ভর-সন্ধ্যাবেলায় নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে দেখে চন্দ্রবাহারের মাথায় যেন আকাশ ভে*ঙে পড়ে। চন্দ্রবাহার ছলছল চোখে একপলক হাস্যজ্জ্বল সরফরাজের দিকে তাকায়। চন্দ্রের সরফরাজ ভাই যে তার কথা রাখেনি! সেও যে হাসতে হাসতে বে-ঈ-মা-ন-দের দলে নাম লিখিয়েছে!
“ও চাচী কই তুমি? দেখে যাও নতুন বউ নিয়া আসছি।“ সরফরাজের ডাক শুনে রান্নাঘর হতে তড়িঘড়ি করে নাজিয়া খাতুন ছুটে আসেন। সরফরাজের পাশে লাল শাড়ি পড়ে মাথায় বিশাল ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীকে দেখে নাজিয়া খাতুন প্রশ্ন করে বসেন,
“ও সরফরাজ এই মাইয়াটা কেডা?”
হাসতে হাসতে সরফরাজ বলে ওঠে, “আমার সদ্য বিয়া করা বউ চাচী। আমার মার ছোট বোনের মেয়ে। মার শখ ছিল ওর সাথে আমার বিয়ে দেবে। কিন্তু মা তো বিয়ে দিয়ে যেতে পারল না। তাই ভাবলাম বিয়েটা করেই ফেলি না হয়!“
নাজিয়া খাতুনের বুকটা ধক করে ওঠে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে মেয়ের দিকে তাকান। চন্দ্রবাহার ঘরের খুটি আকড়ে ধরে কোনো মতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কখন যেন ধপ করে মেঝেতে পড়ে যায়! চন্দ্রবাহার যে সরফরাজকে জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে তা তার অজানা নয়। সরফরাজের চোখে যে সে স্পষ্ট চন্দ্রবাহারের জন্য অসম্ভব ভালোবাসা দেখেছে। তবে ছেলেটা আজ এমনটা কেন করল! কি এমন কারণে করল? নাজিয়া খাতুনের তীব্র সন্দেহ জাগে তার স্বামী দবীর উদ্দিনের প্রতি। লোকটা কেন যেন সরফরাজকে সহ্যই করতে পারেনা। এক কথায় বলা যায় চক্ষুঃশূল! যেদিন হতে জেনেছেন চন্দ্র সরফরাজকে ভালোবাসে,সেদিন হতেই দবীর উদ্দিন উঠে পড়ে লেগেছেন চন্দ্রকে বিয়ে দেবার জন্য।
“চাচী বাড়ির দিকে গেলাম। আজকে কিন্তু শেষবারের মতো তোমাদের বাড়িতে খাব। এখন তো আমার বউ আইসা গেছে! বলতে বলতে সরফরাজ এক নজর চন্দ্রবাহারের দিকে তাকায়। চন্দ্রবাহারের চোখে পানি দেখে মৃদু কেঁপে ওঠে সে।
“সে কি? নতুন বউ নিয়ে এসে উঠোনের উপর দিয়েই চলে যাবি? ঘরে উঠে বয় নতুন বউরে নিয়া!” (নাজিয়া খাতুন)
“না চাচী এখন আর বসব না। রাতে আসতেছি তো খেতে। (সরফরাজ)
সরফরাজ বাড়ির উঠান ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই চন্দ্রবাহার তার পিছে ছুটে যায়। নাজিয়া খাতুন আটকাতে গিয়েও কি ভেবে যেন থেমে যান। চিন্তিত ভঙ্গিতে মেয়ের ছুটে যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকেন।
“আমি কি এমন দোষ করেছি সরফরাজ ভাই? কেন কথা দিয়ে কথা রাখলেন না আপনি? কথা দিয়েছিলেন আজ রাতে আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবেন দূর-দূরান্তে। তবে কেন মিথ্যা আশা জাগালেন বলুন আমাকে! কেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজ বে-ঈ-মা-ন-দের দলে নাম লেখালেন? তবে এই ছিল আপনার ভালোবাসা!”
চন্দ্রবাহারের কথায় চমকে উঠে চলার গতি থামিয়ে দিয়ে পেছন ঘুরে তাকায় সরফরাজ ও তার স্ত্রী। ভ্রু কুচকে সরফরাজ খো-চা মেরে বলে ওঠে,
“তোকে ভালোবাসে কে? আমি? হাসাইস না চন্দ্র। তোর মতন আলালের ঘরের দুলালিকে আমি কোন দুঃ*খে ভালোবাসতে যাব শুনি? আমার বউয়ের সামনে এসব বলিস না তো। প্রথম দিনেই মেয়েটার মনটা খারাপ হয়ে যাবে। তাছাড়া আমার মা ওর সাথেই আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছিল। তাই অন্য কাউকে ভালোবাসা তো বিলাসিতা মাত্র!”
“মিথ্যা কেন বলেন সরফরাজ ভাই? আপনার মায়ের তো কোনো বোনই নেই!” (চন্দ্রবাহার)
“তোকে এত ভাবতে হবেনা সত্য বলছি নাকি মিথ্যা বলছি। আমারটা আমি বুঝবো। আর আমি কখন বলেছি যে তোকে নিয়ে পালাবো আমি? অনেক সহ্য করেছি আমি তোর পা-গ-লা-মি। আমি অতি*ষ্ট হয়ে গেছি। এবার অন্তত মাফ কর আমাকে!”
সরফরাজের একেকটা বুলি যেন তীরের রূপ ধারণ করে চন্দ্রবাহারের বুকে এসে আ*ঘা*ত হানছে। কি যে য*ন্ত্র*ণা এই আ*ঘা*তে! যে ছেলেটার চোখের চাহনি,কথার ভঙ্গিই প্রতি মুহূর্তে বলে দেয় চন্দ্রবাহারের জন্য তার ভালোবাসার কথা। সেই ছেলে আজ এভাবে সবটা অস্বীকার করছে! চন্দ্রবাহার আর কোনো দিকে না তাকিয়ে বাধ না মানা চোখের পানি আগলে নিয়ে ছুট লাগায় বাড়ির পথে। মুখে সে একটা কথা বারবার বিড়বিড় করে যাচ্ছে,”সে কথা রাখেনি, সে আমাকে ব্য*থা দিয়েছে।“ প্রায় বাড়ির কাছাকাছি এসেই কিছু একটার সাথে বেধে ধপ করে মাটিতে পড়ে যায় চন্দ্রবাহার। ওমনি মনের ব্য*থা আর শরীরের ব্য*থা একত্রিত হয়ে চোখের অশ্রু আরও তীব্র হয়। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে চন্দ্র। ক্ষানিক বাদেই চন্দ্রের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দেয় যে এই পথ ধরেই কেউ হয়তো আসছে! চন্দ্রবাহার কোনো মতে চোখের পানি মুছে নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটে যায়।
মেয়েকে এলোমেলো ভঙ্গিতে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে দেখেই বুকে কিঞ্চিত ব্য*থা অনুভব করেন নাজিয়া খাতুন। কিন্তু মেয়ের কাছে আর যান না। কাঁদুক আজ মেয়েটা। জীবন সংসারে টিকতে হলে যে কঠোর শক্ত হতে হবে। চন্দ্র নিজের ঘরে প্রবেশ করে দরজা ভিড়িয়ে দিয়েই বিছানার ওপর ঝা*পি*য়ে পড়ে।বালিশে মুখ গুজে অঝোর কান্নায় ভে*ঙ্গে পড়ে। হৃদয় ভা*ঙ্গা*র য*ন্ত্র*ণা যে কতটা ভ-য়া-ব-হ! আচমকা গা ছাপিয়ে জ্ব*র আসে চন্দ্রের। একটু কান্না করলেই মেয়েটার গা কাপিয়ে জ্ব*র আসে সবসময়। জ্ব*রের ঘোরেই চন্দ্র শুনতে পায় তার ছোট বোন দোয়েলকে মা খুব করে ব*ক*ছেন। আজও নিশ্চয়ই পা*জি মেয়েটা অর্ধ ভেজা হয়ে সন্ধ্যা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরেছে! সবে দোয়েল কিশোরী জীবনে পা দিয়েছে। সকলে মিলে কত বোঝায় ওকে সন্ধ্যার পরে বাইরে টো টো না করতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! জ্ব-রে-র ঘোরে কতশত চিন্তা-ভাবনা শেষে অতীতের কথা ভাবতে ভাবতেই অচেতন হয়ে পড়ে চন্দ্রবাহার।
এইতো গত পরশু রাতের কথা,
“সরফরাজ ভাই! আব্বা আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পা-গ-ল হয়ে গেছেন। আমি আপনাকে ভালোবাসি। অন্য কাউকে বিয়ে করা আমার দ্বারা সম্ভব না।“
ভাতের থালার শেষ লোকমাটা সরফরাজের মুখে তুলে দিয়ে কথাটা বলে ওঠে চন্দ্রবাহার।
“আমার মতো বা*উ*ন্ডু*লে এক বে*কা*র ছেলের সাথে তোর আব্বা জীবনেও তোকে বিয়ে দেবেনা চন্দ্র। ভুলে যা আমাকে। অভাবের ঘরে ভালোবাসাও জানালা দিয়ে পালায় শুনিসনি কখনো? আর আমি তোকে ভালোবাসিনা চন্দ্র। (সরফরাজ)
“মিথ্যা কেন বলছেন আপনি? আপনার চোখের ওই চাহনি ক্ষণে ক্ষণে বলে দেয়, আপনার মনের সকল ভালোবাসা শুধু এই চন্দ্রবাহারের জন্য। চলুন না পালিয়ে যাই সরফরাজ ভাই। নয়তো এই সমাজের নি*ষ্ঠুর মানুষগুলো যে আপনাকে আমার হতে দেবেনা। আমার আব্বা যে বোঝেনা, আমি এই বা*উ*ন্ডু*লে আপনিটাতেই মানসিক শান্তি খুজে পাই। কোনো অর্থ-বিত্তও যে আমাকে এই মানসিক শান্তি এনে দিতে পারবেনা। আমার আপনাকে চাই-ই চাই। আর আমি কিছুই জানিনা। (চন্দ্রবাহার)
সরফরাজ কিছুক্ষণ চুপ করে নীরব হয়ে চন্দ্রবাহারের দিকে তাকিয়ে থাকে। চন্দ্রবাহারকে ফুঁপিয়ে কেদে উঠতে দেখে সরফরাজ চমকে ওঠে।
“এই মেয়ে কাদছিস কেন? কথা দিচ্ছি তোকে নিয়ে পালিয়ে যাব দূর-দূরান্তে। যেখানে কেউ আমাদের চাইলেও খুজে পাবেনা। জানিনা তোর মুখে কিভাবে আমি এক মুঠো খাবার তুলে দেব। ভবিষ্যত ঘোর অনিশ্চিত জেনেও তোকে নিয়ে চলে যাব দূরে। এখন থাম। তোর চোখের পানি আমার সহ্য হয়না জানিস না?” (সরফরাজ)
আনমনে চন্দ্র সরফরাজের বুকে মাথা রাখে। সরফরাজ স্নেহের সাথে চন্দ্রের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে ওঠে,
“ওহে চন্দ্রভামিনী! আমি যদি অচিরেই কোনোদিন হারিয়ে যাই তবে কেঁদে বুক ভাসিয়ো না কখনো। তুমিতো জানোই তোমার চোখের পানি আমার স*হ্য হয়না। তুমি বরং আমায় খুজে নিও তোমার উঠানের ওই গন্ধরাজ গাছের ফুলগুলোর মাঝেতে। কখনো একটা দুটো ফুলকে আমি ভেবে ঠাই দিও তোমার এই এলোকেশের খোপাতে নয়তো ডান পাশের কানে। প্রতিদিন না হয় একবেলার জায়গায় দুইবেলা পানি দিও গন্ধরাজ ফুলের গাছের গোড়াতে। দেখবে আমি প্রতিদিন হেসে খেলে বেড়াবো ওই ফুলগুলোর মাঝেতে।“
সরফরাজের এই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা কথাগুলো মাথায় ঢোকে না চন্দ্রবাহারের। শুধু এটুকুই বোঝে তার সরফরাজ ভাই তাকে ছেড়ে কোথাও হারিয়ে যাবার কথা বলছে।কিন্তু সেতো কোথাও হারিয়ে যেতে দেবেনা সরফরাজকে! সরফরাজের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে পিটপিট করে চন্দ্র বলে ওঠে,
“আচ্ছা আপনার হাতে কি রোজ কিছু না কিছু সমস্যা হয়ই সরফরাজ ভাই? রোজ রাতে আপনার হাতে কিছু না কিছু হয়। আর আমার আপনাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয়। কোনোভাবে ইচ্ছাপূর্বক এই কাজ করেন না তো হ্যা?”
সরফরাজ মুচকি হেসে বলে ওঠে, “তোর এই এটুকু মাথায় এত কথা নিয়ে চাপ নিতে হবেনা। কাল আমি গ্রামের বাইরে যাচ্ছি। ফিরব না কাল। সব ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি। একবারে পরশু ফিরব। তুই সবকিছু গুছিয়ে রাখবি।আমরা ওইদিনই রাতে গ্রাম ছেড়ে বের হয়ে যাব।“
সরফরাজের কথায় চুপচাপ মাথা নাড়ে চন্দ্রবাহার।
।
।
সকালে ঝিম ধরা মাথা ব্য*থা নিয়ে ঘুম ভাঙ্গে চন্দ্রবাহারের। সন্ধ্যারাতে সেই ধুম জ্ব*রের জন্য অচেতন হয়ে পড়ার পরে মাঝ রাতের দিকে জ্ঞান ফিরেছিল তার। চোখ খুলে দেখতে পায় নাজিয়া খাতুন ঠায় বসে জলপট্টি দিচ্ছে তার মাথায়। ক্ষানিকটা দূরেই দোয়েল আর দবীর উদ্দিন চুপ করে চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। এটুকু দেখেই গভীর ঘুমের অতলে হারিয়ে গিয়েছিল সে। এতক্ষণে শোয়া হতে উঠে বসেছে চন্দ্রবাহার। জ্ব*রও নেই বললেই চলে। হঠাত দোয়েল হাপাতে হাপাতে দৌড়ে চন্দ্রবাহারের ঘরে প্রবেশ করে।
“আপারে!” (দোয়েল)
“কি হয়েছে দোয়েল? এমনে হাপাচ্ছিস কেন?” (চন্দ্রবাহার)
“আপা সরফরাজ ভাইরে কারা জানি মা*ই*রা ফালাইছে। সবুজদের মাঠের ওই মোটা মেহেগুনি গাছটার সাথে বাইন্ধা খুব নির্মম ভাবে তারে খু*ন করছে আপা। ভাইর নতুন বউটাও নিখোঁজ। সবাই কইতেছে দ*স্যুরা নাকি এই কাজ করছে আর সরফরাজ ভাইর বউরে উঠায়ে নিয়া গেছে।“ বলেই হু হু করে কেঁদে ওঠে দোয়েল।
ঘরে আর একদন্ড দাঁড়ায় না চন্দ্রবাহার। চিৎকার করে ছুটে যেতে আরম্ভ করে মাঠের দিকে। চারদিকের ভীড় ঠেলে হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়ে সরফরাজের নি*স্তে*জ দেহখানার দিকে। লোহার তার*কা*টা দিয়ে হাত-পা বাধায় ক্ষ*ত-বি*ক্ষ*ত হয়ে গেছে সরফরাজের হাত-পা। গলা এপোড়-ওফোড় হয়ে বেরিয়ে গেছে একটা তী*ক্ষ্ণ*ধা*র ছু*ড়ি। র*ক্তে মাখামাখি হয়ে আছে সরফরাজের সারা দেহ। চোখজোড়া এখনো খোলা। চন্দ্রবাহার চিৎকার দিয়ে সরফরাজের বাহু জড়িয়ে ধরে আ*র্ত*না*দ করে বলে ওঠে,
“ও সরফরাজ ভাই তুমি আমার হইলানা ঠিক আছে। তবে এভাবে কেন হারায়ে গেলা? আমি কেমনে বাচব তোমারে ছাড়া? তবে তুমি কি এই হারায়ে যাবার কথা বলছিলা আমারে গত পরশু রাতে? আমি কেন একটাবার বুঝলাম না ফরফরাজ ভাই? এই দেখো আমার বুকটা ফে*টে চৌ*চি*র হয়ে যাচ্ছে। দেখো কত য*ন্ত্র*ণা হচ্ছে আমার! তুমি ফিরে আসোনা! কথা দিচ্ছি আর জ্বা*লা*ত*ন করব না তোমাকে। তোমার জায়গায় কেন আমারে মারল না ওরা? মানুষ কেন এত নি*ষ্ঠু*র হয় হ্যা? আমি এখন কই পাব আমার বা*উ*ন্ডু*লে সরফরাজ ভাইরে?”
চন্দ্রবাহার চিৎকার করে আ*র্ত*না*দ করতে করতে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। কারো সাহস হয়না তার কাছে এগিয়ে যাবার। চন্দ্রবাহারের হা*হা*কা*রে কেঁদে ওঠে সকল মানুষেরা। কেঁদে ওঠে গাছের পাতারা। কেঁদে ওঠে এই আকাশ,বাতাস আর পাখিরা।
চলবে…
#চন্দ্রবাহার
#সূচনা_পর্ব
আফিয়া অন্ত্রীশা