#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-০৫
তখন প্রায় মধ্যরাত। ঘড়িতে হয়তো আনুমানিক দুটো বাজে । অর্থাৎ এখন রাত্রি দ্বিপ্রহর। চারিদিক শুনশান, নিস্তব্ধ। শুধু বাহির থেকে একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে । আলুথালু জ্যোৎস্নায় একমুঠো কুয়াশার চাদরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে বাহিরের প্রকৃতি। কখনো কখনো ছোট ছোট গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে জ্বলে উঠছে জোনাক পোকার মিটিমিটি আলো । সেইসাথে দখিনা হাওয়ায় ভেসে আসছে বনো ফুলের মিষ্টি গন্ধ।
চন্দ্রা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাহিরের সীমান্তের দিকে। চোখে শুকিয়ে যাওয়া পানির দাগ এখনো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। গায়ের শাড়িও এলোমেলো হয়ে আছে ওর। চন্দ্রার পাশে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে রাশেদ। নিশ্চিন্তে ঘুমাবেই বা না কেন ?এতক্ষণ চন্দ্রার ওপর যে পাশবিক অত্যাচারের চালিয়ে বেশ শান্তি পেয়েছে ও।
চন্দ্রা নিজের গায়ে আঘাতের চিহ্ন গুলো দেখে আবারও ডুকরে কেঁদে উঠল। তখন চন্দ্রাদের ছোট্ট কুঠরিতে এনে বেধড়ক মেরেছে ওকে রাশেদ। তবুও ওর মন ভরেনি তার তাইতো এই আঘাতপ্রাপ্ত শরীরেও রাশেদকে চন্দ্রার দিতে হয়েছে যৌন তৃপ্তি। এটা অবশ্য আজ প্রথম নয় ও বাড়িতে থাকতেও চন্দ্রাকে এভাবেই প্রতিদিন নিজ স্বামী নামক লোকটির কাছে হতে হয়েছে ধর্ষিত। তবে আজ রাশেদ চন্দ্রাকে শাস্তিস্বরূপ সারা গায়ে কামড়ের ক্ষত উপহার দিয়েছে। চন্দ্রার শরীরে এমন কোন স্থান নেই যেখানে রাশেদের কামড়ের দাগ নেই। গায়ের ক্ষতের থেকেও আজ মনের ক্ষত বেশি পুড়াচ্ছে চন্দ্রাকে। আপনজনকে না পাওয়ার তীব্র যন্ত্রনা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে ওকে।
বাঁশ বাগানের মাথার উপর পূর্ণিমার গোল চাঁদ ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে পুব আকাশের কোলে। আর কিছুক্ষণ পরেই উদয় হবে ভোরের লাল টকটকে সূর্য। সূচনা হবে আরও একটি নতুন দিনের। চন্দ্রাও অপেক্ষা করে আছে সেই দিনের যেদিন ও এই রাশেদ নামক পাশন্ডটার হাত থেকে মুক্তি পাবে।
সন্ধ্যা আকাশের গোল চাঁদের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
–“চাঁন্দ তুমি তো সব্বাইরে তোমার আলোয় আলোকিত করো। তোমার এই চান্দের কিছু আলো আমারে ধার দিবা? তোমার আলোয় আমি আমার জীবনের অন্ধকার দূর করতাম।”
একটু দম নিয়ে চন্দ্রা কান্নাভেজা বলে আবারো বলে উঠলো,
–“জানো চান্দ আমারো বড় ইচ্ছা আছিলো আমি আমার স্বামীরে লইয়া তোমার আলো গায়ে মাখুম, তোমার আলোয় খেলা করুম। দুজনে মিইল্যা আমাগোর পুকুর ঘাটে বইসা জ্যোৎস্নাবিলাস করুম আর সারাডা রাত গল্প করুম । গল্প করতে করতে ঘুম আইলে তার কোলে মাথা রাইখা ঘুমামু কিন্তু তা আর হইলো না ভাগ্য আমাকে এমন এক মানুষের লগে মিলাইয়া দিছে যার মনে আমার জন্য কোন মায়া-দয়া নাই।”
ভাগ্যকে দোষারোপ করতে করতে সারাটা রাত নির্ঘুমে কেটে দিলো চন্দ্রা। কাক ডাকা ভোরে ওঠে গায়ের শাড়ি ঠিক করে চলে গেল শান বাঁধানো পুকুর পাড়ের দিকে। তখন সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। চারিদিকে হালকা কুয়াশা স্তর পড়েছে। চারিদিক জন-মানবহীন তখনো। চন্দ্রা আশেপাশে তাকিয়ে অতঃপর পুকুরে ঠান্ডা পানিতে নেমে গেল চন্দ্রা । তারপর ডলে ডলে তুলতে লাগলো রাশেদের নোংরা স্পর্শগুলো। কিন্তু হায় এভাবে কি শরীর থেকে স্পর্শ মুছে ফেলা যায়?
এদিকে গত রাতে মাষ্টারবাড়ির লাহারি ঘরের ছোট্ট চৌকিতে ঘুমিয়েছিলেন বিলকিস বেগম ও রমজান নিয়ে । শেষ রাত থেকে ধানের কাজ শেষ করে এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন তিনি । জামাইয়ের জন্য সকালের খাবার রাধতে হবে যে তার।
বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখলেন চন্দ্রা ওর ভেজা কাপড়গুলো শুকাতে দিচ্ছে চন্দ্রা। চন্দ্রার গায়ে সাদা শাড়ি দেখেই ধমকে উঠলেন বিলকিস বেগম। বললেন,
–“এই তুই সাদা রংয়ের শাড়ি পরছিস কিল্লাই? আর কোন শাড়ি আছিল না?”
মায়ের কথা শুনে চন্দ্রা মুচকি হেসে বলল ,
–“ক্যান সাদা রংয়ের শাড়ি পড়লে কি হইবো? তাছাড়া শাড়িতো শাড়িই তার আবার বাছন-কছন আছে নি?”
–“খবরদার চন্দ্রা হেঁয়ালি করবি না। তুই জানোস না সাদা রং বিধবার রং।”
–” তোমারে এই কথা কে কইল মা ? তুমি কি জানো সাদা রঙ পবিত্রতার প্রতীক । ”
চন্দ্রার এমন ভারী ভারী কথা শুনে বিলাকিস বেগম বিরক্ত স্বরে বলে উঠলেন,
–” এসব এতকিছু আমি বুঝি না । তুই এই সাদা শাড়ি পড়বি না ব্যস ।”
মায়ের কথা শুনে চন্দ্রা মনে মনে বলল,
-‘ মানুষটা তো আমার কাছে সে কবেই মইরা গ্যাছে মা। নতুন কইরা আর কবে মরবো?”
কিন্তু মুখে হাসি ফুটে বলে উঠলো,
–” ঠিক আহে মা এর পর থেইকা মনে রাখুম নে কথাটা । ”
–” আইচ্চা এবার আমার লগে আয়। জামাই ঘুম থেকে উঠোনের আগেই রান্না করোন লাগবো তো।”
চন্দ্রা কোন কথা না বলে ওর মায়ের পিছুপিছু চলে গেল রান্না ঘরের দিকে। রান্না শেষ করতে করতে বেলা ততক্ষণে নটা বেজে গেছে। রাশেদ গোসল শেষে তৈরী হয়ে বসে আছে চন্দ্রাকে বাড়িতে নিয়ে যাবে বলে। চন্দ্রাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেই বিলকিস বেগম অনুমতি দিয়েছে ওকে কিন্তু বাঁধ সেধে বসে আছে চন্দ্রা নিজেই। মায়ের কাছে সেই কখন থেকে গাইগুই করেই যাচ্ছে রাশেদের বাড়িতে যাবে না বলে। রাশেদও একরোখা মানুষ। ও যখন বলেছে চন্দ্রাকে নিয়ে যাবে তার অর্থ ও চন্দ্রাকে নিয়ে যাবেই।
অনেক বাক-বিতন্ডতার পরে অবশেষে ঠিক হলো চন্দ্রাকে রাশেদের সাথে ওর শ্বশুর বাড়িতে যেতেই হবে। বিলকিস বেগমের মতে চন্দ্রা যদি ওর শ্বশুরবাড়ি না যায় তবে এই বাড়িতেও ঠাই হবে না ওর। চন্দ্রার জন্য উনি সমাজের কোন কথা শুনতে পারবেন না। তাছাড়া ওনার মতে, মেয়েদের আসল ঠিকানা নাকি শ্বশুর বাড়ি। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় মৃত্যু। এছাড়া শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়েদের বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই।চন্দ্রা আর কোন কথা না বলে নিশ্চুপে রাশেদের সাথে চলে গেল মিয়া বাড়ির উদ্দেশ্যে।
চন্দ্রা আর রাশেদ যখন মিয়া বাড়ির উঠানে পৌঁছায় তখন বেলা এগারো টা বাজে। সূয্যি মামা এখন মাথার ওপর রয়েছে। রোদের তাপ কিছুটা বেড়েছে। উঠানের দাওয়াতেই বসে রয়েছেন আকলিমা বেগম ও ওনার স্বামী গফুর মিয়া। গফুর মিয়া ও ওনার স্ত্রী আকলিমা বেগম চন্দ্রাকে দেখে খুশি হলেও সায়মাকে দেখে মনে হলো না ও খুশি হয়েছে । কেমন নাক ফুলিয়ে চন্দ্রার দিকে রাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও। রাশেদের দিকেও রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন তারপর আবারো কাজে মন দিল সে ।
এদিকে আকলিমা বেগম চন্দ্রাকে বলে উঠলেন,
–“নাওর তো অনেক খায়াইয়া আইলা। এহন হাতে হাতে কাম করো দেকি নি।”
চন্দ্রাও ওর শ্বাশুড়ির কথা মতো শাড়ি মাজায় গুজে নেমে পড়ল কাজে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে সন্ধ্যায় কলপাড় থেকে গোসল সেরে ঘরে এলো চন্দ্রা। খাটে বসে একটু জিরিয়ে নিল শরীর। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি সারা গায়ে ব্যথা করছে ওর। কিন্তু করার কিছুই নেই। কাজ না করলে তো আর শ্বশুর বাড়িতে ভাত জুটবে না । আর ওর স্বামীও অতটা দয়াবান নয় যে কাজ করবেনা তাকে মাগনা মাগনা ভাত খাওয়াবে। চন্দ্রার এই জিরিয়ে নেওয়ার ফাঁকে ঘরে প্রবেশ করল রাশেদ। আড় চোখে তাকালো চন্দ্রার দিকে। গোসলের শেষে ভেজা চুলে চন্দ্রকে ওর কাছে সব সময় স্নিগ্ধ লাগে কিন্তু ভালোবাসার টানে চন্দ্রাকে কাছে টানতে পারে না ও। কে জানে এর অন্য কোনো কারণ আছে কিনা?
রাশেদের ধ্যান ভাঙলো ওর মায়ের ডাকে। রাতের খাবার খাওয়ার জন্য সবাইকে ডাকছেন তিনি। মায়ের ডাকে চন্দ্রা ও রাশেদ উভয়েই বের হয়ে গেল ঘর থেকে। খাবার-দাবারের পর্ব শেষ করে ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে গেল ওদের। গ্রামে রাত আটটা বাজা মানে অনেক রাত। চারিদিকে শুনশান, নিরবতা বিরাজ করছে। আজকেও আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। শান্ত কুয়াশার চাদর আলতো করে আজও আচ্ছন্ন করে রেখেছে বাহিরের প্রকৃতি। ঘরে ফিরেই রাশেদ হামলে পড়ল চন্দ্রার ওপর। জাহির করলো নিজের পুরুষত্বের বাহার। অসহায় চন্দ্রা তখনো বাহিরের দিকে তাকিয়ে অঝোরে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। এছাড়া আর কিইবা করার আছে ওর যেখানে নিজের মা ওকে বোঝেনা?
রাত্রি দ্বিপ্রহরে পাশের ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে দুজন নর-নারীর ফিসফিস কথোপকথন আর উল্লাসের চাপা আর্তনাদ। দুজনে দুজনার সাথে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে মিশে আছে। দুজনার নিঃশ্বাস একে অপরের সাথে মিশে গিয়েছে বহু আগে। চাপা নিঃশ্বাসের সাথে তারা মেতে ওঠেছে আদিম খেলায়।
চলবে