গোধূলিলগ্ন 6

0
776

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৬

আবুল কালাম সন্ধ্যার দিকে বারান্দায় বসে তার কাজের জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করছিল। আর রুজন পাশে বসে বাবার কাজ দেখে যাচ্ছে কোন প্রকার নড়াচড়া,সাড়াশব্দ না করে। রুজন বরাবরই শান্ত স্বভাবের ছেলে। পাঁচ বছর বয়স হিসেবে এখনো তার বিকাশ সেই অনুযায়ী হয়ে ওঠেনি। কথা কম বলে। বেশিরভাগ সময় মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বা নাসূচক উত্তর দেয়। কারো সাথে মেশে না। একা একাই খেলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে সে। সে সবসময় তার মা রুপালির কাছেই থাকে। মিতুর সাথেও তেমন ভাব নেই তার। কিভাবে থাকবে? মিতু যে তার আপন খেয়ালে কাজ করে বেড়ায়। অবশ্য রুজন শান্তশিষ্ট বলেই মিতু নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারে। আবুল কালাম কাজের মধ্যে বাঁধাগ্রস্ত হন। তার মস্তিষ্কে আচমকাই মিতুর খেয়াল আসে। আশেপাশে কোথাও মিতুর ছায়াছবি না দেখতে পেয়ে রুপালিকে জিজ্ঞেস করে,

‘রুপালি? এই সন্ধ্যার দিকে মাইয়াডা কই গেল?’

রুপালি রান্নাঘর থেকে গলা ফাটিয়ে উত্তর দিল, ‘তুমি চিন্তা কইরো না। মাইয়া আশেপাশেই কোনোহানে আছে। এহনি চইল্যা আইবো। দ্যাহো গিয়া নয়না গো বাইত্তে গেছে হয়তো। ওইহানে ছাড়া আর কই যাইবো?’

‘চিন্তা করুম না মানে? কি কইতাছো তুমি? মাইয়া এহন আর ছোডো নাই। হামার মাইয়া আর নাবালিকা নাই। তুমি কি হামার কতাখান বুঝতাছো না? এই সময় মাইয়ার দিকে বেশি বেশি নজর রাহন লাগবো। মাইয়ারে সাবধান করতে হইবো। আমি নাইলে হেই ভোরে কাজে যাই আর রাইতে ফিরি। তুমিতো বেশিরভাগ সময় বাইত্তেই থাহো। মাইয়ার ইশকুলের সময়ডায় কাজে যাও খালি। তারপর তো কোনো কাজ নাই তোমার। বাসায় থাইক্যাও মাইয়াডার উপর নজর রাহো না ক্যান? মাইয়া কই যায় না যায়, সেইডা দ্যাহার দায়িত্ব তোমার। এমনে চললে তো মাইয়া খারাপ হইয়া যাইবো। পাড়াবেড়ানি হইয়া যাইবো। তারপর যহন গাঁয়ের লোক পাঁচটা কতা হুনাইবো, তহন যাইয়া বুঝবা। তার আগে না।’

‘বুঝি গো সব বুঝি। কিন্তু মাইয়াডা আমার কয়দিন ধইরা কেমন মনমরা হইয়া গেছে। ইকটু আগের মতোন চঞ্চল হোক,পরিবেশ বুঝুক, শিশু স্বভাবডা যাক, তারপর এমনিতেই বুঝবো। এহন জোর কইরা মাইয়ারে কিছু বুঝাইতে গেলে উল্ডা বুঝবো। তারপর মনডা ছোডো হইয়া যাইবো হের। তার লাইগ্যাই তো কিছু কইনা আমি।’

‘তোমার কতাখানে যুক্তি আছে রুপালি। কিন্তু তুমি বুঝতাছো না গাঁয়ের হগলে মিতুর সাবালিকা হওয়ার ব্যাপারডা জাইন্যা গেছে। কার মনে কি আছে কওন যায়না। বিপদ ঘরের দরজা খটখটাইয়া আহে না। কতাখান মাথায় থাহে যেন।’

রুপালি আঁচলে ভেজা হাত মুছতে মুছতে পাকঘর থেকে বের হয়ে আসলেন। বললেন,
‘এহন থেইক্যা সাবধানে থাকুম। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি নামাজ পড়তে গেলাম।’

‘চিন্তা না করলেও চিন্তা কি পিছা ছাড়বো রুপালি? যার ঘরে মাইয়া মানুষ আছে তার চিন্তা করা লাগে না। চিন্তা নিজেই মাথায় আইয়া খেলা করে। বড়ো মাইয়াডারে আল্লাহ,আল্লাহ কইরা মান সম্মান বাঁচাইয়া শ্বশুরবাড়ি পাডাইছি। এহন ছোডো মাইয়ারে পাডাইতে পারলেই বাঁচি আমি।’

‘কারে কই পাডাইবা বাজান?’

মিতুকে দেখে আবুল কালাম মুখ গম্ভীর করে বললেন, ‘তুই হেই বিকাল থেইক্যা সন্ধ্যা পর্যন্ত কই আছিলি?’

‘ক,ক,কই আর থাকমু? নয়নাগো বাইত্তে আছিলাম বাজান।’

‘নয়নাগো বাইত্তে নাকি ওই হেডমাস্টারের পোলার লগে ঘুইরা বেড়াইতাছিলি?’

মিতুর কলিজায় পানিশূন্য হয়ে এলো। চোখ বড়ো হয়ে গেল। ইতোমধ্যে ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। মিতুকে চুপ করে থাকতে দেখে আবুল কালাম আবার জিজ্ঞেস করল,

‘কিরে কতা কসনা ক্যান? কই ছিলি তুই?’

‘আমি সত্যি কইতাছি বাজান, আমি নয়নার লগেই আছিলাম এতক্ষণ। কাব্য ভাইয়ের লগে না। তুমি চাইলে নয়নারে যাইয়া জিগাইতে পারো।’ যথাসম্ভব স্বাভাবিক থেকে মিথ্যা বলে দিল।।

‘এই কতাখান কইতে এত ভয় পাইতাছোস ক্যান? আর হঠাৎ তোর চোখ মুহের রঙ পালডাইয়া গেল ক্যান?’

মিতু মুখে হাত ছুঁইয়ে বলল,
‘কই? মুহের রঙ আবার পালডায় কেমনে বাজান? কেমন কথা এইডা?’

‘হামারে আর হাত তুলতে জোর করবি না কইয়া দিলাম। হেই হেডমাস্টারের পোলাডারে হামার একদমই পছন্দ হয়না। কহন কি কইরা বহে ঠিক নাই। মতি গতি ভালো না হেই পোলার। নাইলে অত বড়ো পোলা তোর লাহান একটা শিশুর সমান মাইয়ার লগে এত মেশতে চায় ক্যা? হের মাতায় কোন না কোন মতলব ঠিকই আছে। তুই কিন্তু ওই পোলার ধারে কাছে ঘেঁষবি না কইয়া রাখলাম। আর একটা কতা, কোনদিন যদি হেই পোলায় তোরে জ্বালায়,তাইলে হামারে আইয়া কইবি। তারপর কি করা লাগে না লাগে আমি দেইখ্যা লমু।’

মিতু ছোট স্বরে জবাব দিল,
‘আইচ্ছা বাজান।’

‘এহন যাইয়া পড়তে বগা। কয়দিন ইশকুলে না যাইয়া তো ভালোই পাখনা গজাইছে তোর। পরীক্ষার সময় বুঝবি ঠ্যালা। হামার সেতু মারে কোনদিনও পড়তে বহার লাইগ্যা কইতে হয় নাই। কোনো সময় হামার আর তোর মার মুহে মুহে থাকে নাই হেয়। তারে ডাকতে দেড়ি আইয়া হাজির হইয়া যাইতো। তারে নিয়া কোনদিন ও চিন্তা করা লাগে নাই। একা একাই পড়তে বইতো সেতু মায়। পড়া রাইখ্যা একটা কাজও করতে চাইতো না হামার সেতু। বই নিয়াই পইড়া থাকতো মাইয়াডা হামার। হামার সেতু মায় পুরা গ্রামের মইধ্যে একটাই মাইয়া,যারে সবাই ভালো কয়।’ বিরতিহীন একনাগাড়ে বলে ফেললেন আবুল কালাম। এসব শুনে মিতুর চোখ ছোট হয়ে এলো। সে ঈষৎ ঝাঁঝ মেশানো কন্ঠে বলে ওঠে,

‘আর আমি বুঝি পড়তে বহি না? আমারে লোকে খারাপ কয়? ইশকুল কয়দিন কামাই কি দিলাম, তুমি আর মায় মিল্যা আমার মাথা খাইয়া ফেলাইছো। নয়নার থেইক্যা পড়া বুইঝ্যা নিছিলাম। আমি গিয়া পড়তে বহিগা। আমি পড়তে বইলে তো কারো চোখে পড়ে না। আমি নাকি পড়ি না? খালি বুবুই নাকি পড়তো। বুবুরেই ভালো কয় সবাই। আর আমি তো খারাপ। শুধু পাড়ায় বেড়াই।’
মিতু সমানে গিজগিজ করতে করতে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।

***
সন্ধ্যার পর পর নয়নার মা বারান্দায় বসে মেয়ের মাথায় পরম আদরে তেল লাগিয়ে দিচ্ছেন। নয়নার দুনিয়া বলতে মা আর ভাই। বাবা মারা গেছে। আরও একজন আছে যার সাথে নয়নার রক্তের সম্পর্ক নেই। নেই আত্মীয়তার সম্পর্ক। তবুও যেন সে নয়নার আত্মীয় থেকে কম নয়। আত্মীয় বললে ভুল হবে। নয়না তাকে নিজের বোনের চোখেই দেখে। মায়ের পেটের বোন না হয়েও নয়না মিতুকে তার আপন বোনই ভাবে। মিতু যেন নয়নার জীবনের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে আছে। নয়না যেভাবে মিতুকে নিজের জীবনের একটা অংশ মনে করে,ঠিক সেভাবে মিতুও। মিতুর কাছে নয়না মানে ভালবাসার আরেক পরিচয়। দুজন দুজনকে ছাড়া একটা দিনও কল্পনা করতে পারেনা। প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন কিছু কিছু মানুষ থাকে,যারা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মস্তিষ্কের গভীরতায় লেপ্টে থাকে। নয়নার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে নয়নার ভাই মামুনই তার সব আবদার পূরণ করে এসেছে। ভাইয়ের কাছে নয়না কোনো রাজকন্যার থেকে কম নয়। মা একটু বকাঝকা করলেই নয়না তার ভাইয়ের কাছে বিচার দিয়ে দেয়। নয়নার গায়ের রঙ বেশ চাপা। মিতুর মতো ধবধবে ফর্সা নয়। তবে কালো হলেও নয়নার মুখটা ভারী মায়াবী। যাকে বলে মায়াবিনী। মিতুর কাছে নয়নার মুখের গড়ন বেশ ভালো লাগে। নয়নার মুখ দেখলে মিতুর দিনটাই যেন চাঙ্গা হয়ে যায়। আসলে ভালো বন্ধুর সব কিছুতেই যেন অমৃতের ছোঁয়া লেগে থাকে। এটা কেবল ভালো বন্ধুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। প্রতিটি ভালো চরিত্রের লোকের সব কিছুই যেন মনোমুগ্ধকর। সে দেখতে যতই কুৎসিত হোকনা কেন, শুধুমাত্র তার ভালো গুণ ও স্বভাবের জন্য সে সকলের কাছেই প্রশংসনীয়। পক্ষান্তরে, খারাপ চরিত্রের লোক যতই সুশ্রী হোকনা কেন, সকলের দৃষ্টিতে সে শুধুই ঘৃণার পাত্র। তার থেকে বিশ্রী বোধয় আর একটাও নেই দুনিয়ায়।

নয়না ওর মায়ের কাছে বেশ আহ্লাদী। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর চিরুনি নিয়ে বসে মায়ের থেকে চুল আঁচড়াবে বলে। রোকেয়ার বেশ ভালোই লাগে মেয়ের ছোট ছোট আহ্লাদে অংশগ্রহণ করতে। নয়না ওর মায়ের সাথে এই একটা সময়ে সারাদিনের সব গল্প, মনের ইচ্ছা ভাগ করে।

‘আইচ্ছা মা, তুমি ভাইয়ারে বিয়া দেওনা ক্যান? আমার লাল টুকটুকে একখান ভাবি চাই।’ হুট করেই বলে ফেলল নয়না।

রোকেয়া বেগম মেয়ের চুল আঁচড়ে দিতে দিতে বলল, ‘তোর খালি এই চিন্তাডাই ঘুরপাক খায় নাকি মাতার মইধ্যে?’

‘হ, তুমি কত কাজ করো একলা। ভাবি থাকলে তো তোমার কষ্ট ইকটু কম হয়। বয়স তো কমতাছে না তোমার। আমি তো তেমন কাজ পারিনা যে তোমারে সাহায্য করমু। তুমি তো আমারে কিছুই করতেও দেওনা। তার লাইগ্যাই কইতাছি ভাইয়ারে বিয়া দিয়া দেও। ভাইয়া ঢাকা থাইক্যা চাকরি করুক, আর ভাবি আমাগো লগে গেরামেই থাকলো নাইলে।’

‘সেইডা আমারে না কইয়া তোর ভাইরে যাইয়া কবি। তোর ভাই এত সকালে বিয়া করতে চায়না। কত কই তোর লাইগ্যা মাইয়া দেহি, কয়দিন ছুডি নিয়া বাইত্তে আয়। কে হুনে কার কতা? মামুন সাফ সাফ কইয়া দিছে, তোরে বিয়া দেওয়ার পরই হেয় বিয়া করবো।’

‘আইছে! শখ কতো তোমার পোলার? আমারে নাকি আগে বিয়া দিবো! আমার বিয়া হইতে হইতে টাক পইড়া যাইবো তোমার পোলার মাথায়। তারপর আমিও দেখমু কোন বাপে তার মাইয়ারে এমন টাক পড়া পোলার লগে বিয়া দেয়।’

‘তোরে কে কইছে আমার মামুনের মাতায় টাক পড়বো? বয়সডা কি আমার পোলার? ওইতো ভাদ্র মাস আইলে ২৮ শে পড়বো।’

‘ভাইয়ার বর্তমান বয়স ২৮ বছর। আর আমার পড়ালেখা শেষ হইতে ১৪ বছর লাইগ্যা যাইতে পারে। ততদিনে ভাইয়ার বয়স গিয়া দাঁড়াইবো ৪২ বছরে! নাতি নাতনির মুখ দেহার বয়সে ভাইয়া বিয়া করলে মাথায় টাক তো পড়বোই।’

‘তোরে এত বছর পড়াইবো কেডা?’

‘ক্যান, তোমরা।’

‘মাইয়াগো অত পড়ন লাগে না। তোর ১৮ বছর বয়স হইলেই তোরে বিদায় দিয়া দিমু।’

‘আমি পড়ালেখা শেষ করতে চাই মা। আমি আর মিতু একসাথে পড়ালেখা শেষ করমু। তারপর যেই ঘরে দুই ভাই বিবাহযোগ্য থাকবো, সেই ঘরেই বিয়া করমু। যাতে মিতু আর আমি একলগে থাকতে পারি সারাজীবন।’

‘তোর যত ঢঙের কতা। তোরে আর মিতুরে এক ঘরের দুই পোলা নেওয়ার লাইগ্যা ছালা বিছাইয়া বইয়া থাকবো মনে হইতাছে!’

‘ছালা না মা, ফুল বিছাইয়া বইয়া থাকবো। তুমি দেইখ্যা লইও।’

‘কি লইয়া কতা কইতাছোস রে তোরা মায়-ঝি?’
পলি খাতুন দাঁতের মধ্যে শলার কাঠি দিয়ে গুতাতে গুতাতে কথাটা বললেন। পলি খাতুনকে দেখে নয়নার কপালে দুশ্চিন্তার বলিরেখার দেখা মেলে। সাথে নাকটাও ফুলে উঠে।

‘খালাম্মা যে! বসেন আমি মোড়া নিয়া আইতাছি।’
রোকেয়া বললেন।

‘থাক রে রোকেয়া, মোড়া আনোন লাগবো না। আমি তোরে একখানা বিচার দেওনের লাইগ্যা আইছিলাম। বিচার দিয়া চইল্যা যামু। আমার বসার সময় নাই। মেলা কাম পইরা আছে বাইত্তে।’

রোকেয়া অবাক চোখে শুধালেন,
‘বিচার! কার বিচার?’

‘তোর মাইয়ার বিচার দিতে আইলাম। আইজ আমার লগে তোর মাইয়ায় বেয়াদবি করছে। তারপর মুহে মুহে তর্কও করছে। তুই কি বেয়াদবি শিকাইতে ইশকুলে পাডাস মাইয়ারে?’

‘আমার নয়ন আপনার লগে বেয়াদবি করছে? মুহে মুহে তর্কও করছে?’

‘হ তোর মাইয়ারেই জিগা কি কি কইছে আমারে।’

রোকেয়া চোখ রাঙিয়ে নয়নাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে নয়ন? তুই খালাম্মার লগে নাকি বেয়াদবি করছোস?’

নয়না সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘তুমি এই বুড়ির কথা বিশ্বাস কইরো না মা।’

‘দেখলি রোকেয়া! আমি বয়স্ক বইল্যা তোর মাইয়া আমারে বুড়ি কইলো? বলি, আমি কি শয়তান নাকি যে তোর মাইয়া আমারে বুড়ি কইলো?’ পলি খাতুন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল বুড়ি নামটা শুনে।

রোকেয়াও মহা রেগ গেলেন।
‘নয়ন! তোরে কি আমি এই শিক্ষা দিছি? বড় মাইনষের লগে কেমনে কতা কইতে হয়, সেইডা কি তুই জানোস না?’

‘মা তুমি সব হুনো তারপর কইও আমি ভুল করছি নাকি ঠিক করছি।’

‘তোর কি কতা হুনুম আমি? তুই আমার সামনে খালাম্মারে বুড়ি কইলি। এরপর আর কি হোনার বাকি আছে?’

‘আমি হেরে এমনি এমনি বুড়ি কইনাই মা। হেয় মিতুরে গাঙে নাইতে মানা করছে। তার লাইগ্যাই আমি হের লগে তর্ক করছিলাম।’

‘মিতুরে নাইতে দেয় নাই মানে!’

পলি খাতুন বলল, ‘আমি কইতাছি রোকেয়া। তোর মাইয়া আর মিতু আইজ গাঙে নাইবার লাইগ্যা নামছিল। তুইতো জানোস মিতুর মাসিক হইছে। হেই মাইয়া সাতদিন শেষ হওয়ার আগেই গাঙে নাইতে আইছে। তার লাইগ্যাই কইছিলাম যে, মিতু তুই তো নাপাক, তাই গাঙে নামিস না। হেইডা নিয়া তোর মাইয়া আমারে কয় কি? কয়, গাঙ কি আপনার বাপের! তুই ক তোর মাইয়ার নাক টিপলে দুধ বাইরায়, আর ওয় কিনা আমার বাপ তুইল্যা কতা কয়!’

‘বেশ করছি কইছি। আপনি আমার বান্ধবীরে গাঙে নামতে মানা করছিলেন ক্যান?’

রোকেয়া সঙ্গে সঙ্গে জোড়ালে ধমক প্রয়োগ করলেন,
‘চুপ কর নয়ন! বড়ো মাইনষের মুহে মুহে কতা কবি না কইয়া দিলাম। তুই হের থেইক্যা অনেক ছোডো। তার লগে বেয়াদবি করাডা ঠিক হয় নাই তোর। তুই এহনি মাফ চা খালাম্মার কাছে।’

‘কিন্ত মা তু…..।’

‘মাফ চা কইতাছি!’ রোকেয়া বেশ রুষিলা হয়ে বললেন।

নয়না রোকেয়ার রাগের মাত্রা বুঝে উঠে না চাইতেও বাধ্য হয়ে বলল,’আমারে মাফ কইরা দেন দাদী।’

তখন পলি খাতুন মুখ বাকিয়ে বললেন,
‘এইবার থেইক্যা আর বড়ো মাইনষের লগে বেয়াদবি করবি না। আমি দেইখ্যা মাফ করলাম। অন্য কেউ হইলে আশেপাশে না তাকাইয়া সপাটে দুইখান লাগায় দিতো তোর গালে।’

‘নয়ন নাইলে বাচ্চা মাইয়া দেইখ্যা ভুল কইরা ফেলছে। কিন্তু আপনে তো বড়ো। আপনে কেমনে বাচ্চাগো লগে এমন অরুচি কাজ করলেন? আপনে ভালো কইরা বুঝাইয়া কইতে পারতেন। মিতু তো অবুঝ মাইয়া। আপনে কাজডা ভালো করলেন না খালাম্মা।’

‘আমি আবার কি করলাম রে রোকেয়া? আমারে এমনে কইলি ক্যান তুই?’

‘আবার জিগান? গাঁয়ের অন্যান্য মহিলা মাইয়াগোও মাসিক হয়। তারাও কিন্তু গাঙে নাইতে যায়। আইজ মিতু আপনার চোখে পড়ছে বইল্যা ওয় গাঙে নামলে হেই পানি নাপাক হইয়া যাইবো? ওর লাইগ্যা যদি গাঙের পানি নাপাক হয় তাইলে অন্য মাইয়া/মহিলারা মাসিকের সময় যহন গাঙে নামে, তহন গাঙের পানি পইচ্চা যায় না?’

পলি খাতুন চুপ হয়ে গেলেন। তার মুখ যেন তালাবদ্ধ হয়ে গেল রোকেয়ার ঝাঁঝালো কথায়। সাথে মাথাটাও ঘুলিয়ে গেল। ফলে এই মুহুর্তে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। তা দেখে রোকেয়া আবার বলল, ‘এহন চুপ কইরা আছেন ক্যান খালাম্মা? উত্তরখান আমি পামু না?’

‘আ,আ, আমার মেলা কাজ আছে। উডান ভর্তি ধান। এহনো উডাই নাই। আমি যাইলাম।’ পলি খাতুন রোকেয়ার প্রশ্নে থতমত খেয়ে কোনভাবে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে প্রাণে বাঁচলেন।
চলবে ইনশাআল্লাহ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here