#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ২
খাওয়ার টেবিলে নানারকম হাসিঠাট্টা, মজা, আনন্দ চললো। রৌদ্রূপ খাওয়া দাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে যখন উঠে যাচ্ছিলো। তখন,রুবি আক্তার পেছন থেকে রৌদ্রূপকে ডাক দিলেন। রৌদ্রূপ মায়ের ডাক শুনে থেমে গেল। রুবি তারার সামনেই রৌদ্রূপকে বললেন,
— ঢাকায় কবে ফিরে যাচ্ছো বাবা?
রৌদ্রূপ তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বললো,
— কালকে সকালেই রওনা দেবো ভেবেছি।
রুবি আক্তার মুখটা একটু অন্ধকার করে ফেললেন। রৌদ্রূপ এবার মায়া কন্ঠে বললেন,
— আর কয়েকটা দিন থেকে যাও বাবা।
রৌদ্রূপ তাঁর মায়ের হাত ধরে বললো,
— আমার ছুটি শেষ মা। অফিস থেকে কল আসছে বারবার। আর থাকতে পারবো না।
রুবি ছেলের হাতে হাত রেখে বললেন,
— তারাকে নিয়ে কিছুদিন পরপর চলে এসে কিন্তু।
রৌদ্রূপ মুচকি হেসে তারার দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো,
— আচ্ছা মা।
রৌদ্রূপকে এভাবে নিজের দিকে তাকাতে দেখে তারার বেশ অস্বস্তি হলো। তারা রৌদ্রূপের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করলো। রৌদ্রূপ বিষয়টা বুঝতে পেরে তারার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
রাতে রৌদ্রূপ ঘরে ঢুকতেই দেখল তাঁরা ঘরে নেই। রৌদ্রূপ চমকে এদিক ওদিক তাকালো। কোথাও নেই মেয়েটা! গেল কোথায় তাহলে? রৌদ্রূপ ধীর পায়ে নিঃশব্দ পদক্ষেপে বারান্দার দিকে অগ্রোসর হলো। বারান্দার সামনে গিয়ে বারান্দার দরজায় হালকা করে টোকা দিয়ে বললো,
— আসতে পারি কী?
তারা নিজের গায়ের শাড়িটা ঠিক করে জবাব দিলো,
— জী আসুন!
রৌদ্রূপ বারান্দায় প্রবেশ করেই তারাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— বারান্দায় আসার অনুমতি পেলাম তাহলে।
তারা রৌদ্রূপের কথা শুনে তাচ্ছিল্যকর হাসি দিয়ে বললো,
— আপনার বাড়ি আপনার ঘর। আপনি আসবেন এতে আবার অনুমতির কী দরকার? যখন ইচ্ছে ঢুকে পড়বেন।
রৌদ্রূপ মৃদু নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
— প্রত্যেকটা মানুষেরই প্রাইভেসি কিংবা গোপনীয়তা থাকে। তাই আমি চেষ্টা করি সেটা মেনে চলার। তাতে তোমার সমস্যা হলেও আমার কিছু করার নেই। আমি বারবার তোমাকে লজ্জায় ফেলতে চাই না।
তারা আর মুখে কিছু বললো না। নিরবতা দিয়ে নিজেকে ঘিরে ফেললো। রৌদ্রূপ নিরব কন্ঠে তারাকে বললো,
— প্যাকিং করা শেষ?
তারা জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো৷ ছোট্ট করে বললো,
— কীসের প্যাকিং?
রৌদ্রূপ জানালার গ্রীল ধরে বললো,
— ঢাকা যাবো সেজন্য।
তারা কিছু বুঝতে না প্রশ্নোতর কন্ঠে রৌদ্রূপকে বললো,
— কেন? হঠাৎ ঢাকা কেন যাবেন?
রৌদ্রূপ দেয়ালে হালকা হেলান দিয়ে বললো,
— আমি তো ঢাকায়ই থাকি। মানে চাকরিসূত্রে ঢাকা থাকা হয় আরকি। এখানে শুধু বাবা মা থাকে। তবে আমি ছুটি পেলেই কিছুদিন পরপর চলে আসি এখানে।
তারা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,
— হুম।
রৌদ্রূপ হঠাৎ বারান্দার গ্রিল হতে চাঁদের দিকে তাকালো। চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— আজকের চাঁদটা কত সুন্দর! পুরো তোমার মতো!
তারা চমকে উঠলো রৌদ্রূপের কথা শুনে। চমকে উঠে প্রথমে চাঁদের দিকে তাকালো। এরপর তাকালো রৌদ্রূপের দিকে। রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়েই তারা মলিন হেসে বললো,
— কিন্তু,আমি তো চাঁদ না!
তারা এবার সেখান থেকে দ্রুত গতিতে চলে গেল। রৌদ্রূপ বিমূঢ় দৃষ্টিতে তারার প্রস্থান দেখলো। এরপর আবার চাঁদ দেখায় মন দিলো।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বসলো রৌদ্রূপ। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো, তারা আয়নার সামনে এক ঘোরে তাকিয়ে আছে। রৌদ্রূপ দেয়ালে থাকা ঘড়িটার দিকে একবার তাকালো। এরপর ফ্রেস হতে ওয়াশরুমে চলে গেল। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে নিচে নাস্তা করতে চলে গেল রৌদ্রূপ। আনহাফ হোসেন সকালে নাস্তা খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। রৌদ্রূপ নাস্তার টেবিলে বসে নিজেই সবকিছু বেড়ে খেয়ে নিলো। রুবি রান্নাঘর থেকে ছেলেকে দেখতে পেয়ে,খাবার টেবিলের সামনে এসে বসলো। রৌদ্রূপ মায়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। রুবি স্নেহ সূলভ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন। আলতো করে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলেন। রৌদ্রূপ আরামে চোখ বন্ধ করে ফেললো। রুবি স্পষ্ট গলায় ছেলেকে বললেন,
— রৌদ্রূপ বাবা আমার। যে মেয়েটা নিজের সবকিছু ফেলে তোমার জন্য চলে এসেছে। কখনো কষ্ট দিও না বাবা। মানিয়ে গুছিয়ে থেকো ওর সাথে। তারা মেয়েটা যথেষ্ট ভদ্র সভ্য। তাঁকে তাঁর যথাযথ মর্যাদা দেবে। সংসার তাঁরার একা-র না। তুমিও হাতে হাতে সাহায্য করবে। সবকিছু ওর একার ওপরে ছেড়ে দেবে না। তারা মেয়েটার হয়তো প্রথম প্রথম তোমার সাথে মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে একটু কষ্ট হবে। কিন্তু,আস্তে আস্তে সবঠিক হয়ে যাবে। তুমি খেয়াল রেখো ওর।
রৌদ্রূপ মায়ের কথায় মাথা নাড়লো। যাঁর অর্থ সে বুঝতে পেরেছে সব। রুবি তারাকেও জোরে একটা ডাক দিলেন। তারা সামনে এসে দাঁড়াতেই, তারাকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন। তারার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে শুরু করলেন রুবি। তারা রুবির পাশে বসে চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে সব শুনতে শুরু করলো।
রৌদ্রূপ খাওয়া দাওয়া শেষ করে রেডি হলো। তারা রৌদ্রূপের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। রৌদ্রূপ হাত ইশারায় তারাকে থামতে বললো। তারা থেমে গেল। রৌদ্রূপ তারার সামনে গিয়ে আলতোভাবে বললো,
–রেডি হওনি এখনো।
তারা প্রশ্নোতর দৃষ্টিতে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। রৌদ্রূপ গলা খাঁখারি দিয়ে বললো,
— বের হবো আমরা, এখান থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগবে অনেক। এখন বের না হলে পরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে।
বাসের জানালার সিটটায় হেলান দিয়ে তারা। তীব্র বাতাসের বেগে বারবার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তারার। রৌদ্রূপ একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। অতীত বর্তমানের বিনি সুতোয় নিজেকে পর্যবেক্ষন করছে। হঠাৎ রৌদ্রুপের চক্ষুদ্বয় তারার দিকে পর্যবেক্ষনের দৃষ্টিতে তাকালো। তারা বাসের সামনে সিটের ওপরে হাত রেখে ঘুমিয়ে পরেছে। জানালার কাঁচের দিকটায় হালকা ভাবে মাথা পাশ করে রেখেছে তারা। রৌদ্রূপ এক হাত বাড়িয়ে আলতো ভাবে তারার মাথার পাশটা ধরে রাখলো। ওভাবে জানালার কাঁচে মাথা দিয়ে ঘুমানো ঠিক না। বাসের ঝাঁকিতে জানালার কাঁচে মাথা বারি খেয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
রৌদ্রূপ জানালা দিয়ে খেয়াল করলো এখন কোথায় অবস্থান করছে বাসটি। রৌদ্রূপ এবার তারাকে আলতোভাবে ডাকলো,
— তারা!
তারা ঘুমু ঘুমু চোখে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। রৌদ্রূপ তারাকে তাকাতে দেখে বললো,
— আমরা এসে পরেছি। আস্তে আস্তে উঠো এবার। সামনেই নেমে পরবো আমরা।
রৌদ্রূপের কথা শুনে তাড়াতাড়ি তারা ঠিকঠাক হয়ে বসলো। রৌদ্রূপ তারার মাথা থেকে খুব সাবধানে হাতটা সরিয়ে নিলো। তারা এতক্ষন বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসলেও এবার সোজা হয়ে বসলো। তারা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। রৌদ্রূপ নিজের সিট ছেড়ে দাঁড়ালো। তারাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— সাবধানে এসো আমার সাথে। চলে এসেছি আমরা।
তারা খুব সর্তক ভাবে নিজের শাড়ি আঁচল ধরে নামলো বাস থেকে। রৌদ্রূপ তারার হাত ধরে রাস্তা পার হলো। তারার হাত ধরায় তারা বারবার রৌদ্রূপের দিকে তাকাচ্ছিল। রৌদ্রূপ সেদিকে খেয়াল না করে খুব সাবধানে তারাকে নিয়ে রাস্তা পার হলো।
রৌদ্রূপের সাথে রৌদ্রূপের ফ্ল্যাটে ঢুকলো তারা। রৌদ্রূপের ফ্ল্যাটে ঢুকতেই ড্রয়িংরুম সামনে পরে। তারপর এক-এক করে বাকি ঘরগুলো। তারা ছোট-ছোট পা ফেলে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলো। ড্রয়িংরুমে বিশাল বড় একটা ছবি টাঙানো। একটা রক্তিম বর্ণের আকাশের মধ্যে বড় একটা চাঁদ উঠেছে! তারা কৌতুহলী চোখে ছবিটা খেয়াল করলো। রক্তিম আকাশে চাঁদ! যে এই ছবিটা এঁকেছে তাঁর কল্পনা শক্তি খুব তীক্ষ্ণ এটা নিশ্চিত। নাহলে এত সুন্দর একটা ছবি যে কেউ আঁকতে পারবে না। তারা ছবিটার নিচে রৌদ্রূপের একটা সাইন দেখতে পেল। তারা অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে সাইনটা আবার দেখলো। ছবিটা রৌদ্রূপ সত্যিই রৌদ্রূপের আঁকা! সাইনটাও রৌদ্রূপের!
চলবে….