#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব :- ০৩
ভোররাত থেকে হেমন্তের কুয়াশা নেমেছে মাঠে। বিন্দুবিন্দু শিশির জমে আছে ধান গাছের বুড়ো পাতায়। ক্ষেতের ওপর উড়াউড়ি করছে ফড়িংয়ের দল। সোনালী ধানের ক্ষেত ডিঙিয়ে পূর্ব দিগন্ত রাঙিয়ে উঠছে ভোরের টকটকে লাল সূর্য। হালকা শীত শীত ভোরের ভেতর মিষ্টি রোদের ওম।
গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে কুয়াশা ভেঙ্গে দিয়ে হেটে যাচ্ছে গাছিরা। অতঃপর তরতর করে গাছে উঠে ধারালো দা দিয়ে খেজুর গাছের মাথা চিড়ে রস নামানোর আয়োজন শুরু করে। হেমন্তের মাঝখান থেকে শুরু হয় সেসব রস জাল দিয়ে গুড় বানানোর মহাউৎসব । গৃহস্থ বাড়ির উঠানে বড় উনুন তৈরি করে তার ওপর তাপাল রেখে খেজুরের রস জ্বাল দেওয়া হয়। সেই রস জালের ঘ্রানে মম করে পুরো রূপগঞ্জ।
সকালের সোনালী রোদের ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙে গেল চন্দ্রার। পিটপিট করে দু চোখের পাতা মেলে তাকালো ও। জ্বর কমলেও গায়ে আঘাতের ব্যথা এখনো কমে নি ওর। পাশে তাকিয়ে দেখতে পেল বিলকিস বেগম ওর পাশে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। চোখে গতরাতের নিদ্রাহীনতার ছাপ স্পষ্ট । আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসলো চন্দ্রা। ঘরে বাবাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো ও।
বাড়ির কোথাও বাবাকে খুঁজে না পেয়ে ওঠানের দিকে চলে গেল চন্দ্রা । সেখানে গিয়ে দেখল সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। কেউবা উঠানে ধান শুকাতে দিচ্ছে , কেউবা আবার দাওয়ায় বসে পাহাড়া দিচ্ছে সে ধানগুলো। গ্রামের মুরগি আর শালিক পাখির যে বড্ড লোভ এই ধানের প্রতি।
চন্দ্রাকে দেখে সবাই উৎসব দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন । তারপর আবারো কাজে মগ্ন হয়ে পড়ল সবাই। যেন চন্দ্রাকে হরহামেশায় দেখেন ওনারা।
চন্দ্রা গুটিগুটি পায়ে সামনের দিকে এগোতেই কোথায় থেকে যেন ফুলি ছুটে এলো ওর সামনে। তারপর হাসতে হাসতে বলল,
–” আরে চন্দ্রা যে, কেমন আছো তুমি? ভালা আছো নি ? কাল দেখনু সাঁঝের বেলা একা একাই আইলা।হামার লগে কথাডাও কইলা না। হের লাইগা হামি কিন্তু বহুত রাগ করছি বুঝলা।”
ফুলি চন্দ্রাদের পাশের বাড়ির সার বানুর বড় ছেলে রনির বউ। বয়স বছর পনেরো হবে। খুব মিশুক প্রকৃতির মেয়ে বলা যায় । চন্দ্রা সাথেও মিল আছে খুব। তবে সমস্যা হলো অতিরিক্ত কথা বলে ফুলি। এক কথায় যাকে বলে বাচাল। একবার কথা বলা শুরু হলে আর থামতে চায় না ও । সে সামনের ব্যক্তি ওর কথা শুনতে চাক বা না শুনুক ও ঠিক ওর মতো বকবক করতে থাকে।
চন্দ্রা ফুলির কথার উত্তর দেওয়ার আগেই ওরা দুজনেই চিনচিনে একটি গলার স্বর শুনতে পেল।
–“কিগো ফুলি কই গেলা আবার ? বলি সারাদিন এমন উড়নচণ্ডীর মতো ঘোরপাক খাইলে হইবো? কাজগুলো কে করবো শুনি ? ধানগুলো উঠানে দিতে হইব তো , বেলা যে পইড়া যাইতাছে । হেরপর ধান দিলে শুকাইবো নি। হামার হইছে মত জ্বালা। পরের মাইয়্যারে কি এতো বলে কইয়্যা কাম করোন যায় নাহি। কই ফুলি? তাড়াতাড়ি এহানে আসো?”
গলার স্বর টি শুনতে পেয়ে ফুলি তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,
–” মা ডাকতাছে। যাই এহন। এখন না গেলে চিল্লায়বো। জানোই তো কাম না করলে খায়ন পামু না। তোমার লগে পরে কথা কমুনে।”
কথাগুলো বলে ঠিক যেমনভাবে হাওয়ার বেগে চন্দ্রার সামনে এসেছিল ঠিক সেভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো ফুলি। চন্দ্রপুলি দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল “মাস্টার বাড়ির” ভেতরে।
বেড়া দেওয়া বড় উঠানের দুদিকে দুটি ঘর একটি শোবার ঘর অন্যটি লাহারি ঘর। বাড়ির পিছনে রয়েছে টিনের চাল তোলা রান্নাঘর তার ঠিক পিছনে কলপাড়। কলপাড়ে চারদিকে অবশ্য টিনের বেড়া দেওয়া হয়েছে যাতে বাড়ির মহিলারা নির্বিঘ্নে গোসল করতে পারে সেখানে।
চন্দ্রা মাস্টার বাড়িতে ঢুকেই দেখতে পেল আনোয়ারা বেগম তখনো রান্নার কাজে ব্যস্ত । ও একটা পিড়ি নিয়ে আনোয়ারা বেগমের পাশে বসে বলে উঠলো,
–“কেমন আছো বড়মা?”
এতক্ষণ একমনে কাজ করছিলেন আনোয়ারা বেগম। হঠাৎ করে রিনরিনে কন্ঠস্বর শুনে মুখ তুলে সে দিকে তাকালেন তিনি কিন্তু চন্দ্রাকে দেখে পরক্ষণেই হাসি ফুটে উঠল ওনার মুখে।
প্রতিদিন নয়টার আগেই রান্না শেষ হয়ে যায় ওনার কিন্তু আজ বিলকিস বেগম না থাকায় ধান শুকাতে দিতে গিয়ে রান্নার কাজটা একটু দেরি হয়ে গিয়েছে ওনার। প্রতিদিন নয়টার দিকে আমজাদ হোসেন খাওয়া দাওয়া করে চলে যান স্কুলের দিকে। সবসময় সময়ের কাজ সময়ের মধ্যে করেন তিনি। জীবনের এতগুলো দিনের মধ্যে একদিনও ওনার রুটিনের হের ফের হয় নি। আনোয়ারা বেগম তাই দ্রুত হাতে কাজ সারছিলেন কিন্তু বয়সের ভারে এখন আর তেমন দ্রুত কাজ করতে পারেন না তিনি।
–কি রে চন্দ্রা তুই কখন এলি?”
–” কাল সাজের বেলায় আইছি বড়মা?”
–” জামাই আসে নি তোর সাথে?”
–” না বড়মা আহে নাই আর আইবো কিনা তাও কইবার পারতাছি না।”
চন্দ্রার এমন কথা শুনে আনোয়ারা বেগম ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন,
–” কেন জামাই লগে গোসা করছোস নি?”
কথাটা বলেই জিভ কাটলেন তিনি আশেপাশে তাকিয়ে আমজাদ হোসেনের উপস্থিতি দেখলেন। কিন্তু তার উপস্থিতির আভাস না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন আনোয়ারা বেগম। বিয়ের পর থেকে ওনার কর্তা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছেন । আমজাদ হোসেনের এই নিষেধাজ্ঞা উনার স্ত্রী সন্তান সবার উপরে ওয়াকিবহাল রয়েছে এখনো। বিয়ের পর শাশুড়ির কথামতো আনোয়ারা বেগম এখনো আগের মতোই প্রচন্ড ভয় পান ওনার কর্তাকে। যা বিবাহের এতগুলো বছর পেরিয়ে আসার পরেও এক চুল পরিমান কমে নি ।
এদিকে চন্দ্রা আনোয়ারা বেগমের কান্ড দেখে মিটিমিটি হেসে বলল,
–” তুমি এখনো জেঠুরে দেইখা এহনো এত ডরাও?”
–“অনেকে ভয় পেতে বয়েই গেছে আমার আর তুই এমন মিটিমিটি করে হাসছিস কেন? চুপ করে বসে থাক। উনি চলে যেতেই তোর সাথে গল্প নিয়ে বসবো আমি । অনেক কিছু জানার আছে আমার। ”
ঈষৎ ঠোঁট ফুলিয়েই কথাগুলো বললেন আনোয়ারা বেগম। মনে মনে স্বামীকে আচ্ছা মতো বকে যাচ্ছেন তিনি। গ্রামের মেয়ে হয়ে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে কি স্বস্তি পাওয়া যায়।
–” ঠিক আছে বড় মা।”
কথাগুলো বলে আবারো মুচকি হাসলো চন্দ্রা। এদিকে চন্দ্রার কথা শেষ হতেই এক ভরাট পুরুষালী কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া গেল।
–“কে রে চন্দ্রা এসেছিস নাকি?”
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে পিছনে ঘুরে তাকাল চন্দ্রা পাঞ্জাবি পরা লোকটিকে দেখে খুশিতে চকচক করে উঠলো ওর দুচোখ। অতঃপর ছুটে চলে গেল লোকটির কাছে। ইস্ কতদিন পরে দেখছে লোকটাকে । চন্দ্রা কে কাছে আসতে দেখেই লোকটি বলে উঠলো,
–“কিরে এই বুড়ো লোকটাকে ভুলে গেলি?”
–ভুলে যামু ক্যান জেঠু ? আপন্যার কতা তো হামার সব সময় মনে পড়ে।”
চন্দ্রকে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে দেখেই আমজাদ হোসেন ধমকে বলে উঠলেন,
–“ঐটা কতা নয় কথা হবে। কতদিন বলেছি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে । আমার কথা না তুই শুনিস আর না তোর জেঠিমা শুনে। বিয়ের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল অথচ এখনো তাকে শুদ্ধ ভাষা শিখাতে পারলাম না। বড় আফসোস রয়ে গেল এ জীবনে আমার। এবার বোধহয় চারুই তোদের ঠিক করতে পারবে ।”
চারুর কথা উঠতেই আবারো খুশির ঝলক খেলে গেল চন্দ্রা চোখে। খুশি হবে নাই বা কেন ? একমাত্র সখি বলে কথা। তাই চন্দ্রা আকুল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
–“জেঠু চারু কবে আইবো?”
–“ওইটা আইব হবে না আসবে হবে। তোদের নিয়ে আর পারি না আমি। চারুর বোধহয় স্কুল খোলা আছে। এতক্ষনে হয়তো স্কুলেও চলে গেছে। দাঁড়া দেখি কি করে মেয়েটা।”
–“এখনি কল করো জেঠু?”
–“করছি রে বাবা একটু সবুর কর তো মা।”
–” আইচ্ছা।”
চারুর কথা শেষ না হতেই আমজাদ হোসেন আবারো চোখ পাকিয়ে বলে উঠলেন,
–“ফের।”
–“আর হইবো না মানে হবে না।”
–“হুঁ।”
কথাটা বলেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে কালো রংয়ের নোকেয়া ফোনটি বের করে কল দিলেন বড় মেয়ে আফিফা বেগমের কাছে। কল করার মিনিট দুয়েকের মাথায় কলটা রিসিভ হলো ওপাশ থেকে।
–“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম আব্বা।”
–“ওয়ালাইকুমুসসালাম । কেমন আছো মা?”
–” আলহামদুলিল্লাহ । আপনি কেমন আছেন আব্বা?”
–” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা। চারু আছে কি?”
–” না বাবা জানো ও তো নেই । এইমাত্র স্কুলে গেল ।”
–“ওও জামাই বাবাজি কেমন আছে?”
–” জী ভালো আছে।”
–” ঠিক আছে ভালো থেকো তোমরা। আমি এখন স্কুলে যাব তো স্কুল থেকে এসে তোমাকে কল দিব তখন তোমার মায়ের সাথে কথা বলিও কেমন।”
–” ঠিক আছে বাবা । ভালো থাকবেন।”
–” তোমরাও ভালো থেকো।”
কথাগুলো বলেই কল কেটে দিলেন আমজাদ হোসেন তারপর স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,
–” তাড়াতাড়ি খেতে দাও স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে গেল তো?”
বলেই ঘরের ভেতরে চলে গেলেন তিনি। তিনি চলে যেতেই আনোয়ারা বেগমও রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এদিকে ছাড়ো সাথে কথা বলতে না পেরে চন্দ্রার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কোন রকমে এদিক সেদিক টলতে টলতে “মাষ্টার বাড়ি” থেকে বেরিয়ে ওদের বাড়ির পাশে শান বাধানো পুকুরের পাড়ে এসে বসল।
পুকুরের পানিতে পা ভিজিয়ে শান বাঁধানো সিঁড়িতে বসে আছে চন্দ্রা। দৃষ্টি সামনের ঘোলাটে পানির দিকে। অজান্তেই চোখের কোনে ভেসে ওঠল গতকালের গোধূলি লগ্নের সেই বিষাদময় তিক্ত ঘটনা।
গতকাল গোধূলি লগ্নে চন্দ্রা তখন সবে কাজ শেষে দাওয়ায় বসে গা জিরিয়ে নিচ্ছিল। সারাদিনের ধকলে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ওর শরীর । এমন সময় ওর কোথায় থেকে যেন হন্তোদন্ত হয়ে বাড়িতে এলো ওর স্বামী রাশেদ। বাড়িতে এসেই চন্দ্রার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–” এ কোন ফকিরের মাইয়্যারে বিয়া করলাম হামি। বিয়াতে তো কোন কিছু পাইলামই না তার ওপর মাইয়্যারও চেহারা সুরত নেই। তারে লইয়্যা হাজারো কথা শুনতে হয় হামার।”
স্বামীর এমন চিৎকার শুনে চন্দ্রা এগিয়ে এসে চাপা গলায় বলল,
–“দোহাই লাগে আফনার। এইসব কতা জোরে কইয়েন না। আপনার যা কওন ঘরে গিয়া কন।”
চন্দ্র কথা শুনে রাশেদ আরো জোরে চিল্লিয়ে বলে ওঠল,
–“ক্যান ঘরে গিয়া কমু ক্যান? যা কওনের এইহানেই কমু। হয় আজ তুই তোর বাড়িতে গিয়া আমার সাইকেল কেনার টাকা আনবি নাহয় বাড়িত থাইকা বাইর হইয়া যাবি। অনেক সহ্য করছি তোরে আর না।”
–“এই সংসারে এসে হমিও তো মেলা কিছু সহ্য করছি। তার কি কোন দাম নাই আপনাগোর কাছে।”
ব্যাস চন্দ্রার বলা এই কথাগুলোই কাল হয়ে দাঁড়ালো ওর। চন্দ্রার কথা শেষ না হতেই রাশেদ ছুটে এল চন্দ্রার কাছে। তারপর অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে লাগলো ওকে সেই সাথে গায়ে হাতও তুলল। বিয়ের প্রথম দিকে মারার সময় ওর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি এগিয়ে এলোও এখন আর আসে না। যৌতুকের টাকা না পাওয়ায় তারাও যেন বিরক্ত এখন চন্দ্রার প্রতি। চন্দ্রাকে মেরে আধমরা করেও রাশেদের যেন তৃপ্তি মিটে নি গতকাল। তাইতো চন্দ্রাকে ঐ অবস্থাতেও জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে মায়ের বাড়ি। সেই সাথে বলে পাঠিয়েছে এবার যদি ও টাকা নিয়ে যেতে না পারে তবে ওর কপালে দুঃখ আছে। কথাগুলো ভাবতেই দুচোখ নোনা পানিতে ভরে ওঠল চন্দ্রার। দারিদ্র্যতার অভিশাপ যেন ওর জীবনে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এই অভিশাপ বোধহয় এ জীবনে আর ঘুচবে না ওর। তিলে তিলে পিষে মেরে ফেলবে ওকে। কথাগুলো ভেবে আবারো ডুকরে কেঁদে উঠলো চন্দ্রাবতী।
চলবে