#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৬
সকাল বেলা রৌদ্রূপ ঘুমে ঢুলতে ঢুলতেই অফিসে চলে গেল। কালকে রাতের ঘটনার পর তারা কিংবা রৌদ্রূপ কেউই আর ঘুমাতে পারেনি।
রৌদ্রূপ বাড়ি থেকে বেরোনোর পর তারা সারাদিন একাই বাড়িতে থাকে। টোনাটুনির সংসার তাই রান্নাবান্না, কাজকর্ম তেমন একটা থাকে না। বিকেলের দিকে রৌদ্রূপের মা রুবি তারাকে ফোন দিলেন। কেমন আছে না আছে তারা। কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা সবকিছুর খোঁজ নিলেন। তারাকে রুবিকে জানালো তাঁর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছে। রুবি তারার মুখে এসব শুনে খুশি হলেন। বেশ কিছুক্ষন দুজনের মধ্যে বেশ গল্প হলো। তারপর রুবি ফোন রেখে দিলেন। তারাও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলো।
রাতে রৌদ্রূপ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলো। হাতে লাল টকটকে গোলাপের তোড়া। রৌদ্রূপ তারার সামনে গোলাপের তোড়াটাকে পানিতে ভিজিয়ে রাখলো। এতে ফুল বেশি সময় তরতাজা থাকে। তারা গোলাপের তোড়াটা দেখে হালকা করে হাসলো। রৌদ্রূপ গোলাপের তোড়া থেকে একটা গোলাপ নিয়ে তারার দিকে এগিয়ে দিলো। তারা গোলাপটা রৌদ্রূপের কাছ থেকে নেওয়ার জন্য একবার হাত বাড়ালো। কিন্তু, অজানা কারণে হাতটা আবার সরিয়ে নিলো। রৌদ্রূপ কিছু বুঝতে না পেরে তারার দিকে তাকালো। তারা রৌদ্রূপের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বললো,
–ফুল পছন্দ না তোমার? ”
তারা নিবিড় কন্ঠে বললো,
–হুম, খুব পছন্দ। ”
রৌদ্রূপ উৎসুক দৃষ্টিতে তারার দিকে ফুলটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
–তবে, নিচ্ছো না কেন এটা?”
তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললো,
–ফুল হলো পবিত্রতার প্রতীক। আমার মতো অপবিত্র মানুষের হাতে ফুল মানায়?”
রৌদ্রূপ পুনরায় ফুলটা আগের স্থানে রেখে দিলো। ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে ধীর পায়ে তারার সামনে থেকে চলে গেল। তারা বিছানায় ক্লান্তি মাখা শরীর নিয়ে আবার শুয়ে পরলো। কিছুক্ষন পর রৌদ্রূপ তারার সামনে গিয়ে আলতোভাবে বললো,
–তারা!”
তারা বিছানা থেকে চমকে উঠে দাঁড়ালো। রৌদ্রূপ একেবারে তারার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আচমকা রৌদ্রূপের আগমনে একটু বিষ্মিত। রৌদ্রূপ তারার বিষ্ময়কে আরও কয়েক ধাপ ওপরে নিয়ে গেল। তারার হাত ধরে টানতে টানতে ওয়াশরুমের সামনে নিয়ে এলো। এক বালতি পানি তারার গায়ে ঢেলে দিলো। হঠাৎ এমন ঠান্ডা পানির স্পর্শ পেয়ে প্রচন্ড ভাবে চমকে গেল তারা। প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে রৌদ্রূপকে কিছু বলার আগেই রৌদ্রূপ সেই সুযোগটুকু তারাকে দিলো না। তারা রৌদ্রূপকে এভাবে তাকাতে দেখে নিচের দিকে তাকালো। ওয়াশরুমের পুরো ফ্লোর জুড়ে গোলাপের পাপড়িতে ছেঁয়ে গেছে। তারা আঁতকে উঠে নিজের শরীরে হাত দিলো। পুরো শরীর ভেজা! ভেজা গায়ে গোলাপের পাপড়িগুলো আঠার মতো আঁটকে রয়েছে। রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো। তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে বিষ্মিত হলো। রৌদ্রূপ তারার দিকে একটু এগিয়ে এসে তারার নেত্রদ্বয়ের দিকে স্থির চিত্তে তাকিয়ে বললো,
–ফুল পবিত্রতার প্রতীক। ফুলের পাপড়ি মিশ্রিত পানিও তাহলে পবিত্র পানি। তোমার শরীর পবিত্র পানি ছুঁয়েছে তারা। নিজেকে আর কখনো অপবিত্র দাবী করো না। ফুল যেমন পবিত্র! তুমিও আমার নিকট ফুলের মতো পবিত্র! ” রৌদ্রূপ আর এক মিনিটও দাঁড়ালো না। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গেল তারার চোখের সামনেই। তারা একচক্ষু জল নিয়ে অবস্থান করছে সেখানে। রৌদ্রূপ আর একটা মিনিট সেখানে দাঁড়ালে হয়তো তারার জল ভর্তি চোখটা দেখতে পেতো। পুরো শরীর আজ পবিত্র তারার! পবিত্র নারী সে! পুরোই প-বি-ত্র!
আজ অফ ডে। তাই রৌদ্রূপের অফিস নেই আজকে। সকাল বেলা রৌদ্রূপ ওয়াশরুমের সামনে বেশ দৌড়াদৌড়ি করতো লাগলো। তারা রৌদ্রূপের এহেন কান্ড দেখে জিজ্ঞেস করলো,
–কী হয়েছে?”
রৌদ্রূপ ক্যাবলাকান্তের মতো জবাব দিলো,
–ওয়াশরুমের লাইনে গোলাপের পাপড়ি পরে পুরো ওয়াশরুম জ্যাম হয়ে আছে। সেগুলোকে পরিস্কার করবো।”
রৌদ্রূপ ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে যাওয়ার জন্য হাঁটা ধরতেই তারা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। আহা! কাল বেচারা কত শখ করে গোলাপের পাপড়ি নিয়ে কত আহ্লাদ করলো। আজ সেগুলোকে আবার নিজেরই পরিষ্কার করতে হচ্ছে! হাহা!
রৌদ্রূপ হাসির শব্দ শুনে পেছনে চমকে তাকালো। তারা জোরে জোরে ঘর কাঁপিয়ে হাসছে। রৌদ্রূপ হাসোজ্জল তারার দিকে একবার তাকিয়ে আবার সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো। শুধু বিরবির করে অস্পষ্ট স্বরে বললো,
–তোমার এই মোহনীয় হাসি অমলিন থাকুক তারা!”
রৌদ্রূপ একেবারে গোসল করেই বাইরে এলো। তারার সামনে গিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বললো,
— মায়ের সঙ্গে এরমধ্যে আর কথা হয়নি তোমার? ”
তারা রৌদ্রূপের দিকে মনোযোগ দিয়ে বললো,
— হুম হয়েছিল কালকে। বেশ কিছুক্ষন কথা বলেছি আমরা।”
রৌদ্রূপ শুধু ছোট্ট করে বললো,
–হুম।”
তারা আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। রৌদ্রূপ বিছানায় বসে তারা বা পাশে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পরলো।
তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে বললো,
–আপনার এত সুন্দর পরিবার রেখে আপনি এখানে একা একা পরে থাকেন। আপনি একটা বোকা মানুষ। আমি হলে এমন বোকামি কখনোই করতাম না।”
রৌদ্রূপ তারার দিকে ফিরে বললো,
–আমারও ভালো লাগে না। কিন্তু, কী আর করার আছে? থাকতে হয় কাজের জন্য। অনেক কাজই আমাদের করতে ভালো লাগে না। কিন্তু, জীবনে চলার পথে একটা না একটা সময় সেগুলো আমাদের করতেই হয়।”
তারা আর কথা বললো না। তারা সারা না পেয়ে রৌদ্রূপও চুপ হয়ে গেল। তারা কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর রৌদ্রূপের দিকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
–আপনাকে একটা প্রশ্ন করবো?”
রৌদ্রূপ হেসে বললো,
–যত ইচ্ছে করো। আমার এত চুপচাপ থাকতে ভালো লাগে না।”
তারা বিছানা থেকে কুশন বালিশ হাতে নিয়ে বললো,
–আপনি তো চাইলে ঢাকার একটা মেয়েকেই বিয়ে করতে পারতেন। আপনি জব করেন। সেই সূত্রে আপনার তো চেনা জানা আছেই। আপনি আপনার মায়ের পছন্দে বিয়ে কেন করলেন?”
রৌদ্রূপ উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললো,
–মা আমাকে বেশ কিছুদিন যাবতই বিয়ের জন্য জ্বালাতন করছিল। আমার না বলার কারণ কিংবা সুযোগ কিছুই ছিল না। পরে অনেকগুলো মেয়ের ছবি দিয়ে বলেছিল কাকে ভালো লাগে। আমার এত পছন্দ অপছন্দ দিয়ে কাজ ছিল না। আমি মাকে বলেছিলাম তোমার কাকে পছন্দ মা?। মা তোমার কথা বললো। তোমাকে দেখাশোনা করার জন্য কোনো লোক নেই। তাই আমারও মনে হলো তোমাকে বিয়ে করলে তোমারও খেয়াল রাখতে পারবো৷ মায়ের কথাও রাখা হবে। সেটা ভেবেই হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম। ”
তারা মনোযোগ সহকারে রৌদ্রূপের কথা শুনলো। আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলে রৌদ্রূপ। কথাবার্তার ধরন খুব শালীন। প্রত্যেকটা কথা খুব যুক্তি দিয়ে বলেন। মাথার মগজে আঁটকে থাকে কথাগুলো।
রৌদ্রূপ কাজ শেষ করে চুলায় রান্না বসালো।ছুটির দিনে সবাই কমবেশি ভালো-মন্দ রান্না করে খেতে পছন্দ করে। রৌদ্রূপ বিরিয়ানি রান্না করলো। বাসার নিচের দোকান থেকে কোক আনলো। টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখার দেখলো তারা সবজি কেটে সালাদ বানিয়েছে। রৌদ্রূপ তারার অগোচরে মিটমিট করে হাসলো। বিরিয়ানির সাথে সালাদের কথা বেমালুম ভুলে গেছে সে। তারা প্লেট-বাটি ধুয়ে খেতে বসলো রৌদ্রূপের সঙ্গে। রৌদ্রূপ কচ করে শশায় কামড় দিয়ে বললো,
–গুনবতী হয়ে যাচ্ছো দিনদিন। কাজকর্ম শিখে যাচ্ছো দেখি।”
তারা রৌদ্রূপের কথায় মৃদু হাসলো। প্লেটে বিরিয়ানি তুলে নিয়ে বললো,
— এসব টুকটাক কাজ আমি পারি। শুধু ওসব রান্নাবান্নাই আমার দ্বারা হয় না।”
রৌদ্রূপ হাত নাড়াতে নাড়াতে বললো,
–শিখে যাবে সব আস্তে আস্তে। প্রথম প্রথম ওরকম হয়-ই একটু আকটু।”
তারা খাওয়া দাওয়া শেষ করে টেবিল মুছে পরিস্কার করলো। রৌদ্রূপ থালাবাসন সব ধুয়ে ফেলেছে। তাই, তারা টেবিল পরিস্কার করছে। কিছু না কিছু কাজ তো করতেই হবে। নাহলে, ঘরের সব কাজই বলা যায় রৌদ্রূপ নিজেই করে। বাসার ভেতরে সবজান্তা গুনী ব্যাক্তি হচ্ছে রৌদ্রূপ। সব কাজেই কমবেশি পটু সে।অতিরিক্ত দক্ষতার সাথে ঘরের সব কাজ করে সে। তারা কাজকর্ম তেমন একটা পারে না। আস্তে আস্তে সবকিছু শিখছে। এতে অবশ্য রৌদ্রূপের কোনো অসুবিধা নেই। শিখতে শিখতে একসময় তারাও সব পারবে। মানুষ চেষ্টা করলে পারে না এমন কোনো কাজ নেই।
চলবে….