চন্দ্রাবতী,পর্ব:১০

0
323

#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-১০

সকালের সোনালি আলোর আভায় ঘুম ভেঙ্গে গেল চন্দ্রার। তখন সবে সূর্যি মামা আকাশটাকে লাল আভায় রাঙিয়ে উঁকি দিচ্ছে পুবের আকাশ পানে। কিছু সময় পরেই গ্রামের মেঠো পথে দেখা যাবে মানুষের আনাগোনা। সূচনা হবে আরো একটি ব্যস্ততম দিনের।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই চন্দ্রা ওর গায়ের শাড়ি ঠিক করে চলে গেলো কল পাড়ের দিকে। গায়ে জ্বরের মাত্রা কিছুটা কম এখন। শীতের এই কুয়াশায় কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আছে চারিদিক। কুয়াশার দরুন হাত চারেক দূরের কোন কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না চন্দ্রার। তবুও হাতড়িয়ে হাতরিয়ে এগিয়ে গেল কল পাড়ের দিকে। ভোরের হীমশীতল পানিতে বারংবার কেঁপে উঠল ও। শীতের দাপটে চোয়াল লেগে যাওয়ার যোগাড় হয়েছে ওর। তবুও গায়ে অনবরত পানি ঢেলে চলেছে চন্দ্রা। এতে যদি রাশেদের দেওয়া কলঙ্ক মুছে যায়। অতঃপর গোসল শেষে চলে গেল রান্না ঘরের দিকে।

সকাল আনুমানিক নয়টার দিকে মিয়া বাড়িতে এলো সোহান। সোহান সম্পর্কে আকলিমা বেগমের ভাগ্নে। দেখতে শ্যামবর্নের, উচ্চতা মানানসই। তবে মুখ চোখ ফোলা ফোলা লাগছে ওর আজ। চোখ-মুখে রাত জাগার ছাপ স্পষ্ট। মিয়া বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়িয়েই হাঁক ছেড়ে ডাক দিল সোহান।বলল,

–“খালা কই আপনে? এইহানে আসেন।”

আকলিমা বেগম তখন বিছানায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। সোহানের হাঁক শুনে তড়িখড়ি করে ছুটে গেলেন সেদিকে।

–“আরে সোহান তুই এত সকালে এলি যে সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?”

খালাকে দেখে সোহান কান্নাভেজা গলায় বলে ওঠল,

–“না খালা কিছু ঠিক নাই।মায়ের শরীরডা আবার খারাপ করছে।বারবার আপনেরে দেখবার চাচ্ছে। ”

বোনের এমন অবস্থার কথা শুনে কেঁদে ওঠলেন আকলিমা বেগম। তারপর গফুর মিয়াকে নিয়ে সোহানের সাথে চলে গেলেন বোনের বাড়ির দিকে। সকালের খাবার আর খেলেন না তারা। রান্না করা খাবার পড়ে রইল সেভাবেই। চন্দ্রা ওর প্লেটে অল্প ভাত নিয়ে খেয়ে চলে গেল ওর ঘরের দিকে। রাশেদ বাবা-মা যাওয়ার পরে আজও চলে গেছে সায়মার ঘরে। এ নিয়ে অবশ্য এখন আর কোন কষ্ট হয় না চন্দ্রার ।ও তো ওর মুক্তির অপেক্ষায় আছে এখন।

রাশেদ যখন সায়মার ঘরে আসে তখন সায়মা গুনগুন করে কান্না করছিলে। সায়মাকে কান্না করতে দেখে ওর দিকে এগিয়ে গেল রাশেদ। সায়মার কাঁধে হাত রেখে বলল,

–” এই কান্না করতাছো ক্যান? ”

রাশেদকে সামনে দেখে আরো বেশি কান্না করতে লাগলো সাইমা। এদিকে সাইমার কান্না দেখে রাশেদ পড়ল বিপাকে । একটু বিরক্ত হয়েই বলে উঠল,

–” আজব তো আমারে না কইলে আমি বুঝমু ক্যামনে কি হয়েছে তোমার ?”

রাশেদের কথা শুনে সাইমা ওর ফোলা ফোলা চোখে তাকালো সেদিকে। তারপর কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে উঠলো,

–“তুমি দেখলানা মা যাওনের আগে কি কাম কইরা গ্যালো?”

সাইমার কথা শুনে রাশেদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল,

–“কি করছে মা?”

–“মা যাওনের আগে বাড়ির চাবি চন্দ্রারে দিয়া গ্যাছে? শুধু কি বাড়ির চাবি , ওনাদের ঘরসহ আলমারির চাবিও দিয়া গ্যাছে।”

–“তো এতে এতো কানন্দনের কি হইল কও দেহি?”

–“তুমি কি আসলেই বুঝো নাই নাহি আমার লগে মশকরা করতাছো?”

সাইমার কথা শুনে রাশেদ জিহ্বা কেটে বলে উঠলো,

–“ছি ছি তোমার লগে কি আমি মশকরা করবার পারি বলো? আমি সত্যিই বুঝি নাই।”

রাশেদের কথা শেষ হতেই সাইমা এবার একটু নড়েচড়ে বিছানায় ভালো করে বসল। তারপর রিনরিনে কণ্ঠে বলে উঠলো,

–“দেখো হিসেব মতে আমি এ বাড়ির বড় বউ। সেই অধিকারে বাড়ির সব কিছুতে আমার হক বেশি তাই না?”

–“তোমার কথাতে তো হিসেব মতে তাই হওনের কথা।”

কথাগুলো বেশ ভাবুক কন্ঠেই বলে উঠলো রাশেদ।

রাশেদের কথা শুনে এতক্ষণে সাইমা যেন আবারো মনে জোর ফিরে পেলো। অভিযোগের স্বরে বলল,

–” তা হলে তুমিই কও মা যাওনের আগে আমারে দেখাইয়া চন্দ্রারে যে চাবি দিলো কামডা কি ভালা হইছে? ”

–“না না কামডা এক্কেবারে ভালা হয় নাই। মা এমন কাম করলো কিভাবে?”

–“হের লাইগাই মোর মনডা খুব খারাপ। আমি কি মায়ের লগে কহনো খারাপ ব্যবহার করছি তুমিই কও?”

–” না না আমার সাইমা রানী কি কারোর লগে খারাপ আচরন করতে পারে? এই কতা আমারে কেউ সারাদিন কইলেও তো আমি বিশ্বাস করুম না। আমি তো জানি আমার সাইমা রানী কেমন । আচ্ছা থাক তুমি আর এ লইয়া রাগ কইরো না। মা আইলে আমি তারে কইয়্যা দিমু নে। এহন ওঠো,খাইতে দাও। বেলা তো অনেক হইছে, খিদাই পেট জ্বইল্যা যাইতাছে।”

রাশেদের কথা শুনে সাইমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–“আমার খিদা নাই। তুমি খাইয়্যা লও। বড় ঘরে ভাত রাইখা দিছি । যাও নিজে গিয়া খাইয়া আসো।”

সাইমার কথা শুনে রাশেদ গম্ভির স্বরে বলল,

–“এর আগে কোনদিন তোমারে ছাড়া খাইছি নাহি আমি যে আজ খামু। আহো দুজন‌ এক লগে ভাত খামু।”

–“বললাম তো তুমি একাই খাইয়া আসো। আমার আজ ভালা লাগতাছে না । যাও তো।”

সায়মার কাঁধে হাত রেখে রাশেদ গম্ভির স্বরে বলল,

–“তুমি কি চাও কও তো? কি করলে তোমার ভালা লাগবো আমি হেইডাই করুম।”

রাশেদের কথা শুনে সাইমার মনে কোনে জমে থাকা কালো মেঘ যেন নিমিষেই কেটে গেল। দুচোখ জুড়ে খেলে গেল আনন্দের জোয়ার। ঈষৎ হেসে বলল,

–“সত্যিই আজ যা করতে বলুম তাই করবা?”

–“হু তুমি কইয়াই দেহো।”

–“ঠিক আছে। আগে আমারে ছুইয়া কতা দেওন লাগবো।”

সাইমার কথা শুনে রাশেদ মুচকি হেসে বলল,

–” এই নাও তোমারে ছুইয়াই কথা দিলাম। এবার
কও কি চাও তুমি।”

–” আমার ঐ চাবির গোছা চাই যা মা চন্দ্রারে দিয়া গ্যাছে।”

সাইমার কথা শুনে রাশেদের মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়ে সেখানে দেখা গেল কালো মেঘের কালো ছায়া। ফ্যাকাশে মুখে বলল,

–“কিন্তু………..

রাশেদকে কথা শেষ করতে না দিয়েই সাইমা বলে ওঠল,

–“আমি কোন কিন্তু শুনবির চাই না। আমার ঐ চাবির গোছা চাই মানে এহনি চাই। তুমি কিন্তু না করবার পারবা না। কতা দিছো কিন্তু আমাকে।”

রাশেদ একটু গম্ভির স্বরে বলল,

–“দেহি কি করন তাই।”

কথাগুলো বলেই সাইমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। উদ্দেশ্যে চন্দ্রার থেকে চাবির গোছা নেওয়া। রাশেদ জানে কাজটা মোটেও সহজ নয়। চন্দ্রার কাছ থেকে চাবি নেওয়া খুব একটা সহজ হবে না । তাছাড়া আগের চন্দ্রা আর এখনকার চন্দ্রার মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এখনকার চন্দ্রা বড্ড বেশি বেয়ারা। ওর কথা শুনতে চাই না মোটেও। দেখা যাক কি হয়।

অন্যদিকে চারু সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে না খেয়েই বেরিয়ে পড়ল বিলকিস বেগমের বাড়ির উদ্দেশ্যে। মাষ্টার বাড়ি থেকে মিনিট দুয়েক সোজা পূর্ব দিকে গেলেই হাতের ডানে পড়ে চন্দ্রাদের বাড়ি। চন্দ্রাদের বাড়ির সাথেই রয়েছে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। চন্দ্রাদের বাড়িতে পৌঁছিয়েই চারু মৃদু স্বরে ডেকে ওঠল,

–” নানী বাড়িতে আছো নাকি?”

বিলকিস বেগম তখন সবে রান্না করে ঘরে ফিরেছেন। বাহির থেকে কারো গলার স্বর শুনতে পেয়ে ভেতর থেকেই বলে ওঠলেন,

–“কেডা ? কেডা ডাহে আমারে? ফুলি আইছো নি?”

–“না না নানী আমি চারু। তোমার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি।”

চারুর নাম শুনেই আবারো বিরক্তি ফুটে উঠল ওনার মুখে। বিরক্তি মুখেই বলে ওঠলেন,

–“বাহিরে খারাও, আমি আইতাছি।”

–“ঠিক আছে নানী। ”

কথাগুলো বলেই চারু রান্নাঘরের পাশে পিড়ি পেতে বসল। রান্নাঘরের সামনেই রয়েছে মাঝারি গড়নের একটি আম গাছ । এই গাছের আম বেশ ভালো লাগে চারুর। প্রতিবারই চন্দ্রা নিজ দায়িত্বে কয়েকটা আম রেখে দেয় ওর জন্য।এ নিয়ে অবশ্য কম বকা খাই নি ও । তবুও চারুর জন্য প্রতিবার সে একই কাজ করে চন্দ্রা।

প্রায় মিনিট পাঁচেকের মাথায় ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বিলকিস বেগম। পরনে তার পুরোনো সবুজ শাড়ি, মুখ মলিন। তিনি চারুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

–“কি কওবা তাড়াতাড়ি কও? আমার অনেক কাম পইড়া আছে।”

বিলকিস বেগম দেখে ওঠে দাঁড়ালো চারু। অতঃপর মৃদু স্বরে বলল,

–“গতকালের ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত নানি।। আমার আপনার সাথে ঐভাবে কথা বলা উচিত হয় নি। আমাকে মাফ করে দিবেন।”

চারুর কথা শুনে বুক থেকে বড় মাপের পাথরের চাপ যেন কমল রাবেয়া বেগমের । গতকাল থেকে ছটফট করছেন তিনি। যাক অবশেষে ওনার মেয়ের সংসার বাঁচল। তবুও তিনি গম্ভির স্বরে বললেন,

–“যাক শ্যাষম্যাষ সুবুদ্ধি হইছে তোমার। যাও নিজের শহরে ফিরে গিয়া লেহাপড়া করো। চন্দ্রারে লইয়া এত মাথা ঘামাইতে হইবো না তোমার।”

–“নানী আমি তোমারে সরি বলছি এর মানে কিন্তু এইটা না যে চন্দ্রারে আমি ঐ কারাগার থেকে মুক্ত করবো না। চন্দ্রারে তো আমি মুক্ত কইরাই ছাড়ব। ”

চারুর কথা শুনে গর্জে ওঠলেন বিলকিস বেগম। রেগে বললেন,

–“এহনো তোমার তেজ যাই নাই দেখতাছি। অপরের মাইয়া নিয়া তোমার এত মাথা ব্যাথা ক্যান? কই আমরা তো তোমাগোর নিয়া মাথা ঘামাই না।”

–“আপনারা মাথা ঘামান না কারন আমাদের নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন কারন নেই। কিন্তু চন্দ্রার বিষয়টা ভিন্ন। আপনি আমার কথা একটু বোঝার চেষ্টা করুন।”

–” তোমার কোন কথাই বুঝনের দরকার নাই আমার। তুমি এহনি আমার বাড়ি থেইকা বাইর হইবা। বাহির
হও কইতাছি। যতসব ফালতু পোলাপাইন। কামে‌ নাই শুধু অকামের বেলাই আছে। আমার মাইয়া সুখে সংসার করতাছে হেইডা কারো সহ্য হইতাছে না। ওর সংসার ভাঙনের লাইগা উইঠা পইড়া লাগছে।”

কথাগুলো বলতে বলতে চারুকে ধাক্কা দিয়ে‌ ওনার বাড়ি থেকে বের করে দিল বিলকিস বেগম। শুধু বের করে দিয়েই ক্ষ্রান্ত হন নি তিনি । মাষ্টার বাড়ির সামনে গিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলেন। মাষ্টার বাড়ির কর্তা আমজাদ হোসেন স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। কিন্তু বাহিরে থেকে সোড়গোল এর আওয়াজ শুনে দরজা ঢেলে বাহিরে এলেন তিনি। ওনার সাথে সাথে বাহিরে আসলেন আনোয়ারা বেগম নিজেও ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here