গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে দ্বিতীয় খন্ড (পর্ব ১৪)

0
444

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৪ (২য় খণ্ড)

প্রায় একঘণ্টা ধরেই চুপ নীরব এবং নিশ্চেষ্ট অভিরূপ। গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে বলে অনেকক্ষণ আগে ঘরের দরজা আঁটকে দিয়েছিল ঠিকই তবে এখনো মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারেনি সে। রূপা এবার তার চুপ থাকাটাকে নিতে পারছে না। উশখুশ করে বলেছে মাঝে মাঝে বিরতি নিয়ে। এবার তাকে বিস্ময়ে ফে/লে দিয়ে থমথমে সুরে অভিরূপ প্রশ্ন করে,
“কিছু বলতে চাও?”

রূপা অতি সল্প সময় চুপ থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“আমি তো কিছু বলতে চাইনি। আপনি কিছু বলতে চাইছিলেন।”

“ওহ হ্যাঁ। বাট কীভাবে বলব?”

অন্যদিকে ফিরে বসে অভিরূপ। মাথা নিচু করে নিজের অযত্নে বড়ো হওয়া চুলগুলোকে চেপে ধরে দুহাতে। এই শখের চুল নিয়ে আগে সারাদিন পড়ে থাকত অভিরূপ। হালকা বড়ো বড়ো এই চুলে সামান্য ডার্ক কালার করার ফলে যেই ঝিলিক দেখা যেত তা সময়ের সাথে মুছে গিয়েছে। তার মুখচ্ছবিতে যেই সুন্দর জৌলুসে মেতে থাকতে পছন্দ করত তার অনুরাগীরা সেই জৌলুস কোথাও যেন নিখোঁজ হয়েছে। রূপা মানুষটিকে অবলোকন করে দেখতে পেল স্পষ্ট পরিবর্তন। এমন আচরণে কিছুটা উদ্বিগ্ন নিয়ে রূপা বলল,
“আপনি ঠিক আছেন?”

“হু। পালিয়ে যাবে?”

অভিরূপের ভেজা কণ্ঠে এমন কথায় বাকহারা হলো রূপাঞ্জনা। গলায় কণ্ঠস্বর যেন মিইয়ে পড়েছে তখনই। কাঁপা কাঁপা সুরে পাল্টা প্রশ্ন করল,
“কী বলছেন?”

অভিরূপ এবার উঠে দাঁড়াল। রূপার সংলগ্নে গেল ধীর পায়ে। রূপার এবার ভয় ভয় করছে। হাজার হোক তার নারী মন! দুরুদুরু বুকে উঠে দাঁড়ানোর জন্য উদ্যত হতেই তার সামনাসামনি এলোমেলো হয়ে দুই হাঁটু গেঁড়েই ফ্লোরে বসে গেল অভিরূপ। নিজের দুহাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগল,
“আমি আর পারছি না রূপা। সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে। নয়ত আমি এভাবে ধীরে ধীরে তীব্র য/ন্ত্ণায় মৃ/ত্যু পানে লুটিয়ে পড়ব। অনেক ভেবেছি। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেছি। নিজেকে বুঝিয়েছি। আশ্বস্ত করেছি নিজেকে এই বলে যে, তুমি ব্যতীত আমার সামনে আরো ভালো কিছু আছে। কিন্তু পরবর্তীতে বুঝলাম আমার এত ভালো কিছু চাই না। এই বহুরূপীকেই চাই। তার নকল চেহারা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি তোমায় নিয়ে বাঁচতে পারলেই সবথেকে ভালো থাকব।”

রূপা এবার বিস্ময়ের সর্ব সীমানায় পৌঁছায়। মাথাটা ভনভন করতে থাকে। সামনের এই মানুষটির কথাগুলো তীব্র আকারে জলোচ্ছ্বাসের রূপ নিয়ে ভিজিয়ে দেয় সেই র/ক্তা’ক্ত হৃদয়। রুক্ষ ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপতে থাকে। বিভ্রান্ত হয়ে শুধাতে চাইল,
“আপনি আমাকে… ”

“আমি তোমাকে ভালোবাসি রূপা। সেই প্রথম দিন থেকে। ওই সাহসী রূপটাকে আমি ভীষণ ভালোবেসেছি। সবসময় চেয়েছি। রাগিনীকে কখনোই ভালোবাসিনি। কোনোকালেই নয়।”

একটু থামল অভিরূপ। ঢক গিলে গলা ভিজিয়ে বলল,
“আমি সব শুনেছি তোমার আর রাগিনীর কথোপকথন। তুমি পালিয়ে এসেছ। তুমিও বাঁচতে চাও। আমিও বাঁচতে চাই। চলো না পালিয়ে যায়! দরকার নেই আমার বিলাসিতা। আমার তোমায় নিজের সবচেয়ে বড়ো বিলাসিতা বানাতে চাই রূপাঞ্জনা!”

রূপা বাকরুদ্ধ। মূর্তির ন্যায় বসে রইল বিছানায়। নড়াচড়া বন্ধ হলো তার। সামনের মানুষটার এই প্রতিক্রিয়া তার মস্তিষ্ক নিতে পারছে না। ভাবনাচিন্তা ব্যতীত সে বলল,
“আমি একা পালাতে চেয়েছি। আপনি কেন পালাবেন আমার সঙ্গে? আপনার পরিবার আছে, ক্যারিয়ার আছে। আপনাকে এসব মানায় না।”

“আই ডোন্ট কেয়ার।”

“বাট আই কেয়ার। আমি একবারও বলিনি আপনার সঙ্গে পালাব।”

অভিরূপ এবার মাথা উঠিয়ে তাকায় রূপার চোখের দিকে। শীতল গলায় প্রশ্ন করে,
“আমায় ভালোবাসতে পারবে না?”

“ভালোবাসা কী আমি জানি না। এই শব্দটা আমি বুঝিনা। আমার জটিল লাগে। আমি ভালোবাসতে পারি না।”

রূপার স্পষ্ট উত্তর। অভিরূপের মাঝে ভাবান্তর দেখা গেল না। সে খপ করে রূপার হাত ধরে বসল।
“আমি শিখিয়ে দেব। ভালোবাসা সরল অংকের মতো। যেটা বাহিরে থেকে ভীষণ জটিল লাগে। কিন্তু একবার বুঝে উঠতে পারলে তার চেয়ে সহজ এবং সুখকর জিনিস আর একটাও পাওয়া যায় না।”

রূপাঞ্জনা মৃদু কেঁপে উঠল। এই স্পর্শে তার প্রতিটা লোম শিউরে তোলে। লোমহর্ষক নয়, এ যেন মাতিয়ে তোলা এক প্রয়াসমূলক ছোঁয়া!

আশেপাশে চোরের মতো তাকিয়ে দ্রুত টিফিনবক্সে খাবার তুলল সৈয়দ। চোখ তুলে বাহিরের হলরুমে উঁকি মে/রে দেখল আরেকবার। কেউ না থাকায় বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড়ো বড়ো ধাপ ফেলে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো সদর দরজার কাছে। দরজা খুলে বাহিরে পা রাখতেই উপস্থিত হলেন স্বয়ং রাশেদ সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে হকচকিয়ে উঠল সৈয়দ। অস্ফুটস্বরে বলল,
“স্যার আপনি!”

রাশেদ সাহেব আগে পরখ করে নিলেন সৈয়দকে। এই বিকেলবেলা বাড়ির বাহিরে টিফিনবক্স সহিত সৈয়দকে দেখে খটকা লাগতে শুরু করল উনার। সন্দিহান হয়ে বললেন,
“ভয় পেলে নাকি?”

“না, স্যার। ভয় পাব ক্যান? আপনার সাথে আমার ভয় পাওয়ার সম্পর্ক? আপনি তো রাতের আগে বাসায় আসেন না তাই একটু চমকাইছিলাম।”

“অভিরূপের বাবা নাদিম ফোন করে ডাকল আমায়। কী যেন কাজ আছে দেশে। ফিরতে হবে তাদের। তাই চলে এলাম। তুমি কোথায় যাচ্ছো এভাবে হাতে টিফিন বক্স নিয়ে?”

সৈয়দ আমতাআমতা করতে শুরু করে এবার। মিহি সুরে বলে,
“আমার মাইয়াডা একটু বিরিয়ানি খাইতে চাইছিল স্যার। আমার তো বিরিয়ানি চাল কেনার টাকাপয়সা থাকে না সবসময়। আজকে তো এখানে বিরিয়ানি রান্না হইছিল ওখান থেকে একটু বেঁচে গেছিল। তাই ভাবলাম…”

শেষ কথাগুলোতে বোঝা গেল দুঃখের রেশ। রাশেদ সাহেব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন,
“ব্যাপার না। কিন্তু তুমি যদি একটু টিফিনবক্স খুলে দেখাতে!”

ফ্যালফ্যাল করে এবার চেয়ে রইল সৈয়দ। প্রথমে অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিলো পরক্ষণেই। বিগত কয়েকদিন যাবত রাশেদ সাহেব অতিরিক্ত সন্দেহ করা শুরু করেছেন। কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। সৈয়দ ভেতরে এলো। পিছুপিছু রাশেদ সাহেব ঢুকলে হলরুমের টেবিলে টিফিনবক্স খুলে দেখাল সৈয়দ। সব ঠিকঠাক দেখে স্বস্তি পেলে রাশেদ সাহেব। সৈয়দের কাঁধে হাত রেখে নম্র গলায় বললেন,
“কিছু মনে করো না। আমি জানি তুমি সবচেয়ে পুরোনো সদস্য এই বাড়ির। তবুও মনটা অস্থির অস্থির করে। এমনিতে আমার মেয়েটার উপর বি/পদ ঝুলছে বোঝোই তো!”

“আপনার বিশ্বাস কোনোদিনও ভাঙবে না স্যার। ভরসা রাইখেন।”

“ভরসা আছে বলেই সব জানো তুমি। তাড়াতাড়ি যাও। আর… ”

পুরো কথাটা না বলে নিজের মানিব্যাগ বের করে পাঁচশ টাকার নোট নিয়ে সেটা সৈয়দের হাতে ধরিয়ে বলে,
“তোমার মেয়ের জন্য আমার পক্ষ থেকে।”

সৈয়দ নিতে চাইল না। কিন্তু সফল হলো না। রাশেদ সাহেব তাকে টাকা ধরিয়ে ছাড়লেন। খুশিমনে বাড়ি থেকে বের হলো সে।

সদ্য রিওকে গোসল করিয়ো তাকে টাওয়ালে জড়িয়ে নিয়ে পেরিয়ে গার্ডেনে যাচ্ছিল রাগিনী। রিও গোসল করে গায়ের লোমগুলো চুপসে ফেলেছে। অবশ্য সে গোসল করতে চায়না। গরম পানিতেও বেশ জোর করেই গোসল করাতে হয় তাকে। রাগিনী যেন একটা যু/দ্ধ জয় করে ফেলেছে গোসল করিয়ে। এখন গার্ডেনে যাচ্ছে তাকে নিয়ে খেলতে। এতে রোদে গা শুকিয়ে যাবে। এই অসময় গোসল করানোর কোনো ইচ্ছে ছিল না তার। তবে রিও দু/ষ্টুমি করে বিছানার নিচে গিয়ে শরীর ময়লা করে ফেলেছে। রাগিনী বড়ো বড়ো শ্বাস নিতে নিতে বলে,
“আজকাল তুমি প্রচন্ড দু/ষ্টু হয়েছ রিও। কোহিনূর ঠিকই বলে তুমি দেখতে ইনোসেন্ট হলেও একটু মিটমিটে দু/ষ্টু।”

রিও যেন বুঝেই নিলো রাগিনীর কথা। জোরে জোরে মিও করে ডেকে উঠল। রাগিনী একগাল হেঁসে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিতেই দরজার ওপাশে কেউ জোরে জোরে কলিংবেল বাজাল। হকচকিয়ে উঠলেও নিজের অভিব্যক্তি সামলে একহাতে দরজা খুলে দিলো রাগিনী। সঙ্গে সঙ্গেই হতবাক হলো সে। পুলিশের ইউনিফর্ম পড়া পুরো টিমকে দেখে চক্ষু চড়কগাছ হলো পরক্ষণেই। দুজন মহিলা কনস্টেবল আর দুজন পুরুষ কনস্টেবল রয়েছে। সামনে রয়েছে ইন্সপেক্টর রায়ান। গলা শুঁকিয়ে এলো রাগিনীর। ক্ষীণ সুরে বলে উঠল,
“আপনারা?”

“রাগিনী তাজরীন?”

“জি, হ্যাঁ।”

“বাড়িতে আর কে কে আছে?”

রায়ানের সোজাসাপটা প্রশ্নে ভড়কাল রাগিনী। ধীর পায়ে তখনই ঠিক সময়ে নেমে এলেন রাশেদ সাহেব। সিঁড়ি থেকেই জোর গলায় রাগিনীকে ডেকে বললেন,
“কে এসেছে রাগিনী?”

রাগিনী কিছু বলার সুযোগই পেল না। রাশেদ সাহেব চলে এলেন দরজার কাছে। পুলিশ দেখে অবাক হলেন তিনিও। বিস্ময় নিয়ে কিছু বলার আগেই রায়ান স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলো,
“স্যার, আমাদের কাছে এভিডেন্স আছে যে আপনার বাড়িতে এখনকার সবচেয়ে বড়ো ক্রি/মিনা/ল আপনার মেয়ের মতোই দেখতে সেই বহুরূপী মেয়েটি অবস্থান করছে। একারণেই আমরা সার্চ করেছি। অ্যান্ড সি, আমাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্টও আছে।”

রায়ান নিজের হাতে থাকা ওয়ারেন্ট দেখিয়ে আবারও বলে,
“আশা করছি আপনারা এই বিষয়ে কোওপারেট করবেন।”

রাশেদ সাহেব বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েই রইলেন। কিছু বলার সুযোগ বা ভাষা কিছুই পেলেন না। যেন উনার জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পেয়েছে। যখন উনি উপলব্ধি করলেন ততক্ষণে রায়ান সহ সমস্ত কনস্টেবল বাড়িতে প্রবেশ করে ফেলেছে। রাগিনীর হাত থেকেও যেন অল্প সময়েই সবটা বেরিয়ে গিয়েছে। কোনো কিছু বলে আটকানোর সময় বিন্দুমাত্র পেল না। তার মাথায় শুধু ঘুরতে থাকল এই বিষয়টা পুলিশ কী করে জানল? কার মাধ্যমে জানল? বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর অবিন্যস্তভাবে সোফার কাছে গিয়ে বি;ক্ষিপ্তভাবে বসে পড়লেন রাশেদ সাহেব। টেবিলে হাতের কনুই রেখে কপালে হাত দিয়ে আফসোসের সঙ্গে বিড়বিড় করতে লাগলেন,
“এটা কী হচ্ছে আমার বাড়িতে?”

রাগিনী নিশ্চুপ। এই হালকা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় সে দরদর করে ঘেমে চলেছে। কী হতে চলেছে পরবর্তী অবস্থা তা ভেবেই অন্তরটা শুঁকিয়ে কাঠ। রিওকে নামিয়ে দিতেই নোমান বেশ বিরক্ত হয়ে উপস্থিত হলো। জিজ্ঞেস করল,
“কী হচ্ছে? বাড়িতে পুলিশ কেন আঙ্কেল?”

রাশেদ সাহেব কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। রাগিনী কোনদিকটা সামলাবে বুঝে উঠতে পারল না। সে নোমানের কথার জবাব না দিয়ে একপ্রকার ছুটেই গেল অভিরূপের ঘরের দিকে। কাঙ্ক্ষিত ঘরে দ্রুত ছুটে যাবার পর ভিড়িয়ে রাখা দরজা ঠেলে প্রবেশ করতেই দুটো মহিলা কনস্টেবলকে চোখে পড়ল তার। স্থির হয়ে দাঁড়াল সে। তবে অস্থির লোচন দুটো একাধারে খুঁজে বেড়ালো তার মতোই দেখতে হুবহু সেই মেয়েটিকে। পেল না কোথাও! আরেক দফা চমক খেল। কোনোভাবে, কোনোখানে কি মেয়েটি লুকিয়ে রয়েছে কোথাও? এসব ভাবনার অন্ত ঘটিয়ে দিলো এক কনস্টেবলের প্রশ্ন।
“ম্যাম, কিছু বলতে চান?”

থতমত খেলো রাগিনী। হালকা কেশে নিজের অসঙ্কোচ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় বলল,
“না মানে দেখতে এসেছিলাম একটু।”

রাগিনী আঁড়চোখে তাকাল ওয়াশরুমের দিকে। অন্য কনস্টেবল সেদিকেই গিয়েছে চেক করতে। সর্বাঙ্গে তড়িৎ খেলে গেল রাগিনীর। কী বলে আটকাবে সেটা খুঁজে পেতে না পেতেই ততক্ষণে কনস্টেবল ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েছে। এই যেন মেয়েটা ধরা পড়ে যায়! কিন্তু রাগিনী ভুল প্রমাণিত হলো। ঘটল বিপরীতটা ঘটনা। ওয়াশরুম থেকেই সেই মহিলা জোরে বলল,
“আরে! ওয়াশরুমের উপরে থাকা কাঁচ তো ভাঙা। মনে হচ্ছে এদিক দিয়েই কেউ পালিয়েছে।”

আরেকজন কনস্টেবলও গিয়ে দেখল তা। নিশ্চিত হয়ে তারা দুজনেই ছুটল রায়ানের কাছে। রাগিনী ঠাঁই দাঁড়িয়েই রইল। বড়ো বড়ো কয়েকবার শ্বাস নিয়ে সেও দেখতে গেল আসলেই ব্যাপারটা সত্যি কিনা! ওয়াশরুমে ঢুকে প্রথমেই নজরে পড়ল ভাঙা সেই ছোট্ট জানালার মতো অংশ। সেখান থেকে একটু উঁচু হয়ে উঁকি দিলে দেখা যাচ্ছে নিচে সমস্ত কাঁচ পড়ে রয়েছে। তবে কি রূপাঞ্জনা পালিয়ে গিয়েছে? এই ওয়াশরুম থেকেই পালিয়েছে? অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা, তারা অনেককিছুই করার ক্ষমতা রাখে। যদি সে পালিয়ে গিয়ে থাকে অখুশি হবেনা রাগিনী।

হলরুমে রাগিনী ফিরে দেখল রাশেদ সাহেব একই ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন। নোমানও বেজার হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একইভাবে। অভিরূপকে দেখে উৎসুক চোখে তাকায় সে। সদ্য শাওয়ার সেরে বেরিয়েছে লোকটা। তাদের দুজনের চোখাচোখি হতেই রাগিনী মাথা ঝাঁকিয়ে না জানাল। অভিরূপ তার মানে বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকায়। রাগিনী আর সেদিকে খেয়াল করে না। ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার বাবাকে নিয়ে। কাঁচের জগ থেকে পানি গ্লাসে নিয়ে এগিয়ে দেয় রাশেদ সাহেবের দিকে। মৃদু গলায় বলে,
“বাবা, টেনশন করো না প্লিজ! শরীর খারাপ করবে তোমার।”

“আমি তো বুঝতেই না পারছি না কোথা থেকে কী হচ্ছে।”

চিন্তিত হয়ে কথাটি বলে দিলেন রাশেদ সাহেব। হাতে গ্লাস নিতেও হাত কাঁপছে উনার। রাগিনী না পেরে পানি পান করিয়ে দিলো উনাকে। বেশি পানিও পান করতে পারলেন না উনি। যেন গলায় পানিও আঁটকে যাচ্ছে। কর্ণকুহরে কারোর পায়ের তীব্র শব্দে ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকা রাগিনীর ধ্যান ফিরলে দরজার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। নিজের বাড়ির সদর দরজাটিকে কালো রঙের কোট পরিহিত নিজের প্রিয় মুখটি দেখে যেন অঙ্গ, মস্তিষ্ক সকল কার্যক্রম বন্ধ করে। সবেই স্বাভাবিক হতে থাকা হৃৎস্পন্দনের বেগ অস্বাভাবিক হতে শুরু করে।

কোহিনূর একজায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে কিছুটা সময় রাগিনীকে পরখ করে। মেয়েটার দিকে তার প্রশ্ন ছুঁড়তে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে না তার এই নির্মলতায় ভরা চেহারায় বিষাদ দেখতে। কিন্তু পরিস্থিতির সামনে সে ব্যর্থ। সে আসতে চায়নি। তার আসার কথা নয়। সে শুধুমাত্র এসেছে রাগিনীকে নিজে প্রশ্ন করবে বলে! দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ভেতরে এলো কোহিনূর। পিছু পিছু ঢুকল মেহরাজ। রাগিনীর সামনাসামনি দাঁড়াল সে। মেয়েটির মুখটা তখন কৌতূহলে পরিপূর্ণ। সে কিছু একটা বলতেও যাচ্ছিল তার আগেই কোহিনূর প্রশ্ন করে বসল,
“তুমি নিজে জেনেশুনে একটা ক্রি/মি/নালকে আশ্রয় দিয়েছিলে?”

ভাবলেশহীন হলো রাগিনী। এই লোকটিও তবে সবকিছুই জেনে গিয়েছে। কিন্তু অন্যের কাছ থেকে। সেকারণেই তার প্রতিক্রিয়া আজ এমন ভ/য়ানক হবে হয়ত! রাগিনী হ্যাঁ বলবে নাকি না বলবে খুঁজে পেল না। মাথা নিচু হলো সাথে সাথেই। কোহিনূর গাম্ভীর্যের সাথে ফের বলল,
“যা বলার সত্যি সত্যি বলবে!”

রাশেদ সাহেব কোহিনূরকে এমন জেরা করতে দেখে ক্ষি;প্ত হলেন এইবার। দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন,
“আশ্চর্য! আমার মেয়েকে কেন দো/ষারোপ করা হচ্ছে।”

“স্যার, আপনার মেয়ে সেটা খুব ভালো করে জানে। আমি কেন ওকে প্রশ্ন করছি।”

রাগিনী এবার বুকে সাহস নিয়ে মিনমিন করে বলে দিলো,
“হ্যাঁ। রূপা মানে আমার মতো দেখতে ওই মেয়েটার বাড়ি থাকায় সম্পূর্ণ সম্মতি আমার ছিল। আমি পুরো বিষয়টা জানতাম। আমি লুকিয়ে গিয়েছি।”

রায়ান উপস্থিত ছিল সেখানে। তার অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করল তবে সে নীরবই রইল কারণ সে জানে এটা কোহিনূর এবং রাগিনীর মাঝখানের কথাবার্তা। তার মাঝে কথা বলাটা ভালো দেখায় না। অপরদিকে রাগিনী অনেক ভেবে বের করে ফেলেছে এই খবরটা দেওয়ার একমাত্র বাহক ছিল নয়নতাঁরা। রাশেদ সাহেব যেন বিস্ময়ের সর্ব সীমানায়। তার মেয়ে এসবকিছু এই বাড়িতে থেকে করছে তিনি জানতেও পারলেন না। নিঃশ্বাস নিতে ক/ষ্ট হলো এবার। রাগিনী কোহিনূরের দৃষ্টি দেখে ভড়কালো এবার। এই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন বুঝিয়ে দিলো সে কত বড়ো অ/ন্যায় করে ফেলেছে। সে আগ বাড়িয়ে বলতে চাইল,
“কিন্তু তার পেছনেও কারণ আছে আমি…”

“তুমি কি জানো? একজন ক্রি/মিনালকে সাহায্য করার কারণে তোমায় এই মূহুর্তে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে আমরা পুলিশ কাস্টারিতে রাখতে পারি?”

ঢক গিলল রাগিনী। কোহিনূর এসব কথা বলবে তার ভাবনাতেও আসেনি কখনো। মুখটা বিবর্ণ হয়েছে তার। চোখ ফে/টে কান্না আসতে চাইছে। তবুও সে মুখ তুলছে না। মাথা নুইয়ে রয়েছে। অভিরূপ এবার চুপ থাকতে পারল না। তার কারণে রাগিনীর এত কথা শোনা মানতে পারল না। ফট করেই বলে দিলো,
“সি ইজ ইনোসেন্ট। আমি ওকে জোর করেছিলাম বিষয়টা কাউকে না জানাতে। সে বাধ্য হয়ে গোপন রেখেছে।”

কোহিনূর এবার নিজের দৃঢ় নজর রাখল অভিরূপের দিকে। ঘাড় বাঁকিয়ে বলল,
“আই নো দ্যাট। আপনাকে আলাদা করে জানাতে হবে না। আপনারা চরম ভুল করেছেন। আপনাকে এসব মানায় না মি. অভিরূপ!”

“পানিশমেন্ট দিলে দিতে পারেন।”

অভিরূপের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি! কোহিনূর মাথা ঝাঁকাল। রাগিনীর দিকে তাকাল। মেয়েটা কী করে বসল সেটাই সে ভেবে উঠতে পারছে না। এতক্ষণ সে বারবার এই ভেবে রাগিনীকে প্রশ্ন করছিল যে সে কোহিনূরকে ভুল প্রমাণ করবে। কিন্তু হলো না। মেয়েটার প্রতি অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় জন্ম নিলো তার। তবে শক্ত গলায় কিছু বলে ওঠার সাহসও জুগিয়ে উঠতে পারল না সে। তবুও বুকে যেন ভারি পাথর রেখে বলল,
“আই ডিড নট এক্সপেক্ট দিস ফ্রম ইউ।”

রাগিনী ছলছল নয়নে তাকাল এবার। অশ্রুসিক্ত তার মায়াবী মুখখানা স্পর্শ করেও যেন ভেদ করে চলে গেল কোহিনূরের হৃদয়। কোহিনূর সত্যিই তার প্রেয়সীর এই বোকামী আশা করেনি। দৃঢ় শ্বাস নিয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকাল সে আর বলল,
“দিস ইজ মাই ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট ওয়ার্নিং। এমনটা যদি পরবর্তীতে হয় আমি এর বিরুদ্ধে যেতে দুইবারও ভাববো না।”

আর বিলম্ব করল না কোহিনূর। দরজার দিকে ফিরে মেহরাজকে বলল,
“চলে এসো মেহরাজ।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here