উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৪
মিতু ছুটে গেল নয়নাদের বাসায়। নয়নারা এক ভাই এক বোন। ভাই বড়ো। সে ঢাকায় থাকে। ভালো বেতনের চাকরি করে। নয়না ও তার মা রোকেয়া গ্রামে থাকে। নয়নার ভাই মামুন ঢাকা থেকে মাস গেলে তাদের জন্য টাকা পাঠায়। মিতুদের থেকে নয়নাদের পারিবারিক অবস্থা ভালোই। নয়না মিতুর মতো পড়ালেখায় তেমন হুশিয়ার না। তবে মোটামুটি মনোযোগী। ওদের বন্ধুত্ব ছোট বেলা থেকেই। মিতু আর নয়না একে অপরের পরমবন্ধু। মিতু কখনো স্কুলে টিফিন নিয়ে যায়না। ওদের পরিবার তেমন স্বচ্ছল নয় বলে টিফিন নেওয়ার সামর্থ্য নেই। তাই নয়না রোজ মিতুর জন্য আলাদা করে টিফিন নিয়ে যায়। দুই বান্ধবীর গলায় গলায় ভাব। ওদের দুজনের মধ্যে একজনের সাথে কারো ঝগড়া লাগলে অন্যজনও নিজের ঝগড়া মনে করে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে শুরু করে দেয়। তাই কেউ আগ বাড়িয়ে মিতু ও নয়নার সাথে ঝগড়া করতে আসেনা। এই কয়দিন নয়না একা একাই স্কুলে গিয়েছে। সে রোজ মিতুকে ডাকতে আসে। তবে কোনো লাভ হয়না। চারদিন যাবৎ মিতুকে ছাড়াই যেতে হয়েছে তাকে। নয়না বাসায় এসে স্কুলের জামা বদলে নিজের ঘর থেকে বের হবে কি মিতু হঠাৎ প্রকট হয়ে ”ভাউ” বলে শব্দ তুলল তার সামনে গিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে নয়না ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। তারপর বুকে থুতু দিয়ে দুহাত কোমড়ে গুজে অগ্নিমূর্তির ন্যায় তাকায় মিতুর দিকে। সেই অবস্থা ধরে রেখে বলল, ‘তুই আমারে ভয় পাওয়াইয়া দিলি পেত্নী কোনহানকার।’
মিতু ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
‘আমি পেত্নী হইলে তুই পেত্নীর বান্ধবী।’
‘এই জায়গায় কি চাই তোর? আবার দাঁত কেলাইয়া হাসে! আমার কাছে আর কোনদিনও আইবি না কইয়া দিলাম।’
নয়না কথাটা বলে রাগী মুখশ্রী অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল।
তা দেখে মিতু বলল, ‘ঠিক আছে তাইলে যাই গিয়া রজনীর লগে ভাব করিগা।’
‘ওই দাঁড়া! তুই রজনীর লগে ভাব করবি মানে?’
‘তুইতো তোর কাছে যাইতে মানা করছোস। তাই বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণ করবার লাইগ্যা যাইতাছি। স্যার যে কইছিলো কহনো হাল ছাড়বা না। বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণ করবা। আমি তাই করতে যাইতাছি।’
নয়নার চোখ মুখ লাল হয়ে আসলো মিতুর কথায়।
সে কটমট করে বলল, ‘এক পা নড়লে ঠ্যাং ভাইঙ্গা কাকেরে খাওয়ামু কইয়া দিলাম। চার চারটা দিন তোরে ছাড়া ইশকুলে গেছি। ভালো লাগে না আমার তোরে ছাড়া। তুই কি জানোস না তোরে ছাড়া আমার ইশকুলে যাইতে মন লয়না? সব কিছুই কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে!’
নয়নার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা নোনা পানি গড়িয়ে পড়ল। মিতু নয়নার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, ‘আমি কি আর ইচ্ছা কইরা ইশকুল কামাই দিছি নাকি? তুই দেখলি না ওইদিন আমারে নিয়া পুরা ইশকুল হুদ্দা মানুষ কানাকানি, হাসাহাসি করতাছিল? ইশকুলে গেলে আবারও তাই করতো। তার লাইগ্যাই তো যাই নাই।’
‘কেউ কিছুই কইতো না। ইশকুলের আপা কইছে তোর ওই বিষয়ডা নিয়া কেউ যেন হাসাহাসি বা কানাকানি না করে। আর যে করবো তার লাইগ্যা কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করবো। তারপরও যদি কেউ তোরে নিয়া উল্টা পাল্টা কিছু কয়,তাইলে আমি তো আছি। তার অবস্থা আমি গলাকাটা মুরগির মতো কইরা দিমু। দেখিস খালি তুই।’
কথাটা বলে নাক দিয়ে আগুন নিশ্বাস ছাড়ল নয়না। রাগে শরীর কাঁপছে তার। এখন সত্যি সত্যি কেউ যদি মিতুকে নিয়ে উল্টো পাল্টা কিছু বলতো, তাহলে নয়না তার আসল রূপটা দেখিয়েই দম ছাড়তো।
মিতু তৎক্ষণাৎ নয়নাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘তুই আমারে কত ভালবাসোস রে নয়না। তোর মতো বান্ধবী দেশ বিদেশে ঘুরলেও পামু না। আমি কাইল থেইক্যা আবারও ইশকুলে যামু। তোরে আর একা একা যাইতে হইবো না।’
‘সত্যি কইতাছোস মিতু?’
‘হ রে সত্যি কইতাছি। এইবার চল গিয়া গাঙে ঝাপ দেই। গরম পড়ছে মেলা। আর তো সইতে পারতাছি না। মেলা দিন ধইরা তুই আর আমি গাঙে গোসল দেই না।’
‘হ ঠিক কইছোস। চল যাই।’
মিতু ও নয়না পা বাড়াচ্ছিলো ঠিক তখন পিছ থেকে রোকেয়ার ডাক পরে।
‘খাড়া তোরা।’
‘কি হইছে মা?’ পেছনে তাকিয়ে নয়না বলল।
‘আমি যে আমসত্ত্ব বানাইছিলাম, মিতুর লাইগ্যা এক বোয়াম রাখছি। ভালোই হইছে মিতু আইছে। তোরে মিতুগো বাইত্তে দিয়া আইতে কইলে তো তুই নিয়া যাবি, যাবি কইয়া ভুইল্যাই যাস।’
‘খালা তুমি আমার লাইগ্যা আমসত্ত্ব বানাইছো!’ মিতুর চোখে মুখে খুশির ঝলক উপচে পরে।
‘হ বানাইছি। তুই দাঁড়া আমি নিয়া আইতাছি।’
‘তুমি বাইর কইরা রাহো আমি আর নয়না গাঙে ডুব দিয়া আহি। যাওয়ার সময় নিয়া যামুনে।’
‘আইচ্ছা তাড়াতাড়ি আইছ তাইলে।’
নদীতে জোয়ার এসেছে। নদীর পানি প্লাবিত হয়ে উপচে উপরে চলে এসেছে। কচুরিপানা কিনারায় ভীড় জমিয়ে নদীর চারপাশে সবুজ দীপ্তি ছড়াচ্ছে। কত ছেলেমেয়ে, জওয়ান,বুড়ো নদীতে নেমেছে। কেউ কেউ এপার থেকে ওপারে সাঁতার কেটে যাচ্ছে।
‘দেখছোস নয়না, গাঙে কত ভীড়!’ চকিত কন্ঠে বলে উঠে মিতু।
‘হুম, হেইডাই দেখতাছি। গাঙে জোয়ার আইছে। চল বাইত্তে ফেরত যাই। মায় কইছে জোয়ার আইলে গাঙে যেন না নামি।’
‘কিছু হইবো না। আমি আছি তো। চল তুই, আমরা আইজ সাঁতার কাটমু না। খালি ডুব দিয়া উইঠ্যা যামু।’ মিতু বলল।
নয়না খানিক ভরসা জুগিয়ে বলল,
‘আইচ্ছা তাইলে চল।’
মিতু আর নয়না গাঙে পা ডোবানো মাত্র একজন বয়স্ক মহিলা এক ঝাঁক আতংক সমেত বলে ওঠে,
‘কিরে মিতু! তুই এই শইল নিয়া গাঙে নামোছ ক্যান? সাত দিনের আগে তুই গাঙে নামবি না কইয়া দিলাম। তোর লাইগ্যা অন্য মানুষ গোসল করতে পারবো না। তোর শরীর নাপাক।’
‘মিতু ক্যান নামবো না দাদী? তুমি যেইভাবে কইতাছো গাঙ মনে হয় তোমার বাপের!’ কঠোর গলায় দ্বিধাহীনভাবে বলে ফেলল নয়না।
‘ওরে আল্লাহ্! এই মাইয়া আমার মরা বাপ তুইল্যা কতা কইতাছে! দুই দিনের ছেড়ি হইয়া আমার বাপেরে তুইল্যা এত বড় কতা কেমনে কইলি তুই? আইজ রোকেয়ারে ধরমু আমি। মাইয়ারে কি শিক্ষা দিছে জিগামু। মাইয়ারে ইশকুলে আদব কায়দা শিকাইতে পাডায়, নাকি বেয়াদবি শিকাইতে পাডায়? সব জিগামু।’
‘তুমি আমার বান্ধবীরে কেমনে কইতে পারলা গাঙে না নামার লাইগ্যা? উচিত কথা কইলে বেয়াদব হইয়া যাই নাকি দাদী?’
‘আমি হইতাছি পলি খাতুন। তিনকাল যাইয়া এককালে ঠেকছি। আইজ কাইলকার পুঁচকে ছেড়ি কিনা আমার লগে তর্ক করে! আমি এর শেষ দেখমু রে নয়না।’
‘যাও,যাও। তুমি যা মনে লয় তাই করো গিয়া। মার হাতে দুইডা মাইরই নাইলে খাইলাম। তাতে কি?’
মিতুর মুখ অতিমাত্রায় ভাড় হয়ে আছে। পলি খাতুনের কথা তার কোমল হৃদয়ে আঘাত হেনেছে, তা যেন স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে।
মিতু নয়নাকে থামানোর চেষ্টায় বলল, ‘থাক নয়না আমি চইল্যা যাইতাছি। তুই দাদির লগে আমারে নিয়া আর ঝগড়া করিস না।’
পলি রাগে গিজগিজ করতে করতে ভেজা শাড়ির আঁচল নিংড়ে চলে গেলেন। যাবার আগে একবার একবার করে নয়না আর মিতুর মুখের দিকে আক্রোশ ভরা চোখে তাকিয়েছলেন। পলি খাতুন চলে গেলে নয়না বলল,
‘ওনারে মনে হয় ভয় পাই আমি। আইছে মার ভয় দেহাইতে।’
‘উনি ঠিকই কইছে রে নয়না। তুই এই নিয়া আর কিছু কইস না। তুইতো আর আমার মতো অসুস্থ হসনাই, তাই বুঝতাছোস না। দোষ আমারই। আমি ভুইল্যাই গেছিলাম আমার অসুখের ব্যাপারখান। মায়ও আমারে মানা করছিল এই শইল নিয়া গাঙে না নামার লাইগ্যা। আমার সেইডা মনে আছিলো না। তুই গোসল কইরা আয় আমি বইয়া থাকি উপরে।’
‘উহু, সেইডা হয়নারে। আমিও গাঙে নামুম না। চল আমরা যাইগা এইহান থেইক্যা। নইলে পলি বুড়ির মতো আরেকজন কথা হুনানোর লাইগ্যা চইল্যা আইবো। আমি সেইডা হুনতে পারমু না। এর থেইক্যা দুইজনই বাইত্তে যাই। যাইয়া টিউবওয়েলে গোসল করিগা।’
‘আমার লাইগ্যা তুই ক্যান গাঙে গোসল করবি নারে, নয়না?’
‘যেইহানে তুই নাই, সেইহানে আমিও নাই। এমনিতেও আমার জোয়ারের সময় গাঙে নাইতে মন লয় না। ডর লাগে। আর তুই মন খারাপ করবি না কইয়া দিলাম। আমি থাকতে তোরে কেউ কিছু কইলে তারে আমি ছাইড়া দিমু না। হেয় যেই হোকনা ক্যান আমি এক তিম সমান ছাড় দিমু না তারে।’
নয়নার কথা শুনে মিতুর মন কিছুটা ভালো হলো। খানিক বেদনা কাটিয়ে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটলো তার। নয়না বরাবরই এমন। মিতুকে কেউ কিছু বললেই নয়না অগ্নিমূর্তি ধারণ করতে এক সেকেন্ডও সময় লাগায় না। মিতুও তার ব্যতিক্রম নয়। সময় আসলে মিতুও নয়নার প্রতি তার ভালবাসা প্রকাশ করতে একটুও কৃপণতা দেখায় না।
চলবে ইনশাআল্লাহ….
বিঃদ্রঃ নেক্সট নাইস না লিখে গঠনমূলক মন্তব্য করুন, নইলে আমি বুঝবো না আপনাদের কেমন লাগছে।