গোলকধাঁধা পর্ব ১৩

0
160

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩

সিরাত সান্ত্বনা দিয়ে ওকে বলল,
‘চোর ধরতে আসবে মা, তোমাকে না।’
প্রত্যয়ের মনে হলো কথাটা ওকেই উদ্দেশ্য করে
বলেছে সিরাত। অপমানে থমথমে হয়ে ওঠলো মুখ।
রেগে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। এদিকওদিক
কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সোহার জন্য কিছু কিনে রাত দশটায় ফিরে এলো। খাবারের পর্ব সেরে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লো। পরদিন খুব সকালেই বেরিয়ে গেলো আবার, নাস্তা করতে পারলো না। মিনারা বারবার করে বলে দিলেন কাজ সেরে চলে আসতে। প্রত্যয়ও আর না করতে পারলো না।

গোধূলির রঙচঙে আকাশ। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। সিরাতদের বাড়িটা বেশ পুরোনো, তেমন একটা বড়ও নয়। শ্যাওলা পড়া ছাদে একটুখানি হেঁটে ঢিবির ওপর এসে বসলো সিরাত। হাঁপাচ্ছে ও। আজকাল হাঁটাহাঁটি, ভারী কাজ করতে ভালো লাগে না ওর। ইনফেক্ট কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। খাওয়া আর ঘুম ছাড়া নড়াচড়া করতেও অলস লাগে। তবুও ঘরে আর কত বসে থাকা যায়! মিনারা নীরুকে সঙ্গে করে ঠেলে ঠুলে ওকে ছাদে পাঠিয়েছেন কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে। নীরু ফুলগাছগুলোতে পানি দিচ্ছে।
একটু পর প্রত্যয় এসে উপস্থিত হলো। সকালে বেরিয়ে ছিলো, কাজ শেষে মাত্রই এসেছে। ঘরে সিরাতকে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে এখানে উপস্থিত হয়েছে সে। সিরাতকে দেখে হাঁফ ছেড়ে এসে ওর পাশে বসলো। তৎক্ষনাৎ সিরাত বসা থেকে ওঠে পড়লো। নীরু মাথা নিচু করে নিচে চলে গেলো। প্রত্যয় নিজেও ওঠে কিছুক্ষণ আশপাশটা ঘুরে সামনে এসে দাঁড়ালো সিরাতের। এরপর শান্ত স্বরে বলল,
‘তোমার সাথে কথা আছে।’
‘কোনো কথা নেই।’
বলে সিরাত চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। পেছন থেকে প্রত্যয় ধৈর্য্যহীন হয়ে চেঁচিয়ে ওঠলো,
‘তুমি আমার কথা শুনতে চাও না। তাহলে কিভাবে সমস্যার সমাধান হবে? নিজেকে জাস্টিফাই করার সুযোগ তো দাও। ক্ষমা কিভাবে চাইলে তুমি সন্তুষ্ট হবে বলো, আমি ঠিক তাই করবো। সেদিন আমি যা বলেছিলাম সেগুলো ঠিক নয়।’
সিরাতের পা থেমে গেলো। ঘুরে না তাকিয়েই
রুক্ষ স্বরে বলল,
‘সেদিন আপনি যা বলেছিলেন সেটাই সত্যি।’
প্রত্যয় এগিয়ে এসে একদম ওর সামনে পথরোধ
করে দাঁড়ালো। দৃঢ় গলায় বলল,
‘না সেটা নয়। আমার উদ্দেশ্য এটা থাকলেও আমি
পরে সেগুলো থেকে সরে আসি, শুধু তোমার জন্য।আমি নিজের অনুশোচনা থেকে সবকিছু স্বীকার করেছিলাম, মনের ভার কমাতে। ভাবিনি তুমি
এরকম রিয়েক্ট করবে। তাহলে কখনোই বলতাম
না তোমায়।’
সিরাত তাচ্ছিল্যভরে হাসলো,
‘এটা সিনেমা নয়, বাস্তব। আপনার কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমাকে যেতে দিন, কানের কাছে ঘ্যানরঘ্যানর করবেন না।’
প্রত্যয় চটে গেল,
‘আমি ঘ্যানরঘ্যানর করি?’
‘জি করেন। আপনি বুঝতে পারেন না আমি বিরক্ত
হই আপনার এসবে?’
প্রত্যয় হুট করে জাপ্টে ধরলো ওকে,
‘এই মেয়ে, এই! তুমি আমার সাথে এমন করছো কেন?
আমার বুকটাতে আগুন জ্বলে, কষ্ট হয় বুঝো না?’
সিরাত রেগে বলল,
‘বুঝতে চাই না। কারণ সব আপনার নাটক। আর
ভুলছি না এসবে।’
প্রত্যয়ের রাগে গা জ্বলে গেলো। ধৈর্য্য ধরে রাখা
কঠিন। তবুও শান্ত স্বরে বলল,
‘আমাদের বাচ্চা কি খুব ভালো থাকবে যখন সে
শুনবে তার মা তার বাবাকে বিশ্বাস করে না? মাফ
করে দাও আমাকে এসবের জন্য।’
সিরাত কটাক্ষ করে বলল,
‘অমানুষ, জানোয়ার! বাচ্চার জন্য দরদ উতলে পড়ছে তাইনা? আপনি আমাদের থেকে দূরে থাকুন। কখন আবার আমার বাচ্চাটাকে লা’শ বানানোর ইচ্ছে জাগবে বলা যায় না।’
প্রত্যয় বাক্যহারা হয়ে গেলো। এ এটা কিভাবে বলতে পারলো সিরাত? একটুও বিশ্বাস করে না? নিজের বাচ্চার ক্ষতি করার কথা কীভাবে ভাবতে পারে প্রত্যয়?
ও ধীরপায়ে ছাদ থেকে নেমে এলো। শিমুল সাহেব চা খাচ্ছেন। মিনারা নাস্তা বানাচ্ছে। নীরু ওকে
দেখে বলল,
‘দুলাভাই বসেন। খালাম্মা আপনার জন্য পায়েস
রান্না করছে।’
প্রত্যয় ভদ্রতার খাতিরে দু’চামচ পায়েস মুখে দিলো। এরপর জরুরি কাজের বাহানা দেখিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এলো। মিনারা বেগম ওর মুখ দেখেই বুঝলেন মেয়ে হয়তো আবারও কিছু বলেছে ছেলেটাকে। তিনি সিরাতকে অনেক বকাঝকা করলেন। মায়ের বকবক শুনে সিরাত বিরক্ত হলো। ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকলো। অমানুষটা এত নাটক জানে যে, এখন সিরাতের বাবা-মাও ওকে
দোষ দেয়! অথচ সত্যি ঘটনাটা শুনলে তারা
নিজেরাই ছাড়িয়ে আনতে চাইবে প্রত্যয়ের কাছ থেকে।
কিন্তু একটা কারণেই সিরাত তা করছে না। তার অনাগত বাচ্চাটার প্রতি প্রত্যয় আর ওর পরিবার ভীষণ দুর্বল। বাচ্চাটাকে কোনোভাবেই ছাড়বে না, নিশ্চয়ই নিজেদের কাছে নিয়ে নেবে। তারা ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ! সিরাত চাইলেও পারবে না কিছু করতে। আর নিজের সন্তানকে হারাতে হবে ভাবলেই বুক কেঁপে ওঠে ওর!

সপ্তাহ খানিক পর শিমুল সাহেব স্কুল থেকে ফিরে জানালেন প্রত্যয়ের জ্বর হয়েছে। যে সে জ্বর না, একদম ডেঙ্গুজ্বর। অবস্থা বেশ খারাপ, হসপিটালে এডমিট। ক’দিন আগে ডেঙ্গু প্রতিরোধী কর্মসূচি আয়োজন করেছিলো সে, আর নিজেই এখন এতে আক্রান্ত বলে শিমুল সাহেবের আফসোসের শেষ রইলো না। সিরাত শুনে বাইরে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। মিনারা বেগম তাদের সাথে একপ্রকার জোর করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন সিরাতকে। প্রত্যয়ের দলের চেলা পেলা, ভাই-বন্ধুসহ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিচিত লোক দিয়ে ওর কেবিন ভরা। ডাক্তারদের বিধিনিষেধ কেউ মানছেই না। বাইরে দরজার কাছে দু’জন চেলা দাঁড়িয়ে প্রটেকশন দিচ্ছে। সিরাত মনে মনে তাচ্ছিল্য করলো। ওকে দেখেই সবাই ভাবি ভাবি করে আদিক্ষেতা শুরু করলো। না চাইতেও হাসি হাসি মুখ করে সবার সাথে কুশল বিনিময়ে করলো। ভাইয়ের ‘বউ’ এসেছে শুনে প্রায় সবাই কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এলো। সিরাতরা ভেতরে ঢুকে দেখলো মুশফিকা চৌধুরী ছেলের কাছে বসে আছেন। আর জ্ঞানহীনের ন্যায় চোখ বন্ধ করে হাতে স্যালাইন লাগিয়ে মশারির ভেতর শুয়ে আছে দীর্ঘদেহী প্রত্যয়। মুশফিকা চৌধুরী জোর করে টুকরো করা আপেল খাওয়াচ্ছেন ছেলেকে। প্রত্যাশা দুধের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু এসব খাওয়ার রুচি হারিয়েছে প্রত্যয়। চোখমুখের বেহাল দশা, উষ্কুখুস্কু চুল। দেখে ভালো লাগলো না
সিরাতের। চোখ ছলছল করে ওঠলো। মুশফিকা চৌধুরী সিরাতকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠলেন,
‘তুমি বাড়ি গিয়ে বসে আছো। আমার ছেলেটার নিজের প্রতি একটুও খেয়াল নেই তা তো জানতে। দেখো কি অবস্থা করেছে নিজের। এত জ্বর, গা ব্যথা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কাউকে বলেও নি। কি বিপদ বাঁধিয়ে বসে আছে।’
মিনারা বেগম আঁৎকে ওঠলেন,
‘কি বলেন আপা? বুঝলেন কিভাবে?’
ফুঁপিয়ে ওঠলেন মুশফিকা চৌধুরী,
‘জ্ঞান ছিলো না। মাহিন ফোন করে খবর দিলো। ওরাই তো ধরাধরি করে হাসপাতালে এনেছে। এরপর এসে
জানতে পারলাম ডেঙ্গু।’
হায় হায় করে ওঠলেন মিনারা বেগম। মেয়ের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন। শ্বাশুড়ি আর মায়ের সামনে চুপসে গেলো সিরাত। মুখ ছোট হয়ে গেলো ওর। মিনমিন করে বলল,
‘আপনার ছেলে আমাকেও বলেনি মা। না বললে
আমি কিভাবে জানবো? চেনেন তো ওনাকে। যোগাযোগ রাখেনা, ফোন করেনা, ঘাড়ত্যাড়া লোক।’
একটু পর প্রত্যয় নড়ে ওঠলো। এরপর দুর্বল
চোখ খুলে তাকালো। ওর অস্ফুট গলার স্বর শোনা গেল। কেউ তেমন কিছু বুঝলো না।
প্রত্যাশা বলল,
‘ভাইয়া সবাইকে যেতে বলেছে। ভাবী তুমি না হয়
একটু থাকো।’
মুশফিকা চৌধুরী আপত্তি জানালেন৷ কিন্তু পরে
ছেলের কথা শুনে বেরিয়ে এলেন। সবাই বেরিয়ে যেতেই প্রত্যয় ডাকলো সিরাতকে,
‘এই মেয়ে, ওখানে দাঁড়িয়ে কাঁদছো কেন? বাড়ি
গিয়ে ঘুমিয়ে থাকো। আর আসবে না এখানে।’
সিরাত মিনমিন করে বলল,
‘আপনি ঠিক করে দেওয়ার কে? শুনবো না আপনার কথা।’
প্রত্যয় কড়া চোখে তাকালো,
‘খুব তো সাধু সাজা হচ্ছে। এসব লোকদেখানো নাটক বন্ধ করে বাড়ি যান। আমার বাচ্চার কিছু হলে আস্ত রাখবো না।’
‘আমি লোকদেখানো নাটক করছি?’
প্রত্যয় কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘করেন নি? ওহ আচ্ছা! আমি আপনাকে ফোন
করিনা, যোগাযোগ রাখিনা, কিছু বলি না, ঘাড়ত্যাড়া লোক তাই তো? তাহলে কে যেন আমার নাম্বার ব্লকলিস্টে ফেলে রেখেছে? কে যেন আমার গলা শুনলেই ফোন কেটে দেয়? বাড়ি গেলে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়?’
সিরাতের গলা শুকিয়ে গেলো। গুন্ডাটা এই মরমর দশায়ও ঠিক কান খোলা রেখেছে। সব শুনে
নিয়েছে। তবুও জোর গলায় বলল,
‘বেশ করি। ড্রামাবাজ, বিশ্বাসঘাতকের সাথে এমনই করা উচিৎ।’
প্রত্যয় ধমক দিলো,
‘এত এত উপাধি যে দিচ্ছো। তুমি তো প্রথম থেকেই জানতে আমি তোমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই বিয়ে করেছি। তাহলে কেন আমার প্রেমে পড়লে? ভালোবাসলে? আমার ক্ষমতা, প্রতিপত্তি দেখে নাকি আমার রুপ-যৌবন দেখে?’
সিরাতের রাগে-দুঃখে চোখ ফেটে জল চলে এলো।
‘ছিঃ! আমার এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে। আর আসবো না। বেশ হয়েছে ডেঙ্গু হয়েছে। আমার সাথে ঠকবাজি করার ফল এসব।’
প্রত্যয়ের মাথা গরম হয়ে গেলো অবান্তর কথাবার্তা শুনে। তেড়েমেরে ওঠে বলল,
‘যা যা ছলনাময়ী কোথাকার! ভালোবেসে আমাকে উদ্ধার করে ফেলেছে। আমি ছুঁলে তার গা জ্বলে, যা আমাকে মেরে এরপর আবার গিয়ে বিয়ে কর ভালোমানুষ দেখে। আমি মরে গেলেও দেখতে আসবি না আর বেয়াদব মেয়েমানুষ কোথাকার।’
সিরাতের গায়ে যেন আগুন জ্বলে ওঠলো এসব শুনে। বাইরে সবাই আছে সেজন্য কথা বাড়ালো না। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। প্রত্যয় পেছন থেকে গজগজ
করে বলল,
‘নির্দয় মেয়ে।’
মুশফিকা চৌধুরী সিরাতকে কাহিল দেখে বাড়ি
পাঠিয়ে দিলেন। শিমুল সাহেব রয়ে গেলো। তিনি পরে ফিরবেন৷ রিকশায় বসে সিরাত কেঁদে দিলো।
মিনারা ঝাড়ি মেরে বললেন,
‘এখন কাঁদিস কেন? বাড়ি এলে দূরছাই করিস
আবার কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিস।’
সিরাত নাকমুখ মুছে বলল,
‘কথা বলো না তো। বাড়ি চলো।’
‘তোর মতিগতি ভালো না। কি হয়েছে তোর?
মায়ের কথা শুনে সিরাত তেলেবেগুনে জ্বলে
ওঠলো,
‘হা হা আমিই খারাপ। আর সবাই ভালো।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here