চন্দ্রাবতী,পর্ব:৬

0
309

#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-০৬

সেদিনের সেই কালো রাত্রির পরে কেটে গেছে তিন দিন । এই তিন দিনে কোনো পরিবর্তন ঘটে নি চন্দ্রার জীবনে। সেই একই প্রবাহমান রুটিনে কেটে যাচ্ছে ওর দিনগুলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির কাজ দিয়ে শুরু হয় ওর দিন আর শেষ হয় রাতের নিকষ কালো আঁধারে রাশেদের করা অত্যাচারের মাধ্যমে। প্রথম প্রথম এ নিয়ে প্রতিবাদ করলেও এখন খুব একটা প্রতিবাদ করে না ও। আর যদিওবা প্রতিবাদ করে তবে তার বদৌলতে লাথি আর মার জুটে ওর কপালে। তাই চুপচাপ ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে চন্দ্রা।

প্রতিদিনের মতো আজকেও চন্দ্রা ঘুম থেকে ওঠেই কাজে লেগে গেছে। ওঠান আর ঘর ঝাড়ু দিয়ে আকলিমা বেগমকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে এলো ও। সাইমা এখনো ঘুম থেকে ওঠে নি। সকালেই বলে দিয়েছে ও অসুস্থ তাই ওকে যেন কেউ ডাকাডাকি না করে। অগত্যা চন্দ্রাকেই একা হাতে সব কাজ করতে হয়েছে আজ। শুধু আজ নয় বেশিরভাগ দিনই চন্দ্রা বাড়ির সব কাজ একা হাতেই করে।

সকালে রান্না শেষে চন্দ্রা ওর শ্বাশুড়ীর কথা মতো রাশেদকে ডাকতে ওদের ঘরে চলে যায় । ঘরে গিয়ে দেখে রাশেদ তখনো ঘুমে বিভোর হয়ে রয়েছে। আজকাল রাশেদকে দেখলেই কেমন যেন ঘৃণার সৃষ্টি হয় ওর তবুও বিরক্তি মাখা মুখে রাশেদের দিকে এগিয়ে গিয়ে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে চন্দ্রা ওঠলো,

–” আম্মা আপনারে ওঠতে কইছে। তাড়াতাড়ি উঠেন।”

চন্দ্রার ধাক্কাতে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যায় রাশেদের। অতঃপর পিটপিট করে চোখের পাতা খুলে রাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ,

–“কি হয়েছে কি ? এমন হাক-ডাক পারতাছো ক্যান? বাড়িত চোর -ডাকাত আইছে নাহি?”

–“চোর-ডাকাত আহে নাই । আপনি থাকতে আবার চোর-ডাকাত আহন লাগে নি?”

–” কি করবার চাও তুমি?”

–” কইতে তো অনেক কিছুই চাই কিন্তু কইতে পারি না। আপনারে আম্মা আর আব্বা ডাহে। এছাড়া আমার এত শখ জাগে নাই আপনারে ডাকনের।”

রাশেদ চন্দ্রার কথা শুনে স্মিত হেসে বলল,

–” সাহস দেখছি আবার বাইড়্যা গ্যাছে? গতকালের মারের কথা মনে আছে নি নাহি মনে করোন দেওন লাগবো আবার ?”

–“থাক আপনারে আর এত কষ্ট করন লাগতো না।আমার সবকিছুই মনে আছে । একদিন সবকিছু সুদে-আসলে ফিরাইয়া দিমু আমি।”

–“তাই নাহি। ঠিক আছে সেদিনের আশায় রইলাম।”

–” থাহেন তয় সেই দিন আহোনের বেশি দেরি নাই।”

–” ঠিক আছে অপেক্ষায় রইলাম।”

বিদ্রূপের স্বরে কথাগুলো বলল রাশেদ । অতঃপর বেরিয়ে গেল মায়ের ঘরের দিকে । চন্দ্রাও এলোমেলো বিছানা গুছিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

মিয়া বাড়ির বড় ঘরটিতে বসে আছে সবাই । চন্দ্রা আর সায়মা খাবার পরিবেশন করতে ব্যস্ত। গফুর মিয়া আর আকলিমা বেগম তৈরি হয়েই খেতে বসেছেন। খাবারের পাট চুকতেই তারা রওনা দেবেন জমিলা বেগমের বাড়ির উদ্দেশ্যে। জমিলা বেগম সম্পর্কে আকলিমা বেগমের বড় বোন হন। বাড়ি অলিন্দপুর। বোনের অসুস্থের কথা শুনে অলিন্দপুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন‌ আকলিমা বেগম। আকলিমা বেগমের সিদ্ধান্তে অমত করেন নি শান্তশিষ্ট গফুর মিয়া।

খাওয়া – দাওয়া শেষ করে আকলিমা বেগম সাইমার উদ্দেশ্যে বললেন,

–” বড় বউ আমি আর তোমার আব্বা মিইল্যা অলিন্দপুর যাইতাছি। চার-পাঁচ দিন থাকন লাগবো বোধহয়। বাড়ির দিকটা তুমি আর চন্দ্রা মিইল্যা খেয়াল রাইবা। তুমি জানি বাপু অত পইড়া পইরা ঘুমাইও না । চন্দ্রার লগে হাতে হাতে কাজ করবা । শশুর বাড়ি আইয়া অত শুয়ে বসে কাটাইলে চলব না। গায়ে-গতরে খাটতে হইব। আমার কথাটা বুঝছো নি?”

শাশুড়ির কথায় সাইমা মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখ ফুটে বলে উঠলো,

–“ঠিক আছে আম্মা । আইজ একটু অসুস্থ আছিলাম তো তাই সকালে উঠবার পারি নাই। তয় আপনি কোন চিন্তা করবেন না মা , আমি আর চন্দ্রা দুজনে মিইলা বাড়ির দেখাশোনা করুম নে।”

–“শুধু কথায় কইলে হইব না , কাজে করোন দেখোন লাগব।”

–“জি মা।”

–“চন্দ্রা তুমি তো জানো আমি সাইমারে খুব একটা ভরসা পাই না। তুমি একটু বাড়ি-ঘরগুলান দেইখা রাইখো। আর হুনো ধান এই কয় দিনে শুকাইয়া গ্যাছে। তাই ধান শুকাতে দিতে হইব না আর।”

–“ঠিক আছে আম্মা। আপনি কোন চিন্তা কইরেন না। আমি আছি তো, সবকিছু দেইখা রাখুন।”

–“তুমি আছো বইলাই নিশ্চিন্তে যাইতে পারতাছি।”

সবার সাথে কথা বলে গফুর মিয়া ও আকলিমা বেগম বেরিয়ে পড়লেন তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। রাশেদেও ওনাদের এগিয়ে দিতে গেল। আজ ওর মন খুব ভালো। গফুর মিয়া ও আকলিমা বেগম চলে যাওয়ার পরে সাইমা বেশ কটাক্ষ করেই চন্দ্রাকে বলল,

–” খুব তো যাদু জানো দেহি। তা আম্মা- আব্বাকে কি করে বশে আনলা আমরাও একটু শুনি।”

সাইমার কথা শুনে চন্দ্রা মুচকি হেসে বলে উঠলো,

–” কি যে কও ভাবি। যাদুর কি জানি। যাদু যদি জানতামই তাহলে তো সব্বার আগে নিজের স্বামীরেই বশে আনতাম। কিন্তু তা আর পারলাম কই। এহন তো আমার মনে হয় আমার থেইকা তুমিই বড় যাদুকর। না হলে কি পরের স্বামীরে নিজের বশে আনতে পারতা নি।”

চন্দ্রার কথা শুনে সাইমা রেগে বলে উঠলো,

–“কি কইতে চাইতাছে তুমি চন্দ্রা? তুমি আমার চরিত্রে দাগ লাগাইতে আসছো। মানলাম আমিই খারাপ তাইলে তোমার মহৎ চরিত্রবান স্বামী আমার কাছে আহে ক্যান? তোমার স্বামীরে তুমি আটকাইতে পারো না ? নাহি তোমার স্বামীরে তুমি সুখ দিবার পারো না। কোনটা?”

সাইমার কথাগুলো শুনে চন্দ্রার শরীর যেন ঘৃণায় রি রি করে উঠলো। একটা মানুষ এতটা খারাপ কি করে হতে পারে তা ভেবে পেল না ও। নিজেকে যথাসম্ভব সামলিয়ে বিদ্রুপ করে উত্তর দিলো চন্দ্রা,

–” পুরুষ মানষের তো কুকুরের স্বভাব ‌। তাই যেহানে যা দ্যাহে তাই খাইতে থাহে। আপনি কিল্লাই তার সাথে ওমন সম্পর্কে জড়াইলেন? আর আমি আগে কোন দিনও কই নাই মানুষডা ভালা । ও তো একডা মানুষরুপি পিশাচ। ”

–” তো পিশাচের লগে ঘর করতাছো ক্যান? চইলা গেলেই পারো?”

–” ঘর করমু না বইলাই বাপের বাড়ি থেইকা আসবার চাই নাই এবার কিন্তু আপনার পেয়ারের রাশেদ জোর কইরাই আমারে নিয়া আসছে। বিশ্বাস না হইলে আপনার পেয়ারের রাশেদরে জিগাইয়েন।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চন্দ্রা নিজের ঘরের দিকে চলে গেল । এদের সাথে বেশি কথা বলা মানে নিজের সম্মান নষ্ট । আজকাল এদের সাথে কথা বলতেও চন্দ্রার রুচিতে বাধে। চন্দ্রা ওর ঘরের খিল দিয়ে ভেতরে বসে চুপচাপ চোখের অশ্রু গড়াতে লাগলো। কবে এই জেলখানা থেকে মুক্তি পাবে ও? নাকি সারাটা জীবন এই জেল খানায় পচে মরতে হবে ওকে । কে জানে শেষ অব্দি কি লেখা আছে চন্দ্রার কপালে?

এদিকে ভর দুপুরে বাজার থেকে ঘেমে নেয়ে বাড়ি ফিরেছে রাশেদ। বাবা- মাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে চায়ের দোকানে বসেছিল ও। বন্ধু-বান্ধব সবার সাথে গল্প করতে করতে দুপুর গড়াতেই বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। বাড়ি ফিরে নিজ ঘর থেকে গামছা আর লুঙ্গি নিয়ে ছুটল কলপাড়ের দিকে। গোসল করে সোজা চলে গেল সাইমার ঘরের দিকে। আজ বাড়িতে ওরা তিনজন ব্যতিত আর কেউ নেই। তাই আজ লুকিয়ে চুরিয়ে যাবার প্রয়োজনবোধ করল না ও। এদিকে চন্দ্রা সবটাই লক্ষ্য করেছে কিন্তু ওর করার মতো কিছু নেই।

এদিকে ঘরে ঢুকতেই দেখলো সাইমা কাঠের বিছানায় বসে কান্না করছে। ওর ভাইয়ের বিয়ের আগে থেকেই সাইমার সাথে ওর সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক দুজনের বিয়ে হবার পরেও রয়ে গেছে এখনো। ভাই মারা যাবার পর ও সাইমাকে বিয়ে করবে ভেবেছিল কিন্তু এতে বাধ সাধে ওর মা। আকলিমা বেগম রাশেদকে হুমকি দিয়েছিল যে ও যদি সাইমাকে বিয়ে করে তবে ওকে ত্যাজ্য পুত্র করবেন। মায়ের কথার ভয়ে আর পা বাড়াই নি রাশেদ তবে সাইমাকেও ছাড়ে নি। যদি কোনভাবে বাবা – মায়ের থেকে সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে পারে তবে সাইমাকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে ও। রাশেদ কথাগুলো মনে মনে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাইমার পাশে বসে ওকে জিজ্ঞাসা করল,

–“কি হইছে? এভাবে কানতাছো ক্যান?”

রাশেদের প্রশ্ন শুনে সাইমা ফোলা ফোলা চোখে রাশেদের দিকে তাকিয়ে আবারো ডুকরে কেঁদে ওঠলো। ইতিমধ্যে কান্না-কাটি করে চোখ-মুখ ফুলিয়ে একাকার করে ফেলেছে ও। সাইমাকে আবারো কাঁদতে দেখে রাশেদ আদুরে কন্ঠে বলে ওঠলো,

–“আবারো কান্না শুরু করলা। কি হইছে আমারে না কইলে আমি বুঝমু কেমনে? আমারে কইতে হইবো তো নাহি?”

রাশেদের কথা শুনে কান্নাভেজা কণ্ঠে সাইমা বলল,

–“তুমি চন্দ্রারে কবে ছাড়বা তাই আগে কও? তুমি যহন ওরে ছুও তহন আমার খুব কষ্ট হয়। আমি তোমারে ওর লগে সহ্য করবার পারি না।”

সাইমার কথা শুনে রাশেদ বুঝতে পারল চন্দ্রার সাথে ঝামেলা হয়েছে সাইমার। আলতো স্বরে বলল,

–“তোমারে বিয়া করুম বইলাই তো এতো কষ্ট করতাছি। তয় চন্দ্রারে এহন ছাড়ন যাইবো না। আগে সম্পত্তিগুলান হাতে আনি তারপর ওরে ছাইড়া দিমু। বুঝলা আমার সাইমা রানী। এহন কও তো কি হইছে?”

রাশেদের প্রশ্ন শুনে সকালের সব কথা একনাগাড়ে বলে দিলো সাইমা। রাশেদ অবশ্য কিছু কথা ও বানিয়ে বানিয়ে বলেছে যাতে চন্দ্রার ওপর রাশেদ রেগে যায়। হলোও তাই। সাইমার কথা শুনে রাশেদের দু-চোখ রাগে লাল হয়ে গেল। তাই সাইমার কথা শেষ না হতেই ছুটে চলে গেল নিজ ঘরের দিকে।ঐখানেই চন্দ্রাকে পাওয়া যাবে এখন। এদিকে রাশেদ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই চোখের পানি মুছে মুচকি হেসে সাইমা বলে ওঠল।

–” তুমি আমারে এহনো চিনো না চন্দ্রা। এহন বুঝবা আমি কি জিনিস। শুধু সম্পত্তি গুলান হাতে পেলেই সব্বাইকে এই বাড়ি থাইকা যদি বাহির না করছি তয় আমার নামও সাইমা না।”

সাইমার কথা শেষ না হতেই ওপাশের ঘর থেকে শোনা গেল এক নারী কন্ঠের আর্তনাদ।

এদিকে বিকেলের গোধূলি লগ্নে গ্রামের আঁকা বাঁকা মেঠো পথে হেঁটে নানা বাড়ি যাচ্ছে চারু। বয়স আনুমানিক সতের বছর। গৌঢ় বর্নের চেহারা, ঠিকঠাক দেহের গড়ন, কাজল কালো দুইটি চোখ। কমোড় অব্দি গড়িয়ে পড়া মাথার চুল হেমন্তের এই মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে। সময় এখন পড়ন্ত বিকেল। সূর্য মামা আকাশটাকে লাল রঙে রাঙিয়ে অস্ত যাচ্ছে পুব আকাশের কোলে। ক্লান্ত – শ্রান্ত পাখিরাও তাদের নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততা শেষে গৃহস্থ কৃষকেরাও ফিরছে নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে।
আজকের মতো শেষ হলো তাদের কাজ। সেই ঘরমুখো কৃষানদের সাথেই গুটি গুটি পায়ে চারু এগিয়ে চলেছে রূপগঞ্জের দিকে।

চারু যখন মাষ্টার বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছায় তখন ধরনীর বুকে নেমে এসেছে নিকষ কালো অন্ধকার। সন্ধ্যা নামতেই গ্রামের প্রতিটি ঘরে জ্বলে ওঠেছে কুপবাতি। নাতনির আগমনের বার্তা পেয়েই কুপি হাতে বেরিয়ে এলেন আনোয়ারা বেগম। অতঃপর সানন্দে নাতনিকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। আমজাদ হোসেন তখন মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছেন। চারু আসবে জানলে তিনি নিজে গিয়ে নিয়ে আসতেন ওকে। কিন্তু চারু আজ সবাইকে না জানিয়েই এসেছে রূপগঞ্জে। এত দিন পর নাতনীকে কাছে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন আনোয়ারা বেগম। পরম আদরে জড়িয়ে নিয়ে আছেন চারুকে। চারুও ওর খুনসুটি দিয়ে ব্যস্ত রেখেছে পুরো মাষ্টার বাড়িকে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here