উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৭
দুপুরের কড়া রোদ। পুরো মাথায় চড়া রোদের উত্তাপ। কাঠফাটা রোদে বাড়ির উঠোনে ধান ঝাড়ছে সেতু। সে মাথায় চওড়া করে ঘোমটা টেনে রেখেছে রোদ থেকে বাঁচার জন্য। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ সে। উত্তপ্ত আত্মা তার। সেই আত্মা যেন এক ফোঁটা পানির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। মছিদা বেগমের হুকুম, কাজ শেষ না হওয়া অবধি এক চুলও নড়তে পারবে না এখান থেকে। এমনকি বাথরুমে যাওয়া বা পানি খাওয়ার জন্যও যেতে পারবে না। যদি নড়ে তাহলে সেতুর কপালে ভাত নেই আজ। মছিদা বেগম আরও পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন, আজ সেতু কাজ শেষ হওয়ার আগে সামান্য বিরতি নিলেই সেতুর ভাগের চালটুকু চুলায় বসবে না। শরীর ঘেমে প্রায় নেয়ে গেছে সেতুর। বাহু তার উত্তপ্ত চুলার ন্যায় গরম। এমতাবস্থায় একজন স্বাভাবিক তাপমাত্রার মানুষ যদি সেতুকে স্পর্শ করে,তাহলে নির্ঘাত তার হাত ঝলসে যাবে। রোদের তাপে মুখ চোখ লাল বর্ণ ধারণ করে নিয়েছে সেতুর। একটু গিয়ে যে পানি খাবে তার উপায় ও নেই। সেতুর ননদ রাবেয়াকে কড়া পাহারায় রেখে মছিদা বেগম ঘুমোতে গিয়েছে। সেতু প্রাণ বাঁচাতে ছায়ায় গিয়ে বসল। বেশ বাধ্য হয়ে না পেরেই বসেছে সে। কিন্তু সে শান্তি করে বসে থাকতে পারলো না। দু দণ্ড বসা মাত্রই রাবেয়া এসে পেছন থেকে সজোরে এক লাথি বসিয়ে দিল। ফলে টাল হারিয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে গিয়ে পরল সেতু।
পরে যাওয়ার সাথে সাথে রাবেয়ার উগ্র কন্ঠ কানে গিয়ে বারি খেল সেতুর।
‘তোর এতো বড় কলিজা কিভাবে হয়? মা তোকে কি বলে গিয়েছিলো মনে নেই?’
‘আপা,আমারে ইকটু জিরাইতে দেন। রুহুখান আমার আর পারতাছে না। হাত পাও যেন আর চলে না। গলা শুকায় মরুভূমি হইয়া গেছে।আমার কাজ বেশি বাকী নাই। আরেকটু আছে। আমি জিরাইয়া বাকী কাজ গুলান সম্পন্ন করতাছি।’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সেতু।
রাবেয়া পানের পিক ফেলে কর্কশ গলায় বলল,
‘মূর্খ মেয়ে! বাংলা ভাষা বুঝিস না? তোকে কাজ শেষ না হওয়া অবধি এক চুলও নড়তে নিষেধ করে গিয়েছে মা। মা যদি এসে দেখে তুই কাজ ফেলে আরাম করছিস তাহলে তোর কি হাল হবে ভেবেছিস একটাবার?’
সেতু দুহাতের তালু একজোট করে বলল, ‘আপনি আম্মারে কিছু কইয়েন না দয়া কইরা। আমার অসহ্য যন্ত্রণা হইতাছিল রোইদের তাপে। তার লাইগ্যাই বেশিক্ষণ টিকতে পারি নাই।’
রাবেয়া দিল আরেকটা লাথি সেতুর পা বরাবর। আরেকটা মারার আগেই সেতু রাবেয়ার পা ধরে থামিয়ে নিল। সে করুণ দৃষ্টি মেলে রাবেয়ার দিকে চাইতেই রাবেয়া থু মেরে মুখে জমানো পানের দলা গুলো ফেলে দিল। তারপর মুখের রাগী ভাবটা আরও স্পষ্ট করে বলল,
‘তোর সাহস দেখে আমি অবাক! নোংরা হাতে আমাকে ধরিস তাও আবার বহ্নির মতো শরীর নিয়ে?’
সেতু রাবেয়ার পা ছেড়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। পরক্ষণেই বলল,
‘আপনারে ইকটু ধরলাম তাতেই আপনে ছ্যাত কইরা উঠলেন। আর আমি যে হেই কহন থেইক্যা কড়া রোইদে দাঁড়াইয়া ধান ঝারতাছি! আমার কেমন লাগতাছিল কইতে পারবেন? আমার শরীরের গরমই আপনি সইতে পারতাছেন না, তাইলে দুই মিনিট রোইদে দাঁড়াইলে আপনার অবস্থাখান একটু কল্পনা কইরা দেহেন তো!’
‘মূর্খের জাত। আমার মুখের উপর কথা। তাও আবার আমার বাপের বাড়িতেই?’
‘বাপের বাড়ি! বাপের বাড়ি পইড়া থাহেন,আর দাপট দেহান বাড়ির বউয়ের উপর? বউয়ের থেইক্যা বাড়ির মাইয়ার অধিকার কি বেশি?’
রাবেয়া গরম চোখে বলল,
‘কি বলতে চাস তুই?’
‘সোজা একখান হিসাব। আমি আমার বাপের বাড়িতে ১ মাস থাকারও যোগ্যতা রাহিনা। আমি ক্যান? কোনো মাইয়াই তার বাপের বাড়িতে চিরকাল থাহার যোগ্যতা রাহেনা। রাহে শুধু বাড়ির বউরা। আমরণ পর্যন্ত একটা মাইয়া তার শ্বশুরবাড়িতে হুকুম চালাইতে পারে। বাপের বাড়িতে না। বাপের বাড়ির কোনো সিদ্ধান্তেই
হেরা জড়িত থাকতে পারে না। পারে শুধুই শ্বশুরবাড়িতে। কারণ হেইডাই তাগো আসল ঘর। শেষ বিদায়ও তাগো হেই বাড়ি থেইক্যাই হইবো। যেমন আপনার মারে ধরেন। সে এই বাড়িতে বিয়ার পর থেইক্যা সব কিছু দেহাশোনা করতাছে। কারণ তার অধিকার আছে। কিন্তু তার বাপের বাড়িতে গিয়া আর সেইডা পারে না। সেইহানে তার হুকুম চালানোর অধিকার নাই। কারণ সেইডা তার সংসার না।’
সেতুর কথাগুলো রাবেয়ার মোটেও পছন্দ হলো না। তার চোখ দিয়ে যেন আগুনের অদৃশ্য আগুনের লাভা ফুটছে। এর কারণ, সেতু কথাগুলো সহজ ভাবে বললেও রাবেয়া তা সহজ ভাবে গ্রহন করেনি। সে হয়তো ভাবছে সেতু তাকে বাপের বাড়ি পড়ে থাকার জন্য মুখের উপর খোটা দিতে কথাগুলো বলেছে।
‘আজ নাহিদ বাড়ি আসুক শুধু। আমাকে অপমান করার বিচার আমি চাইবো ওর কাছে। নাহিদকে আজ এই মূর্খ মেয়েকে তালাক দিতে হবে,নয়তো আমাকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলবে। এই অপমানের বিহিত একটা করতেই হবে আমাকে।’
রাবেয়া কথাগুলো মনে মনে বলল। তারপর সেতুর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে উল্টো ঘুরে চলে গেল। সেতু রাবেয়ার চাহনি দেখেই চটজলদি বুঝে গেল ওই চাহনি কোন সাধারণ চাহনি নয়। এ যেন কোন আগাম ঝড়ের পূর্বাভাস। সেতু বেশ বুঝেছে রাবেয়া আজ গুরুতর কিছু একটা করতে চলেছে। যা সেতুর জন্য কাল হয়ে নেমে আসবে। রাবেয়া বরাবরই সেতুকে মূর্খ বলে অপমান করে। তার কারণ সে উচ্চশিক্ষিতা। আর সেতু কেবল জেএসসি পাস। রাবেয়া ও নুরুল দুজনেই মাস্টার্স পাশ করেছে। তবে নাহিদ স্বল্প শিক্ষিত। এসএসসি তে ফেল করার পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল সে। ব্যবসার কাজে মন যায় তার। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে টাকা কামাতে গিয়ে হাত বড়ো হয়ে যায়। ফলে মাঝপথেই পড়াশোনায় ইতি টানতে হয় তাকে। পড়াশোনা ত্যাগ করার পিছনে আরও একটি প্রধান কারণ বিয়ে। নাহিদ কম বয়সেই বিয়ে করার জন্য উতলা হয়ে ওঠে। যাকে বলে প্রাণপ্রার্থী। মছিদা বেগম নাহিদকে কোনমতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিয়ের বয়স পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। মছিদা বেগমকে তার ছেলে নাহিদকে নিয়ে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। নাহিদ এমন কোন অপকর্ম নেই যে করেনি। পাড়ার মেয়েদের দিকে খারাপ নজরে তাকায় সে। হিসেব ছাড়া মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। তার জন্য অনেক জরিমানা বহন করতে হয়েছে মছিদা বেগমকে। অবশ্য স্বামীর অনেক অর্থ সম্পদ থাকায় গায়ে বাঁধেনি তার। শেষে না পেরে বড়ো ছেলের আগে ছোট ছেলেকে বিয়ে দিতে হয়েছিল তাকে। এখনো নাহিদের স্বভাবে কোন পরিবর্তন আসেনি। স্বভাব চরিত্র খুব বিচিত্র এক গুণ। যা ভালো হলে জীবন সুন্দর। তবে খারাপ হলে সারা জীবন পাপের বোঝা বয়ে যেতে হয়।
***
মিতু আজও নদীর ঘাটে আসেনি। এদিকে সূর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে এলে কাব্য বাড়ি চলে যাবার উদযোগ পাকায়। সে বুঝল আজও তার মিতু দেখা দেবে না। এক নদী সমান বিষাদ কুড়িয়ে চলে যাবার পথে কেউ একজন পেছন থেকে হাঁকতে লাগে, ‘ওই কাব্য, কাব্য!’
কাব্য পেছনে তাকায়। দেখে দূর থেকে তার বন্ধু ফরহাদ নৌকা বাইতে বাইতে কিনারার দিকেই এগিয়ে আসছে। ফরহাদ কিনারার বেশ কাছাকাছি এসে গেলে কাব্য কৌতূহল চোখে শুধায়,
‘কিরে ফরহাদ, তুই নৌকা নিয়ে নামলি যে আজ?’
ফরহাদ নৌকা কিনারায় ঠেকায়৷ তাচ্ছিল্যের হাসিসমেত বলে, ‘জাল ফেলতে আইছি রে। কি করমু আর? তোর মতো আমার আব্বায় তো হেডমাস্টার না, তাই আব্বায় অসুস্থ হইলে আমারেই রুজিরোজগারের ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু তুই আইজ একা ক্যান? তোর সেই ছোট বান্ধবীটা কই?’
কাব্য মুখ অন্ধকার করে বলল, ‘আজ আসেনি সে। এখন আর আসবে বলে মনে হচ্ছে না। এইজন্য ভাবলাম বাড়ি চলে যাব। তুই কখন যাবি?’
ফরহাদ বলল, ‘দেহি কহন যাইতে পারি। একটা কথার উত্তর দেতো বন্ধু।’
‘কি কথা?’
‘তোর বড়ো মাইয়াগো ছাইড়া ওই মিতুর মতো ক্লাস সিক্স পড়ুয়া মেয়েরেই বন্ধু বানাইতে হইলো? মানে হাসুম না কাঁন্দুম ক তো আমারে? এত গাঁধা ক্যান তুই? তুই কি মজা পাস বাচ্চা ওই মাইয়ার লগে কথা কইয়া?’
কাব্য একগাল হাসল। ফরহাদ সেই হাসির কারণ না পেয়ে পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে,
‘না হাইস্যা ক নারে ভাই?’
কাব্য বলল, ‘যার মন যেখানে শান্তি খোঁজে, সে সেখানেই ছুটে যায় এবং যাবেই। সবার চিন্তাভাবনা এক না। আমার ভালো লাগে মিতুর সাথে মিশতে, তাই মিশি। অন্তত চালাকচতুর লোকজনদের মতো অবুঝেরা ছলচাতুরী বোঝেনা। তারা তো নিষ্পাপ, নির্মল বাতাসের মতো। যা হৃদয়ে প্রশান্তি আনে মাত্র। থাক সেসব। তোরা আমাকে বোকা, নির্বোধ ভাবিস, ভাব না! বিশ্বাস কর, এতে আমার কিছুই যায় আসেনা। এমনকি আমাকে পুরো দুনিয়া নির্বোধ ভাবলেও আমি হাসিমুখে মেনে নেব। তবুও মিতুর মতো স্বচ্ছ আলোকে হারাতে পারবো না। কতজনের কত শখ, ইচ্ছা সে গাড়ি কিনবে, প্রচুর টাকা রোজগার করবে। কিন্তু আমার ইচ্ছে খানিক ব্যস্ততা কাটিয়ে একটু একান্ত ভালো থাকা। কারো অনুভূতি কেউ যথাযথভাবে অনুভব করতে পারেনা৷ তাই আর বেশি কিছু বললাম না।’
ফরহাদ বার দুই নিজের কপাল থাপড়ায়। বৈঠা চালিয়ে পুনরায় নৌকা সচল করে বলে, ‘তোর লগে আজাইরা কথা আর না কই। কোন ভূতে যে তোরে লাড়ে! আইচ্ছা আমি যাই, কাইল দেহা হইবো।’
কাব্য ফরহাদের কোনো কথাই গায়ে মাখল না। কাব্য যে মাখতে ইচ্ছুক নয়, সেটা তার ভাবভঙ্গিই জানান দিয়ে দিচ্ছে। ফরহাদ একটা সময় কাব্যর চোখের ত্রিসীমা থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে, কাব্যও নদীর ঘাট ছাড়ল।
চলবে ইনশাআল্লাহ…