#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-১৩
প্রকৃতির নিয়মেই সন্ধ্যা গড়িয়ে চলে এসেছে রাতের প্রহর। নিশুতি রাত এখন। চারিদিক শুনশান, নিস্তব্ধ। গ্রামে সন্ধ্যা গড়ালেই প্রকৃতিতে নেমে আসে রাতের নিস্তব্ধতা। সন্ধ্যারাত শেষ না হতেই সকলে পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে। পুরো গ্রাম নিশ্চুপ হয়ে আছে। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। শুধু মাঝে মাঝে দূর থেকে পাখির পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আকাশে আজ চাঁদের ছিটেফোঁটাও নেই। অমাবস্যার কালো অন্ধকার ছেয়ে আছে চারিদিক।
নিঝুম এই নিশুতি রাতে চন্দ্রার শিউরের পাশে একাই জেগে আছে চারু। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে চন্দ্রার দিকে। আনোয়ারা বেগম নিজেই থাকতে চেয়েছিলেন চন্দ্রার কাছে কিন্তু চারু না করে দিয়েছে ওনাকে। বুড়ো বয়সে রাত জাগা ঠিক হবে না ভেবেই চারু আনোয়ারা বেগম ও আমজাদ হোসেনকে ঘুমাতে বলে নিজে একাই রাত জাগার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আনোয়ারা বেগম প্রথমে দ্বিমত করলেও পরবর্তীতে চারুর জেদের কাছে হার মানেন তিনি। তবে চন্দ্রাকে না বলেই চারু ওর নানাকে দিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতে রাশেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েত অভিযোগ শোনার পর তিন দিন পরে বিচার সভার আয়োজন করবে বলে জানিয়েছেন। গ্রাম পঞ্চায়েতদের আশ্বাস শুনে কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়েছে চারু।
এখন রাতের দ্বিপ্রহর। কিন্তু চোখে ঘুমের লেশ মাত্র নেই চারুর। মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে হাজারো চিন্তা। তবে সেই সব চিন্তার কূল – কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না ও। হঠাৎ মৃদু স্বরে কেশে ওঠল চন্দ্রা। পিটপিট করে চোখের পাতা খুলে আশে পাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ঠিক কোথায় আছে সে। মুখের ওপর হাত দুয়েক দূরে চারুর মুখ দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। একবার মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে কিন্তু পরক্ষণেই চারুর কন্ঠস্বর শুনে সকল দ্বিধা গেল গেল ওর। মৃদু হেসে বলল,
–“আমি কি সত্যিই তোকে দেখতে পাচ্ছি নাকি স্বপ্ন দেখছি?”
চন্দ্রার কথা শুনে চারু অবাক হয়ে চন্দ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন । তারপর সশব্দে হেসে উঠে বলল,
–“না আমি চারুর আত্মা। কি বোকা বোকা কথা বলছিস বল তো।”
চন্দ্রার ধীরে ধীরে ওঠে বসার চেষ্টা করল। চারু নিজে ওকে সাহায্য করল ওঠে বসতে। চন্দ্রা খাটের সাথে বালিশে হেলান দিয়ে বসে গম্ভির স্বরে বলল,
–“আমি এখানে এলাম কিভাবে? আমি তো রায়পুর ছিলাম।”
চন্দ্রার কথা শুনে চারু ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো,
–” দুপুর অব্দি রায়পুর ছিলিস কিন্তু এখন রূপগঞ্জে আছিস। ”
–“কিন্তু আমাকে নিয়ে আসলো কে ?”
–‘রায়পুর থেকে রূপগঞ্জ পর্যন্ত তুহিন মামা তোকে কোলে করে নিয়ে এসেছেন।”
–“ঐ নরপশুটা আইতে দিল আমারে?”
চারু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” প্রথমে রাজী হয়নি কিন্তু পুলিশের ভয় দেখাতেই তোকে আসতে দিয়েছে আমাদের সাথে।”
চন্দ্রা মুচকি হেসে বলল,
–_ আমি জানতাম একদিন না একদিন তুই ঠিক আইবি আমারে ওই শয়তানের হাত থেকে বাঁচাতে।”
–“যদি না আসতাম তখন কি করতিস?”
–“নিজের ভাগ্যকে মেনে নিতাম।”
–“সব সময় ভাগ্যের উপর ভরসা রেখে চুপচাপ বসে থাকলে হয়না কখনো কখনো নিজের হাতে ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে হয়।”
–“পরিস্থিতি আমার হাতের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল । নিজের পরিবার আমাকে সহায়তা দেয় নি আর না দিয়েছে সমাজ। আমাদের সমাজে মেয়েদের ভুল আগে ধরে । একটা সংসার ভেঙ্গে চলে আসলে মেয়েদের শুনতে হয় হাজারো অপবাদ। ছেলেদের দোষ সব সময় কম দেখে আমাদের এই তথাকথিত সমাজ। এমন কি ছেলে যদি পরকীয়াতে লিপ্তও থাকে তখনো দোষ হয় মেয়েদের। কেন সে নিজের স্বামীকে নিজের কাছে বেঁধে রাখতে পারে নি। বোধ হয় মেয়েরই দোষ আছে নাহলে স্বামী অন্য কোথাও যাবে কেন। এমন হাজারো অপবাদ দেওয়া হয় নারীদের।”
–“তার মানে ঐ জানোয়ারটা অন্য নারীতে আসক্ত। কে সে?”
প্রশ্ন প্রশ্ন শুনে চন্দ্রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–“তোর মনে আছে আমার বিয়ে হঠাৎ করেই ঠিক করে আমার চাচারা। ছেলের অবস্থা ভালো দেখে আমার বাবা-মাও তাড়া দিতে শুরু করে আমাকে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই বিয়েটা করেছিলাম আমি। বিয়েটা এত দ্রুতই হয় যে বিয়ের কথা তোকে অব্দি জানাতে পারি নি । বিয়ের প্রথম দিন আমি যখন ওদের বাড়িতে যাই সেদিনেই জানতে পারি ওর পরকীয়ার কথা । তবে সেদিন কিন্তু খুব একটা নিশ্চিত ছিলাম না কিন্তু দিনের পর দিন কাটলে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে। বুঝতে পারি আমার স্বামী আর আমার নেই। সে এখন অন্য কারো হয়ে গেছে, সে এখন পরনারীতে আসক্ত। অবশ্য আমার সাথে বিয়ের আগেই সেই নারীর সাথে তার ছিল গভীর প্রণয় । তখন ঘূনাক্ষরেও কেউ জানতো না । সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়ে যখন জানতে পারি আমার ভাশুর অর্থাৎ সাইমা ভাবি আমার স্বামী প্রাক্তন ও বর্তমান প্রেমিকা। তার রূপের নেশায় আসক্ত হয়ে আছেন স্বামী নামক মানুষটি।”
–“মানুষ কতটা নিচে নামতে পারে নিজের ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে ছি ছি ছি ছি ছি।”
–“বিয়ের কিছুদিন পর হঠাৎ রুপ বদল হয়ে যায় তার। যৌতুকের জন্য নির্যাতন শুরু করে আমার উপর । কথায় কথায় মারধর আর অশ্রাব্য গালিগালাজ ছিল তার নিত্যদিনের কাজ। মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হতো আমার। অন্যায় দেখছি কিন্তু সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারছি না । প্রতিবাদ করতে গেলে তার দ্বিগুন পরিমান নির্যাতন সহ্য করতে হতো আমাকে। একবার তো মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল আমাকে । বলেছিল বাড়ি থেকে টাকা না নিয়ে গেলে ও বাড়িতে আর ঢুকতে দেবে না আমাকে। সারাটা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছি এই রূপগঞ্জে । মায়ের আঁচলে কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম দুঃখের কথা, সাথে বলেওছিলাম সে বাড়িতে আমি আর যাব না।”
–“তারপর?”
–” আমার মত পোড়া কপালির কপালে কি আর সুখ আছে। সেদিন কেউ শুনেনি আমার কথা। আমার জন্মদাত্রী মাও তথাকথিত সমাজের ভয়ে দূরে ঠেলে দিয়েছিল আমাকে। পাষণ্ডটার সাথে আমারও ফিরে যেতে হয়েছিল সেই নরকে। সেদিনের পর থেকে অত্যাচারের মাত্রা যেন দিনকে দিন বেড়েই চলছিল। আজ ছিল তার অন্তিম অধ্যায়।”
–” ঐ শয়তানকে শাস্তি না দেওয়া অব্দি শান্তি নেই আমার। এত ঘটনা ঘটে গেছে তবুও আমাকে জানাস নি কেন?”
–“তোর সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারেনি । কখনো হয়তো সুযোগ হয়ে ওঠেনি নতুবা পরিস্থিতির চাপে পড়ে পিছিয়ে গিয়েছিলাম । মেনে নিয়েছিলাম আমার নিয়তিকে। ভেবেছিলাম সংসারে মানিয়ে নিবো নিজেকে কিন্তু তা আর হলো না।”
–” শোন তুই কোন চিন্তা করিস না তোর জীবনটা গুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা আমার। আরেকটা কথা শোন এবার তোর মাকে একটা উচিত শিক্ষা দিতে চাই আমি।”
চন্দ্রা ভ্রু-কুচকে জিঙ্গেস করল,
–“কেন মা আবার কি করেছে তোর সাথে?”
–“সে অনেক বড় কাহিনী, পরে একদিন বলব। তিন দিন পর বিচার সভা বসবে । গ্রাম পঞ্চায়েত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেদিন দুই পক্ষের কথা শুনে বাদ বাকি সিদ্ধান্ত নিবে।”
–” গ্রাম পঞ্চায়েতকে কে বলেছে এই কথা?”
–“আমি বলেছি। জানিসই তো আইন আদালতে এখন কি হয়?আর এই গ্রামের রীতিমতো সকল বিচার আগে গ্রাম পঞ্চায়েতের লোকরা করে তারপর যদি ইচ্ছে হয় তবেই আইনের কাছে ছুটে ভুক্তভুগিরা।”
–“সে জানি। তবে তোর কি মনে হয় পঞ্চায়েতে আমি সুষ্ঠ বিচার পাবো?”
–” পাবি ।তুই হয়তো ভুলে গেছিস পঞ্চায়েতের পাঁচ জন সদস্যের মধ্যে আমার নানু একজন। আর আমার নানু কোনদিন অন্যায়ের সাথে আপোষ করে নি, আর না কোনদিন করবে।”
–” আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম সে কথা।”
–“হুম এখন ঘুমিয়ে পড়। এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।”
–“তুইও পেঁচার মত না জেগে ঘুমিয়ে পড়।”
দুই সখি নিজেদের যত কথা জমিয়েছিল সব একে অপরের সাথে আলাপ করে নিচিন্ত মনে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।”
সময়ের তোড়ে গেটে গেছে তিন দিন। গত তিন দিনে বেশ খানিকটা সুস্থ হয়েছে চারু। তবে আঘাতের দাগগুলো এখনো মুছে যায় নি। আজ গ্রামে পঞ্চায়েত বসবে। পঞ্চায়েতের সদস্য মোটে পাঁচজন। এই পাঁচজনই পঞ্চায়েতের প্রধান। অর্থ্যাৎ গ্রামের যে কোন বিচার সভাই তাদের বিচারই চূড়ান্ত বলে মানা হয়। পঞ্চায়েত প্রধানের মধ্যে আছেন মোঃ মোবারক হোসেন, মোঃ মগড় মিয়া, হিন্দু পাড়ার নন্দন কুমার, নজরুল ইসলাম ও আমজাদ হোসেন।
গ্রামের স্কুল ফিল্ডে বিচার কার্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পঞ্চায়েত প্রধানগন কাঠের কেচারায় বসে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে। ওনাদের থেকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দু’পক্ষের সদস্যগন। রাশেদের পক্ষ থেকে গফুর মিয়া, আকলিমা বেগম ,সাইমা ও রাশেদ এসেছে। যদিও সাইমা এখানে আনতে নারাজ ছিলেন আকলিমা বেগম কিন্তু ছেলের রাগারাগিতে নিয়ে এসেছেন। এদিকে চন্দ্রার পক্ষ থেকে চারু, বিলকিস বেগম ও রমজান মিয়া। স্কুল ফিল্ডের পুরোটা লোকসমাগমে পূর্ণ হয়ে রয়েছে । মনে হচ্ছে যেন কোন মেলা বসেছে এখানে। চারু একবার রাশেদের দিকে রাগিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আবারো পঞ্চায়েতগনের দিকে তাকাল। দেখল মোঃ মগড় মিয়া তার লম্বা সাদা দাড়িগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আর অন্যদিকে রাশেদ ও পঞ্চায়েতের দিকে তাকিয়ে ফিসেল হাসি দিল । ব্যপারটা নজর এড়ালো না চারুর। কে জানে বিচার সভায় ন্যায্য বিচার পাকে কি না চন্দ্রা? নাকি আবারো হেরে যাবে নিজের নিয়তির সাথে?
চলবে