মনে তার ভগবানকে ডাকছে।তার ভগবান কী এই বিপদের দিনে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন!
‘
‘
কাল চন্দ্রার বিয়ে।
রাতে চন্দ্রার সাথে শুয়েছেন ভূবন। তিনি আজ ঠিক করেছেন সারারাত ঘুমাবেন না।চন্দ্রাকে পাহাড়া দিবেন। কিন্তু রাত বারোটা বাজার আগেই তিনি ঘুমের কোলে ঢলে পড়লেন।এর আরো অনেক পরে তার দরজায় ঠক ঠক করে কে যেন নাড়া দিলো। ভূবন টের পেলেন না। চন্দ্রা তখন শুয়ে শুয়ে পরিকল্পনা করছিলো খুব সহজে এবং দ্রুত কীভাবে সে আত্মহত্যা করতে পারে এমন কিছু। কিন্তু দরজার নাড়া শুনে কেন যেন তার মনে আশার আলোর দেখা মিললো।সে চটপট বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখলো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বারিষ।বারিষ বললো,’চল।’
চন্দ্রা ভয় এবং আনন্দে কাঁদছে। কিন্তু শব্দ করছে না।সে আর দেরি না করে বললো,’চলো।’
ওরা খুব সাবধানে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।বারিষের হাতের মুঠোয় ধরা চন্দ্রার একটি হাত। তারা হাঁটছে পাশাপাশি।বারিষের বুকটা ঢিপঢিপ করে বাজছে।তার কেবল মনে হচ্ছে এই পথ যদি আর কোনদিন শেষ না হতো। কিন্তু
মিনিট দশেক হাঁটার পরেই বড় রাস্তায় এসে গেলো তারা। রাস্তার এক পাশে সাদা রঙের একটা মাইক্রোবাস দাঁড় করানো। সেই মাইক্রোবাসের কাছে গিয়েই বারিষ ডেকে উঠলো,’মাহমুদ, মাহমুদ?’
বারিষের ডাক শোনে চটজলদি দরজা খুলে দিলো মাহমুদ।আর হাত ধরে টেনে নিলো চন্দ্রাকে ভেতরে। তারপর বারিষের দিকে তাকিয়ে মাহমুদ বললো,’তুই সত্যিই মানুষ।সত্যিকারের মানুষ।’
চন্দ্রার কেন জানি তখন কান্না পেয়ে গেল খুব।সে কেঁদে কেঁদেই চিৎকার করে বললো,’বারিষ দা, আবার দেখা হবে আমাদের।’
তারপর ড্রাইভার স্টার্ট দিয়ে দিলো গাড়ি।বারিষ দু হাত উপরে তুলে টা টা দেখিয়ে বিদায় জানালো। তারপর ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল অনেক্ষণ বারিষ।আর ওরা চলে গেল ততক্ষণে অনেক দূরে।
‘
সে রাতে বাসায় ফিরে ছাদে উঠে গেল বারিষ।তার বুকটা কেমন পুড়ে খাক হয়ে গেছে।তার ভেতরে যে মনের মানুষ হারানোর ভয়ংকর রোগ হয়েছে তা থেকে একমাত্র বাঁচার উপায় মৃত্যু। তার বিশ্বাস মরে গেলেই একমাত্র সে ভুলতে পারবে চন্দ্রা কে।
তখন রাত প্রায় শেষ।আকাশে গোটা কয়েক তারা মিটমিট করে জ্বলছে আর কামিনী ফুল তীব্র ঘ্রান ছড়াচ্ছে বাতাসে।বারিষ এইসব ফুল আর তারাদের মায়া ছাড়িয়ে চলে গেল একেবারে ছাদের শেষ প্রান্তে। এরপর যা আছে তা শূন্য। ওখান থেকে পা ফসকে গেলেই মৃত্যু। কিন্তু বারিষ পা ফসকে পড়তে চায় না।সে চায় দ্রুত মৃত্যু।তাই সে আজ লাফাবে। লাফিয়ে মরবে। তার শরীর কেমন এখন থরথর করে কাঁপছে।কান্নায় বুক ভেঙে যাচ্ছে। কেন জানি বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে খুব। আচ্ছা মানুষ এতো কষ্টের পরেও বেঁচে থাকতে চায় কেন?
___সমাপ্ত___