#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১০
রৌদ্রজ্জ্বল সকালে তারা বিছানা থেকে উঠলো। রৌদ্রূপ সেই সকালে অফিসে চলে গেছে। অগত্যা কী আর করা? তারা আরেকবার ঘুমন্ত পুরিতে পাড়ি জমিয়েছে।
চা হাতে নিয়ে বারান্দায় গেল তারা। রোদের তাপে চোখ ঝলসে এলো। অবিলম্বেই বারান্দা থেকে প্রস্থান করলো তারা। এমনিতেই হাতে গরম চা! আবার তাঁর মধ্যে এত তীব্র রোদ! বিরক্তি মাখা মুখ করে তারা হেঁটে চললো। বসার ঘরে গিয়ে চা হাতে নিয়ে বসলো তারা। চায়ে চুমুক দেওয়া মাত্রই, দেয়ালে জুড়ে বসে থাকা এক অপরূপ বস্তুর দিকে দৃষ্টি গেল তারার। তৎক্ষনাৎ চায়ের কাপখানা রেখে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো তারা। দেয়ালের সন্নিকটে গিয়ে মূহুর্তেই হেসে ফেললো তারা। সেদিন রৌদ্রূপের রঙ মাখা ছবিটা দেয়ালে টানানো। রঙের বিভীষিকায় রৌদ্রূপকে চেনাই যাচ্ছে না। তারা ছবিটায় রিক্তহস্তে হাত বোলালো। দেয়ালে থাকা ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবিটা সত্যিই অসাধারণ। জাদু আছে রৌদ্রূপের হাতে! সত্যিই অসাধারণ ছবিটা!
তারা এলোমেলো পায়ে বাড়ি জুড়ে হাঁটাহাঁটি, ঘোরাঘুরি করতে আরম্ভ করলো। কী আর করবে? বাড়িতে সে যে একেবারে একা! টেলিফোনটার দিকে চোখ যেতেই তারা থমকে গেল। এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন। তবুও, এই বাড়িতে কী সুন্দর টেলিফোন! তারা দ্রুত রৌদ্রূপের নাম্বারটা তাঁর ফোন থেকে টুকে নিলো। টেলিফোনে রৌদ্রূপের নাম্বারে কল দিয়ে তারা অপেক্ষা করলো। একি! রৌদ্রূপ ধরছে না কেন ফোনটা? তারা অভিমানে টেলিফোনটা পূর্বের স্থানে রেখে দিলো। বাড়িতেই যত ভাব-ভঙ্গি রৌদ্রূপের। এই বাইরে গিয়েই তারাকে ভুলে গেল সে? এত ভুলোমনা মন কেন তাঁর? একটু খেয়ালে রাখা যায় না তারার কথা?
টেলিফোনটা হুট করে বেজে উঠলো। তারা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে টেলিফোনটা উঠিয়ে বললো,
— হ্যালো”
রৌদ্রূপ দ্রুত আতংকমাখা গলায় পাশ থেকে বললো,
— কী হয়েছে? তারা! তারা!
তারা ভারী গলায় বললো,
— কী হবে? মরে যাবো এই হবে!”
রৌদ্রূপ মুখ থেকে বিরক্তিমাখা শব্দ উচ্চারণ করলো। নির্লিপ্ত গলায় বললো,
— আমি ভয় পেয়েছিলাম তারা। ভেবেছিলাম বাসায় কেউ হয়তো ফোন করে বলবে, রৌদ্রূপ সাহেব;আপনার ওয়াইফ সুইসাইড করেছে। লাশটা কী পোড়াবো না কি কবর দেবো?”
তারা শব্দ করে হেসে ফেললো। ঠোঁটে হাসির রেখা ধরে রাখলো। নিভৃতে বললো,
— রৌদ্রূপ! আমার মতো জীবিত মানুষটাকে এভাবে মেরে ফেললেন! আমি রাগ করলাম রৌদ্রূপ। আপনি আমাকে নিয়ে মজা করেছেন!”
অভিমানে ফুলে ফেঁপে উঠলো তারা। রৌদ্রূপ উৎকন্ঠা যুক্ত গলায় বললো,
— আমি কিন্তু ওভাবে বলিনি।তোমার মাথা মাঝে মধ্যে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তখনই তো সুইসাইড করার বাসনা জেগে ওঠে।”
তারা মিটমিটিয়ে হেসে ফেললো। ঘটনা কিন্তু সত্য!
রৌদ্রূপ অফিস থেকে বেড়িয়েই তারার জন্য ভালো কোচিং সেন্টারের খোঁজ করলো। ভালো কোচিং সেন্টার পেল বটে। তবে, সমস্যা ওই একটাই বাসা থেকে একটু দূরে। রৌদ্রূপ তবুও তারার নাম রেজিষ্ট্রেশন করে তারাকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এলো। সপ্তাহে পাঁচদিন ক্লাস। রৌদ্রূপ ক্লান্তিমাখা শরীরে এবার বাড়ির পথ ধরলো। কোচিং সেন্টারটা আসলেই প্রয়োজন ছিল। কষ্ট হলেও তারাকে রোজ এখানে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাবে। একটা মেয়ের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য হলেও পড়াশোনা করা জরুরি।
রৌদ্রূপ বাড়ি ফিরে দেখলো বাইরে থেকে গেট লাগিয়ে দেওয়া। রৌদ্রূপ বিলম্ব না করেই ছাঁদের সিঁড়িতে উঠে এক দৌড়ে ওপরে উঠলো।
ছাঁদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে তারা কফি খাচ্ছে। রৌদ্রূপ জোরে জোরে শ্বাস ফেললো। কড়া পাহারায় রাখতে হবে এই মেয়েকে। কখন কী করে ফেলে কে জানে! রৌদ্রূপ শার্টের কলার ঠিক ঠিক করতে তারার সন্নিকটে গিয়ে উপস্থিত হলো। গলা খাঁখাঁরি দিয়ে আওয়াজ সৃষ্টি করলো। তারা কফির কাপটা মোটা সিমেন্টের রেলিঙের ওপরে রেখে পাশ ফিরে তাকালো। তাকানো মাত্রই রৌদ্রূপের দিকে দৃষ্টি গেল তারার। তারা হেসে বললো,
— কখন এলেন?
রৌদ্রূপ প্রতিত্তরে কোনো জবাব দিলো না। কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। শেষে মৌনতা কাটিয়ে বললো,
— ছাঁদে আসলে যে?
তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে হাসলো। পরিতৃপ্ত কন্ঠে বললো,
— আমার চিরকালের বন্ধু, আমার সখা চাঁদকে দেখতে এসেছিলাম।”
রৌদ্রূপ অধরে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো।বেশ আদুরে ভঙ্গিতে বললো,
— চাঁদ আবার চাঁদকে দেখে কীভাবে? চাঁদ তো একটাই!”
তারা বিস্মিত হয়ে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। রৌদ্রূপ ঘাড় এদিক ওদিক ঘুরিয়ে কথার প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলো।
— ভালো একটা কোচিংয়ে রেজিষ্ট্রেশন করে রেখেছি। সকাল সাতটা থেকে ক্লাস শুরু। কালকে থেকেই ক্লাসে জয়েন করবে। পড়াশোনার ওপরে কোনো রূপ ফাঁকিবাজি আমি কিন্তু মেনে নেবো না।”
তারা ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
— আমার পড়াশোনা নিয়ে ফুপিদের সেই কত্ত অজুহাত! মেয়ে মানুষ এত পড়ে কী করবে? মেয়ে মানুষকে বেশি পড়াশোনা করানো মানেই উশৃংখলতা! মেয়ে মানুষ যত শিক্ষিত হবে সমাজে ডির্ভোসের হার তত বৃদ্ধি পাবে। দেখলেন না? বয়স আর কত হবে আমার? এর মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেল!”
রৌদ্রূপ তারার কথায় হেসে ফেললো। ব্যাক্তি বৈশিষ্ট্য ধরে রেখে কথা বলে তারা। রৌদ্রূপ নিবিড় কন্ঠে বললো,
— আমাদের সমাজে এসব মানুষ হচ্ছে মরিচিকা। আশেপাশের মানুষদের আজেবাজে কথা বলে জ্ঞান দেবে। কিন্তু, নিজের চরিত্রের দিকে কোনো খেয়াল নেই। এসব মানুষদের যত পারো এড়িয়ে চলবে তারা।”
তারা কিঞ্চিৎ পরিমাণ হাসলো।রৌদ্রূপ ছাঁদের এপাশ ওপাশে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
— আমার মা কী বলতেন জানো? মেয়েরা হচ্ছে পানির মতোন। যে-ই পাত্রে রাখা হয় সেই পাত্রের আকার ধারণ করে ফেলে। তুমি পানিকে ফ্রিজে রাখো। সে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাবে। তুমি আবার সেই পানিকে আগুনের তাপে রাখো। সে তৎক্ষনাৎ টগবগিয়ে ফুটতে থাকবে। এসব তোমার ওপরে নির্ভরশীল তুমি নিজেকে কীভাবে গড়তে চাও। নিজেকে শক্ত ভাবে গড়ে নিজের মতো বাঁচতে চাও। না কি তরল হয়ে নিজের সত্তাকে বির্সজন দিতে চাও।
তারা নিভৃতেই বিস্মিত হলো। নারী নিয়ে কী সুন্দর মনোভাব রৌদ্রূপের! আসল পুরুষের বৈশিষ্ট্য হয়তো এটাই! একজন সত্যিকারের সুপুরুষ কখনো নারীর গায়ে হাত তুলে নিজের শক্তি জাহির করে না। বরং নারীকে সম্মান করে পরম স্নেহে আগলে রাখে।
তারা নিজের ভাবনার জালে বারবার আঁটকে যায়। আপন মনে আবারও গভীর চিন্তায় মত্ত্ব হয়ে গেল সে। রৌদ্রূপ টিশার্ট পরিধান করে টিভির সামনে গিয়ে বসলো। তারা আপনমনে পা দুলাচ্ছে আর কী যেন ভাবছে। রৌদ্রূপ পাশ থেকে একবার তারা বলে ডাক দিলো। তারার তবুও কোনো সাড়া নেই। রৌদ্রূপ এবার উঠে গিয়ে তারার একেবারে মুখোমুখি হয়ে বসলো। অস্ফুটে বললো,
— তারা!
তারা কিছুটা হকচকিয়ে উঠলো। রৌদ্রূপ তারার হাতে পানির গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
— তোমার যে কী হয় মাঝেমধ্যে তারা!আমি না ভেবে পাই না। মাঝেমধ্যে খুব হাসিখুশি থাকো। মাঝেমধ্যে আবার গুরুগম্ভীর বেশে থম মেরে বসে থাকো। তোমায় নিয়ে আর পারলাম না তারা!”
তারা অবিলম্বে মাথাটা নিচু করে ফেললো। নিচুস্বরে বললো,
— সারাদিন আমি ঠিকই থাকি রৌদ্রূপ। রাত হলেই আমার পুরনো দিনের কথা। সেই মানুষগুলোর পৈশা/চিক আচরণের কথা আমার খুব করে মনে পরে। আমি আর তখন ঠিক থাকতে পারি না। আমি কেন ওই অপ্রিয় মুখগুলোকে ভুলতে পারি না রৌদ্রূপ?”
রৌদ্রূপ তারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
–জীবনের খুব প্রিয় কিংবা অপ্রিয় মানুষগুলোকে কখনো একেবারে ভোলা যায় না তারা। মনের কোনো না কোনো এক কোনে এরা রয়েই যায়। সেসব মানুষদের একেবারে ভুলে যাওয়া হয়তো সম্ভব না তারা। কিন্তু, তুমি তাদের মনে করার চেষ্টা করো না। মনে করবে তোমার জীবনের একটা খারাপ অধ্যায় ছিল সেটা। সবকিছুর শুরু যেমন আছে। তেমন শেষও আছে। এই জীবনের খারাপ মূহুর্তগুলোর পরিসমাপ্তিও খুব শীঘ্রই হবে তারা। অযথা এসব নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করো না। তোমার মতো কত মেধাবী একটা মানুষের মূল্যবান সময় কিনা নষ্ট হচ্ছে ওসব মানুষের কথা ভেবে? এসব কিন্তু একদম ঠিক না! আর এসব চিন্তা করে মন খারাপ করবে না। কেউ না থাকুক। তোমার আমি তো আছি? আমি থাকতে কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। মে/রে হাত ভে/ঙে দেবো না আমি!”
তারা হেসে ফেললো রৌদ্রূপের এহেন আদুরে আচরন দেখে। রৌদ্রূপ সত্যিই একটা ভালো মনের মানুষ। কথা বললেই মনটা ভালো হয়ে যায়।
চলবে….