চন্দ্রবিলাসীনি পর্ব ১

0
1135

“দয়া করে আমার কাছে আসবেন না।”

নতুন বউয়ের কাছ থেকে একথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল রৌদ্রূপ। বুকে সাহস নিয়ে একটু সামনে এগোতেই আবারও কাছ থেকে শুনতে পেল,

” আমার থেকে দূরে থাকুন। কাছে আসবেন না দয়া করে।”

রৌদ্রূপ থমকে গিয়ে তাকালো মেয়েটির দিকে। চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু জল। মাথা নিচু করে বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি।

রৌদ্রূপ মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটি ভয় পেয়ে পিছনে সরে গেল।রৌদ্রূপ আরও একহাত সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটি মাথা নিচু করে দুইহাত পেছনে সরে দাঁড়ালো। মেয়েটির চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে নিচে পরছে। রৌদ্রূপ মেয়েটির থুতনিতে হাত রেখে শান্ত গলায় বললো,
” ভয় পাচ্ছো কেন আমাকে? তোমার কী এই বিয়েতে মত ছিল না?”

রৌদ্রূপ বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করেও অপর প্রান্তের মানুষটির কাছ থেকে কোনো জবাব পেল না। নিজের কাঙ্খিত মানুষটির কাছ থেকে জবাব না পেয়ে, ব্যর্থ হয়ে রৌদ্রূপ মেয়েটির সামনে থেকে সরে গেল। মনে মনে নিজেকে বারবার প্রশ্ন করতে লাগলো। কেন মেয়েটি তাঁর সাথে কথা বলছে না? সে কী এই বিয়েতে রাজি ছিল না? কিন্তু, কোনো জবাব খুঁজে পেল না রৌদ্রূপ। এই মুহুর্তে মেয়েটিকেও কিছু জিজ্ঞেস করা সম্ভব নয়। মেয়েটি প্রচন্ড পরিমানে ভয় পাচ্ছে রৌদ্রূপকে।মেয়েটির ভীতিগ্রস্ত চেহারা এখনও রৌদ্রূপের চোখে ভেসে বেড়াচ্ছে।

হাতমুখ ধুয়ে এসে বিছানায় বসে পরলো রৌদ্রূপ। আজ সারাটাদিন বেশ ধকল গিয়েছে। আজ নয় এক সপ্তাহ যাবতই এমনটা হচ্ছে। রৌদ্রূপের বিয়েটা আজ অনুষ্ঠিত হলেও আত্নীয় স্বজন এক সপ্তাহ যাবত তাদের বাড়িতে অবস্থান করছে। রৌদ্রুপ প্রথমে একটু দ্বিমত করেছিল এই ব্যাপারটায়। কিন্তু, পরে অবশ্য মামাতো,চাচাতো ভাইবোনেদের আড্ডা, মজা হুড়োহুড়ি দেখে আর কিছু বলেনি।

রৌদ্রূপ ক্লান্তি মাখা শরীর নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। বিছানার ওপরে দৃষ্টিপাত হতেই আবার সেই মেয়েটিকে দেখতে পেল। রৌদ্রূপ এবার ধীর পায়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল। মেয়েটি রৌদ্রূপকে তাঁর অগ্রোসর হতে দেখতেই মাথা নিচু করে ফেললো। রৌদ্রূপ বিছানায় বসে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করলো। মেয়েটি তো জানিয়ে ছিল সে এই বিয়েতে রাজি। তাহলে এখন এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? রৌদ্রূপ মনে মনে নানা প্রশ্নের কথামালা বুনতে শুরু করলো। মেয়েটি এবার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার জিনিসপত্র গুলো কোথায়?”

রৌদ্রূপ হঠাৎ মেয়েটির গলার কন্ঠস্বর শুনে একটু চমকে গেল। মেয়েটির দিকে তাকাতেই মেয়েটি রৌদ্রূপের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।রৌদ্রূপ মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল। আলমারির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো,
” এখানে আছে সবকিছু,আমি গুছিয়ে রেখেছি।”

মেয়েটি এবার দ্রুত গতিতে রৌদ্রূপের সামনে থেকে সরে গেল। রৌদ্রূপ অবাক দৃষ্টিতে মেয়েটির কার্যকলাপ সমূহ দেখতে শুরু করলো। মেয়েটি আলমারি খুলে নিজের জিনিসপত্র বের করলো। এরপরই অগ্রোসর হলো ওয়াশরুমের দিকে। রৌদ্রূপ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবকিছু খেয়াল করলো। মেয়েটিকে এত রহস্যময়ী লাগছে কেন তাঁর? বিয়ের আগে কথাও হয়েছিল মেয়েটির সাথে। দেখা সাক্ষাত হয়েছিল তবে শুধু তিনবার। এরপরে তো বিয়েটাই হয়ে গেল। রৌদ্রূপ মেয়েটিকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিল তাঁর এই বিয়েতে মত আছে কি না। মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে নিজের সম্মতির কথা জানিয়ে ছিল। তবে এখন এমন আচরণের কারণ কী? নেহাতই পরিবারের চাপে পরে বিয়েটা করেছে না কি অন্য কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে? রৌদ্রূপ এসব ভাবতে ভাবতেই খেয়াল করলো মেয়েটি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসেছে। সদ্য ফুটে ওঠা নিষ্পাপ ফুলের মতো লাগছে মেয়েটাকে। কিন্তু আচার-আচরণ? আচার-আচরণের দিক থেকে মেয়েটা মোটেও নিষ্পাপ না। আসার পর থেকে একটা কথাও বলেনি রৌদ্রূপের সঙ্গে। বিয়ের অনুষ্ঠানেও একদম চুপচাপ বসে ছিল। রৌদ্রূপ টুকটাক কথা বললেও মেয়েটা যে রৌদ্রূপের সাথে কথা বলতে আগ্রহী না সেটা তাঁর চোখেমুখে জানান দিচ্ছিল। তাই বাধ্য হয়ে রৌদ্রূপও আর কথা বাড়ায়নি। চুপচাপই বসে ছিল।

মেয়েটি হেঁটে এসে বিছানায় বসে পড়লো। বালিশ ঠিকঠাক জায়গায় রেখে শুয়ে পরলো। তাঁরই সামনে যে রৌদ্রূপ বসে আছে সেটার দিকে খেয়ালই করলো না। রৌদ্রূপ এবার একটু অসন্তুষ্ট বোধ করলো। নিজেও বালিশ ঠিক করে মেয়েটির পাশে শুয়ে পরলো। পাশ ফিরে শুয়েই মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটি রৌদ্রূপকে এভাবে তাঁর পাশ ফিরে শুতে দেখেই বেশ ইতস্তত বোধ করলো। রৌদ্রূপের সাথে চোখাচোখি হতেই ওপাশ ফিরে শুয়ে পরলো। রৌদ্রূপের এবার মনঃক্ষুন হলো। এটা কেমন আচরণ? ভদ্রতার বুঝি এতই অভাব? রৌদ্রূপও এবার ওপাশ ফিরে শুয়ে পরলো। দুটি একত্রে একসঙ্গে একই বিছানায় শুয়ে আছে। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ঘোর দুরত্ব! এই দুরত্বের পরিধি যে পরিমাপ করা যায় না!

সকালে রৌদ্রূপ ঘুম থেকে উঠে দেখল, মেয়েটি তাঁর পাশে নেই। রৌদ্রূপ ফ্রেস হতে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল। ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই দেখল মেয়েটি তাঁর টেবিলের ওপরে কফির কাপ রাখছে। রৌদ্রূপ দ্রুত পায়ে মেয়েটির সামনে এগিয়ে গেল। মেয়েটির সামনে গিয়ে তাঁকে বললো,
— কফিটা কী তুমি বানিয়েছো?

মেয়েটি রৌদ্রূপের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
— জি!

মেয়েটি এবার দ্রুত পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলো। রৌদ্রূপ পেছন থেকে মেয়েটার হাত চেপে ধরলো। অস্ফুট কন্ঠে রৌদ্রূপ বলে উঠলো,
— তারা!

মেয়েটি যেন কিছুটা আঁতকে উঠল। তবুও পেছন ফিরে তাকালো রৌদ্রূপের দিকে। রৌদ্রূপ আবার উচ্চারণ করলো,
— তারা!

রৌদ্রূপের সামনে থাকা মেয়েটি এবার জবাব দিলো,
— জী বলুন।

রৌদ্রূপ সামান্য চমকে উঠলো। মেয়েটির হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,
— কিছু না! তুমি যাও তারা।

তারার হাত রৌদ্রূপ ছেড়ে দিল। তারা ছোট ছোট পা ফেলে ঘরের বাইরে চলে গেল।

রৌদ্রূপ দুপুরের খাবার খেতে নিচে এলো। টেবিলে সামনে রৌদ্রূপের মা রুবি আক্তার দাঁড়িয়ে আছেন। সাথে দাঁড়িয়ে আছে তারা। রৌদ্রূপের বাবা আনহাফ হোসেনও টেবিলে বসে আছেন। রৌদ্রূপ হাত ধুয়ে এসে টেবিলে বসতে বসতে বললো,
— বাসার মেহমান কোথায়? বাসা এত ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন?

রুবি টেবিলের ওপরে পানির গ্লাস রেখে বললো,
— সকালে চলে গেছে সবাই। আমি অনেকবার বলেছিলাম আরও কয়েকটা দিন থেকে যেতে। শুনলো না কেউ; সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, সবাই ব্যাগ প্যাকিং করছে। চলে যাওয়ার জন্য।

রৌদ্রূপ আর কিছু বললো না। মনে মনে রৌদ্রূপ একটু খুশিই হলো। বাসায় এত মানুষের আনাগোনা ভালো লাগে না। বাসা থাকবে নিরিবিলি নিস্তব্ধ। এত হই-হুল্লোড় কতদিন সহ্য করা যায়। রৌদ্রূপ বিসমিল্লাহ বলে খাবার খাওয়া শুরু করলো৷ তারা অবশ্য টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। পরে রৌদ্রূপের বাবা আনহাফ তারাকেও খাবার খেতে বসিয়ে দিয়েছে। কেউ খাবে কেউ পরিবেশন করবে এটা কেমন কথা? যাঁর যা প্রয়োজন সে সেটা নিয়ে খাবে। সবাই-ই সমান ক্ষুদার্থ।অতএব সবাই একসঙ্গে বসে খাবে।

রৌদ্রূপের মা রুবি আক্তার খাবার টেবিলে রৌদ্রূপকে বললেন,
— বলো তো বাবা আজকে রান্না কে করেছে?

রৌদ্রূপ রুবি আক্তারের দিকে তাকালো একবার। আরেকবার তাকালো তারার দিকে। তারা চুপচাপ মাথা নিচু করে খাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে এখন তাঁর মনোযোগ শুধু খাবারের দিকে। রৌদ্রূপ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
— তুমি কিংবা তারা।

তারা হঠাৎ চমকে উঠে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। তবে সেটা রৌদ্রূপের দৃষ্টি অগোচর হলো না। রৌদ্রূপকে অবাক করে দিয়ে রুবি বললেন,
–আজকে তোমার বাবা রান্না করেছে।

রৌদ্রূপ আনহাফ হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— হুম, ভালো হয়েছে কিন্তু খাবারটা!

আনহাফ হোসেন রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,
— এই কয়েকদিন তোমার বিয়ে উপলক্ষে অনেক খাটা-খাটনি করতে হয়েছে। তোমার মায়ের শরীরটা বেশি ভালো না। তাই ভাবলাম আমি নিজেই রান্না করি।

রৌদ্রূপ খাবারের দিকে তাকিয়ে বললো,
— হুম, ভালো করেছো বাবা। মায়েরও একটু বিশ্রাম নেওয়া হলো।

চলবে…

#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১

(গল্পের শুধুমাত্র একটা পর্ব পড়ে গল্পটা বিচার করবেন না। একজন অপরিপক্ক হাতের লেখিকা হিসেবে এই গল্পটি সাজাতে আমার সময় লেগেছে দুই বছরের অধিক।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here