গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে দ্বিতীয় খন্ড (পর্ব ২২)

0
435

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২২ (২য় খণ্ড)

“কীরে! আর কত দেখবি? আর দেখিস না। একটু পরই তো বিয়ে। তারপর তো সারাজীবন তো পড়েই আছে। এখন চল ঘরে। আর কয়েকটা গয়না পরিয়ে দেওয়া বাকি আছে।”

এমনিতেই লাজুক রাগিনীর কানটা গরম হচ্ছিল কোহিনূরকে বর বেশে দেখে। উর্মিলার এমন কথায় তৎক্ষনাৎ জায়গা ছাড়ল রাগিনী। হনহনিয়ে রিও-কে নিয়ে ঢুকে এলো ঘরের ভেতরে। পেছন পেছন উর্মিলাও ছুটে এলো। ড্রেসিংটেবিলের লাইটের সামনে ঝকঝক করছে রাগিনীর গায়ের গয়না। তার চেয়েও যেন বেশি আলোকিত হচ্ছে রাগিনীর মুখশ্রী। কখনো হাসি, কখনো লজ্জা, কখনো তৃপ্তির ছোঁয়া! এই মূহুর্তে তার নিজেকে সবচেয়ে বেশি সুখী নারী মনে হচ্ছে। যেই নারী নিজের প্রিয় মানুষকে বৈধ করে পেয়ে থাকে তার চেয়ে খুশি আর কে-ই বা হয়? হাত ভর্তি চুড়ি পড়িয়ে মাথায় লাল রঙের কাপড় দিয়ে আবৃত করে ক্ষ্যান্ত হলো উর্মিলা। অতঃপর রাগিনীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এভাবেই খুশি থাক। সুন্দর একটা সংসার হোক তোদের।”

রাগিনীর হাসি প্রসারিত হলো। প্রতিত্তোরে বলল,
“তা নাহয় হবে! তোর সংসারটা কবে দেখতে পাচ্ছি? এভাবে চোখে চোখে প্রেমকথা আর মুখে মুখে ঝগড়া কতদিন চলবে?”

এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল উর্মিলা। টনক নড়ল তার।
“কীসের প্রেমকথা? কার সাথে ঝগড়া?”

“নোমান ভাই! আর কার সঙ্গে ঝগড়া করিস আবার?”

নোমান নামটা শুনেই হকচকিয়ে গেল উর্মিলা। আজকাল তার কাছে এই নামটি আতঙ্ক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যখন তখন মানুষটির চেহারা ভাসে। আমতা আমতা করে বলল,
“তুই এটা বলতে পারলি? আমি উনার সঙ্গে ঝগড়া করি? করলেও বা ভুল কোথায়? উনি কারোর মুখ থেকে মিষ্টি কথা শোনার যোগ্যও না।”

“ওসব যোগ্য অযোগ্য বুঝি না। আমার তো মনে হয় উনি তোর মুখ থেকে মিষ্টি কথা শোনার অপেক্ষাতে রয়েছেন।”

ভ্রু কুঁচকায় উর্মিলা। উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে,
“তুই কী করে বুঝলি?”

“মানলাম আমি এখনো সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারিনি। কিন্তু একটুআধটু এক্সপেরিয়েন্স তো আছে নাকি!”

রাগিনীর কথায় তাকে একটু ধা/ক্কা দিলো উর্মিলা। তারও বোধহয় এবার লজ্জা লাগছে। অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। কাকে নিয়ে? নোমানকে নিয়ে?

বার বার সিঁড়িতে দৃষ্টি রাখছে কোহিনূর। কাজি সাহেব মেয়েপক্ষকে ডেকেছেন। রাশেদ সাহেব উপস্থিত হয়েছেন। প্রতীক্ষায় রয়েছে রাগিনীর। কোহিনূরের এমন অস্থিরতা, বিচলতা চোখ এড়ায় নি রায়ানের। সে কোহিনূরের কাঁধ জড়িয়ে কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“এত তাড়া কীসের ভাই? মেয়েদের বিয়েতে অনেক শখ আহ্লাদ থাকে। স্বাভাবিক! এমনিতে তো বেচারিকে গায়ে হলুদের ফাংশন করারও সুযোগ দিলি না। এখন এমনভাবে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিস যে মনে হচ্ছে তোর এই দৃষ্টির টানে তোর বউ উড়ে উড়ে চলে আসবে।”

রায়ানকে ঠেলে দিয়ে কোহিনূর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“বিলিভ মি! একটা কেইস সলভ করতেও এত ধৈর্য ধরতে হয় না যতটা এই মেয়ের জন্য ধরতে হচ্ছে।”

রায়ান ঠোঁট কামড়ে হাসল। আগের মতোই নিচু সুরে বলল,
“রিয়েলি? এতটা ধৈর্যহারা হচ্ছিস বউয়ের জন্য? আমি তো শুনলাম এইতো গতকালকেই বিয়ে করবি না অবধি সীমাবদ্ধ ছিলি। হবু মিসেস. রাগিনীর হাতে থা/প্পড় খেয়ে নিমিষেই মাথার তার উল্টেপাল্টে গেছে?”

বি/স্ফোরিত চোখে তাকাল কোহিনূর এবার। সে চ/ড় খেয়েছে এটা রায়ানের কানে কী করে পৌঁছাল? একদম মানসম্মান নিয়ে টানাটানি! বিস্ময় নিয়ে বলল,
“এ…এটা কে বলল তোকে?”

“তোর বিশ্বস্ত, পেটে কথা রাখতে না পারা মেহরাজ!”

বিলম্ব না করেই মেহরাজকে ফাঁ/সিয়ে দিলো রায়ান। এবার কোহিনূর অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তার অন্যপাশে বসা মেহরাজের দিকে। মেহরাজের তখন আলুথালু অবস্থা। সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
“রায়ান স্যার! এটা তো কথা ছিল না। আপনি কথাটা ফাঁ/স করবেন না বলেছিলেন।”

রায়ান তার জবাব না দিয়ে ঠোঁট চেপে হেঁসে কুটিকুটি হতে থাকল। কোহিনূর এবার মেহরাজকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল,
“ওয়েট! এটা তুমি কী করে জানলে যে রাগিনী আমাকে থা/প্পড় দিয়েছিল?”

‘দরজা তো ফাঁকাই ছিল স্যার। চেয়ারে বসে থেকেই সব দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন! আমি জাস্ট চ;ড় দেওয়াই দেখেছি। বাকি কিছুই দেখিনি।”

কোহিনূর নিজের ক্রো;ধ সামলানোর জন্য বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে বিড়বিড়িয়ে হু;ম/কি দিয়ে বলে,
“বিয়েটা শেষ হোক। অফিসে তোমায় বোঝাচ্ছি বাকিটা!”

অপেক্ষার ঘটল অবসান। রিনঝিন শব্দে মেতে উঠল পুরো হলরুম। সকলে হলো শান্ত। চুড়ির ঘর্ষণের মাধ্যমে সৃষ্ট সুন্দর আওয়াজ জানান দিলো বধূ বেশে রাগিনীর আগমন। সকলের নজর পড়ল তার দিকে। রাগিনীর কোলে রিও। তার হাবভাব একেবারেই রাজকীয়! কোনো হেলদোল নেই তার। তবে ফিওনাকে কোহিনূরের কোলে দেখামাত্র সে হঠাৎ ডেকে উঠল! নয়নতাঁরা রাগিনীকে দেখামাত্র বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে দেখে ধৈর্যহারা হয়ে দৌড়ে যেতে চাইল তার দিকে। তার এমন অধৈর্য আচরণে উঠে দাঁড়াল রায়ান। হাতটা চেপে ধরল তার। শান্ত গলায় বলল,
“গতকালকেই হসপিটাল থেকে রিলিজ পেলে আজকেই এমন দৌড়াদৌড়ি করলে কী করে হবে মিস. নয়নতাঁরা! নিজের শরীরের দিকেও তাকাও একটু।”

নয়নতাঁরা বিচলিত হয়ে বলল,
“আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল এক বন্ধু আরেক বন্ধুর মতোই হবে। দুজনেই সারাক্ষণ আমার দৌড়াদৌড়ি নিয়ে এলার্জি হয়। ভাইয়ের বিয়েতে দৌড়াদৌড়ি করব নয়ত কি আপনার বিয়েতে করব?”

“আমার বিয়েতে দৌড়াদৌড়ি করলে আমি বাঁধা দেব না। এখন তো অসুস্থ আছো। তাই বাঁধা দিতে হচ্ছে।”

নয়নতাঁরা আবারও অধৈর্য হয়ে বলল,
“আরে ধুর! নিজের বিয়েতে কেউ লাফালাফি করে নাকি? নিজের বিয়েতে বউ সেজে একটু লজ্জা লজ্জা ভাব নিতে হবে না? যদি লাজুক ভাবটা না আসে তাহলে বিয়ে বিয়ে ফিলিং আসবে কী করে? আশ্চর্য!”

কথাটা বলে এক মূহুর্তও দাঁড়াল না নয়ন। নিজের বেগুনি রঙের লেহেঙ্গার নিচের অংশটি হাত দিয়ে ধরে হন্তদন্ত হয়ে ছুটল রাগিনীর কাছে। সে যে মুখ ফসকে বেফাঁস কিছু কথাবার্তা বলে দিয়ে গেল তাতে তার খেয়ালও নেই। অপরদিকে রায়ান এসব শুনে বাকহারা। ঠাঁই নড়াচড়া বাদ দিয়ে হা হয়ে রইল। মেয়েটা কী বলে গেল কিছুক্ষণ আগে?

রাগিনীকে নিয়ে এসে বসানো হলো কোহিনূরের সামনাসামনি। কোহিনূরের অপলক দৃষ্টি গ্রাস করতে লাগল বধূ রাগিনীকে। লাজে রাঙা রাগিনী তখন চোখ উঠিয়ে তাকাতেও পারছে না। এত নির্লজ্জের মতো দেখার কী আছে? বাকিরা কী মনে করবে? এভাবেই কাটল অনেক সময়। তখন বিয়ে পড়ানো চলছে। উর্মিলা বড়ো মানুষদের ভিড়ে টিকে থাকতে না পেরে সরে যেতে যেতে উঁচু হিল পরে থাকায় স্লিপ কে/টে নিজেকে সামলানো দায় হয়ে পড়ল তার। তখনি তার দুটো কাঁধে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল কোনো এক ব্যক্তি। এখনো তার পায়ে সমস্যা রয়েছেই। ডক্টর বলেছে যত সময় সম্ভব বিশ্রামে থাকতে। কিন্তু নিজের বান্ধবীর বিয়েতে না এসে কি থাকা যায়? উর্মিলা দ্রুত পিছু ফিরে তাকায় তাকে সাহায্য করা মানুষটিকে ধন্যবাদ জানাতে। এই লম্বাচওড়া মানুষটিকে দেখে মুখভঙ্গি পাল্টে যায় তার। ইতস্তত বোধ করে। নোমান তখনো স্বাভাবিক হাবভাবে ঘুম কম হওয়ায় হাই তুলে চলেছে। তারপর বলল,
“মেয়েদের একটাই সমস্যা! তারা নিজেদের পা ভা/ঙবে তবুও হিল পরে চলাফেরা করা ছাড়বে না। আজকের হিল জুতো না পড়লে কী হতো? তাও দেখো আবার! পড়েছে পেন্সিল হিল! আরো একবার পড়ে গেলে যখন পা আজীবনের জন্য অকেজো হয়ে যাবে তখন তোমার মা বিয়েটাও দিতে পারবে না। তখন বুঝবে ঠ্যালা কাকে বলে!”

উর্মিলা নিজের চশমা ঠিকঠাক করে আবারও লোকটিকে দেখে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না এই মানুষটা হঠাৎ তার সামনে। মনে চাপা উত্তেজনা কী করে প্রকাশ করবে ভেবেই পাচ্ছে না। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“হিল জুতো না পরলে তো আপনাদের মতো হাতিদের কাছে আমি বাচ্চা হয়ে যাব। তখন যদি আমাকে দেখতে না পেয়ে ফে/লে দেন। এমনিতেই তো যখনতখন ধা/ক্কা;ধাক্কি চলে।”

“উমম… তোমায় দেখতে পাবো না এই কথা তুমি কী করে বললে? তোমার ঝগড়ুটে সেই গলা শুনলে তোমায় লাখো নারীদের মাঝেও খুঁজে নিতে পারব!”

উর্মিলা এবার হালকা রা;গল। বারবার ঝগড়া করার বিষয়টা উল্লেখ করার কী আছে? এখন তো সে ঝগড়া করছে না। তবুও সে প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইল,
“কখন এসেছেন এখানে আবার? গতকাল যে বললেন এখানে আসবেন কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এত দ্রুত নিশ্চিত হয়ে গেলেন?”

নোমান মুচকি হাসে। চোখটা সরু করে উর্মিলার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে ওঠে,
“কী করব বলো! কাল এক রমনী আমায় কল করেছিল। তার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম সে আমায় প্রচণ্ডরকমের মিস করছে। তাই তার জন্য এত তাড়াতাড়ি চলে আসতে হলো।”

উর্মিলার অস্বস্তি লাগল হঠাৎ। নিজের লেহেঙ্গার ওড়নাটি চেপে ধরল। ঢক গিলে নিলো শুকনো। অদ্ভুত এই অনুভূতি! ঠান্ডার মাঝে অনুভূত হওয়া গরম জানান দিচ্ছে তার ভেতরে দখিনা হাওয়া বইছে। মিনমিন করে বলে উঠল,
“আর কী?”

নোমান সোজা হয়ে দাঁড়াল। একটু ভেবে নিতে নিতে উর্মিলাকে পর্যবেক্ষণ করল ঠিক করে। সাদা লালের সংমিশ্রণে তার জামা। টকটকে লাল লিপস্টিকে মাখানো ঠোঁট হালকা কাঁপছে। খোলা পাতলা চুল ঢেকে দিয়েছে তার চশমার কিছুটা। এই চাশমিশের মাঝেই নিজের অজান্তেই নিজের মনকে সমর্পণ করে চলেছে নোমান সেটা সে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। তাই স্বীকারোক্তি করতে বিলম্ব করল তার। মেয়েটির পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল,
“আর শুকনো মরিচকে আজ দারুণ লাগছে। লাল জামা আর ঠোঁটের লাল লিপস্টিকে সত্যিই আমি শুকনো মরিচ ভাইব পাচ্ছি। সেই মরিচের ঝালে বোধহয় জ্ব/লেই গেলাম!”

কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে গেল উর্মিলার। পিছন ফিরে ড্যাবড্যাব করে তাকাল নোমানের দিকে। লোকটি বিয়ে যেখানে পড়াচ্ছে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আচমকা পিছু ফিরে বলল,
“শুকনো মরিচটা আমার পছন্দ হয়েছে। তাই চাইছিলাম তোমার মা অন্য কারোর হাতে এই মূল্যবান মরিচ তুলে দেওয়ার আগেই আমি সম্পূর্ণ নিজের আধিপত্য খাটাতে!”
উর্মিলা থম মে/রে থাকল। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। মাথায় একটা বাড়ি দিলো সে। অবিশ্বাস্য লাগল সব! গায়ের লোম ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গেছে। পরিবেশটা মধুর থেকে মধুময় লাগল এবার!

শেষমেশ কোহিনূরকে কাজি সাহেব তিনবার কবুল বলতে বলা হলে কোহিনূর প্রথমে নিজের হবু স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে সময় না নিয়েই তিনবারই গড়গড়িয়ে ‘কবুল’ বলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে রায়ান ছেলের কাণ্ড দেখে না হেঁসে থাকতে পারেন না। সকলে মিলে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলে কোহিনূর রাগিনীর দিকে চোখে চোখ রেখে বলে,
“কবুল বলার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে হবু স্ত্রী থেকে নিজের প্রিয়তমা স্ত্রী হিসেবে রূপান্তরিত করলাম।”

রাগিনীর ভেতরে উথাল-পাতাল ঢেউয়ের ন্যায় হৃদয় ভেসে যেতে থাকল। দরদর করে ঘামতে থাকল। যেন এই মূহুর্তে নিঃশ্বাস আঁটকে যাবে তার। যখনই কাজি সাহেব তাকেও কবুল বলতে বললেন তখন সকলে তার দিকে উন্মুখিয়ে চাইল। কোহিনূরের ধারা/লো দৃষ্টিতে নিজের ঠোঁট চেপে কবুল বলার চেষ্টা করল। এ এক অদ্ভুত মূহুর্ত! এর জন্য সে গত রাত থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে। তবে আজ সেই সময় উপস্থিত! কিন্তু গলা থেকে যেন কণ্ঠস্বর হারিয়েছে তার। কোলে থাকা রিও-কে একহাতে আঁকড়ে ধরল সে। রাশেদ সাহেব তার মাথায় হাত রাখতেই নিমজ্জিত এবং কম্পিত সুরে তিনবার কবুল বললেই সকলে ক্ষ্যান্ত হয়। রাগিনীর নত দৃষ্টি তখন আঁড়চোখে তার কিয়ৎপূর্বে থাকা প্রেমিক পুরুষ এবং বর্তমানে তার স্বামীর দিকে তাকালে কোহিনূর নিজের হাতটা বুকের বাম পাশে রেখে কিছুটা থাবা দিয়ে ইশারা করে যেন, রাগিনীর তিনবার কবুল বলা তার বুকে গিয়েছে লেগেছে। রাগিনী মিটমিটিয়ে হেসে দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে।

শেষমেশ রেজিস্ট্রি ম্যারেজটাও হয়ে যায় তাদের। আগের মতোই তাড়াহুড়ো করে করা কোহিনূরের সাইন দেখে এবার সবার আগে হাসেন মিসেস. রমিলা। পরক্ষণেই রাগিনীকে সাইন করতে দেওয়া হলে ধীর হাতে পেপারে সাইন করতে গিয়ে চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রু পড়ে গিয়ে বিয়ের কাগজ ভেজায়। এই কান্না সুখ এবং দুঃখ উভয়ের। নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার তুষ্টি এবং নিজের বাবা ও পরিবারকে ছেড়ে যাওয়ার ক/ষ্ট!

তখন সন্ধ্যার ঠিক আগ মূহুর্ত! হালকা কুয়াশায় ঢাকা পড়তে শুরু করেছে শহর। তবে শেষ মূহুর্তের সূর্যের কিরণ তার রঙ দেখাতে ছাড়ছে না মোটেও। রাগিনীদের বাড়ির পেছনে সেই কাঠগোলাপের গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা এক নতুন দম্পতির আগমন ঘটেছে। ছবি তোলা হচ্ছে তাদের। গোধূলির আলোমাখা সামান্য ঝলকানিতে জ্বলজ্বল করতে থাকা রাগিনীর হাসিখানা দেখে বারবার ভীমড়ি খাচ্ছে কোহিনূর। অপরদিকে তাদেরকে উৎসর্গ করে বেশ শখ করে গিটার নিয়ে গান গাইছে অভিরূপ। তালে তাল দিচ্ছে সকলেই। রাগিনীর হাত এবং কোমড় ধরে হালকা দুলছে কোহিনূর গানের তালে।

“ঠিক এমন এভাবে, তুই থেকে স্বভাবে!
আমি বুঝেছি ক্ষতি নেই,
আর তুই ছাড়া গতি নেই।”

অভিরূপের সুমধুর কণ্ঠ গোধূলি বেলাকে করে তুলল আরো রঙিন! কোহিনূর রাগিনীকে ঘুরিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“ছুঁয়ে দে আঙ্গুল
ফুটে যাবে ফুল, ভিজে যাবে গা
কথা দেয়া থাক, গেলে যাবি চোখের বাহিরে না!”

রাগিনী তৃপ্তিদায়ক হাসি দিয়ে কোহিনূরের কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে ধরলেই কোহিনূর এবার তাকে সম্মোধন করে,
“বউরানি! কে জানত বলো তো গোধূলি বেলায় হঠাৎ করেই এই রমনীকে ফাঁসাতে গিয়ে আমি নিজেই ফেঁসে যাব?”

“উঁহু! ফেঁসে গিয়ে বুঝি আফসোস হচ্ছে এবার?”

“একদমই না। শান্তি হচ্ছে। পরম শান্তি! নির্জন আহমেদ কোহিনূর এবার সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করল নিজের বউরানির কাছে! যা পানিশমেন্ট দিতে চান দিতে পারেন!”

রাগিনী নিজের মুখ কোহিনূরের কানের কাছে নিয়ে বলল,
“আমাকে ভালোবাসতে হবে প্রচুর! যাই হয়ে যাক না কেন আর কখনো আমাকে মিথ্যে বলা যাবে না। পরিস্থিতির চাপে পড়েও না। এটাই আপনার পানিশমেন্ট!”

কোহিনূর মাথা নুইয়ে বলল,
“আদেশ মঞ্জুর করা হলো রাগের রানি!”

রাগিনী এবার মাথা উঠিয়ে তার কাঠগোলাপের গাছের দিকে তাকাল। আফসোসের সঙ্গে বলল,
“কাঠগোলাপ থাকলে আরো বেশি সুন্দর লাগত!”

কোহিনূর সেসব পাত্তা না দিয়ে বলল,
“এই বাড়ির সবচেয়ে দামী ও জীবন্ত কাঠগোলাপ তো আমি নিয়ে যাচ্ছি নিজের করে। আর কী চাই?”

রাগিনী কিছুই বলল না। মগ্ন হয়ে রইল মানুষটির দিকে। মানুষটি এখন শুধুই তার। যার পেতে সে এতটা দিন অপেক্ষা করেছে। মিও মিও আওয়াজ শুনে কোহিনূর এবং রাগিনী দুজনের দৃষ্টিই গেল রিও এবং ফিওনার দিকে। দুজন দুজনকে কী সুন্দর জড়িয়ে রেখেছে। ঘাসের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। তাদের কাণ্ড দেখে কোহিনূর এবং রাগিনী দুজনেই মিটমিট করে হেসেই দুজন দুজনকে বলল,
“দুজনকে বেশ ভালোই মানিয়েছে!”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here