গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে দ্বিতীয় খন্ড (পর্ব ১৬)

0
468

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৬ (২য় খণ্ড)

মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে একপ্রকার তড়িঘড়ি করেই ঘর থেকে বের হয়ে এলো রায়ান। প্রথমে ভেবেছিল সে ভুল শুনেছে কিন্তু অবশেষে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়ে ঠিক ঝাড়বাতির নিচে মাথায় হালকা রঙের স্কার্ফ পড়া সেই মহিলাকে দেখে নিশ্চিত হলো সে। মাকে এই অসময়ে দেখে হতবাক হলো নিজেই। চকিতে তাকিয়ে বলল,
“মা তুমি?”

মিসেস. রমিলা অর্থাৎ রায়ানের মা এবার কড়া দৃষ্টিপাত করলেন ছেলের দিকে। অতঃপরই কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন,
“এইদিন দেখার জন্য আমায় বিদেশ রেখেছিলে তুমি?”

“মানে কী দেখার জন্য?”

রায়ান তার মায়ের প্রশ্নটা বুঝতেই পারল না। কপালটা ওমনি জড়িয়ে গেল। তৎক্ষনাৎ চোখ গেল নয়নের দিকে। কিছুটা সন্দেহ হলো এবার মায়ের করা প্রশ্নে। মা কি কোনোভাবে নয়নকে নিয়ে কিছু বলছে? সঙ্গে সঙ্গেই তার সন্দেহটা ঠিক হলো যখন মিসেস. রমিলা চিল্লিয়ে বললেন,
“কী দেখার জন্য মানে? এখন না বোঝার ভান করছ? লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করার খুব দরকার ছিল? আমি জানি আমি বলেছিলাম আমার পছন্দ করা একটা মেয়ে আছে। তাই বলে না বলেই বিয়ে করে ফেলবে? আমি এতটাও খা/রাপ মা নই যে ছেলের বিয়েতে বাঁধা দেব।”

রায়ান না পারে মাটির নিচে ঢুকে যায়। এমনিতে বাড়িতে কেউ না থাকলে সমস্যা ছিল না এখন নয়নের সামনে এসব বলায় সত্যিই তাকে খুব লজ্জা দিচ্ছে। নয়ন খুসখুস করে কাশছে। সে নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে বোঝাই যাচ্ছে। রায়ান আস্তে করে এগিয়ে এলো মিসেস. রমিলার দিকে। তার মায়ের কাঁধ দুটো চেপে ধরে শান্ত হয়ে বলল,
“মা, মা, মা। তোমার পছন্দের মেয়ে ছাড়া কাউকে বিয়ে করিনি আমি। বিলিভ মি!”

“মানেটা কী? বিয়ে করো নি মানেটা কী? তার মানে বিয়ে ছাড়াই একসাথে থাকছ? ইট মিনস লিভ ইন? ছি! আর তুমি ভাবছ আমার নিষ্পাপ মেয়ে নয়নতাঁরাকে আমি তোমার সাথে বিয়ে দেব? কোনো জন্মেই না।”

এবার মিসেস. রমিলার কথায় বিষম খেয়ে গেল নয়নতাঁরা। নেত্রপল্লব বড়ো বড়ো করলেও কাশি বাড়তে থাকল। অপরদিকে রায়ানের অবস্থা হলো বেশ শোচনীয়! লজ্জা, সংকোচে যেন পিঁপড়ের ন্যায় ছোটো হয়ে গেল! এই মূহুর্তে পালাতে পারলে সে যেন খুব শান্তি পেত। কিন্তু তা তো হবেনা। সে নিজেও জানত না তার মা স্বয়ং নয়নকেই ঠিক করে রেখেছে। এখন তার কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে ধাতস্থ করে নয়ন এবার কথার বলার চেষ্টা করে নিচু স্বরে,
“আসলে আন্টি আমি…”

মিসেস. রমিলা কাউকে কিছু বলার সুযোগই দিলেন না। কঠোর সুরে বললেন,
“দেখো! মেয়ের কাণ্ড দেখো! শাশুড়িকে মা বলতে হয় সেটাও শেখাও নি তুমি রায়ান।”

রায়ান এবার কিছুটা চিল্লিয়েই বলল,
“মা! মেয়েটা কে জানো?”

“আমি কী জানব?”

মিসেস. রমিলার ঝাঁঝালো কণ্ঠ। রায়ানও পূর্বের ন্যায় বলল,
“সি ইজ নয়নতাঁরা আহমেদ। নির্জন আহমেদ কোহিনূরের ছোটো বোন। আর ওর সাথে আমার কোনো বিয়ে বা কোনোকিছুই হয়নি। জাস্ট ও আমাকে কিছু ব্যাপারে হেল্প করছিল। তখনই তুমি চলে এলে! আর কীসব বলতে শুরু করলে?”

মিসেস. রমিলা তব্দা খেয়ে রইলেন। রায়ানের কথাগুলো বুঝতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। তারপর ঢক গিলে নীরবে গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নয়নতাঁরার দিকে তাকালেন। বেশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিলেন। সেই ছোটোবেলায় মেয়েটাকে কোলে নিয়ে কত চুমু খেয়েছেন। তখনই যেন মনস্থির করেছিলেন মেয়েটাকে নিজের কাছেই রাখবে। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে অসাময়িক হাসি হাসলেন তিনি। নয়নের নিকটে গিয়ে তার বাহু ধরে নম্র সুরে বললেন,
“কিছু মনে করো না আমার কথায়। আমি একটু পা/গল!”

বলেই বুকে জড়িয়ে নিলেন নয়নতাঁরাকে। নয়নও হতভম্ব হলো প্রথমে। তারপর বেশ ভালো লাগল তার। বড়ো হতে হতে সে মায়ের ছোঁয়া পায়নি কখনোই। এই মায়ের ছোঁয়াও বেশ স্নিগ্ধ!

টেবিলের উপর দুটো পা তুলে চেয়ারে ঠেস দিয়ে উপরে ছাঁদের দেয়ালের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রয়েছে কোহিনূর। তার ভাবলেশহীন ভঙ্গিটাই যেন অনেক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। চুলগুলো আশেপাশে মেলে গিয়েছে গোছালো ভাবে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে লম্বা কা/টা একটা দাগ। হলুদ ফর্সা কপালে যেন অন্যরকম বৈশিষ্ট্য এনে দেয় দাগটি। ওই রূপাঞ্জনা মেয়েটাকে এখন কোথায় খুঁজবে? ভাবতে ভাবতেই দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে সে। তখনি মনে পড়ছে রাগিনীর করা বোকামির কথা। সেই মূহুর্তেই যেন মাথার রগ ফুলে ফুলে যাচ্ছে। অন্যদিকে রয়েছে আরেক চিন্তা! রায়ানকে অনেক বেছে বেছে গিফট পাঠিয়েছে সে প্রতিবারের মতো। রায়ানের পছন্দের ব্র্যান্ডের ঘড়ি এবং স্নিকারস্। ছেলেটা স্নিকারস্ পড়তে অসম্ভব পছন্দ করে! কে জানে আজকের উপহার তার ভালো লাগবে কিনা! সব মিলিয়ে মাথাটা কেমন যেন ঝিম ধরে আছে তার। হুট করেই কানে খটখট আওয়াজ আসায় সে প্রথমে পাত্তা না দিলেও পরক্ষণেই মেহরাজের হাঁকাহাঁকি করা কণ্ঠে চোখমুখ জড়িয়ে পা নিচে নামিয়ে সোজা হয়ে বসে কোহিনূর। রাগিনীকে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করতে দেখে এবং পেছন পেছন মেহরাজকে আসতে দেখে বাকি রইল না বিষয়টা বুঝতে।

“ম্যাডাম, স্যার আমার আস্ত রাখবেন না। ভেতরে যাবেন না প্লিজ!”

মেহরাজের কথায় রাগিনী তেজী গলায় স্পষ্ট বলে,
“আর যদি আমাকে যেতে না দেওয়া হয় তবে আমি আপনার আস্ত রাখব না!”

মেহরাজ এবার অসহায় পানে তাকায় কোহিনূরের দিকে। আর বলে,
“স্যার, রিকুয়েষ্ট করছি আমাকে সন্ন্যাসী জীবনে পাঠিয়ে দিন। এসব আস্ত রাখারাখির মাঝে আমি নেই।”

কোহিনূর এবার রা/গ ঝেড়ে বলে,
“কী এমন সিক্রেট টিমের মেম্বার হয়েছ মেহরাজ? যে সামান্য একটা মেয়েকে আটকাতে পারে না।”

মেহরাজ কিছু বলতে চায় আবারও। কিন্তু রাগিনী কোহিনূরের টেবিলে থা/বা মে/রে বলে,
“মি. মেহরাজের অন্য যেকোনো মেয়েকে আটকানোর ক্ষমতা আছে তবে কোহিনূরের রাগিনীকে আটকানোর ক্ষমতা নেই।”

মেহরাজ না চাইতেও দাঁত বের করে হাসে এবার। তার হাসিটাই যেন আগুনে ঘি ঢালা হয়ে দাঁড়ায়। চোখ রাঙিয়ে ইশারায় তাকে বাহিরে যেতে বলে কোহিনূর। মেহরাজও তৎক্ষনাৎ প্রস্থান নেয়। কোহিনূর একবারও রাগিনীর দিকে তাকালও না। তার আগেই জিজ্ঞেস করল,
“হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে আমার কাছে আসার কারণ?”

রাগিনীর মনটা সাথে সাথে খা/রাপ হলো। উজ্জ্বল মুখটা কেন যেন নিভে গেল। আজ সে কোহিনূরের পছন্দের বেগুনি রঙের জর্জেট শাড়ি পড়েছে। বাঁকা করে বেণি করল এবং ফাঁকে ফাঁকে কাঠগোলাপ গুঁজেছে। যদিও তা আসল নয়। খুব যত্ন করে যখন প্রিয় মানুষটির জন্য সাজা হয় তখনও যদি সে মুখ ফিরিয়ে না তাকায় তখন হৃদয়টা যেন দ/গ্ধ হতে থাকে। তবুও নিজের দুঃখটা লুকিয়ে সে বলল,
“আপনার কাছে আসার জন্য কোনো কারণ, কোনো ছুতো আমার দরকার হয় না, কোহিনূর সাহেব। আপনার কাছে আমি অকারণেই ছুটে এসেছি বারবার। আর ভবিষ্যতেও ছুটে আসব।”

কোহিনূরের জবান এবার বন্ধ হলো। এভাবেও কাউকে চুপ করিয়ে দেওয়া যায় বুঝি? গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের শক্ত রূপটা ধরে রাখার চেষ্টা করল সে। তবুও কেন যেন সক্ষম হলো না। রাগিনী হালকা নিচু হয়ে বলল,
“আমার সঙ্গে এখনি আপনি বের হবেন।”

কোহিনূর এবার আঁড়চোখে তার রাগের রানির দিকে দেখে। তার ঘন চুলে বিনুনির ফাঁকে সেই কাঠগোলাপ! এ যেন সেই দিনগুলোতে ফিরে যাওয়া! এইতো কয়দিন আগেই মেয়েটাকে এভাবেই প্রথম দেখে জীবন্ত কাঠগোলাপ নাম রেখেছিল সে! সে-কী স্নিগ্ধতা মেয়েটির ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে। সঙ্গে সঙ্গেই নিজের অভিব্যক্তি সামলে বলল,
“কেন কী দরকার?”

“উফফ…কথায় কথায় প্রশ্ন করবেন না। আমার দরকার আছে তাই আপনাকে বের হতে হবে আমার সঙ্গে।”

“আমার সঙ্গেই কেন? অন্যকেউ কি ছিল না?”

রাগিনী জেদ ধরেই বলে,
“অন্য কাউকে নিতে চাইলে আপনাকে নিতে আসব কেন? আপনি উঠুন চেয়ার থেকে।”

কোহিনূরের প্রতিত্তোরের অপেক্ষা আর করল না রাগিনী। সে এগিয়ে এসে কোহিনূরের হাত ধরে টেনে উঠিয়ে দাঁড় করাল। তার হাতটা চেপে ধরলে প্রথমে কোহিনূর ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও পরক্ষণে রাগিনীর সঙ্গে পেরে উঠল না। অগত্যা রাগিনীর সঙ্গেই বের হলো সে।

অনেকদিন পর মাকে কাছে পেয়ে একপ্রকার দিশেহারা রায়ান। ঘরে দুজন একা একা কিছু কথা বলছে। ড্রয়িংরুমে একাই টেবিল সাজাচ্ছে নয়নতাঁরা। চোখেমুখে উচ্ছ্বাস স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে। কখনো বা দৃশ্যমান হচ্ছে গালে লাজুক ভাব। চোখটা মিটমিটিয়ে বন্ধ করছে আবার খুলছে। তার হরেক রকমের প্রতিক্রিয়া দেখে সে নিজেও বুঝতে পারছে না আসলে কোন অনুভূতি আগে প্রকাশ করা উচিত! খুশি ধরছে না ফোনে আসা এক মেসেজ পাওয়ার পর থেকে। অপরদিকে রায়ানের মা মিসেস. রমিলার বলা কথাগুলো কানে যখন বারবার ভেসে আসছে তখন লজ্জায় লজ্জাবতী হয়ে পড়ছে। তিনি তার ছেলের জন্য আগের থেকেই নয়নকে বেছে রেখেছেন ভাবলেই মুখশ্রী নিমজ্জিত হচ্ছে। সব বাদ দিয়ে এবার কানে এলো আরেকবার কলিংবেলের আওয়াজ। বিরক্তি নিয়ে দরজার পানে তাকাল সে। এই নিয়ে তিনবার দরজা খুলতে হবে তাকে। ইচ্ছে করছে না। তবে না গিয়েও উপায় নেই। বাড়ির একজন সহকারী কর্মী খুলতে চাইলে নয়নতাঁরাই মানা করে নিজে দরজা খোলে। একজন ডেলিভারি ম্যানকে দেখতে পায় এবার। সেই সঙ্গে তার হাতে থাকা দুটো গিফটের কাগজ দিয়ে মোড়ানো পার্সেলও দেখতে পায়।
“এটা কি সিকান্দার বাড়ি?”

ডেলিভারিম্যানের কথার সাথে সম্মতি জানাতেই লোকটি তাড়াহুড়ো করে বলেন,
“রায়ান সিকান্দারের নামে পার্সেল এসেছে।”

নয়নতাঁরার চোখ যায় এবার পার্সেলের ওপরে থাকা একটা ছোট্ট চিরকুটের দিকে। লেখার ধরণটা বেশ চেনা। ছোটো অক্ষরে লেখা, ‘হ্যাপি বার্থডে, রায়ান সিকান্দার। এই অচেনা উপহারদাতা সবসময় আপনাকে প্রিয় উপহার দিতে চায়।’

লেখাটা কার সেটা বুঝে ফেলতে সময় লাগল না এবার নয়নের। সে মৃদু হাসল। পার্সেল গ্রহণ করল। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে মনে মনে একটা পরিকল্পনা এঁটে ফেলল।

গাড়ির ড্রাইভিং সিটে একমনে বসে থেকে গম্ভীর মুখে স্টিয়ারিং-এ ধ্যান দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে কোহিনূর। ঢাকায় তেমন শীত না পড়লেও কুয়াশার দেখা মেলে মাঝে মাঝে। সবটা ঘোলাটে লাগে সন্ধ্যার আগে আগে। এই ব্যস্ত সময়ে তার ফোনের মেসেজ এলে সে গাড়িটা সাইড করে থামায়। আজকাল তাকে সব মেসেজ, কল রিসিভ করতে হয়। বলা যায় না কখন কোন ইম্পরট্যান্ট তথ্য নেওয়া দেওয়ার জন্য ফোন ব্যবহার করতে হয়! আজও ব্যতিক্রম হলো না। গাড়ি থামিয়ে দেওয়ায় আঁড়চোখে তাকাল রাগিনী। এতক্ষণ জানালা দিয়ে বাহিরটা দেখছিল সে। মুখটা তার ভার। তাই সরাসরি কোহিনূরের দিকে তাকানোর বোধটা হলো না। মানুষটা তার সঙ্গে কথা বলছে না, তাকে দেখছে না! এ যেন রোবট! রাগিনী খুব করে চাইছে মানুষটি মন খুলে কথা বলুক আর গতকালকের ঘটনা একে অন্যকে বলে সব মিটিয়ে নেক। কিন্তু রূপা মেয়েটির কথা তুললেই রেগেমেগে আ/গুন হচ্ছে কোহিনূর। মুখের দিকে তাকানোও যাচ্ছে না। তাই রাগিনী নীরব, নিশ্চল।

ফোন পকেট থেকে বের করে স্ক্রিনে ওঠা নামটা দেখে কিছুটা ক্ষীণ বিস্ময় জাগল মনে। ইন্সপেক্টর রায়ান মেসেজ করেছে! ইহা কি এই জন্মে সম্ভব? রায়ানের প্রয়োজন হলে সে শেখরকে দিয়ে মেসেজ পাঠায়, খবর পাঠায়। তবুও কখনো নিজে থেকে কোহিনূরের সঙ্গে যোগাযোগ করেনা। আজ যেন সম্পূর্ণ বিপরীতটাই ঘটছে। মেসেজটা ওপেন করে আরো একদফা চমকায় সে। গলা শুকিয়ে আসে।
‘উপহার পাঠিয়ে নিজেকে মহান ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার সেটাই হবে যখন আমি আমার পুরোনো বন্ধুত্বকে ফিরে পাবো। এই উপহারটার জন্য রায়ান সিকান্দার আজ অপেক্ষায় রইল।’

কোহিনূর স্তব্ধ, বিমূূঢ় হলো। চোখটা ঝলকানি দিয়ে উঠল। সে বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের নেত্রপল্লবকে। মেসেজটা আদেও রায়ানের নম্বর থেকে এসেছে কিনা বারবার চেক করে নিলো। গলার স্বর আঁটকে এলো! এ এক আবেগপ্রবণ অনুভূতি! ভাষাহীন অনুভব! রাগিনীর কথায় ধ্যান এলো তার। নড়েচড়ে উঠে চেতনায় ভরাট চোখে তাকাল তার প্রেয়সীর পানে। কোথাও একটা উপচে পড়ছে খুশি! এই আনন্দে ইচ্ছে করছে সামনে থাকা এই স্নিগ্ধতায় মোড়ানো মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে খুশি ভাগ করে নিতে। তবে সেটা সে করল না। রাগিনী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“এনিথিং রং?”
কোহিনূর মুখে কিছু না বলে মাথা ঝাঁকাল। ফের গাড়ি স্টার্ট দিলো।

কোহিনূর আরো স্তম্ভিত হলো যখন রাগিনীর বলা রাস্তায় এসে রায়ানের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। এখানেই গাড়ি থামিয়েছে রাগিনী এবং একা একা হুড়মুড়িয়ে নেমে গিয়েছে। আর কোহিনূরের কাছে এসে বলছে,
“কী হলো নামবেন না?”

কোহিনূর এবার ভাঙা গলায় প্রশ্ন করে,
“এখানে কেন?”

“আরে! যেখানে দরকার সেখানে না এসে অন্য কোথায় যাব?”

রাগিনীর স্পষ্ট উত্তর। কোহিনূর বলল,
“কী দরকার এখানে?”

“ওহ হো! আপনাকে মনে হচ্ছে ছেলেধরার হাতে তুলে দিতে এসেছি এমন হাবভাব করছেন। নামলেই তো হয়।”

গাড়ি থেকে নামতে নামতে কোহিনূরের কাছে কিছুটা পরিষ্কার হয় ব্যাপারটা। সে সন্দেহ করে প্রথমেই নয়নতাঁরাকে। সেই সঙ্গে রাগিনীকে। এরা আসলে কী পরিকল্পনা করেছে? জানতে হলে রাগিনীর সাথে যেতে হবে।

নয়নতাঁরাকে পাশে বসিয়ে রাজ্যের গল্প করছেন মিসেস. রমিলা। অন্যপাশের সোফায় একমনে বসে রায়ানও সেসব শুনছে। মিসেস. রমিলার গল্পের বিষয়বস্তু হচ্ছে রায়ান, কোহিনূর এবং নয়নের ছোটোবেলা। কথায় কথায় নয়নতাঁরা শব্দ করে হাসছে। তার হাসি ছন্দিত হয়ে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। গল্পটার চেয়ে যেন সেই আকর্ষণীয় হাসিতেই বেশ কান রায়ানের। কথার ফাঁকে এবার মিসেস. রমিলা বলে দিলেন,
“ছোটোবেলায় রায়ান কিন্তু কোহিনূরের সঙ্গে দেখা করতে না গেলেও তোমার সাথে প্রতিদিন দেখা করতে যেত। এই ছেলেটা যে তাঁরা, তাঁরা করে আমাদের কত পাগল করেছে সেটা আমরাই জানি। আর কী বলত জানো? বলত, ‘মা, আমি এই ছোট্ট তাঁরাকে আকাশের সবথেকে সুন্দর তাঁরা বানিয়ে রাখব।’ আর আমরা হেঁসে কুটিকুটি হয়ে যেতাম ছেলেটার কথা শুনে।”

কথাগুলো নয়নতাঁরা শুনে নিজেই থতমত খেয়ে রায়ানের দিকে আঁড়চোখে তাকাল। রায়ান যেন পারে না মাটির নিচে ঢুকে যায়। ছোটোবেলার কথাবার্তা এখন টেনে আনার মানে আছে? কান থেকে যেন গরম ধোঁয়া বর হতে থাকে রায়ানের। মাথা একদম নুইয়ে পড়েছে। এবার সদর দরজার ওপারে কারোর আগমনের আভাস পাওয়ায় মিসেস. রমিলা নিজেই যান দরজার খুলতে। দরজা খুলে গৃহের বাহিরে থাকা সেই প্রশস্ত দেহের অধিকারী এবং লম্বাটে ছেলের মুখটা প্রথমেই ভাসে সামনে। কোহিনূরকে চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয় না মিসেস. রমিলার। রায়ান বেশ কয়েকবার ছবি পাঠিয়েছিল কোহিনূরের। এবার সামনাসামনি দেখে আবেগে আপ্লুত হন তিনি। দেরি না করে জড়িয়ে ধরেন কোহিনূরকে এবং উতলা হয়ে বলেন,
“নির্জন! কতদিন পর চোখের সামনে দেখলাম। কত বড়ো হয়েছ! লম্বায় আমার চেয়েও যেন একহাত বড়ো।”

কোহিনূর আচমকা এমন ব্যবহারে সংকোচ বোধ করলেও পরক্ষণেই শান্তি খুঁজে পায়। ফিরে পায় যেন ছোটোবেলা। সেও একহাতে স্নেহের সঙ্গে মিসেস. রমিলাকে জড়িয়ে বলে,
“আন্টি!”

জড়িয়ে থাকা অবস্থায় এবার মিসেস. রমিলার নজর যায় রাগিনীর দিকে। রাগিনী নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার কাজ এ পর্যন্তই ছিল। নয়নতাঁরা তাকে এতটুকুই করতে বলেছিল! এছাড়া সে কাউকে সেভাবে চেনেও না। তাই সে কিছুটা অস্বস্তিতেও পড়েছে বটে। মিসেস. রমিলা এবার কোহিনূরকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। রাগিনীর থুঁতনিতে হাত দিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে বলেন,
“তুমিও কি রায়ানের মতো কাণ্ড করলে? নাকি সত্যি সত্যিই বিয়ে করে ফেলেছ?”

কোহিনূর উশখুশ করতে শুরু করে। আসলে উত্তরটা কী দেওয়া উচিত সে নিজেও বুঝতে পারছে না। অন্যসময় হলে সময় নষ্ট না করেই উত্তর দিয়ে দিতো এই মেয়েটি তার হবু বউ। কিন্তু এখন সে রে;গে আছে। মনে জে/দ পুষে রেখেছে। এখন এসব স্বীকার করা যাবে না। তবে তাকে তাক লাগিয়ে দিয়ে রাগিনী হাসিমুখে বলে বসল,
“খুব শীঘ্রই বিয়ে হবে আন্টি। আপনার সামনেই বিয়ে হবে।”

“আরে বাহ।”

মিসেস. রমিলা খুশিতে আটখানা! কোহিনূরের কণ্ঠে এবার রায়ান এগিয়ে এলো। সঙ্গে এলো নয়নতাঁরা। নিজের ভাইটাকে দেখেই প্রথমে বিষম খেলো সে। চোরের মতো করে তাকাল। প্রথমেই নয়নকে দেখতেই চোখ গরম করে তাকালে সুড়সুড় করে মিসেস. রমিলার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় নয়ন। এরপর রায়ানকে দেখলেই চোখ নামায় কোহিনূর। কী বলবে ভেবে পায় না। মিসেস. রমিলা কোহিনূর ও রাগিনীকে বাড়িতে নিয়ে এলেন।

তখন কেট কাটার সময়। রায়ান কেক কাটে না কখনো সেভাবে। তাই সে মিসেস. রমিলাকে কেক কাটতে নিয়ে এলো। বলল,
“মা! তুমি আমায় জন্ম দিয়েছ। তাই তোমার উচিত কেক কাটা। আমি তো জাস্ট তোমায় কষ্ট দিয়ে জন্ম নিয়েছি। সো ইউ হ্যাভ টু ডু ইট।”

রায়ানের কথায় সকলে সম্মতি জানাল। মিসেস. রমিলা আর না করলেন না। কেক কেটে নিলেন। রায়ান যেন ফিরেছে ছোটোবেলায়। এভাবে কোহিনূরের পাশে দাঁড়িয়ে কতগুলো বছর জন্মদিন কাটায়নি সে। আজ আনন্দ ধরছে না। বার বার শাড়ি পরিহিত রমনী নয়নতাঁরার দিকে তাকাচ্ছে। এর সবটা করেছে নয়ন নিজে সেটা সে বেশ বুঝতে পারে। মুচকি হাসে সে। তৎক্ষনাৎ ফিরে যায় ছোটোবেলায়। কোনো খেয়াল না করে কেকের অংশ হাতে তুলে তড়িঘড়ি করে কোহিনূরের গালে মাখিয়ে ফেলে ক্রিম। অতঃপর নিজেই বোকা বনে যায় রায়ান! এটা সে কী করল? সে ভুলে গিয়েছে এক মূহুর্তের জন্য এটা তার ছোটোবেলা নয়! ইতস্তত বোধ করে মাথা নিচু করে রায়ান বিনীত সুরে বলে,
“আমি খেয়াল করিনি। সরি অফিসার নি…”

বাকিটা আর বলা হলো না। কেউ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। নির্জনের দুটো শক্ত বাহুর বন্ধন বেশ উপলব্ধি করতে পারল রায়ান। ছেলেটা বেশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ছোটো থেকেই। স্বভাবটা আজও গেল না! রায়ান বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এ কী হচ্ছে? স্বপ্ন নাকি সত্যি? সকলের হাত তালির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। রায়ানের মাথা ঘুরছে। চোখে অস্পষ্ট দেখছে। ভরাট হয়েছে অশ্রু। সেও এবার হাত তুলে কোহিনূরের পিঠে হাত রাখল। আসল বন্ধুত্ব ছিন্ন হতে পারে না। হৃদয়ে থাকে, মস্তিস্কে থাকে, স্মৃতিতে থাকে!

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here