#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৩ (২য় খণ্ড)
“বিয়ের পরবর্তী জীবনের জন্য অনেক শুভেচ্ছা, রাগিনী!”
নিজের বাবার বুকে পড়ে অঝোরে কাঁদছিল রাগিনী। ছাড়তে হবে এই বাড়ি সেই সঙ্গে বাবার সঙ্গ। এই শোকের মাঝে পুরুষালী কণ্ঠ কর্ণকুহরে ভেসে আসতেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে তাকাল সে। ফাহমিদের হাতে বিশাল বড়োসড়ো ফুলের তোড়া। চশমার গ্লাস ভেদ করে দেখা যাচ্ছে তার নম্র দৃষ্টি। কান্না আঁটকে কোনোরকমে ‘ধন্যবাদ’ বলল রাগিনী। তৎক্ষনাৎ ফাহমিদ ফুলটি এগিয়ে দিলো রাগিনীর কাছে। মলিন হেসে ফুলের তোড়া হাতে নিলো সে এবং বলল,
“তোমায় তো অনেক আগে ডেকেছিলাম। কেবল এলে যে!”
“একটু ব্যস্ত ছিলাম। তোমার হাজবেন্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে না?”
“ওহ হ্যাঁ।”
রাগিনী ইশারায় কোহিনূরের দিকে দেখালেই কোহিনূর একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে তাকায় ফাহমিদের দিকে। রাগিনী গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে লাগল,
“উনি নির্জন আহমেদ কোহিনূর। আর কোহিনূর ও হচ্ছে ফাহমিদ। আমার কলেজ লাইফের ক্লাসমেট।”
ফাহমিদ কিছু না বলে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দেয়। কোহিনূরের খুব একটা ভালো না লাগলেও সে হাত বাড়িয়ে হাত মিলাতেই ফাহমিদ তাকে আস্তে করে জড়িয়ে ধরে। মনের গভীর কল্পনা তাকে পৈশাচিক আনন্দ দিয়ে চলেছে। কোহিনূরকে খুব সাবধান করতে ইচ্ছে করছে। তবে এই চালাক অফিসারকে এখনি কোনোরকম সর্তকবানী করা ভুল। ছেলেটা সবে বিয়ে করল। তাকে এখন বিয়ের আনন্দে মজতে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হলো ফাহমিদের কাছে। তাই সে শান্ত সুরে বলল,
“শুভকামনা পরবর্তী জীবনের জন্য।”
“থ্যাংক ইউ।”
কথা শেষে ফের নিজের বাবার দিকে তাকাল রাগিনী। রাশেদ সাহেব নিজের অশ্রু লুকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। বধূরূপে নিজের মেয়েটাকে দেখে মনেই হচ্ছেনা মেয়েটা এত বড়ো হয়ে গিয়েছে। তাকে এখনো নিজের চোখে এক ছোট্ট বাচ্চার ন্যায় দেখতে পাচ্ছেন রাশেদ সাহেব। রাগিনী নাক টেনে অবুঝ শিশুদের মতোই বলল,
“আই মিস ইউ, বাবা!”
রাগিনীর মাথায় সুন্দর করে হাত বুলিয়ে দিলেন রাশেদ সাহেব। শত ক/ষ্টের ভিড় চাপিয়ে মলিন হেসে জবাব দিলেন,
“আই মিস ইউ ঠু মাই ডিয়ার চাইল্ড!”
আরো কথাবার্তা হলো। শেষমেশ গাড়িতে বসানো হলো রাগিনীকে। বিদায়বেলা এলো ঘনিয়ে। গাড়ি ছাড়ল। রাগিনী চলল নতুন ঠিকানায়। নতুন গন্তব্য। যেখানে গড়বে তার নিজের সংসার।
গাড়িতে নীরব রয়েছে কোহিনূর। দৃষ্টি নিবদ্ধ রাস্তায়। রাগিনীর পাশে থাকা রিও এবং ফিওনা ইচ্ছেমতো খেলছে। সঙ্গী পেয়ে একটু বেশিই চঞ্চল হয়ে উঠেছে রিও। এতে রাগিনী খুশি। তবে কোহিনূরের হঠাৎ নীরবতা ভাবিয়ে তুলল রাগিনীকে। তার মনোযোগ পাওয়ার জন্য হালকা কেশে উঠল রাগিনী। তবুও মানুষটি তাকাল না। মুখ কেমন বাংলার পাঁচের মতো করে রয়েছে। ভ্রু কুঁচকায় রাগিনী। আবারও কেশে উঠল কোহিনূর তার দিকে না চেয়েই থমথমে গলায় বলে,
“পানি লাগবে?”
“না। আপনার মনোযোগ লাগবে।”
রাগিনীর স্পষ্ট উত্তরে ভ্যাবাচেকা হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তার পানে তাকায় কোহিনূর। তাতেই রাগিনী ফিক করে হেঁসে উঠে বলে,
“এখন পারফেক্ট! এভাবেই তাকিয়ে থাকুন।”
কোহিনূর এবার সত্যিই অপলক তাকিয়ে রইল রাগিনীর দিকে। রাগিনীও চোখে চোখ রেখে আরেকটু কাছে এসে শুধাল,
“কী ব্যাপার? মুখটা ফ্যাকাসে কেন?”
“ফাহমিদের সঙ্গে তোমার কতদিনের বন্ধুত্ব?”
কোহিনূরের এমন আচমকা করা প্রশ্নে কিছুটা অবাক হলেও পরক্ষণেই রাগিনী বুঝে নিলো মানুষটির এমন হাবভাবে থাকার কারণ। সে অকপটে উত্তর দিলো,
“বললাম তো তখন কলেজ লাইফ থেকে। হিংসে করতে করতে মুখের এই অবস্থা?”
“যাকে আমি নিজের করে ফেলেছি এবং যার প্রতি আমার সীমাহীন আস্থা তার সম্বন্ধে অবিশ্বাসের বীজ বুনে তাকে ছোটো করতে চাই না।”
কোহিনূরের স্পষ্ট স্বীকারোক্তিতে বিভোর হলো রাগিনী। ব্যক্তিটি আবারও বলল,
“আমার ব্যক্তিগতভাবে তাকে অদ্ভুত লাগল। জানি না কেন! তাকে দেখে মনে হলো কোথাও দেখেছি।”
রাগিনী এবার বিষয়টা বুঝে কোহিনূরের হাতে হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“সবাইকে সন্দেহ করা আপনার অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফাহমিদ ছেলেটা আগের থেকেই সহজসরল। কখনো তার মাঝে জটিলতা দেখিনি। ছেলেটা সারাদিন কেমিস্ট্রি আর বিভিন্ন রিসার্চের মধ্যেই ডুবে থাকে।”
রাগিনীর বলা শেষ বাক্যে থমকাল কিছুটা কোহিনূর। চমকে উঠে বলল,
“কেমিস্ট্রি?”
“হুমম। কেন কী হয়েছে?”
রাগিনীকে কে বোঝাবে এই জিনিসটাই সব সমস্যার মূল? তার সঙ্গে এসব আলাপ করে নিজেদের সুন্দর এই মূহুর্ত নষ্ট করতে চাইল না কোহিনূর। নিজের স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে তার মাথা ঠেকিয়ে দিলো কাঁধে। কাঁধে মাথা রেখে প্রশান্তি ভরা নয়নে আঁড়চোখে চাইল রাগিনী নিজের স্বামীর দিকে। কোহিনূর নিভানো গলায় বলল,
“কিছু না। এসব আলাপ বাদ। নিশ্চুপ থেকে তোমায় অনুভব করতে চাই এখন।”
আর কোনো আলাপ হলো না। শুধু শোনা যাচ্ছে যানবাহনের শব্দ এবং কোলাহল। এই ব্যস্ত শহরটাকে নব দম্পতি উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের কাছে এখন এই চেনা শহরটাকেও নতুন মনে হচ্ছে। জ্যামে পড়াতে গলা খাঁকারি দিয়ে হালকা পেছনে তাকানোর চেষ্টা করল মেহরাজ। তখনি কোহিনূরের চোখ রাঙানো দেখেই সোজা সামনে তাকাল। এ এক মহা জ্বালা!
কোহিনূরের গাড়ির পেছনে চলেছে আরেকটা গাড়ি। সামনের সিটে রায়ান এবং পাশে জবুথবু হয়ে বসে থাকা নয়নতাঁরা আঁড়চোখে তাকানোর চেষ্টা করছে। পেছনে মিসেস. রমিলা। নিজের মুখের একাংশ কায়দা করে একহাতে চেপে রেখেছে নয়ন। সে পড়েছে মহা বিপদে। রায়ানকে মুখ দেখাতে লজ্জা করছে তার। বুঝতে পারেনি নিজের ভাই এবং ভাবীকে প্রাইভেসি দিতে গিয়ে এমন ফেঁ/সে যাবে। তার মনে পড়েছে বিয়ের সময় রায়ানকে বলা কথাগুলো। কত সহজভাবে বলে ফেলেছিল রায়ানের বিয়ে মানেই তার বিয়ে। আচ্ছা, এই ইন্সপেক্টর লোকটা কি সত্যিই সব বুঝে ফেলেছে? ফেলারই কথা! এমনি এমনি তো চাকরি খানা পায়নি। আবার অতিরিক্ত ছোটাছুটিতে পিঠে ব্য/থাটাও যেন জেগে উঠেছে। একেবারে সোজা হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। একটু নড়চড় করলেই য/ন্ত্ণা। অপরদিকে তার এমন চুপচাপ থাকা কেন যেন মেনে নিতে পারছেন না মিসেস. রমিলা। নয়নতাঁরাকে দেখার পর উনি বুঝে ফেলেছেন মেয়েটা কথা বলা ছাড়া এক দণ্ডও থাকতে পারেনা। তাই তিনি নীরবতা ভেঙে বললেন,
“নয়নতাঁরা! কোনো সমস্যা হয়েছে?”
হকচকিয়ে উঠল নয়ন। মাথা ঝাঁকিয়ে দ্রুত বলে উঠল,
“না, আন্টি। সমস্যা কেন হবে?”
“কিছু বলছ না যে! শরীর খারাপ করছে নাকি? এখনো তো তোমার পিঠের আ/ঘাত ঠিকই হলো না। তার মধ্যে এত দৌড়াদৌড়ি করলে যে…”
কথার মাঝখানে বাগড়া দিয়ে এবার রায়ান বলতে লাগল,
“কী আর করবে বলো মা! তাকে যদি মানাও করা হয় সে বলে কী জানো?”
ঢক গিলে রায়ানের দিকে অসহায় পানে তাকায় নয়নতাঁরা। উনি কি সব বলে দেবেন তবে? আন্টির সামনে একেবারে নাক-কান কা/টা যাবে তার। ইশারায় হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে বারণ করে ওসব কথা না তুলতে। রায়ান সেসব দেখেও না দেখে বলে,
“নিজের বিয়েতে তো লাফালাফি করতে পারবে না। লজ্জা ভাবসাব নিতে হবে। তাই ভাইয়ের বিয়েতেই লাফিয়ে নিতে চায়।”
মিসেস. রমিলা এবার শব্দ করে হাসলেন। স্বস্তির শ্বাস ফেলল নয়ন। কথায় কথায় আহমেদ বাড়ির সামনে পৌঁছাল তারা। নয়নতাঁরা তাড়াতাড়ি করে নামল। নতুন বৌ বাড়িতে এসেছে। বাড়িতে তো তেমন কেউ নেই আয়োজন করার। তাকেই করতে হবে সব। গাড়িতে মিসেস. রমিলাকে বসিয়ে রেখে রায়ানও নামল এবার। নয়নতাঁরা তড়িঘড়ি করে যেতে গিয়ে রায়ানের ডাকে পিছু ফিরল সে। চোরের মতো ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মাথা নুইয়ে আমতা আমতা করে বলল,
“আই এম সরি।”
“হঠাৎ?”
উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে জানতে চাইল রায়ান। নয়ন অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এই ইন্সপেক্টর কি বুঝতে পারছে না কেন তাকে সরি বলা হচ্ছে? নাকি বুঝতে চাইছেন না? নয়ন সাহস নিয়ে বলল,
“ওইতো তখন ওইসব কথা মিস্টেক করে বলে ফেলেছিলাম। সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছুই নেই। ওসব যখন তখন বলে ফেলি আমি।”
ভ্রু কুঞ্চিত করে আশ্চর্য হয়ে রায়ান বলে উঠল,
“যখন তখন? মানে আর কাকে, কাকে ওসব কথা বলেছ?”
বাকরুদ্ধ হয় নয়ন। কণ্ঠস্বর আঁটকে যায়। কী বলতে কী বলছে সে! এক দোটানা পরিস্থিতি! এবার প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,
“আর কাউকে না।”
“আর কাউকে বলার চিন্তা না করায় ভালো। সবাই আবার সুন্দর মেয়েদের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে ফেলতে পারে না। যাও বাড়ি যাও। আর হ্যাঁ পিঠে ব্য/থা করছে মনে হচ্ছে তোমার। বাড়িতে গিয়ে নিজের যত্ন নিয়ো ভালো করে। বুঝতে পেরেছ?”
নয়নের জবাবের আর অপেক্ষা করল না রায়ান। উঠে গেল গাড়িতে। আবার গাড়ির ইঞ্জিন চালু হলো। গাড়ি ছুটতে লাগল। নয়ন কিছুটা সময় বোকার মতো হেলদোল ব্যতীত দাঁড়িয়ে রইল। রায়ানের শেষ কথাগুলো কেন যেন অনেক চেষ্টা করেও মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে প্রবেশ করাতে পারল না।
বাড়িতে প্রবেশের আগেই নববধূর বাঁধা হয়ে দাঁড়াল নয়নতাঁরা। ছুটে এসে সদর দরজায় আগলে দাঁড়াল সে। রাগিনী কিছুটা হকচকিয়ে উঠলে কোহিনূর বিরক্তির রেশ ধরে বলল,
“কী হচ্ছে নয়ন? তোমার শরীর এখনো ভালো না অথচ এভাবে দৌড়াদৌড়ি করতে তোমার একটুও মনে হচ্ছে না যদি আবার কিছু হয়? আর এভাবে পথ আগলে দাঁড়াচ্ছ কেন?”
“তুমিও চুপ করে দাঁড়াও। আমার কাজে ডিস্টার্ব করো না।”
কোহিনূর কিছু বলতে গেলে রাগিনী মাথা নাড়িয়ে ইশারা করে তাকে চুপ করতে বলে। নয়নতাঁরা তাড়াহুড়ো করে ডাকে মেহরাজকে। আর বলে,
“হেল্প করো আমায়। তাড়াতাড়ি কিচেনে এসো।”
কিছু না বুঝেই মেহরাজ রাজি হলে তার সঙ্গে কিচেনের দিকে এগোয়। নয়ন যাবার আগে বলে যায়,
“তোমরা কেউ বাড়িতে ঢুকবে না।”
মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে হাজির হয় নয়নতাঁরা আর মেহরাজ। মেহরাজের হাতে রেড কার্পেট আর নয়নের হাতে বাটি। বাটিভর্তি লাল গোলাপের পাপড়ি। মেহরাজ দ্রুত দরজার কাছ থেকে শুরু করে রেড কার্পেট বিছিয়ে দিতেই নয়ন বলল,
“আজ আমার আবদারের দিন। আর এখন আমার আবদার ভাবিজানকে কোলে তুলতে হবে, বিগ ব্রাদার!”
“মানলাম না তোমার আবদার। আমার বাড়ি, আমার ড্রয়িং রুম আমি যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে আমার বউকে নিয়ে ঢুকব।”
কোহিনূরের অকপট কথায় ক্ষুদ্ধ হলো নয়ন। চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“হবে না। একজন শক্তি সামর্থ্য অফিসার তুমি! তুমি বউকে হাঁটিয়ে ঘরে প্রবেশ করাবে? আর ননদ হিসেবে আমারও তো কিছু দায়িত্ব থাকে নাকি! আমি দেখব না আমার ভাবিজানকে সামলানোর ক্ষমতা তোমার আছে কিনা!”
মেহরাজ সঙ্গে সঙ্গেই নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলল,
“কথাটা কিন্তু সত্যি স্যার। নয়নতাঁরা ম্যাডামের সাথে আমি সহমত।”
সঙ্গে সঙ্গেই এক ধমক খেলো মেহরাজ। কোহিনূর শাসিয়ে বলল,
“তুমি চুপ করো।”
“ওকে চুপ করিয়ে দিতেই পারো কিন্তু আমাকে পারবে না।”
নয়ন কোনোমতেই মানার মেয়ে নয়। কোহিনূর একবার তাকাল রাগিনীর দিকে। মেয়েটা এখনি কেমন যেন চুপসে গেছে। হয়ত লজ্জায়! কিছুটা সময় নিয়ে কোহিনূর আচমকায় কোলে তুলল রাগিনীকে। এই মূহুর্তের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না রাগিনী। চেপে ধরল দুহাতে কোহিনূরের কাঁধ। তার বড়ো বড়ো আঁখি যেন বলছে, ‘এ কী করছেন সকলের সামনে?’
কোহিনূর মৃদু হেসে শীতল গলায় বলল,
“আসলে নয়ন ঠিকই বলেছ। বউরানির প্রথম এই বাড়িতে বউ হয়ে পদার্পণ করছে। তার স্বাগতম জানানোর পদ্ধতি তো আলাদা হওয়াই উচিত।”
নয়নতাঁরা বিরাট হাসি দিয়ে একটা শিস বাজিয়ে দিলো। কোহিনূর ধীর পায়ে প্রবেশ করল তার রাগের রানিকে নিয়ে বাড়ির অন্দরমহলে। দেরি না করে ফুলের পাপড়ি তাদের উপর ছিটিয়ে স্বাগত জানালো নয়ন। মেহরাজ হাততালি দিলো। তবে হঠাৎ করে কল আসায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। কল রিসিভ করতে চলে গেল অন্যখানে।
হলুদ রঙের শাড়িটা জড়িয়ে বেরিয়ে এলো রাগিনী। খোলা চুলটা বারবার হাত দিয়ে পেছনে ঠেলছে। রিও আর ফিওনার খেলা দেখতে ব্যস্ত থাকা কোহিনূর তখন রাগিনীর দিকে তাকাল। এ যেন স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ রমনী! যার লালিত্যপূর্ণ মুখশ্রী কোহিনূরের বুকে বিদ্ধ হয়! কাছেই ছিল একজন সার্ভেন্ট। তাকে ইশারা করতেই সে এসে রিও আর ফিওনাকে নিয়ে গেল। রাগিনী তা খেয়াল করে এগিয়ে বলল,
“ওরা তো এখানে বেশ ছিল। নিয়ে গেল যে!”
“ওরা এখন এখানে থেকে কী করবে? তোমার আমার ভালোবাসা দেখবে? ওদেরও প্রাইভেসি দরকার সঙ্গে আমারও। অ্যান্ড অলসো নিড ইউ।”
কোহিনূরের স্পষ্ট জবাবে মিইয়ে এলো রাগিনীর মুখ। কোহিনূর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তাছাড়া রিও-কে সঙ্গী দেওয়ার পেছনেও কারণ আছে আমার। ও বারবার আমার বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে তা চাই না।”
“আপনি বড়োই ধূর্ত লোক!”
রাগিনীকে কাছে টেনে নিলো কোহিনূর। তার কোমড়ে দুটো হাত রেখে নরম সুরে বলল,
“নিজের বউকে বেশি বেশি করে কাছে পেতে যদি এটা শুনতে হয় তাহলে তাই!”
অতঃপর দুজনে চুপচাপ। রাগিনী ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে ঘরটাকে। পুরোটাই সাদা রঙের ফুল দিয়ে সাজানো। শুধু বিছানা নয়, দেয়ালেও দেওয়া সাদা গোলাপ। সুন্দর গন্ধ! রাগিনী শুধাল,
“ঘরটা নয়ন সাজিয়েছে।”
“হ্যাঁ। ও ছাড়া এসব আর কে করবে বলো।”
রাগিনী জবাবে কিছু বলল না। কোহিনূর এবার প্রশ্ন করল,
“এখন আমায় একটা কথা বলো! প্রতিটা মেয়ের বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। তার বিয়ে ধুমধাম করে হবে। গায়ে হলুদ, বিভিন্ন অনুষ্ঠান এসব পালন করা হবে। তোমারও নিশ্চয় এমন কোনো ইচ্ছে ছিল! সেটা পূরণ করতে দিলাম না তাই না?”
রাগিনী কিছুটা চুপ থাকল। একটু ভেবে কোহিনূরের গলা জড়িয়ে বলল,
“উমম… সত্যিটা হলো এইযে, আমার সবচেয়ে বড়ো স্বপ্ন ছিল অফিসার নির্জন আহমেদ কোহিনূর। তাকে আমি পেয়েছি। এই পূর্ণতার কাছে ওইসব ইচ্ছে তুচ্ছ!”
“কিন্তু আমার আজকে ইচ্ছে করছে তোমার গায়ে হলুদটা সারতে।”
বি/স্ফোরিত চোখে তাকাল রাগিনী। হতভম্ব হয়ে বলল,
“এখন?”
“হুম এখন। আমার সব এরেঞ্জমেন্ট করা আছে। নয়ন করে দিয়েছে।”
আর কোনো কথা শুনল না কোহিনূর। তার হাত ধরে টেনে নিয়ে বসাল ড্রেসিংটেবিলের সামনে। সেখানকার লাইট জ্বালিয়ে দিলো কোহিনূর। ড্রেসিংটেবিলের চারিপাশে আলো ঝলমল করে উঠল। জ্বলজ্বল করল রাগিনী সুন্দর মুখখানা। সেখানে থাকা ফুলের গয়না এক এক করে পড়িয়ে দিলো রাগিনীকে কোহিনূর। তবে এখানে সমস্যা হচ্ছে লোকটা বেশ লোভী হয়েছে বটে! ফুলের টিকলি পড়াতে গিয়ে রাগিনীর মাথায় চুমু খাচ্ছে, হাতে চুড়ি পড়াতে গিয়ে হাতে নিজের ঠোঁটের পরশ দিচ্ছে। এবার তার চেয়েও ভয়ানক কাজ করে বসল কোহিনূর। রাগিনীকে লিপস্টিক লাগিয়ে দিতে গিয়ে বেশ মনোযোগী ছিল সে। আস্তে করে লিপস্টিক পরাতে গিয়ে মুখ এগিয়ে হুট করে ঠোঁটেও নিজের ঠোঁটের স্পর্শ লাগিয়ে দিলো মানবটি। নিজের চোখমুখ চেপে ধরল রাগিনী। কোহিনূর ঘর কাঁপিয়ে হাসি শুরু করল।
সুন্দর করে যত্নের সাথে রাগিনীকে কোলে তুলে ওয়াশরুমের বাথটাবে বসিয়ে দিলো কোহিনূর। তাও খুবই সাবধানে। রাগিনী যেন সদ্য ফোঁটা এক নম্র পুষ্প তার কাছে। যে একটু জটিল স্পর্শ পেলেই ঝরে যাবে। তাকে আগলাতে হবে পরম আদরে। হলুদের বাটি রাখা ছিল সেখানেই। বাহিরে থেকে আসছে সুন্দর মিউজিক। গালে হাত দিয়ে রাগিনী একমনে দেখে চলেছে কোহিনূরের কর্মকাণ্ড। আলতো করে হাতে হলুদ ভরিয়ে রাগিনীর গালে মাখাল লোকটি। তারপর অন্যগালে। এরপর দুহাতে। রাগিনীও নিজের হাতে হলুদ নিয়ে কোহিনূরের খোঁচা দাড়িতে মাখিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল। এই খুনশুটির মাঝে একটা সময় ঠান্ডা পানিটাও পড়ল দুজনের গায়ে। হাতাহাতি করতে গিয়ে নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে পড়ল কোহিনূর ভরা বাথটাবে। মজা পেলো রাগিনী। অতঃপর কী যেন মনে করে সেও বাথটাবে কোহিনূরের অতি নিকটে বসে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল স্বামীকে। এই শান্তি আর অন্য কোথাও মিলেনা। এই মুহূর্ত হলো দুজনের।
সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করতে ভুললো না তারা। রাগিনী ভেজা চুলে এসে দাঁড়াল জানালার কাছে। শীতল হাওয়ায় দাঁড়িয়ে গেল শরীরের লোম। পিছন থেকে কোহিনূর এসে একটা চাদর দিয়ে জাপটে ধরল তাকে। মুড়িয়ে নিলো নিজের শরীরের উষ্ণতায়। কখনো কাঁধে কখনো বা কানের লতিতে নিজের শুষ্ক ঠোঁটের স্পর্শ দ্বারা নিভু নিভু হলো রাগিনী। শ্বাস-প্রশ্বাস হলো ঘন। কোহিনূরের শীতল কণ্ঠখানি কর্ণগোচর হলো তার।
“বাজে মনটা আর মানতে চাইছে না। অধৈর্য হচ্ছে ভীষণ।”
কোহিনূরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়ালো রাগিনী। একটু ঠেলতে গিয়েও যখন বুঝল মেয়েটাক সরছে না, তাকাচ্ছে না তখন বুঝল সে লাজে সংকুচিত হয়েছে। মৃদু হেসে রাগিনীর হাতটা ধরে আস্তে আস্তে নিজের সান্নিধ্যে আনল সে। আবারও নিজের আয়ত্তে কোহিনূরের তুলনায় ছোটোখাটো তার প্রণয়িনীকে বক্ষে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল ফুল বিছানো বিছানায়। রাগিনীর তুষ্টি ভরা চেহারা প্রমাণ করল সে কতটা সুখী। দুজনেই প্রণয়ের পাগলামির শেষ সীমানায় পৌঁছাল। আসক্তি হলো প্রগাঢ়। নৈকট্য লাভ করল তারা। ঘুচে গেল সমস্ত দূরত্ব! মুছে গেল সমস্ত ব্যবধান।
তখন রাত সাড়ে তিনটা পেরিয়েছে। ফোনে টুংটাং আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সেটা ঘুমন্ত কোহিনূরের কানে আসলেও পাত্তা না দিয়ে নিজের বাহুতে থাকা রাগিনীকে চাদর দিয়ে বেশি করে ঢেকে ফেলে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলল সে। এই নারীর এলোমেলো চুলের কাছে এসে থামল। তন্দ্রাঘোরে তলিয়ে যেতে লাগল আবারও। তবে শান্তি মিলল না। আবারও সেই মেসেজের শব্দ। একবার মেসেজ না দেখলে বারবার সেটা বাজতে থাকে একটু পরপর। অনেকটা বিরক্তি হয়েই হাত বাড়িয়ে হাতে ফোন নিয়ে নিভুনিভু চোখে চাইল কোহিনূর। অচেনা নম্বরের মেসেজ। স্পষ্ট লেখা, ‘বি এলার্টি, বি সেফ।’
বিড়বিড় করে মেসেজ পড়তেই যখন তার কপালে ভাঁজ পড়ল তৎক্ষনাৎ বাড়ির দরজায় কলিংবেল বাজার শব্দে মনে সংশয় নিয়ে দ্রুত উঠে বসল। রাগিনীর মাথায় একটুখানি হাত বুলিয়ে এবং তাকে ভালো মতো শুইয়ে দিয়ে কোনোরকমে গায়ে টিশার্ট জড়িয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে এবার। সে এক্সট্রা গার্ড নিয়োগ করেছিল। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কেউ আ/ক্রমণে এলো না তো আবার? ড্রয়ার থেকে রি/ভলবার হাতে তুলে তাড়াতাড়ি বাহিরে গেল সে। সদর দরজার এপার থেকেই ভালো করে দেখে নিলো বাহিরটা। তারই গার্ড রয়েছে। তবুও মনে সংশয় রেখে দরজার দুটো কপাট খুলে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে? এনি প্রবলেম?”
“তেমন তো প্রবলেম না স্যার। ব্যস…কেউ একজন এলো আর ফুলের তোড়া দিয়ে চলে গেল। প্রথমে আমরা সন্দেহ করলেও তেমন কিছুই নেই এর মধ্যে একটা চিরকুট ছাড়া।”
গার্ড নীল রঙের চিরকুট এগিয়ে দিলে তা তড়িঘড়ি করে হাতে নেয় কোহিনূর। লেখার অবস্থা খুব একটা ভালো না। এলোমেলো বর্ণ। আঁকাবাঁকা লাইন। তবে পড়তে অসুবিধা হয় না। সেখানে স্পষ্ট লেখা,
“বিবাহের শুভেচ্ছা। দেখা হচ্ছে কাল সকালে সিটি হসপিটালে। বি রেডি!”
এ যেন শান্ত ভাষায় হু/মকি। কেউ তাকে সাবধান করছে নয়তবা ভীতিপ্রদর্শন করছে। হসপিটাল শব্দটি দেখে বুকটা ঢিপঢিপ করল কোহিনূরের। কী হবে এখানে? আদেও কিছু হবে? কোনো নতুন আ/ক্রম/ণ? যদি সেটাই হয় তাহলে এভাবে বলে দিয়ে যাবে কে? কোহিনূর অনেক ভেবে বলল,
“তাকে আটকাও নি কেন? সে কি মেয়ে ছিল নাকি ছেলে?”
“একচুয়ালি স্যার আমরা তাকে আটকেছিলাম। তবে সে আমাদের চোখে ধুলোমাটি দিয়ে পা/লিয়েছে। আর ও মেয়ে ছিল। মুখটাও সেভাবে দেখতে পাইনি।”
কোহিনূরের ভাবনাতে প্রথমেই আসে ওই মেয়েটির কথা যে কিনা রাগিনীর মতো হুবহু দেখতে। সে জানে বিষয়টার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই তাকে বিষয়টা নিয়ে ঘাঁটতে হবে। হাতে সময় নেই। গার্ডকে ইশারায় যেতে বলে দরজা লাগাল সে। ঘরে ফিরল। ফোনটা নিয়ে আবার বাহিরে এলো। সময় গেল প্রায় এক ঘণ্টার মতো। নিজের টিমের সাথে অনেক কথাবার্তা এবং বিবেচনা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নিলো কোহিনূর। গায়ে জড়ালো তার ইউনিফর্ম। হাতে রাগিনীর দেওয়া সেই ঘড়িটা পড়তে পড়তে পিছু ফিরে তাকাল বিছানার পানে। রাগিনীর অগোছালো এবং প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা তাকে টানছে ভীষণ। তার নিকটে গিয়ে চোখমুখ থেকে চুল জড়িয়ে বেশ কয়েকটা পরশ আঁকল চোখেমুখে। তার খোলা কাঁধেও নিজের ঠোঁটের স্পর্শের চিহ্ন দিতে বাদ রাখল না সে। একটা মেয়ে যে সদ্য বিবাহিত! তার স্বামী পরদিন ভোরেই তাকে রেখে কাজে চলে যাওয়া মানায় না। মেয়েটা হয়ত অভিমান করবে বেশ। কিন্তু কেন যেন মনে হলো এই যাওয়ার পর ফেরাটা কষ্টসাধ্য হবে তার। রাগিনী নড়ে উঠল। গা টানা দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ফেলল। কোহিনূর তার মনোহারিণীর মায়া কাটিয়ে বেরিয়ে এলো দ্রুত।
চলবে…