#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-১২
সময় তখন বিকেল পাঁচটা। মাষ্টার বাড়ির বড় ঘরের তুলতুলে বিছানায় ঘুমিয়ে আছে চন্দ্রা। ঠিক ঘুমিয়ে আছে বললে ভুল হবে চেতন-অচেতন এর মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে এখন সে। চন্দ্রার শিয়রের কাছেই বসে আছে চারু। বাড়িতে আসার পর থেকেই চন্দ্রার শিউরের কাছে ঠাঁই বসে আছে ও। চন্দ্রাকে বাড়িতে আনার পর বিলকিস বেগম বার তিনেক এসেছিল চন্দ্রার কাছে কিন্তু চারু মানা করে দিয়েছে তাকে। এ নিয়ে অবশ্য একদফা কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। তবে এ নিয়ে এখন মাথা ঘামাচ্ছে না চারু। ওর পুরো মনোযোগ এখন চন্দ্রার দিকে। রায়পুর থেকে ফেরার পর তুহিনের আর কোন খোজ পাই নি কেউ। এক রকম হাওয়ায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে সে । এমন ঘটনা যে ঘটবে তা আগে থেকেই অনুমান করেছিল চারু। তুহিন যে চন্দ্রাকে পছন্দ করে তা অনেক আগেই বুঝেছিল ও কিন্তু প্রকাশ করে নি কখনো।
চারু যখন গভির ভাবনায় মত্ত ঠিক তখনি সেখানে এসে হাজির হন আনোয়ারা বেগম। ওনার একহাতে আকাশী রঙের শাড়ি আর অন্য হাতে কিছু ঔষুধী পাতার রস। ভেজষ ঔষধি বানানোতে মোটামুটি ধারনা আছে ওনার। এক সময় ভেজষ ঔষধি নিয়েই দিনরাত পড়ে থাকতেন তিনি। সে অনেকদিন আগের কথা। চারুকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আনোয়ারা বেগম বলে উঠলেন,
–” সেই কখন থেকে এভাবে বসে আছিস। বিলকিসকেও আসতে দিচ্ছিস না এ ঘরে। তোর কি হয়েছে বলবি?”
এতক্ষন অন্য কোন ভাবনায় মত্ত ছিল চারু কিন্তু আনোয়ারা বেগমের কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই সম্বিত ফিরে পেল ও। নানীর মুখ পানে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
–” ওনার হয়ে ওকালতি করবে না তুমি। আজকে চন্দ্রার এই অবস্থার জন্য একমাত্র তিনিই দায়ী। সেদিন যদি তিনি চন্দ্রার মতের বিরুদ্ধে না গিয়ে ওকে বাড়িতে রেখে দিতেন তাহলে আজ এই দিন দেখতে হত না।”
আনোয়ারা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–” মানুষ মাত্রই ভুল হয় । ভুল না হলে কেউ শিখতে পারে না। আমার মনে হয় বিলকিসকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া উচিত। শত হলেও সে তো মা। সন্তানের জন্য মায়ের মনে কষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক।”
–“তবে আমার মনে হয় না ওনাকে সুযোগ দেওয়া উচিত । আমার তো এখনো মনে হচ্ছে উনি আবারো বলবেন চন্দ্রাকে ওর শশুড় বাড়িতে মানিয়ে নিতে কিন্তু এবার আর সে ভুলটা আমি করতে দেবো না চন্দ্রকে। চন্দ্রা সুস্থ হলেই ওকে নিয়ে আমি শহরে চলে যাব । তারপর আর পাঁচটা মেয়ের মতোই ওর জীবনটা সাজিয়ে দিব আমি।”
–“কিন্তু……..
–“আর কোন কিন্তু নয় আপা। অতীতে যে ভুল হয়েছে হয়েছে । কিন্তু সেই ভুল আর পুনরায় করতে চাই না আমি।”
আনোয়ারা বেগমকে থামিয়ে দিয়ে চারু নিজেই বলল কথাগুলো।
–“ঠিক আছে যেমনটা তোর ইচ্ছে। তবে আমি এখনো বলবো বিলকিসকে আর একটা সুযোগ দেওয়া হোক। দেখা যাক কি করে এবার সে?”
চারু কোন কথার উত্তর না দিয়ে ভিরিয়ে দেওয়া কাঠের দরজার এক পাল্লা খুলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কে জানে কি করতে চলেছে সে? আনোয়ারা বেগম আনমনে সেদিকে তাকিয়ে রইল কিছু সময়। তারপর চন্দ্রার গায়ের ময়লা শাড়ি বদলিয়ে ওকে আকাশী রঙের শাড়ি পড়িয়ে দিল। শাড়ি পড়ানোর আগে আঘাত প্রাপ্ত জায়গায় ঔষধ দিতে ভুললেন না তিনি। কাজ শেষে সেখানেই বসে রইলেন আনোয়ারা বেগম। অপেক্ষা করতে লাগলেন চারুর ফিরে আসার।
সময় এখন পড়ন্ত বিকেল। সূর্য্যিমামা আর কিছুক্ষণ পরেই অস্ত যাবে পশ্চিমাকাশে। তারপরেই ধরনীতে নেমে আসবে নিকষ কালো অন্ধকার। হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে রক্তিম আকাশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে উড়ে বেড়াচ্ছি নাম না জানা হাজারো পাখি। ওদের কিচিরমিচিরের শব্দে মুখরিত হয়ে আছে চারিদিক। গ্রামের গৃহস্থ বাড়ির কর্তারা দলে দলে হাতে কাচি নিয়ে মাঠের সরু রাস্তা দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরে আসছেন। সন্ধ্যা নামতে যে আর বেশি দেরি নেই।
চারু নিরবে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। মাথায় ঘুরছে হাজারো চিন্তা। আবছা আলোয় মনে পড়ল তখনকার কথা।
তুহিন আর চারু তখন মিয়া বাড়ির দাওয়ায় পৌঁছায় তখন সময় দেড়টা। রোদের প্রকোপ কিছুটা বেশি তখন। রুপগঞ্জ থেকে এতোটা পথ হেঁটে আসাতে অবস্থা নাজেহাল চারুর।এর আগে এতদূর অব্দি কখনো হাঁটে নি ও। তুহিন অবশ্য হাঁফিয়ে যায় নি তখনো। ছোট বেলা থেকেই গ্রামে মানুষ হয়েছে ও। তাই হাঁটাহাঁটির অভ্যেস আছে। রূপগঞ্জ থেকে রায়পুরের দুরুত্ব তার কাছে আহামরি কিছু নয়। মিয়া বাড়ির দাওয়ায় পৌঁছাতেই চন্দ্রার গলার ক্ষীন আওয়াজ পায় ওরা দুজনে। দুজন চকিত দুজনের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে চলে যায় সেদিকে। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখে গৌঢ বর্নের এক মহিলা পিছন থেকে জাপটে ধরেছে চন্দ্রাকে আর চন্দ্রার সামনে এক বলিষ্ঠ পুরুষ দাঁড়িয়ে বিকৃত স্বরে হাসছে আর চন্দ্রাকে এলোপাথাড়ি মারছে। এই করুন দৃশ্য দেখে প্রচন্ড রাগ হলো চারুর । দ্রুত দুই পাষন্ডের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলিষ্ঠ পুরুষটির গালে চড় বসিয়ে দিল ও । তারপর মেয়েটির কাছ থেকে এক প্রকার ছিনিয়ে নিল চন্দ্রাকে। চন্দ্রাকে পরম আদরে জড়িয়ে নিল চারু। ততক্ষণে তুহিনও পৌঁছে গেল সেখানে।
এদিকে আকস্মিক ধাপ্পড় খেয়ে আরো বেপোরোয়া হয়ে গেল রাশেদ। প্রথমে ভেবেছিল চন্দ্রাই হয়তো পাল্টা আঘাত করেছে ওকে কিন্তু চন্দ্রার জায়গায় চারুকে দেখে হতবাক হয়ে গেল ও । বিয়ের সময় চারুকে দেখেছিল ও তখন থেকেই চারুকে পছন্দ রাশেদের কিন্তু চারুর পারিবারিক খবর শুনে পিছিয়ে আসে ও । তবে মন থেকে ভালো লাগাটা শেষ হয়ে যায় নি এখনো। রাশেদ চারুকে দেখে বিশ্রী হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
–“আরে এ দেহি আমাগোর চারু ম্যাডাম। তা কি মনে কইরা এই গরীবের ঘরে আইলেন?”
রাশেদের বিশ্রী হাসি শুনে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল চারু। চারুকে মুখ ফিরিয়ে দিতে দেখে রাশেদ আবারো বলে উঠলো,
–” আরে আরে আমারে দেইখ্যা মুখ ফিরাইয়া নিলেন ক্যান? আমি কি দেখতে এতটাই অসুন্দর?”
রাশেদের কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল সাইমা। একটা অচেনা মেয়ে এসে রাশেদকে চড় মারলো কিন্তু তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ করছে না সে। উল্টে মেয়েটির সাথে গদগদ হয়ে কথা বলছে । ব্যপারটা খতিয়ে দেখার জন্য সাইমা রাশেদের কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল,
–” কি ব্যাপার কি, ঐ মাইয়ার লগে কিসের এত কথা তোমার? তোমারে যে একখান থাপ্পর দিল হের কোন প্রতিবাদ করল না ক্যান?”
সাইমার কথা শুনে মনে মনে বিরক্ত হলো রাশেদ। তারপর সেও ফিসফিসিয়ে বলল,
–“যা বুঝ না তা নিয়ে কথা কইতে আইবা না বুঝলা। চুপচাপ থাইকা দেহো আমি কি করি।”
রাশেদের কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল সাইমার। তবুও বাধ্য মেয়ের মত চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো একপাশে।
রাশেদ সাইমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–‘ তুমি এইহানে দাড়াইয়া রইলা ক্যান? যাও যাও মেহমানদের লাইগা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করো গিয়া। নতুন কুটুম বলে কথা।”
রাশেদের কথা শোনা মাত্রই চারু রেগে বলে উঠলো,
–“তার কোন প্রয়োজন নেই । আমি এখানে থাকতে আসি নি। এসেছিলাম চন্দ্রার খোঁজ নিতে কিন্তু তার আর প্রয়োজন নেই । নিজ চোখে দেখে গেলাম চন্দ্রার অবস্থা। এরপর আর যাই হোক এই নরকে ওকে একা ফেলে রেখে যাবো না আমি। আজ এই মুহূর্তে এই নরক থেকে নিয়ে যাব ওকে।”
–” তাই নাকি। নিয়া যামু কইলেই কি নিয়া যাওন যায় ? এত সহজ হলে তো হয়েই যেত।”
–“কে আটকাবে আমাকে?”
–“আমাকে কি আপনার চোখে পড়ছে না নাকি?”
রাশেদের কথা শুনে চারু তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠলো,
–“আপনি আটকাবেন আমাকে? বেশ , চেষ্টা করে দেখতে পারেন।”
–“এতো দেমাগ ভালা না । তয় এই দেমাগ খুব একটা খারাপ লাগে না আমার কাছে।”
চারু রাশেদের কথা পাত্তা না দিয়ে একটু জোরালো স্বরে তুহিনের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–“মামা এদিকে আসুন । চন্দ্রা বোধ হয় জ্ঞান হারিয়েছে। ওকে এখনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।”
চারুর ডাক শুনে সেদিকে এগিয়ে এলো তুহিন। এতক্ষন একটু দূরে থেকেই সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল ও। চারুর কথা শুনে বলে উঠলো,
–“গ্রামে ডাক্তার কোথায় পাবে তুমি ? ডাক্তার পেতে হলে শহরে যেতে হবে যা অনেক সময় সাপেক্ষ। এর থেকে ভালো ওকে নিয়ে আমরা রূপগঞ্জে ফিরে যাই। তোমার নানুমনি ভেজষ ওষুধি সম্পর্কে বেশ ভাল জানেন । বাকি চিকিৎসা না হয় সেখানেই করানো যাবে।”
–“ঠিক বলেছ তুমি। তাহলে চলো রূপগঞ্জের দিকে ফিরে যাওয়া যাক।”
কথাগুলো বলেই তুহিন চন্দ্রাকে কোলে নিয়ে মিয়া বাড়ি থেকে পা বাড়াতেই রাশেদ বলে উঠলো,
–“আরে আরে এত তাড়া ক্যান আপনাগোর? একটু তো সবুর করেন । আমার কথাতো এহনো শেষ হয় নাই। প্রেমিকাকে দেইখা বুঝি আপনার আর তর সইতাছে না?”
রাশেদের অশ্লীল কথা শুনে চারু রাগত কন্ঠে বলে উঠলো ,
–“কি বলতে চাচ্ছেন কি আপনি? আজেবাজে না বকে আমাদের যেতে দিন।”
–“আপনি যদি একা যাইতে চাইতেন তাইলে আমি নিজে গিডয়া আপনারে রাইখা আইতাম কিন্তু আপনে তো আমার বউরে নিয়ে যাইতেছেন। এটা কেমনে হইতে দেই আমি?”
–” নিজেকে স্বামী বলে দাবি করছেন আপনি কিন্তু আমার তো আপনাকে একটা বদ্ধ উন্মাদ আর নৃশংস জানোয়ার বলে মনে হচ্ছে।”
–” সে আপনের মনে হইলে আমি কি করুম। তয় আপনি আমার বউরে এভাবে লইয়া যাইতে পারেন না।”
–“আমার মনে হয় আপনি আমার হাতে আরো মাইর খেতে চাচ্ছেন তাই তো?”
–“দেহেন আমি কিন্তু এহন পুলিশে খবর দিতাম ।”
–” আপনি কি খবর দিবেন আমি নিজেই দিচ্ছি। বধু নির্যাতনের মামলাই যদি আপনাকে জেলের ভাত না খাইয়েছি তবে আমার নামও চারু নয় । মামা তুমি চন্দ্রাকে নিয়ে আগাও আমি আসছি।”
–“কিন্তু……
–“আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না ।এদিকটা আমি সামলাচ্ছি তুমি বরং চন্দ্রা নিয়ে যাও। ওর চিকিৎসা করা প্রয়োজন।”
চারুর কথা শুনে তুহিন চন্দ্রাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মিয়া বাড়ি থেকে। তুহিন যাওয়ার পর চারু আরো কিছুক্ষণ হম্বিতম্বি করে বেরিয়ে পড়ল রূপগঞ্জের উদ্দেশ্যে। রাশেদের সাথে হম্বিতম্বি করার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাশেদকে ভয় দেখানো । যা ও পেরেছে। তুহিনদের পেতে খুব একটা দেরি হয়নি ওর। তারপর দুজনে মিলে অচেতন চন্দ্রাকে নিয়ে এসেছে রূপগঞ্জে।
দূরের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি শুনতেই ধ্যান ভাঙলো চারুর। এতক্ষণ সে দুপুরের ঘটনায় হারিয়ে গিয়েছিল। সময় গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল ধরনীতে। গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে ততক্ষণে জ্বলে ওঠেছে সন্ধ্যার কুপ বাতি। চারিদিক শুনশান,নিস্তব্ধ। কোথাও কোন সাড়া নেই। রাখাল গরুগুলো গোয়ালের দিকে নিয়ে যাচ্ছে রাত হয়ে এলো যে। হেমন্তের সন্ধ্যায় কুয়াশার পাতলা চাদরে আচ্ছাদিত হচ্ছে পুরো গ্রামটি। ঘন পাতার ফাঁকে ফাঁকে জ্বলে ওঠেছে জোনাক পোকার দল। চারু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মাষ্টার বাড়ির দিকে। কি জানে আগামীতে কি অপেক্ষা করছে ওদের জন্য? নিয়তি আবারো কোন দিকে নিয়ে যাবে ওদের?
চলবে