#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-০৮
রাশেদ এর ঘরের সামনে এসে দাড়ালেন আকলিমা বেগম। ভেতর থেকে চন্দ্রার আর্তনাদের কন্ঠস্বর শুনতেই বুকটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো ওনার। ঘরের ভিতরে চন্দ্রার ওপর কি অনাচার চলছে তা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগলো না ওনার। তাই কাঠের দরজায় অনবরত আঘাত করতে লাগলেন তিনি আর চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,
–“হারামজাদা লজ্জ্বা করে তোর প্রেতেকদিন বউয়ের গায়ে হাত তুলতে? দোর খোল কইতাছি। নাহলে আজ তোর কি হাল করুম তুই নিজেই বুঝতে পারবি না কইলাম।”
এদিকে গফুর মিয়া আর সায়মাও এসেছে আকলিমা বেগমের পিছু পিছু। মিনিট দুয়েক আগে রাশেদের উদ্দেশ্যে আকলিমা বেগমের চেঁচিয়ে বলা কথাগুলো শুনে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে সাইমা। নিজেকেই নিজের গালি দিতে ইচ্ছে করছে ওর । কি প্রয়োজন ছিল জিদ ধরার। এখন যদি সবাই সবকিছু জেনে যায় তবে যে আর রক্ষে থাকবে না। না না কিছুতেই এমন অঘটন ঘটতে দিবে না ও। আগে সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে হবে তারপর সাইমা ওর আসল রূপ দেখাবে সবাইকে তার আগে নয়।
গফুর মিয়াকে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আকলিমা বেগম রেগে বলে উঠলো,
–“তুমি ওইখানে সং এর মত দাঁড়াইয়া কি করো? এহানে আহো। ”
আকলিমা বেগমের ঝাড়ি খেয়ে বেচারা গফুর মিয়া থমমতো খেয়ে বলে উঠলো,
–“এইতো আইতাছি।”
কথাগুলো বলে তিনি নিজেও আকলিমা বেগমের পাশে দাঁড়িয়ে দরজায় আঘাত করতে লাগলেন।
যেন আজ এই ঘরের দরজা ভেঙ্গেই ছাড়বেন ওনি।
অন্যদিকে ঘরের ভেতর থেকে মা বাবার কন্ঠ শুনতে পেয়ে চমকে উঠল রাশেদ । ওর সাথে সাথে চন্দ্রাও চমকে উঠলো খানিকটা। রাশেদ প্রথমে ভেবেছিলো ও হয়তো ভুল শুনেছে কিন্তু পুনরায় আবারো নিজের নাম শুনতে টনক নড়ল ওর । এর অর্থ ও ভুল শোনেনি । দরজার ওপাশে ওর বাবা-মা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আবারো চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠল ওর কপালে।
–“কি রে কতা কানে যাইতেছে না নাকি দরজা ভাঙ্গন লাগবো এহন?”
মায়ের কথা কানে আসতেই রাশেদ চন্দ্রার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–” মা রে তোমার কিছু কওন লাগবো না। যা কওয়ার আমি নিজেই কমু। তুমি দয়া কইরা পন্ডিত সাজতে যাইবা না।”
কথাগুলো বলে দ্রুত পায়ে দরজার দিকে চলে গেল রাশেদ। দরজার ছিটকিনি খুলতেই হুড়মুড় করে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়লেন আকলিমা বেগম ও গফুর মিয়া। সায়মা অবশ্য দোর গড়ার সামনেই দাড়িয়ে রইলো।
ঘরে ঢুকে প্রথমেই আকলিমা বেগমের চোখ গেল চন্দ্রার দিকে। বিছানার এককোনে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে চন্দ্রা । শরীরে এখনো গতরাতের মারের আঘাতগুলো রয়ে গেছে ওর। চন্দ্রার দিকে এক পলক তাকিয়েই অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের দিকে। তারপর বললেন,
–” মাইয়াডারে আজ মারছোস কিল্লাই?”
মায়ের কথা শুনে রাশেদ ধীর কন্ঠে বলল,
–“দোষ করছিল তাই মারছি।”
–“কি দোষ করছিল শুনি?”
–“দেহো মা এতো কথার জবাব দিবার পারুম না। আমার বউ আমি মারছি এতে তো কারো কোন সমস্যা হওনের কতা না।”
রাশেদের কথা শুনে গফুর মিয়া চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
–“ক্যান মারবা ক্যান? আমাগোর বংশের পূর্ব পুরুষেরা তো বউ মারে নাই। আমি নিজে তোমার আম্মার গায়ে কোন দিন হাত তুলি নাই। তাইলে তুমি কোন সাহসে বৌমার গায়ে হাত তোলো কও দেহি?”
–“আব্বা…….
গফুর মিয়ার প্রশ্নের উত্তরের রাশেদ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই আকলিমা বেগম সজোরে চড় মারলেন রাশেদকে । তারপর জোর গলায় বললেন,
–“তুই কি ভাবছোস তোর এ সব কাজ কারবার করার পিছনের কারণ আমরা জানবার পারুম না? আবারো কইতাছি ভালো হইয়া যা। আমার বাড়িত এমন অনাচার কিছুতেই সহ্য করুম না আমি। ”
রাশেদকে কথাগুলো বলে সাইমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
–” বড় বউ তুমি যদি ভাইবা থাহো যে কোনদিন তোমারে আমি আমার ছোট ছেলের বউ করুম তাহলে ভুল ভাবতাছো। তোমারে তো আমার শাহেদ মরনের পর পরেই বিদায় করতে চাইছিলাম কিন্তু শাহেদ আমারে কইছিল তোমারে যেন বাড়ি থেকে না বাহির কইরা দেই। তাই এহনো এই বাড়িতে আছো তুমি। কিন্তু মনে রাইখো আমি যদি ঘুর্ণাক্ষরেও কোনদিন কোন কিছু জানবার পারি তবে সেই দিন তোমার এই বাড়িত হইবো শ্যাষ দিন।”
কথাগুলো শেষ করে চলে গেলেন চন্দ্রার দিকে। রাশেদ নত মাথাই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। রাশেদকে বেরোতে দেখেই সাইমাও চলে এলো সেখান থেকে।আপাতত আকলিমা বেগমকে না খোচানোই ভালো। তবে সময় আসলে ঠিক নিজের কাজ হাসিল করে নিবে ও। দিনের বাকি সময়টুকু শ্বাশুড়ির সেবাই কেটে গেলে চন্দ্রার।
এদিকে বিকেলের দিকে মাষ্টার বাড়ি থেকে বের হলো চারু। সারাদিন নানীর সাথেই ছিল আজ। সকালে চন্দ্রাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবলেও কাজের তোড়ে সেদিকে যাওয়া হয় নি ওর। তাই এই পড়ন্ত বিকেলে চন্দ্রাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়েছে ও। পথিমধ্যে দেখা হলো ফুলির সাথে। চারুকে দেখেই ফুলি হাসতে হাসতে বলে ওঠল,
–“ওমা চারু তুমি কহন আইলা? ”
ফুলিকে বেশ ভালো লাগে চারুর। সহজ সরল মেয়েটাকে ভালো না লেগে যাবে কোথায়। ফুলির কথাই চারু হেসে উত্তর দিলো,
–“জি মামী গতকাল সন্ধ্যায় এসেছি। ”
–“তা কয় দিন থাকবা এবার নাহি সখি নাই বইলা চইল্যা যাইবা?”
ফুলির কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল চারুর। রূপগঞ্জে আসার মূল কারণ ছিল চন্দ্রা। ভেবেছিল অনেক দিন পর দুই সখি মিলে খুনসুটিতে দিন কাটাবে কিন্তু চন্দ্রা নেই শুনে ওর সব আশা শেষ হয়ে গেল। এবার ছুটি তাহলে নিরামিষ ভাবেই কাটবে। কথাগুলো মনে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চারু বলল,
–“কবে গিয়েছে চন্দ্রা?”
–“তিন দিন আগে। তয় জানো যাওনের আগে ওর মুখডা ভার আছিল । মনে হইতাছিল যাওনের মন আছিল না ওর কিন্তু জোর কইরাই যাওন লাগতাছে।”
ফুলির কথা শুনে চারুর মনে সন্দেহের দানা বাঁধতে লাগল। কেন যেনো ওর মনে হচ্ছে নিশ্চয় চন্দ্রার সাথে কিছু হয়েছে তাই ফুলিকে আবারো প্রশ্ন করল,
–” চন্দ্র এমন হঠাৎ করে বাড়িতেই বা এলো কেন? আবার এমন তড়িঘড়ি করে চলেই বা গেলো কেনো? এ বিষয়ে কিছু জানো কি তুমি? ”
–“বেশি কিছু জানিনা। তয় চন্দ্রা যেদিন আইছিল সেদিন ওর গায়ে অনেক মারের চিহ্ন দেখছিলাম। মনে হইতাছিল ওরে কেউ মারছে।”
ফুলির কথা শুনে চিন্তার মাত্রা যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল চারুর। তড়িঘড়ি করে ফুলির থেকে বিদায় চলে গেল চন্দ্রাদের বাড়ি দিকে।
বিলকিস বেগম তখন সারাদিনের কাজ শেষ সবে গোসল করে কলপাড় থেকে বের হয়েছেন। ঠিক এমন সময় আগমন ঘটল চারুর। চারুকে দেখেই বিরক্ত হলেন তিনি। চারুকে পাড়ার সবাই ভালোবাসলেও খুব একটা পছন্দ করেন না তিনি । কারন চারু সবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করে হোক সে ছেলে,বুড়ো বা মেয়ে। বিলকিস বেগমের মতে,
–“মেয়েদের এত প্রতিবাদ করনের দরকার নাই। মাইয়্যা মানুষ চুপচাপ ঘরে থাকবো। ”
বিলকিস বেগমের বিরক্তি ভাব ঠিকই বুঝতে পেরেছে চারু। তবুও হাসি মুখে বলল,
–” কেমন আছো নানী? নানু কেমন আছে? ”
বিলকিস বেগম গম্ভির স্বরে বলল,
–“ভালা আছি। তুমি কেমন আছো? কবে আইল্যা?”
–“আমি গতকাল সন্ধ্যায় এসেছি। চন্দ্রার খবর কি নানী?”
–“চন্দ্রাও ভালা আছে।”
–“কিন্তু আমি যে শুনলাম চন্দ্রার স্বামী নাকি মারধর করে ওকে এখানে পাঠিয়েছিল।”
–“কেডা কইছে তোমারে? স্বামী-স্ত্রীর মাঝে এমন দু-একডা ঝগড়াঝাটি লাইগাই থাহে। ও এমনিতেই ঠিক হইয়া যাইবো।”
চন্দ্রার স্বামীর কথাটা এমনিতেই আন্দাজে ঢিল ছুড়ে ছিল চারু। কিন্তু বিলকিস বেগমের কথায় এখন পুরোপুরি নিশ্চিত ও। এই রাশেদকে তো দেখেই ছাড়বে ও। তবে তার আগে বিলকিস বেগমকে কিছু বলা প্রয়োজন।
–“তুমি মা হয়ে তোমার মেয়েকে সেই জেলখানায় আবারো পাঠিয়ে দিলে। কেমন মা তুমি?”
ছাড়ার কথা শুনে বিলকিস বেগম তেতিয়ে বলে উঠলেন ,
–“হুনো আমারে জ্ঞান দিতে আইবা না বুঝছো ।আমরা গরীব ঘরের মানুষ। আমাগোর কষ্ট তোমরা কি বুঝবা? তোমরা তো বড়লোক মানুষ, যখন খুশি তখন যা খুশি করবার পারো কিন্তু আমরা তা পাই না। হুনো অনেক কষ্টে আমি আমার মাইয়্যাডারে ওর শ্বশুর বাড়িতে পাঠায় দিয়েছি তুমি আররে আস্কারা দিও না।”
–“শোনো নানী চন্দ্রাকে তো আমি ওই নরক থেকে বের করবই। সেই সাথে ওর প্রতি যে অন্যায় করেছে তাকেও শাস্তি দিবো আমি। সে তুমি চাও বা না চাও।”
–“দেহো চারু খবরদার আমার মাইয়াডারে তুমি উষ্কাবা না। নাহলে……..
–” তুমি তো ভালো করেই জানো চারু কোন কাজ করবে বলে ঠিক করলে তা থেকে পিছ পা হয় না। আমি আমার কাজ করবোই তুমি মা খুশি করে নিও। চন্দ্রাকে নিয়ে কিছু ভাবতে হবে না তোমার। ও এখন থেকে আমার সাথেই থাকবে ।”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই বিলকিস বেগমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল চারু। তারপর হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল শান বাঁধানো পুকুর পাড়টির দিকে। ততক্ষনে সূর্যি মামা আকাশটাকে লাল আভায় রাঙিয়ে দিয়ে ঢলে পড়ছে পশ্চিম আকাশের দিকে আর কিছুক্ষণ পরেই অস্ত যাবে সে। অস্ত যাবে আরো একটি দিন ,সেই সাথে যুক্ত অতীতের খাতায় যুক্ত হবে আজকের দিনটি।
চলবে