চন্দ্রাণী ৩১

0
119

#চন্দ্রাণী (৩১)
কারো মায়ায় পড়ে যাওয়ার মতো ভয়ংকর নেশা দ্বিতীয় কিছু নেই।নির্ঝর মুগ্ধ হয়ে শর্মীকে দেখছে। মেয়েটার চোখের নিচে পড়া কালিটাও কেমন আদুরে লাগছে নির্ঝরের কাছে।
এতো মায়া কেনো একটা মানুষের জন্য জন্মাবে হুটহাট?

ভাবতে ভাবতে ঘোর লেগে গেলো নির্ঝরের। আকাশের ওই সাদা মেঘের মতো মন ছুটে চলেছে। ঘোর কাটলো টগরের কথা শুনে। টগর স্পষ্ট সুরে বললো, “যে কারণে এসেছি আজ সেটা বলছি।আপনার বাসার সবাই এখানে উপস্থিত আছে তো চেয়ারম্যান সাহেব?”

টগর সটান হয়ে বসেছে চেয়ারে,কপালের উপর কয়েকটা এলোমেলো চুল অবহেলায় পড়ে আছে।
হাতে একটা ঘড়ি,পরনে একটা আকাশি কালার শার্ট।শাহজাহান তালুকদার তাকিয়ে আছে টগরের দিকে। এই ছেলেটাকে আজকে কেমন অন্য রকম লাগছে। সবসময় যেমন ঘোর লাগা একটা দৃষ্টি ছিলো আজ তেমন মনে হচ্ছে না।

শাহজাহান তালুকদার বললো, “সবাই বলতে আমার কর্মচারী বাবুল দাশ তো নেই আর কাজ করার মহিলা একজন এখনো আসে নি।”

নির্ঝর জিজ্ঞেস করলো, “বাবুল দাশ কোথায়?আর কাজের মহিলা?”

শাহজাহান তালুকদার বললো, “বাবুল কোথায় গিয়েছে আমি জানি না আর কাজের মহিলা এখনো আসে নি।আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। ”

টগর বললো, “অসুবিধা নেই,মেইন কালপ্রিট যে সে এখানেই আছে।”

চন্দ্র বাবা মা’র দিকে তাকালো। তার বিশ্বাস, ভরসা সব দিন দিন কেমন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। রেহানার দুই চোখ ছানাবড়া।
শর্মী প্লেট বাটি গুছিয়ে রাখছিলো রান্নাঘরে। টগরের কথা শুনে সে-ও চমকে উঠলো। কি বলছে টগর!

শাহজাহান তালুকদার নড়েচড়ে বসে বললো, “কে অপরাধী আর কে অপরাধী না,সেটা তুমি জানো কীভাবে? এটা পুলিশের দায়িত্ব, কোনো জাত মাতালের না।যে নিজেই কিনা মাতাল হয়ে থাকে,বাড়িতে মদ দিয়ে ভরিয়ে রাখে।তুমি কি ভেবেছো আমি জানি না তোমার বাড়িতে কোথায় মদের গোপন আস্তানা? ”

নির্ঝর বললো, “কি বলছেন আপনি? ”

শাহজাহান তালুকদার বললো, “ইন্সপেক্টর, যাকে আপনি সাথে করে নিয়ে এসেছেন সে যে একজন মাতাল তা তো আপনি জানেন নিজেই।ওর বাড়িতে মদের কারখানা বলতে পারেন।সে এসেছে অপরাধী খুঁজতে। ”

টগর হেসে বললো, “প্রমাণ করতে পারবেন?”

শাহজাহান তালুকদার বললো, “নিশ্চয়। ”

নির্ঝর দুইজন কনস্টেবলকে শাহজাহান তালুকদারের সাথে পাঠিয়ে বললো, “ওনার সাথে যাও,গিয়ে দেখে আসো ওনার কথা কতটা সত্য।”

শাহজাহান তালুকদার উঠে দাঁড়ালো। রেহানা বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শাহজাহান তালুকদার চলে যাওয়ার পর টগর বললো, “এভাবে তাকাবেন না চাচী আম্মা,এটা তো প্রাচীন যুগ না।প্রাচীন যুগ হলে এতক্ষণে আমি ভস্ম হয়ে যেতাম।”

রেহানা হিসহিসিয়ে বললো, “এখানে কেনো এসেছো তুমি? তোমার উদ্দেশ্য কি?”

টগর বললো, “আমার উদ্দেশ্য একটাই আম্মা,আমি আমার বউকে ফেরত চাই।”

রেহানা চমকে উঠলো। চেহারা মুহূর্তে পাংশুবর্ণ লাভ করলো। নিজেকে সামলে বললো, “কিসের বউ?কার বউ?”

টগর হেসে বললো, “মনে নেই আম্মা?কথা ছিলো আমার পুতুলের ১৮ বছর হলে আমার হাতে তুলে দেওয়া হবে। তারপর কি হলো আম্মা?”

টগর পকেট থেকে একটা ছবি বের করে রেহানার সামনে দিলো।
রেহানার হাত পা কাঁপতে লাগলো। পুরো পৃথিবী যেনো কাঁপছে। চন্দ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।তাকে জানতে হবে সবটা।

রেহানা শান্ত স্বরে বললো, “কি বলছো এসব?”

টগর হাসতে লাগলো। রেহানার মনে হচ্ছে তার কানে যেনো কেউ বিষ ঢেলে দিচ্ছে। এই ছেলেটা এভাবে হাসছে কেনো?
চন্দ্র এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো,এবার কি তাহলে সত্যি সত্যি মেয়েকে হারিয়ে ফেলবে?
নিজেকে নিজে সামলাচ্ছে রেহানা।না তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না।কিছুতেই না।

সিতারা বানু রেহানার দিকে তাকিয়ে বললো, “ও রেনু,কি বলছে এই পোলা?কি হইছে রে?”

রেহানা শান্ত স্বরে বললো, “কিছু হয় নি আম্মা।আপনি চিন্তা করবেন না।রুমে গিয়ে বিশ্রাম নেন।”

নির্ঝর বললো, “না দাদী,কোথাও যাবেন না।এখানেই বসুন।আজকে সব নাটকের যবনিকাপাত হবে। সব সত্যি সবাই জানতে পারবে।”

শর্মী এসে টেবিল থেকে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ালো।তার মাথায় ঢুকছে না কোনো কিছু। কিসের কথা বলছে এরা এসব?

রেহানা বললো, “কিসের নাটকের কথা বলছেন?”

নির্ঝর বললো, “নিয়াজের মৃত্যু রহস্য চাচী,গ্রামে ড্রাগের ব্যবসা কে করে সব কিছুই আজ সবাই জানতে পারবে। ”

রেহানা বললো, “নিয়াজের মৃত্যুর সাথে আমাদের কি সম্পর্ক? আর ড্রাগ ব্যবসায়, এসবের সাথে আমাদের কেনো জড়ানো হচ্ছে? এখানে কেনো এসব কথা আসছে?”

টগর মুচকি হেসে বললো, “রক্ষক যখন ভক্ষক হয় তখন এর চাইতে বেশি কি আশা করা যায় বলেন?”

কিছুক্ষণ পর শাহজাহান তালুকদার এলো কনস্টেবলদের সাথে। দুইজন কনস্টেবল হাতে চারটি বোতল নিয়ে এলো।

শাহজাহান তালুকদার বললো, “এগুলো কোথায় পেয়েছে আপনার কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করুন।”

টগর একটা বোতলের ছিপি খুলে একটা গ্লাসে ঢেলে চন্দ্রর সামনে এগিয়ে দিলো। তারপর বললো, “খান এটা।”

শাহজাহান তালুকদার রাগান্বিত হয়ে বললো, “ফাজলামো হচ্ছে না-কি? আমার মেয়ে কেনো এসব হারাম জিনিস মুখে নিবে?এসব কি হচ্ছে ইন্সপেক্টর?
আর ছেলেটা কেনো এতো কথা বলছে?ও কে যে পুলিশ কেসের ব্যাপারে কথা বলবে?কিসের ভিত্তিতে বলছে এসব ও?”

টগর মুচকি হেসে পকেট থেকে নিজের সি আই ডির ব্যাজটা বের করে শাহজাহান তালুকদারের সামনে রাখলো।
এক নজর সেই ব্যাজের দিকে তাকিয়ে শাহজাহান তালুকদার আর রেহানা দুজনেই চমকালো।শর্মী এগিয়ে এসে ব্যাজ হাতে তুলে নিলো।তারপর বিস্মিত হয়ে একবার কার্ডের দিকে আরেকবার টগরের দিকে তাকালো।
এই লোকটা একজন সি আই ডি অফিসার!
শর্মীর বিশ্বাস হচ্ছে না।

টগর বললো, “চন্দ্র,আপনি এটা খান।”

চন্দ্র বিব্রত হয়ে তাকালো টগরের দিকে। এই মানুষটা কি বলছে এসব।
শাহজাহান তালুকদার ক্রুদ্ধ হয়ে বললো, “আমার মেয়ে এসব খাবে না।”

টগর বললো, “চন্দ্র,আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন,আপনি আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার চাইতে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী অন্য কেউ না আপনার। ওনারাও না।”

চন্দ্র বাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এই সেই বাবা চন্দ্রর,অথচ কতো রহস্যময় বাবা।
চন্দ্র ভাবতো বাবা তার কাছে স্বচ্ছ কাঁচের মতো। অথচ এখন মনে হচ্ছে বাবা যেনো গোলকধাঁধা। যেখানের কোনো দিশা খুঁজে পাবে না সে।
ভালোবাসা কি এতোটাই অন্ধ করে তোলে মানুষকে?
শুধু চন্দ্রকে ভালোবাসে বলেই বাবা এরকম করছে?

চলবে…..?
রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here