গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে দ্বিতীয় খন্ড (পর্ব ২৫)

0
442

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৫ (২য় খণ্ড)

“রাস্তার মাঝে ঝা/মেলা করবেন না। সরে দাঁড়ান।”

উর্মিলার কথা যেন কান অবধি গেল না আফরানের। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল তার পথ ধরে। নিজের ক্রো/ধ সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল উর্মিলা। সে জানে তার রা/গ আফরানের সামনে চলবে না। এসব লোকদের সাথে কথা বাড়ালে সমস্যা হতে পারে। এবার নিজেকে ধাতস্থ করে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে আফরান বলল,
“ভাবছি, এবার আমার পরিবার নিয়ে তোমার বাসায় যাব।”

থতমত খেলো উর্মিলা। অপ্রস্তুত হয়ে প্রশ্ন করল,
“কেন? আমার বাসায় যাবেন কেন?”

“তুমি কিছু বুঝতে চাও না নাকি? একটা ছেলে ফ্যামিলি নিয়ে আরেকটা মেয়ের বাড়িতে কেন যায়?”

পেছন থেকে হাজির হলো আফরানের চ্যালাপেলা। আফরানের কাঁধে কয়েকবার থা/বা দিয়ে একজন বলল,
“ভাই আমাদের জন্য একটা ভাবীর ব্যবস্থা করতে চাচ্ছে, ভাবী।”

এবার বিতৃষ্ণা এসে গেল উর্মিলার। চোখমুখ লাল করে কিছু বলার আগেই তার ডান হাতে টান পড়ল এবার। একে তো এই বিবাদ! তার উপর কোনো অপরিচিত কেউ তাকে স্পর্শ করতেই মেজাজ তুঙ্গে উঠল। চোখ গরম করে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতেই নোমান বলল,
কী ব্যাপার উর্মিলা? আমি তোমাকে কখন থেকে কল করে যাচ্ছি তুমি আমার কল ইগনর করে এসব ছেলেদের সাথে কথা বলছ?”

উর্মিলার ক্ষুব্ধ হওয়া বেশিক্ষণ টিকল না। সে আরেকদফা চমক পেলো নোমানের কাছ থেকে। নোমান তাকে কল করেছিল? হতেই পারেনা! উর্মিলা নিজের ফোন সাইলেন্ট রাখে না। সে দ্রুত জবাব দিলো,
“আপনি কখন আমাকে কল করলেন? আমি তো আমার ফোন…”

পুরো কথা বলতেই দিলো না নোমান উর্মিলাকে। সে ধ/মকে উঠে বলল,
“চুপ করো! তোমার অযথা বাহানা আমি শুনব না। আমার উডবি আমাকে ইগনর করে অন্য ছেলেদের সঙ্গে চুটিয়ে কথাবার্তা বলছে! এটা কী করে মানব? দিস ইজ মাই লাস্ট ওয়ার্নিং উর্মিলা। আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার সাহসও দেখাবে না। সবার আগে আমি।”

এবার মাথাটা ঘুরছে উর্মিলার। আশ্চর্য! লোকটা কি পা;গল হলো নাকি? কীসব বলছে! কিছু বলার সুযোগটাও পেল না সে। আফরানের সামনে নোমান আরো বেশি করে তার হাত চেপে ধরে হনহনিয়ে চলে এলো। আফরান এবং বাকিরা বোকা বনে গেল। কেউ একটা শব্দও বলার সময় পেল না। উর্মিলা কিছু বলতে গিয়েও পারল না। কারণ সেও ওই ছেলেগুলোর থেকে বেঁচে যাওয়ার পথ খুঁজছিল। রাস্তার মোড় ঘুরতেই নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো উর্মিলা। অধৈর্য হয়ে বলল,
“কী হলো? ওসব তখন কী বললেন আপনি? অযথা আমাকে ধ/মকে যাচ্ছিলেন। আপনি আমাকে কল করেছিলেন? মিথ্যুক লোক একটা!”

দাঁড়িয়ে পড়ল নোমান। উর্মিলার দিকে নিজের দৃষ্টি মনোনিবেশ করে বলে উঠল,
“ওভাবে না বললে ওসব উটকো ছেলেপেলের কবল থেকে তোমায় নিয়ে আসতাম কী করে?”

“ওহ হ্যাঁ! তাও তো কথা।”

নিজের চশমা নড়িয়ে বোকা হয়ে বলল উর্মিলা। নোমান তৎকালীন একগাল হেসে উর্মিলার কপালে টোকা দিয়ে বলল,
“সিলি গার্ল!”

“থ্যাংক ইউ।”

উর্মিলার প্রতিত্তোরে নোমান খানিকটা ঝুঁকে গিয়ে গাছ থেকে খসে পড়া কৃষ্ণচূড়া হাতে নিয়ে তা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“বাট উর্মিলা! আমি সোজাভাবেই কথা বলতে পছন্দ করি। তাই আমি কোনোরকম তোড়জোড় বা প্রস্তুতি ছাড়াই বলে দিতে চাই যে, আমি তোমাকে পছন্দ করি। খুব পছন্দ করি। আই ওয়ান্ট ইউ টু কমপ্লিট মাই লাইফ। আমি সারাজীবন তোমার পাশে থেকে তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে চাই।”

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল উর্মিলা। এই রসকষহীন কাঠখোট্টা লোকের থেকে এমন প্রস্তাব সে কখনোই আশা করেনি। শীতের মৌসুমে দুজনের মাঝে অনুভূতি ছড়াতে বয়ে গেল শিরশিরে বাতাস। মৃদু কাঁপল উর্মিলা। না, ঠান্ডার কারণে না। চেতনাগুলো প্রগাঢ় হচ্ছে। তার মৌনতায় নোমান শান্ত হয়ে বলল,
“ইটস ওকে। তোমায় এখনি উত্তর দিতে হবে না। তুমি সময় নিতে পারো।”

কিছু না বলে উর্মিলা নোমানের হাত থেকে ফুলটা নিজের হাতে নিলো। একবার ফুল আরেকবার অশান্ত মানুষটির পানে চেয়ে বলল,
“আমার রেজাল্ট দেখতে হবে। এখন আমি যাই। ওরা বোধহয় চলে গিয়েছে এতক্ষণে।”

“ঠিক আছে যাও।”

মলিন উত্তর নোমানের। উর্মিলা ঘুরে ভার্সিটির দিকে হাঁটা দিলো। কয়েক ধাপ যেতে পিছু তাকাতেই দেখতে পেল নোমানের অস্থির দৃষ্টি। যেন প্রস্তাবের জবাব পেতে ছটফট করছে। উর্মিলা ঠোঁট ভিজিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“আপনার পরিবার নিয়ে আমার বাড়িতে উপস্থিত হবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব! সেখানেই কথা হবে। ভার্সিটির ওই ছেলেটাও কিন্তু আমার বাড়িতে যেতে চেয়েছে। তার আগে আপনারকে যেতে হবে। মনে যেন থাকে।”

উর্মিলার কথাগুলো বুঝতে সময় লাগল নোমানের। যখন বুঝল ততক্ষণে মেয়েটা চলে গিয়েছে। নোমানের চোখেমুখে উপচে পড়ল খুশির ঝলক! হৃদয় বইতে লাগল শান্তির আবহ। এই সময়টা তার কাছে হয়ে উঠল মূল্যবান!

“আপনাকে দ্বিতীয়বার এভাবে হেনস্তা করার জন্য দুঃখিত স্যার।”

রায়ানের শীতল কণ্ঠ বিরক্ত করল রাশেদ সাহেবকে। এই মূহুর্তে তিনি বসে আছেন রায়ানের অফিস ঘরের টেবিলের চেয়ারে। রায়ান পারেনি এই লোকটাকে কাস্টারি ঢোকাতে। কোথাও একটা সম্মানে বেঁধেছে। রাশেদ সাহেব স্পষ্ট ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন,
“যখন হেনস্তা করেই ফেলেছেন তখন বলেই দিন আমাকে আবারও এখানে ডাকার কারণ কী? আগেরবার কি যথেষ্ট ছিল না জিজ্ঞাসাবাদের জন্য?”

“আগেরবার আমাদেরকে আপনার ট্যালেন্ট দ্বারা বোকা না বানিয়ে সত্যিটা স্বীকার করে নিলে অবশ্যই আমরা আবার আপনাকে ডাকতাম না।”

সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন রাশেদ সাহেব। কী বলতে চাইছে রায়ান? সে কি আরো কিছু জানতে পেরেছে? কোনো গোপন সত্যের কথা ধরতে পেরেছে? রাশেদ সাহেব বিচলিত না হয়ে যথাসম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করে বললেন,
“আপনার কথার মানে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না অফিসার রায়ান! পরিষ্কার করে বললে ভালো হতো।”

এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা রায়ান এবার নিজের চেয়ারে বসল। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,
“আপনি বেশ ভালো করেই জানেন কোনো মানুষকে কেমন প্রতিক্রিয়া দ্বারা বোকা বানাতে হয়। বেস্ট সাইকোলজিস্ট বলে কথা! কিন্তু এবার আপনি কিছুই করতে পারবেন না এবং আপনি জানেন আমি কী বলতে চাইছি।”

“আসলে কী বলতে চাইছেন আপনি? আমিও তা জানতে চাই।”

রায়ান বুঝল এই ভদ্রলোকটি সহজে দমে যাওয়ার লোক নয়। তাকে কৌশল খাটাতে হবে মুখ থেকে কথা বের করার জন্য। সে নিবৃত্ত হয়ে বলল,
“আপনি তো আগে চট্টগ্রাম থাকতেন নিজের ফ্যামিলি নিয়ে তাই না?”

“হ্যাঁ তো?”

“সেখানে শামীমা আক্তার নামের কোনো মহিলার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কি আপনার?”

এবার ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন রাশেদ সাহেব। বুঝে উঠতে পারলেন না শামীমার নাম রায়ান কী করে জানল? অস্থির এবং মরিয়া হয়ে উঠলেন প্রসঙ্গ কাটাতে। তাই মুখ ফসকে বলে দিলেন,
“শামীমা? শামীমার তো মাথার ঠিক নেই। ওর বোন এসেছিলেন আমার কাছে ওর চিকিৎসা করানোর জন্য। মেন্টাল পেশেন্ট সে এখন। কখন কী বলে তার ঠিক নেই।”

রাশেদ সাহেবের প্রশ্নে বিস্তর হাসল রায়ান। মিহি সুরে বলল,
“বাট, আমি তো জাস্ট জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আপনি শামীমা নামের কাউকে চিনেন কিনা! আপনি তো উনার ইতিহাস বলে দিলেন।”

এখানেই রাশেদ সাহেব ধরা পড়লেন। বুঝতে পারলেন তিনি আটকা পড়ে গিয়েছেন রায়ানের কথার জালে। দরদর করে ঘামতে শুরু করলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে কাঁপা হাতে কপাল মুছতেই রায়ান আবারও বললেন,
“যেহেতু আপনি উনার লাইফ হিস্টোরি সব জানেন তাহলে এটাও জানেন যে উনার সন্তান এখন কোথায়? বা উনার সন্তান কে!”

কণ্ঠস্বর কাঁপছে রাশেদ সাহেবের। সেভাবেই বলে উঠলেন,
“না মানে আমাকে এসব কেন জিজ্ঞেস করা হচ্ছে? আমি এই বিষয়ে কিছু জানি না।”

“কিন্তু প্রমাণ তো অন্য কথা বলে স্যার।”

বিলম্ব না করে নিজের কাছে থাকা কিছু কাগজ রাশেদ সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“এই কাগজপত্রগুলো চট্টগ্রামের সেই হসপিটালের যেখানে শামীমার সিজার করানো হয়েছিল। আর আপনি বন্ড পেপারে সই করেছেন। অনেক বছরের পুরোনো সম্পর্ক আপনাদের!”

চোখের পাতা কাঁপছে রাশেদ সাহেবের। উত্তরে তিনি যা বলে বাঁচতে চাইবেন সেটা বিশ্বাসও করবে না রায়ান। কিন্তু সত্যিটাও স্বীকার করতে বাঁধছে তার। সব জানাজানি হয়ে গেলে তার সম্মানের কী হবে? উনি তো অসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবেন না। রায়ান উনার নিস্তব্ধতা দেখে আরো বলে,
“আপনার কল লিস্টে কিছু নম্বর পাওয়া গিয়েছে। যা পাঁচ বছর আগের সেই কুখ্যাত ক্রি/মিনাল ডার্ক ম্যাক্সের নম্বরের সাথে হুবহু মিলে যায়। হঠাৎ তার সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রয়োজন কেন হলো মি. শাহ্ রাশেদ স্যার?”

“আ…আমি এসব বিষয়ে কিছু জানি না। আমাকে প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর পাবেন না আপনারা।”

রায়ান ধৈর্যহারা হচ্ছে আস্তে আস্তে। এত সুন্দর করে প্রশ্ন করার পর উত্তর না পেয়ে রাগ হচ্ছে। তবুও সে আরেকটা বুদ্ধি অবলম্বন করল। সন্দিহান হয়ে বলে উঠল,
“তাহলে জানে কে? আপনি যদি না জানেন কিছু তাহলে আপনার মেয়ে কী জানে? সে নিশ্চয় কিছু জানে! আমার টিমকে বলি রাগিনী তাজরীনকে এখানে হাজির করতে। কিছু না কিছু অবশ্যই জানা যাবে।”

রাগিনীর প্রসঙ্গ উঠতেই ছটফটিয়ে উঠল রাশেদ সাহেবের মন। নিজের মেয়েকে এসব বিষয়ে কিছুতেই জড়াতে চান না তিনি। উনি মনেপ্রাণে চান, উনার কলিজার টুকরো সবসময় থাকুক ঝামেলা মুক্ত। অবিলম্বে মাথা নাড়িয়ে মানা করে বললেন,
“না, আমার মেয়ে কিছু জানে না। ও ইনোসেন্ট। ওকে এসব বিষয়ে জড়াবেন না অফিসার। আমিই সব জানি।”

“এ টু জেড বলবেন। সবটা জানা ভীষণ প্রয়োজন। আপনার প্রতিটা কথার ভাঁজে আমরা কোনো ইনফরমেশন পেতে পারি। কারণ এই শহর খুব রিস্কের মাঝে আছে। আমি চাইব আপনি আমাদের কো-অপারেট করুন। শহরের জন্য না হোক নিজের মেয়ের জন্য আমাদেরকে সবটা বলুন। আপনার মেয়ের জীবন ঝুঁকিতে আছে। শ/ত্রুপক্ষ সবসময় ওকে টার্গেট করেই রাখে।”

গলায় যেন দলা পাকিয়ে যায় রাশেদ সাহেবের কথা। হয়তবা লুকিয়ে গিয়ে আর কোনোই লাভ হবে না। কুকর্ম তার দ্বারা হয়েছে। এর ফলাফল তার আদরের মেয়েকে ভুগতে না হোক! এটাই তার কামনা! সবশেষে রাগিনীকে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি। তাই সাহস করে বলতে শুরু করেন,
“আগে আমার চাকরি ছিল চট্টগ্রামে। তখন আমি সবে জয়েন করি। সবকিছুতে নতুন ছিলাম। আমার মেয়ে রাগিনীর মায়ের সাথে প্রেম করেই বিয়ে হয়। ভালোবাসতাম তাকে খুব। প্রায় দেড় বছর পর প্রেগন্যান্ট হয় আমার স্ত্রী। প্রথমে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। ওয়াইফের খুব কেয়ার করতাম। কিন্তু সময় যেতে যেতে আমি তার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলি। তাই বলে অবহেলা করিনি তাকে। কিন্তু তার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারতাম না কিছুতেই। সাইকোলজিস্ট হওয়ার দরুণ আমার বুঝতে দেরি হয়নি আমার মনের কথা। আমি আসলে আলাদা নারীসঙ্গ খুঁজছিলাম। পেয়েও গেলাম। শামীমা! তাকে আমি সেভাবে না দেখলেও একটা সময় ভালো লাগল। অন্ধ হয়ে গেলাম। ভালোমন্দ, ন্যায় আর অ/ন্যায় সবকিছুর জ্ঞান হারিয়ে বসলাম। অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম। তারপর কিছু মাস গেল! শামীমা অল্প বয়সী ছিল। সেও ভালোমন্দের পার্থক্য বুঝত না খুব একটা। আমার স্ত্রীর ডেলিভারির ডেট এগিয়ে এলো। এরই মধ্যে আমি জানলাম শামীমাও প্রেগন্যান্ট। আমি দিশাহারা হয়ে পড়লাম। ভয় পেয়ে ওকে বলেছিলাম বাচ্চা ন/ষ্ট করতে। কিন্তু আমার কথা শোনেনি। বলেছিল ওকে বিয়ে করে নিতে। কিন্তু কী করে করতাম? রাগিনীকে মাকে ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি আস্তে আস্তে শামীমার থেকে দূরে সরে আসতে লাগলাম। আমার স্ত্রীও একদিন সন্তান জন্ম দেয়। একটা ছোট্ট মেয়ে সন্তান! রাগিনী! আমার রাজকন্যা। ওকে দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে যায়। মাথা ঘুরে যায়। যতটুকু চেয়েছিলাম আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে সেই চিন্তাও মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। কথায় বলে, সন্তান পারে তার মা-বাবাকে একই সুতোয় বেঁধে রাখতে। ঠিক সেটাই হলো। আমি রাগিনীকে নিয়ে খুশিতে মেতে উঠলাম। আমার ঘর ভরে উঠল। আমার পরিবার নিয়ে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অন্যদিকে শামীমার দিনও ঘনিয়ে এলো। আমাকে ও কল করে কান্নাকাটি করত। আমার কাছে খুব বিরক্ত লাগত। কারণ তখন আমার কাছে আমার পরিবারই পৃথিবী হয়ে উঠেছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমি ভুল পথে এগোচ্ছি। কিন্তু কিছু করার ছিল না।”

রায়ান নিজেও বাকরুদ্ধ হলো। চোয়াল শক্ত হলো তার। উৎসাহ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তারপর কী হলো? শামীমা নামক মহিলাটির বেবি হয়েছিল?”

“হ্যাঁ হয়েছিল। একদিন হসপিটাল থেকে কল আসে। ফোনে বলে, শামীমা নামের একটা মেয়ের নাকি ডেলিভারির জন্য এসেছে আর বারবার আমাকে খুঁজছে। আমি নাকি তার কাছের কেউ। আমি ছুটে যায় হসপিটালে সব জানাজানি হওয়ার আগে। যেহেতু বাচ্চা জন্ম দিতেই হবে তাই বন্ড পেপারে আমাকে সাইন করতে হয়। এসবের মধ্যে আমি সৈয়দকে আমার সব কথা শেয়ার করেছিলাম। কারণ এত কথা নিজের মধ্যে রাখতে পারছিলাম না আমি। সৈয়দ আমাকে আশ্বাস দেয়। আমি শুধু ভাবছিলাম বাচ্চাটা নিয়ে শামীমা অধিকার চাইলে আমি কী করব! সৈয়দ আমাকে বলেছিল ওর নাকি চেনাজানা লোক আছে। একজন নাকি বাচ্চা খুঁজছে। কিন্তু এডাপশনের জন্য পর্যাপ্ত খরচ সে করতে পারবে না। তখন আমি নিরুপায় হয়ে রাজি হয়ে গেলাম। একটা লোক সেদিন রাতেই সদ্য জন্ম নেওয়া মেয়ে শিশুকে নিয়ে চলে গেল। বাচ্চাটার পায়ে ছিল ছয়টা আঙ্গুল। তখন ফোনের প্রচলন তেমন ছিল না। টেলিফোন নম্বর দিয়ে যায় লোকটা। প্রথম প্রথম যোগাযোগ রাখতাম। কুড়িগ্রাম ছিল লোকটার বাড়ি। দেওয়ান বাড়ি নাম। লোকটার একটা ছেলেও ছিল। কিন্তু দিন যেতে যেতে পরবর্তীতে যোগাযোগ বন্ধ করে দিই। আমি আমার পরিবার নিয়ে শামীমা সুস্থ হওয়ার আগেই ঢাকায় চলে আসি খুব তাড়াতাড়ি।”

রাশেদ সাহেবের প্রতি চরম ক্ষে/পে গেল রায়ান। তবে সে নিজেকে বেশ ভালো করে সামলাতে জানে। সে শুধু ভেবে পাচ্ছে না একটা মানুষ এতটা নি’কৃষ্ট কী করে হতে পারে? সে চোখমুখ জড়িয়ে এক রাশ ঘৃ/ণা নিয়ে বলল,
“আমি অবাক হচ্ছি! আপনাকে কী ভাবতাম আর আপনার আসল রূপ কী বের হলো! আই এম শকড। অনেক বড়ো অপ/রাধ করেছেন আপনি। এর শা;স্তি কী হতে পারে আপনার জানা আছে? একটা সদ্য জন্মানো শিশুকে আপনি তার মা থেকে আলাদা করে সহজেই অন্য কারোর হাতে তুলে দিয়েছেন। আপনি কতটা বি/কৃত মস্তিষ্কের আপনি জানেন?”

মাথা নুইয়ে ফেলেন রাশেদ সাহেব। নির্লিপ্তে স্বীকার করলেন,
“হ্যাঁ আমি জানি।”

“আপনি তো বললেন শামীমার মেয়ে বাচ্চা হয়েছিল। আর আপনার কথা অনুযায়ী এটা পরিষ্কার মনে হলো যে আপনি যার হাতে বাচ্চাটাকে তুলে দিয়েছিলেন সে ডার্ক ম্যাক্স ওরফে রামিন দেওয়ান। এখন তো সেই মেয়েটা বড়ো হয়েছে আর…”

রায়ানকে কথার মাঝে থামিয়ে রাশেদ সাহেব বলেন,
“ওই মেয়েকে আমি দেখেছি। ওকে আমি চিনি। এবার আমার কাছে সব পরিষ্কার। যদি ওই লোকটা ডার্ক ম্যাক্স হয় তাহলে রাগিনীর মতো দেখতে মেয়েটাই শামীমার মেয়ে। ওর পায়ে ছয়টা আঙ্গুল আমি সেদিন হসপিটালে দেখে ফেলেছিলাম।”

দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে নিজের মাথায় চুল হাত দিয়ে নাড়িয়ে নিলো রায়ান। সে এটা সন্দেহ করেছিল। আজ নিশ্চিত হলো। তবে সে ভেবেছিল এই শাহ্ রাশেদ লোকটাই মেইন ক্রি/মিনা/ল হবে কিন্তু হিসেবটা তো মিলছে না। হঠাৎ সৈয়দের কথা মাথাতে আসতেই ফট করে রায়ান শুধাল,
“আপনি বলেছিলেন যে আপনাকে সাহায্য করেছে সৈয়দ নামের লোকটি। তিনিও কি রামিন দেওয়ানের আসল রূপ সম্পর্কে কিছু জানতেন না?”

“আমি যা জানতাম আমি সব বলেছি। আর কিছুই জানি না।”

“সৈয়দ কি এই মূহুর্তে আপনার বাড়িতে আছে?”

রাশেদ সাহেব মাথা নাড়ান। টেবিলে থাকা পানিটা পান করে বলেন,
“না। দুদিন ছুটি নিয়েছে। তার মেয়েকে নিয়ে নাকি গ্রামে যাবে।”

শুরু হলো রায়ানের সন্দেহ। কোথাও একটা চক্রা/ন্তের গন্ধ! গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্যই কি তার ছুটি নেওয়া? নাকি আছে অন্য কোনো কারণ?

রাত হলো। রাগিনী তখন রিও আর ফিওনাকে নিয়ে ব্যস্ত। তাদেরকে নিয়ে কখনো বল খেলছে আবার কখনো গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রাতের খাবারটা এখনো খাওয়া হয়নি তার। নয়নতাঁরা বেশ কয়েকবার ডেকেছে। কিন্তু খাবার মুখে উঠতে চাইছে না। তার প্রধান কারণ কোহিনূর। মানুষটার সঙ্গে সেই সকালেই কথা হয়েছিল তার। এরপর সেও কল করেনি আবার কোহিনূরও কল করেনি। হয়ত খুবই ব্যস্ত। তাই রাগিনী তাকে বি/রক্ত করতে চায়নি। কিন্তু এবার ধৈর্যহারা হচ্ছে সে। মানুষটা কি আজ বাড়িতে সত্যিই ফিরবে না? কী এমন কাজ?

নয়নতাঁরা আবার রাগিনীকে ডাকতে এলো। রাগিনীর পাশে বসে বলল,
“অনেক রাত হলো! খাবে কখন?”

“খিদে নেই, নয়ন। তুমি খেয়েছ?”

“আমার তো খিদে পেয়েছিল। আমি খেয়ে নিয়েছি। কিন্তু তোমার কেন খিদে নেই? তেমন তো কিছু খাওনি।”

“এমনিই। ইচ্ছে করছে না।”

নয়নতাঁরা এবার জোর দিয়ে বলল,
“তা বললে কী করে হবে? তোমার হাজবেন্ড এসে যখন শুনবে তুমি এখনো খাওনি তাহলে সব দো;ষ আমার ঘাড়েই চাপাবে।”

রাগিনী নয়নের হাত দিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“ভয় পাচ্ছো কেন? আমি আছি তো। সে দো/ষ চাপালেই আমি তাকে ছেড়ে দেব?”

তবুও হার মানে না নয়ন। জোর করে হাত ধরে টেনে খেতে নিয়ে যেতে চায় তাকে। রাগিনী অবশেষে রাজি হলেও ফোন কলে সব চিন্তাভাবনা এক সাইডে সরিয়ে তাড়াহুড়ো করে ফোনের কাছে এক প্রকার দৌড়ে যায়। কোহিনূরের নামটা জ্বলজ্বল করতে দেখে দেরি না করেই চট করে রিসিভ করে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে নয়ন আঁড়চোখে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসলে খানিকটা মাথা নুইয়ে বলে,
“হ্যালো!”

ওপাশ থেকে কোহিনূর ব্যগ্র হয়ে বলে ওঠে,
“লিসেন ডিয়ার! আমার কাছে বেশি সময় নেই বুঝলে। আমি যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শোনো। আমি ড্রাইভার কল করে দিয়েছি ও গাড়ি নিয়ে রেডি আছে। তুমি, নয়ন আর রিও এবং ফিওনা সবাই রেডি হয়ে গাড়িতে বসো। ড্রাইভার চট্টগ্রাম রায়ানের ফার্মহাউজে তোমাদের নিয়ে যাবে। আপাতত ওখানেই থাকবে।”

“হঠাৎ এত রাতে ফার্মহাউজে কেন?”

রাগিনীর কৌতূহল নিয়ে করা প্রশ্নে কোহিনূর অধৈর্য হয়ে বলে,
“কারণ আছে। ওই বাড়িতে থাকা চলবে না। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো তো?”

“হ্যাঁ করি। সেই প্রথম থেকে আপনার প্রতি বিশ্বাস অটল রয়েছে আমার।”

“তাহলে আমার কথা শোনো। কাল এখানে একটা মিশন আছে। তোমাদের ওখানে থাকা সেফ নয়। রমিলা আন্টিও হয়ত ফার্মহাউজে এতক্ষণে পৌঁছে গিয়েছেন। তোমরা ওখানে যাও। ওখানেই থাকো। বুঝলে?”

রাগিনী নীরব হলো। কিছু একটা ভাবল। মিনমিন করে জিজ্ঞাসা করল,
“খুব বড়ো আর ভয়া/নক মিশন নাকি?”

কোহিনূর বুঝল রাগিনী তাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে। মেয়েটাকে এখন আবারও মিথ্যে বলার জন্য প্রস্তুত হলো কোহিনূর। বড়ো শ্বাস নিয়ে বলল,
“একদম না। সামান্য কিছু কাজ।”

“তাহলে কাজ শেষে আপনি ওই ফার্মহাউজে যাবেন তো?”

কোহিনূর ঢক গিলে জবাবে বলল,
“হুমম যাবো।”

“তাহলে নিজের খেয়াল রাখবেন। ঠিক আছে? আপনার কিছু হবে না, আশা করি। আপনার অপেক্ষায় থাকব।”

“আই লাভ ইউ রাগিনী! আই লাভ ইউ অ্যা লট!”

রাগিনীর আর উত্তর দিতে হলো না। তার আগেই কল কেটে গেল অপরপ্রান্ত থেকে। মনে দেখা দিলো সামান্য সংকীর্ণতা। সব খা/রাপ চিন্তা দূরে ঠেলে সে ভাবল, নিশ্চয় কোহিনূর তাকে মিথ্যে বলেনি! সে খুব দ্রুতই তার কাছে ফিরবে।

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here