চন্দ্রাবতী,পর্ব:১১

0
340

#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-১১

মাষ্টার বাড়ির দাওয়ার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে চারু। ওর সামনে দাঁড়িয়েই চারুকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছেন‌ বিলকিস বেগম। বিলকিস বেগমের শোরগোলে ইতিমধ্যে অনেকেই জড়ো হয়েছে সেখানে। প্রথমে সবাই বিলকিস বেগমের কথা শুনলেও এখন অনেকেই তাকেই কথা শুনাচ্ছে। এত ভিড়-ভাট্টা দেখে এগিয়ে এলেন আমজাদ হোসেন। পরনে তার সাদা রঙের পাঞ্জাবি,গায়ে তার সুগন্ধি আতরের গন্ধ। লম্বা দাঁড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বিলকিস বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,

–” কি ব্যাপার এখানে এতো চেঁচামেচি হচ্ছে কেন? কি হয়েছে কি?”

আমজাদ হোসেনের কন্ঠ শুনে এতক্ষণে হুশ ফিরল বিলকিস বেগমের। গায়ের শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে দিল ততক্ষনাৎ‌। চারু তখনো নিশ্চুপ হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। বিলকিস বেগম যে এতটা শোর -হাঙ্গাম করবে তা ও জানাতেন না। বিলকিস বেগম কোন উওর না দেওয়ায় পাশ থেকে সার বানু বলে উঠলেন,

–” কি ব্যপার এহন চুপ করলি ক্যান? উওর দে ভাইজানরে।”

সার বানুর কথায় চমকে ওঠলেন বিলকিস বেগম। এতক্ষণ রাগের কারনে হিতাহিত জ্ঞান ছিল না ওনার। কিন্তু এখন পুরো পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে গেছে। চারুকে এত কথা শুনানোর পর মাষ্টার বাড়ির কেউ কি তাকে ছেড়ে দিবে? ভয়টা মনে মনে আরো জেঁকে বসল ওনার। এমতাবস্থায় সেখানে এসেছে উপস্থিত হলেন আনোয়ারা বেগম ও রমজান মিয়া। রমজান মিয়া সবে ফিরছেন মাঠ থেকে। বাড়ির আঙিনায় এতো বড় জটলা দেখে সেদিকে এগিয়ে এসেছেন তিনি। এতো ভিড়ের মাঝে বিলকিস বেগমকে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল ওনার। মনে মনে বিলকিস বেগমের প্রতি আজকাল খুব বিরক্ত তিনি। না জানি কি করে বসেছে ?

সবাইকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমজাদ হোসেন আবারো ভরাট কন্ঠে বললেন,

–” সবাই এমন চুপ করে আছো কেন? বলবে তো কি হয়েছে?”

আমজাদ হোসেনের কথাই এবার একটু নড়ে ওঠেন বিলকিস বেগম। মনে সাহস সঞ্চয় করে বললেন,

–“আসলে চারু আমার মাইয়্যার সংসার ভাঙনের লাইগা ওইঠে পইড়া লাগছে বেশ কয়েক দিন হইলো। এর আগেও বুঝাইছিলা কিন্তু শুনে নাই। তাই……….

–” তাই তুই আজ ওকে গালি দিচ্ছিস তাই তো?”

বিলকিস বেগমকে কথা বলতে না দিয়ে আনোয়ারা বেগম নিজেই বলে উঠলেন কথাগুলো। বিলকিস বেগমের গালিগালাজ শুনে রেগে গেছেন তিনি। চারুকে এর আগে কখনো গালি দেন নি তিনি। শাসন করেছেন তবে তা মার্জিত ভাষায় কিন্তু আজ বিলকিস বেগমের কথায় বেশ চটেছেন তিনি।

আনোয়ারা বেগমের রাগত স্বর শুনে বিলকিস বেগম মৃদু স্বরে বলে উঠলো,

–” না মানে ভাবি হয়েছে কি আমি আসলে ……..

–” তোর যদি চারুকে নিয়ে কোন অভিযোগ করার ছিল তবে আমাকে বলিস নি কেন? আমি নিজে চারুকে সাবধান করে দিতাম। আর রইলো বাকি চন্দ্রার কথা । এখানের মধ্যে চন্দ্রার যদি কেউ শুভাকাঙ্ক্ষী থেকে থাকে তবে তা নিঃসন্দেহে চারু। আজকের এই দিনটির জন্য একদিন খুব পস্তাতে হবে তোকে এই বলে দিলাম আমি।”

–“আহ্ লিমনের মা থামো তো। আমাকে কথা বলতে দাও।”

আমজাদ হোসেনের কথা শুনে এবার এগিয়ে এলেন রমজান মিয়া। ক্ষীন স্বরে বললেন,

–” আপনারে কিছু কইতে হইবো না ভাইজান। আমি জানি চারু কেমন। চন্দ্রারে মারে আমিও কম বুঝাই নাই কিন্তু অ্যই মানতেই চাইতেছে না। তয় আমি জানি চারু ঠিক আমার মাইয়্যাডারে ঐহান থাইকা ফিরা আনবো। আপনে চন্দ্রার মায়ের কথাই কিছু মনে কইরেন না।”

–“ঠিক আছে। বিলকিস এরপর থেকে তোমার কোন অভিযোগ থাকলে তুমি আমাকে এসে বলবে তবুও এমন চেঁচামেচি আর গালিগালাজ করবে না।”

–“ঠিক আছে ভাইজান ‌।”

–“এখানে আর জটলা না বেঁধে যে তার ঘরের দিকে যাও আর লেমনের মা তুমিও চারুকে নিয়ে ঘরের ভিতরে চলে যাও।”

আমজাদ হোসেনের কথা শুনে সবাই নিজ নিজ কাজে চলে গেল। আনোয়ারা বেগম ও চারুর কাছে গিয়ে বললেন ,

–” চল ঘরে চল। সকালে না খেয়ে পন্ডিতি করে কে বের হতে বলেছিল শুনি। তুই কি চাস বলতো?”

নানির গলার স্বর শুনে চোখ তুলে তাকালো চারু। তারপর মৃদু স্বরে বলল,

–“আজকের মধ্যেই চন্দ্রার শশুড় বাড়ি যেতে চাই আমি। ব্যবস্থা করো তোমরা।”

চারুর আবদার শুনে আমজাদ হোসেন চিন্তিত স্বরে বললেন,

–“কিন্তু আমার তো আজ স্কুল আছে আজ তো আমি নিয়ে যেতে পারবো না। ”

–“তুমি যেতে না পারো অন্য কাউকে বলে দাও যে আমাকে চন্দ্রার শ্বশুর বাড়ি অব্দি নিয়ে যাবে।”

–“এমন কাউকে কোথায় পাই বল তো? এখন তো কাজের সময় । সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত।”

আমি তোমার সাথে কথা শেষ না হতেই চারু ওদের থেকে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তুহিদকে দেখতে পেল। তুহিনকে দেখেই চারু খুশিতে হাঁক ছেড়ে ডেকে ওঠল,

–” তুহিন মামা।”

তুহিন মাষ্টার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। সকাল বেলা চেঁচামেচির আওয়াজ শুনেই এদিকে এসেছে ও। মাষ্টার বাড়ির সামনে জটলা দেখে দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল ও। হঠাৎ কারো কন্ঠস্বর শুনে প্রথমে চমকে উঠলেও চারুকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। আমজাদ হোসেনের সামনে এসে দাড়িয়ে মৃদুস্বরে বলল,

–“আসসালামু আলাইকুম চাচা।”

–“ওয়ালাইকুমুস সালাম।”

আমজাদ হোসেনকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চারু নিজেই বলে উঠলো,

–“আরে তুহিন মামা কেমন আছেন আপনি?”

–“আছি ভালোই তুমি কেমন আছো আর এখানে এত চেঁচামেচিই বা কিসের?”

–“ও অনেক বড় কাহিনী পরে একসময় বলব আপনাকে। এখন আপনার জন্য একটা কাজ আছে তবে তার আগে বলুন আপনি কি চন্দ্রার শশুড় বাড়ি চিনেন?”

চন্দ্রার নাম শুনেই তুহিনের বুকে চেপে রাখা ব্যথাটা আবারো চিনচিন করে ওঠল। মানস পটে ভেসে ওঠল‌ পুরোনো দিনগুলোর কথা। সন্তোর্পনে চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা ফেলে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো,

–“হুম চিনি । কেন বলো তো?”

–“বাহ তাহলে তো হয়েই গেল। নানু বাকি কথা তুমিই বলে দাও মামাকে?”

চারুর কথা শুনে এবার আমজাদ হোসেন বলে উঠলেন,

–“আসলে চারু চন্দ্রার সাথে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। আমার তো আজ স্কুলে যেতে হবে তাই ওকে নিয়ে যেতে পারছি না।এদিকে ও জেদ ধরেছে। চারু নিজেও চিনে না চন্দ্রাদের বাড়ি। বাবা তুমি যদি ওকে নিয়ে যেতে আমার বড় উপকার হতো।”

আমজাদ হোসেনের কথা শুনলে তুহিনের মনে প্রিয়সিকে দেখার সাধ জেগে উঠলো। কতদিন পরে ও ওর প্রিয়সিকে দেখবে। কথাগুলো ভাবতেই কেমন যেন অনুভূতি হলো ওর । তাই আর দেরি না করে ঝটপট বলে উঠলো,

–“চাচা আপনি কিছু ভাববেন না । আমি আজ চারুকে চন্দ্রাদের বাড়িতে নিয়ে যাব। আপনি নিশ্চিত থাকুন।”

–“তুমি আমাকে বড় বাঁচা বাঁচালে বাবা। ”

–“তো চারু কখন যেতে চাও তুমি?”

–“আর কিছুক্ষণ পরেই বের হতে চাচ্ছি। অনেক সময় নষ্ট করেছি তাই আর সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না।”

–“বেশ তাই হবে। তুমি তৈরী হয়ে নাও ,আমি আসছি।”

–“ঠিক আছে মামা।”

তুহিন সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল ওর বাড়ির দিকে । তুহিন চলে যাবার পর চারু, আনোয়ারা বেগম ও আমজাদ হোসেন তিনজনও চলে গেল নিজেদের বাড়িতে।

সময় আনুমানিক দুপুর বাড়োটা। সূর্য্যিমামা তখন ঠিক মাথার উপরে। সকলের ঘন কুয়াশায় সর্বত্র কেটে গেছে এখন। রোদের তেজ এখন কিছুটা বেশি।চন্দ্রা উঠোনের দাওয়ায় বসে কাঁথা সেলাইয়ে মিলন। ঠিক এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলো রাশেদ। উদ্দেশ্য চন্দ্রার কাছ থেকে যেন-তেন ভাবে চাবির গোছা নেওয়া। রাশেদ চন্দ্রার মনোযোগ ওর দিকে ঘুরানোর জন্য প্রথমে মৃদু স্বরে কাশি দিল। তবে এতে চদ্রা ঘুরেও তাকালো না ওর দিকে। ও ওর সেলাইয়ে ব্যস্ত। চন্দ্রার সাড়া না পেয়ে এবার ওকে বেশ জোরেই ডেকে ওঠল রাশেদ,

–” চন্দ্রা।”

রাশেদের উপস্থিতি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল চন্দ্রা। তবুও সেদিকে ঘুরে তাকাই নি ও। কিন্তু রাশেদের ডাক শুনে এবার আর না সাড়া দিয়ে পারল না ও। তাই সেলাই বাদ দিয়ে মুখ উঠিয়ে বলল,

–” এত জোরে ডাকেন কিরল্লাই? আমি কি কালা নি যে এতো জোরে ডাকতে হইবো? নাহি অন্য কাউরে হুনাইতেছেন?”

চন্দ্রার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল রাশেদ। নিজেকে কোন রকমে সামলিয়ে বলল,

–” মজা রাহো তো। একখান কতা কইতে আইছি তোমাকে।”

–“কি কতা কইবেন কইয়্যা ফেলান। আমার মেলা কাজ পইড়া রইছে এহোনো। বেমাক কামতো আমারে একাই করতে অয়। আমি তো আর অন্য সবার মত বইস্যা বইস্যা খাই না।”

চন্দ্রার কথা শেষ না হতেই সাইমা তেড়ে এলো চন্দ্রার দিকে। এতক্ষণ সে চুপিসারে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। দেখতে এসেছিল রাশেদ সত্যিই চাবির কথা বলে কি না কিন্তু চন্দ্রার কথা শুনে আর আড়ালে থাকতে পারলো না। দরজার পাশ থেকে বেরিয়েই রাগত স্বরে বলে উঠলো,

–” কারে কইল্যা তুমি এই কথাগুলান?”

–” আমি তো কারো নাম ধইরা কই নাই ভাবি তাহলে তোমার গায়ে লাগতাছে কিল্লাই?”

–” দেহো চন্দ্রা আমি দুধভাত খাই না যে কিছু বুঝবার পারুম না। তুমি যে কথাগুলান কইছো তা কিন্তু আমি ঠিকই বুঝবার পারছি।”

–” কইলে কইছি, মিছা কতা তো আর কই নাই।”

দুজনের ঝগড়ার মাঝে বিপাকে পড়েছে রাশেদ। যে কাজের জন্য ও এসেছে তা তো হচ্ছেই না বরং দুজনের ঝগড়াতে মাথা ধরে যাচ্ছে ওর‌ । দুজনের ঝগড়া তখন তুঙ্গে ঠিক তখনি জোরে করে হাঁক ছাড়ল রাশেদ। দুজনকেই শাসিয়ে বলল,

–” চুপ একদম চুপ। আমার কাজ শেষ হলে তোমরা দুজনে মত পারো ঝগড়া কইরো।”

রাশেদের কথা শুনে এতক্ষণে চন্দ্রার মনে পড়ল তখনকার কথা। রাশেদের কাজের কথা শোনার আগেই সাইমার সাথে একচোট ঝগড়া হয়ে গেল ওর । সে যাক গে কিন্তু রাশেদের এমন কি কাজ আছে ওর সাথে সেটাই বুঝতে পারছে না ও । কিছুটা সন্দিহান গলায় বলল,

–” বলুন কি কতা কইবেন?”

চন্দ্রার কথা শুনে কোন রকম ভনিতা ছাড়াই রাশেদ বলে উঠলো,

–” মা যে তোমারে চাবি দিয়া গেছে হেইডা আমারে দাও।”

–“ক্যান?”

–” আমি চাইছি তাই।”

–“উহু মা আমারে এই চাবি কাউরে দিতে না করছে।”

–” আরে আমারে দিতে না করে নাই।”

–“আপনেরে দিতেও না করছে। কইছে এই চাবি খান যেন কাউরে না দেই।”

–” চন্দ্রা আমি কিন্তু তোমারে দিতে কইছি?”

–” আমি দিতে পারুম না।”

–“তুমি দিবা না তো ?”

–“না।”

চন্দ্রার উওর শুনে ওর দিকে তেড়ে এলো রাশেদ। অতঃপর চন্দ্রার চুলের মুঠি ধরে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে গেল ওঠানে । সাইমাও রাশেদের পিছুপিছু ছুটে এল সেখানে । তারপর চন্দ্রার হাত পিছন থেকে ধরে রাখল। রাশেদ সেই সুযোগে চড় থাপ্পড় দিতে লাগল চন্দ্রাকে। রাশেদের আঘাতে ততক্ষণে নেতিয়ে পড়েছে চন্দ্রার শরীর। পড়নের শাড়ির আঁচল খুলে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এত মেরেও যেন রাশেদের আশ মিটে নি তাই চন্দ্রার নরম তুলতুলে মাংশ পিন্ডে কামড় বসিয়ে দিল ও। ব্যথার চোটে গলা ছেড়ে জোড়ে চিৎকার দিল চন্দ্রা। ঠিক তখনি মিয়া বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ালো চারু আর তুহিন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here