#চন্দ্রাণী (৩২)
স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসে সোনালি তরল পানীয়। শাহজাহান তালুকদারের দুই চোখে উৎকণ্ঠা। রেহানার দুই চোখে ক্রোধ।
চন্দ্র বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।বাবার উপর যেই রাগ ছিলো সেই রাগটা হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেলো।পিতৃ স্নেহের কাছে হেরে গেলো। আস্তে করে গ্লাসটা ঠেলে দিলো টগরের দিকে। টগর অবশ্য জানতো এরকম কিছুই হবে।চন্দ্র বাবার কথার বাহিরে যাবে না।
গ্লাসটা নির্ঝর শাহজাহান তালুকদারের সামনে দিয়ে বললো, “আপনি না হয় খেয়ে দেখুন।”
শাহজাহান তালুকদার হতভম্ব
এদের ব্যবহার কেমন উগ্র মনে হচ্ছে তার কাছে। এদের প্ল্যান কি শাহজাহান তালুকদার কিছুই বুঝতে পারছে না। তার বুক কাঁপছে ভয়ে।এতো বছর পরে এসে ভয় তাকে এভাবে কাবু করে ফেলবে ভাবতে পারেন নি তিনি।
বহুদিন পর নিজেকে ভীষণ ক্লান্ত মনে হচ্ছে তার।বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে নাকে কপালে।
রেহানা স্বামীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো, “চন্দ্রর বাপ,আপনি এরকম ভেঙে পড়তেছেন কেনো?”
শাহজাহান তালুকদার ভরসাহীন চোখে মেয়ের দিকে তাকালো। চন্দ্রর মনে হচ্ছে তার কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এতো যন্ত্রণা কেনো হচ্ছে? আর কতক্ষণ চন্দ্র নিজেকে সামলে রাখতে পারবে চন্দ্র জানে না।
কান্নারা সব দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে জমেছে।
বুক কেমন শূন্য শূন্য লাগছে চন্দ্রর।এই জগৎ সংসার সবই মিথ্যে মায়া শুধু।
চন্দ্র নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো বাবার দিকে।
নির্ঝর বললো, “আপনি চেক করে দেখুন না এটা কি!”
শাহজাহান তালুকদার মানুষ চেনেন।এরা এতো কনফিডেন্স নিয়ে বলছে যখন তখন নিশ্চয় কোনো ঘাপলা আছে।এই বোতলে কিছু থাকলে ওরা এভাবে বলতো না।
গ্লাস তুলে নিয়ে এক চুমুক মুখে দিতেই বুঝতে পারলো শাহজাহান তালুকদার আসল কাহিনি। বোতল ভর্তি সফট ড্রিংকস। এরা এতো নিশ্চন্ত কেনো এবার বুঝতে পারছে।
টগর নিজের কার্ড এগিয়ে দিলো শাহজাহান তালুকদারের দিকে।
নির্ঝর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনার নামে আমাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে চেয়ারম্যান সাহেব। ইউ আন্ডার এরেস্ট। ”
শাহজাহান তালুকদার নিজের অপরাধ কি বুঝতে পারছেন না।
হতবাক হয়ে তাকাতেই টগর বললো, “কুসুমপুরে ড্রাগ বিজনেস, নিয়াজ,নীলির খু//নের জন্য আপনাকে এরেস্ট করা হলো।”
শাহজাহান তালুকদার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। চন্দ্র মনে মনে বলছে সত্যিটা বলো বাবা।আর চুপ করে থেকো না।
শাহজাহান তালুকদার এক মুহূর্ত কি যেনো ভাবলো।তারপর রেহানার মুখের দিকে তাকালো। রেহানার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই।যা বুঝার বুঝে নিলো শাহজাহান তালুকদার।
উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “চলুন,যাওয়া যাক।”
চন্দ্র উঠে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। শক্ত করে ধরে বললো, “না আব্বা,আব্বা কোথাও যাবেন না আপনি। আপনি কিছু করেন নি আমি জানি। কেনো অযথা নিজের কাঁধে দোষ নিচ্ছেন?”
শাহজাহান তালুকদার বললো, “আমার মায়ের কাছে আমি নির্দোষ হলেই চলবে গো মা।সারা পৃথিবী আমাকে দোষী ভাবুক।আমার আফসোস নেই আর।”
শর্মী কাঁদতে লাগলো নিরবে।নির্ঝর একবার টগরের দিকে তাকালো। টগরের চোখ হাসছে।নির্ঝর শাহজাহান তালুকদারকে নিয়ে বের হলো।
টগর বের হলো ঘর থেকে। দুই পা গিয়ে আবার পিছিয়ে এলো।চন্দ্রর সামনে এসে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “এই চোখে আমি কান্না দেখতে চাই না,আমার জন্য ভালোবাসা দেখতে চাই। আপনি যদি কখনো কাঁদেন তাহলে আমাকে পেয়ে খুশিতে কাঁদবেন।”
চন্দ্রর ভীষণ রাগ হলো। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিতেই টগর চন্দ্রর ঠোঁটে আলতো করে আঙ্গুল দিয়ে বললো, “উহু,একটা কথা ও বলবেন না।নাটকের শেষ পর্ব এখনো বাকি আছে। ”
চন্দ্রকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টগর চলে গেলো।
কাচারি ঘরের সামনে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ততক্ষণে চারদিকে ছড়িয়ে গেছে চেয়ারম্যানকে পুলিশ ধরেছে নিয়াজের খুনের জন্য।
কাচারি ঘরের সামনে এসে নির্ঝর কিছুক্ষণ দাঁড়ায় চেয়ারম্যানকে নিয়ে। চেয়ারম্যান এদিক ওদিক কিছুক্ষণ দেখলো।তারপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, “চলুন।”
নির্ঝর বললো,”আসুন।”
গাড়িতে উঠে নির্ঝর বসলো শাহজাহান তালুকদারকে নিয়ে। গাড়ি অপেক্ষা করছে টগরের জন্য। টগর একটা সিগারেট ধরিয়েছে।সিগারেটে দুই টান দিয়ে টগর ফেলে দিলো সিগারেট।
পেছনে তাকিয়ে দেখে চন্দ্র আর শর্মী দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে।
লোকজন সবাই নানা কথা বলতেছে।সবার কথা টগরের কানে আসছে।টগর গাড়িতে উঠতে যাবে সেই মুহূর্তে বাবুল দাশ ছুটতে ছুটতে এলো।
টগরের হাত চেপে ধরে বললো, “আমি, আসল অপরাধী আমি স্যার। আপনি আমারে এরেস্ট করেন।”
উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। চন্দ্র,শর্মী বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলো বাবুল দাশের দিকে।
শাহজাহান তালুকদার কিছু বলার আগে বাবুল দাশ বললো, “আমি আপনার নুন খাইছি স্যার।আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আমজ করতে পারবো না।আমাকে ক্ষমা করে দিন।”
শাহজাহান তালুকদারকে ছেড়ে দেওয়া হলো।কাচারি ঘরের সামনে চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা করা হলো।আশেপাশের মানুষ সবাই এসে হাজির। বাবুল দাশের মতো সহজ সরল বোকাসোকা একটা লোক সব কিছুর মাস্টার মাইন্ড এটা কারো বিশ্বাস হচ্ছে না।
চন্দ্র এক ছুটে গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, “মা,আব্বাকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। আসল অপরাধী না-কি বাবুল কাকা।আব্বা নির্দোষ। ”
রেহানা ফ্লোরে লেপটে বসে আছে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “তোর বাপ যে নির্দোষ তা আমি জানি গো মা।”
চন্দ্র মায়ের হাত ধরে বললো, “কিসের এতো ভয় তোমাদের মা?আমাকে নিয়ে? ভয় পেও না মা।তোমরা আমার বাবা মা,সারা দুনিয়ার মানুষ এসে যদি বলে তোমরা আমার আপন বাবা মা না আমি তবুও বিশ্বাস করবো না।আমার মা তুমি মা।তুমি আর আব্বা ছাড়া আমার কেউ নেই।আমি সব জানি মা।”
রেহানার দুই চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেলো।মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রেহানা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
সিতারা বানু কিছু বুঝতে পারছে না। ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো এই বউ একটা কথা ও বললো না, একটু চোখের পানি ও ফেললো না।অথচ এখন মেয়ের কথা শুনে কাঁদছে কেনো?
চন্দ্রর কথার মানে তার কাছে পরিস্কার না।
রেহানা চন্দ্রর হাত চেপে ধরে বললো, “তুই আমার মেয়ে,তুই শুধু আমার মেয়ে মা।আমি তোকে কোথাও যেতে দিমু না।তুই আমার শূন্য কোলে আলো নিয়ে এসেছিস।তুই আসার পর আমি জীবনের সব সুখ ফিরে পাইছি।আমি তোরে হারাতে পারমু না।আমার কাউরে লাগবো না মা তুই ছাড়া। ”
শর্মী ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। কি শুনছে এসব সে?
কিছুই বুঝতে পারছে না।
সব কিছুর পেছনে তাহলে কি কারণ ছিলো?
আপা কি বললো এসব?
বাবুল দাশ একেবারে শান্ত হয়ে বসে আছে।কাদের খাঁন ও এসে হাজির হয়েছে।
নির্ঝর বললো, “শুরু করো বাবুল দাশ।”
বাবুল দাশ শাহজাহান তালুকদারের দিকে এক নজর তাকালো। তারপর মাটির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি বাবুল দাশ। নিচু জাতের মানুষ আমি। হান্নান চৌধুরীর বাড়িতে আমি কাজ করতাম।হান্নান চৌধুরীর বাপ হানিফ চৌধুরীর উদ্যোগে আমি আইএ পাশ করি।এরপর আর পড়ালেখা করতে পারি নাই।”
হান্নান চৌধুরীর নাম শুনে কাদের খাঁন নড়েচড়ে বসলো। কানিজের স্বামী হান্নান চৌধুরী।
বাবুল দাশ বলতে লাগলো, “হান্নান স্যার বিয়ের পর থেকে কানিজ ভাবীর সাথে দুর্ব্যবহার করতো। ওদের বাড়ির সবাই-ই ভাবীর সাথে ভীষণ খারাপ ব্যবহার করতো।
একে একে দুটো কন্যা সন্তানের জন্মের পর কানিজ ভাবী একেবারে ভেঙে পড়ে। ভাবী যখন আবার গর্ভবতী হয় তখন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। খেতে পারতো না কিছুতেই।তার উপর ভাইজানের হাত তো কথায় কথায় ভাবীর গায়ে উঠতো। এতো অত্যাচার সহ্য করে ও কেনো পড়ে ছিলেন উনি আমি জানি না।
মাঝেমাঝে আমাকে দিয়ে দোকান থেকে পান সুপারি আনাতেন বমি ভাব হলে খাবেন বলে। তৃতীয় বার ভাবীর অসুস্থতা ভীষণ বেড়ে যায়।ভাবীকে একবারের জন্য ওরা কেউ ডাক্তারের কাছে নেয় নি।
সবাইরে ফাঁকি দিয়ে ভাবী একদিন আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছিলো। ফেরার পর খালাম্মা ভাবীকে একটা লাথি দিছিলো কোন সাহসে ডাক্তার দেখিয়েছে এই অপরাধে।
আমি গরীব মানুষ, চাইলেও কিছু করতে পারতাম না।মনে মনে ভাবতাম এইবার ও যদি মেয়ে হয় আমি মেয়েটারে নিয়ে পালাইয়া যামু ওরা কিছু করার আগে।
আবারও একটা মেয়ে হইলো। এতো সুন্দর একটা মেয়ে হইলো আমি ভাবছি সবাই সব ভুলে গেছে বুঝি মেয়ের দিকে তাকিয়ে। অথচ ভুল ভাবছি।বাবুর চার মাস বয়সের সময় একদিন দুপুরে দেখলাম খালাম্মা আর ভাইজান চুপি চুপি বাবুরে কোলে নিয়ে বের হইছে।আমি ও পিছু নিলাম।ওরা একটা হাসপাতালে নিয়ে বাচ্চাটারে বিক্রি করে দিলো।
কষ্টে আমার তখন বুক ফেটে যাচ্ছিলো।
আমি এরপর যারা বাচ্চাটা কিনছে তাদের পিছু নিই।আর পিছু নিয়েই চেয়ারম্যান সাবের বাসা পর্যন্ত যাই।
এরপর থেকে সুযোগ পেলেই ওনাদের বাসার সামনে ঘুরাঘুরি করতাম।ওনারা তখন ঢাকায় থাকতো।
মেয়ের নাম দিলো চন্দ্র।চন্দ্র রাখারই কথা, এতো সুন্দর একটা মেয়ে সে চন্দ্র নয়তো কি?
নিজের উপর খুব রাগ হইতো আমার। যদি আগের দুইটা বাচ্চার উপর নজর রাখতাম তাহলে ওদের ঠিকানা ও জানতাম।
চন্দ্ররে দত্তক নেওয়ার দুই মাস পর আমি চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে যাই বাসায় কাজের জন্য। ততদিনে ছোট্ট পুতুলটার উপরে আমার ভীষণ মায়া জন্মে গেছে। ওরে দেখার লোভেই আমি চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায় কাজ নিই।উনি তখনও চেয়ারম্যান হন নাই যদিও। ”
শাহজাহান তালুকদার নিরবে কাঁদছে। এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন তিনি।তিনি চান না কেউ জানতে পারুক চন্দ্র তার জন্ম দেওয়া সন্তান না।এই ভয়ে তিনি মেয়েকে নিয়ে বাড়িতেও আসেন নি প্রথমে। কাউকে কিছু জানান নি।আজ সবাই জেনে গেলো,মেয়েটাও জানবে।এরপর কি মেয়ে আর তাকে বাবা বলে ডাকবে?
কিসের একটা অসহ্য চাপা যন্ত্রণা সারা শরীর ছেয়ে গেলো তার।
চন্দ্র,তার কলিজার টুকরো মেয়ে। মেয়ে অভিমান করে হারিয়ে যাবে না তো এবার!
কাদের খাঁন বুক চেপে ধরলেন।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। এমন লাগছে কেনো?
চন্দ্র,মানে তালুকদারের বড় মেয়ে তার আপন বোনের মেয়ে!
বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি।আশেপাশের সবাই চুপ হয়ে আছে।মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে বাবুল দাশের কথা সবাই।
চলবে……
রাজিয়া রহমান