গোধূলিলগ্ন 2

0
1583

উপন্যাসঃ ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ২

হেডমাস্টার তোসিফ সাহেব বিদ্যালয়ের যাবতীয় কাজ সেরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়িতে ফিরলেন।তার স্ত্রী রেখা বানু এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন তার নিকট। তোসিফ সাহেব এক নিশ্বাসে সবটুকু পানি পান করে নিলেন। রেখা খালি গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন আগের অবস্থাতেই। তিনি যেন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছেন না। বিষয়টা তৌসিফ সাহেবের চোখ এড়ালো না।

‘তুমি কি আমায় কিছু বলবে রেখা?’

তৌসিফ সাহেবের প্রশ্নে রেখা যেন কথা বলার সাহস পেল। তাই বিলম্ব না করে বলেই ফেলল,
‘আজ পুরো গাঁয়ের মানুষ মিতুর ব্যাপারটা নিয়ে কি যে শুরু করেছে, কি আর বলবো তোমায়?’

তৌসিফ সাহেব ভ্রুদ্বয় কুঁচকে বলল,
‘কেন?গাঁয়ের লোকের কি? তাদের কি মেয়ে সন্তান নেই নাকি?’

‘আমারও একই কথা। আমার তো এসব একদম সহ্য হয়না। তাই যাকেই এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে শুনেছি,তাকেই দু চারটা কথা শুনিয়ে দিয়েছি। এ কেমন গাঁয়ে বসবাস করি আমরা!’

রেখা বানুর ভেতর থেকে এক অশান্তির ক্ষোভ বেরিয়ে আসে। আসারই কথা। মানুষের মনোভাব কতটা নিঁচু তা গ্রামীণ অজপাড়া গাঁয়ে না গেলে বোঝাই যায়না।

‘তুমি আর আমি বুঝলে তো হবে না রেখা! যাই হোক,তোমার ছেলে কোথায়? কাব্য কেতো ধারেকাছে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।’

রেখা আনমনে বললেন,
‘আছে কোথাও খালে বিলে।’

‘সেকি! কদিন বাদে তার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা, আর সে কিনা গাঁয়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে?’

‘সবসময় তো পড়াশোনাই করে ছেলেটা। একটু বাহিরে বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘুরে বেড়ালে এমন কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। বুঝলে মাস্টার মশাই?’

‘তুমি বেশি বুঝো না! জীবনে সুযোগ একবারই আসে। সময়ের স্রোত কখনো কারো জন্য থেমে থাকেনি আর থাকবেও না। আমাদের একটাই সন্তান। বিগড়ে গেলে বুড়ো বয়সে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না আমাদের। এখনও আমি অবসরপ্রাপ্ত হইনি বলে সংসারটা সুন্দর গতিতে চলছে। অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার আগে ছেলেটার ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পারলে, ছেলে তার বউ বাচ্চা নিয়ে সুখে থাকতে পারবে। আমার কথা কি তোমার মাথায় গিয়েছে?’

‘হ্যাঁ গিয়েছে মাস্টার মশাই। আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, ছেলে আমার খুব বুদ্ধিমান। আর যাই করুক না কেন নিজের পড়াশোনা নিয়ে অত্যন্ত মনোযোগী সে। আমি তো মা,তাই বুঝি ছেলে আমার কেমন।’

এ নিয়ে আর কোনো কথা বাড়ালেন না তৌসিফ সাহেব।

কাব্য সাড়া বিকেল মিতুর সাথে হই-হুল্লোড় করে কাটিয়ে মাগরিবের আযানের আগে বাড়ি ফেরে।এটা তার রোজকার রুটিন বলতে গেলে।নামাজের পর বই নিয়ে বসল। কাব্যর জীবনে দুটো জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক, তার পড়াশোনা শেষ করে বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ। আর দুই হলো বড়ো হয়ে তার মিতুবুড়িকে বউ করে ঘরে আনা। কাব্য মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল এমন সময় রেখা এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে কাব্যর রুমে প্রবেশ করলেন।

‘প্রাইভেট থেকে আসার পর ব্যাগটা রাখবি শুধু। তারপর ওই দুপুরে একটু খাইয়ে দেই। ব্যাস! ছেলে আমার উধাও। তারপর আর ছেলেটার মুখই দেখা পড়েনা।’ রাগে গিজগিজ করতে করতে বললেন রেখা বানু।

‘ওমা,তুমি ওভারে বলছো কেন? আমি তো তোমার থেকে পালিয়ে যাচ্ছি না।’

‘না পালিয়েও তো পালানোর মতোই। মায়ের মন। তোকে দু দন্ড চোখের সামনে না দেখলে মনটা আমার আকুল হয়ে থাকে। শুধু পড়াশোনা আর নয়তো মিতু বা অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘুরে বেড়ানো। এ ছাড়া আর কোনো কাজ নেই নাকি?’

কাব্য বইটা সাইডে রেখে আহ্লাদী সুরে বলল,
‘তুমি আমার কাছে আসো তো একটু আদর করি আমার আম্মু টাকে।’

‘রাখ তোর আহ্লাদ। এখন আম্মুকে আদর করার কথা মনে পড়েছে! এখন গরম দুধটা শেষ করে আমাকে উদ্ধার কর দেখি।’

‘তুমি রেখে দাও। আমি পরে খেয়ে নিচ্ছি।’

‘হুম,পরে আমাকে ভরা গ্লাস নিয়ে যেতে হবে তাইতো? আমার হাতে ছাড়া তো খাবে না নবাবজাদা।’

কাব্য মিটিমিটি হেসে বলল,
‘বুদ্ধিমতী মা আমার।’

‘ছেলে যদি বুদ্ধিমান হয়,তাহলে মা কেন বাদ যাবে?’

প্রতুত্তরে কাব্য হাসল শুধু। রেখা পরম মমতারসহিত কাব্যকে দুধ খাইয়ে আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে দিয়ে আবারও বলল, ‘বিয়ের পর দেখবো কে খাইয়ে দেয় এভাবে। আমিও দেখবো তোকে কে সহ্য করতে পারে আমার মতো।’

কাব্য পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রেখার হাত টেনে চেয়ারে বসিয়ে দিল। তারপর হাটুমুড়ে মাথাটা রেখার কোলে রাখল। এই দেখে সঙ্গে সঙ্গে রেখা বানু জিজ্ঞেস করে বসলেন,

‘কি হয়েছে বাবা?’

কাব্য খানিক আড়ষ্টতা জড়ানো কণ্ঠে বলে,
‘মা আমি মিতুবুড়িকে আমার বউ করে আনতে চাই।’

ছেলের কথায় রেখার চোখ যেন চড়কগাছ। তিনি বললেন,
‘তোর মাথা ঠিক আছে? মানছি তুই মিতুকে খুব পছন্দ করিস। কিন্তু তোদের দুজনের মধ্যে কারোরই বিয়ের বয়স হয়নি এখনো।’

কাব্য মাথা উঁচিয়ে বলল, ‘আমি কি এখন বিয়ে করবো বলেছি নাকি? আগে আমি বড়ো হই, নিজের পায়ে দাঁড়াই, তোমার আর বাবার স্বপ্ন আমি সাংবাদিক হয়ে গ্রামের উন্নয়নে কিছু করবো, সেটা পূরণ করি, তারপর গিয়ে মিতুবুড়িকে বিয়ে করবো।’

‘মিতুকে এত পছন্দ তোর?’ বিস্মিত চোখে শুধালেন রেখা বানু।

‘হুম খুব। ওর ওই ডাগর আঁখি আমার মন কেড়েছে। জানো মা, মিতুবুড়ির চোখে অদ্ভুত এক মায়া আছে। যা আমাকে ওর প্রতি দুর্বল হতে বাধ্য করে। ওর চঞ্চলতা, বোকা বোকা কথা, মাঝে মাঝে জ্ঞানীদের মতো কথা বলে ফেলা, হঠাৎ বাচ্চামি স্বভাব সব কিছুই আমার অত্যন্ত প্রিয়।’

‘পাজি ছেলে! মায়ের কাছে কেউ এসব বলে নাকি?’

‘হুম বলে। কারণ তুমিতো শুধু আমার মা নও, আমার বেস্ট ফ্রেন্ডও।’

‘বেশ বলেছিস। সেভাবে তুইও আমার শুধু ছেলে নস, বেস্টের থেকেও বেস্ট ফ্রেন্ড। আর তোর কথায় যুক্তি আছে। তবে শুধু মিতু নয়। মিতু আর সেতু দুজনেই যেন রূপের রানী। ঠিক মতো যত্ন-আত্তি করলে ওদের চেহারায় আরও উন্নতি ঘটতো। জানিস,সেতুর কথা বললেই আমার মনটা কেমন খারাপ হয়ে আসে। খুব মেধাবী ছাত্রী ছিল। তোর বাবার খুবই প্রিয় ছাত্রী সেতু। এখনো তোর বাবা সেতুর প্রশংসা করে খুন।মেয়েটার অকালে বিয়ে না হলে কদিন পর তোর সাথেই উচ্চমাধ্যমিক দিতো। কি সুন্দর চাচিমা বলে ডাকতো আমায়! মনটা জুড়িয়ে যেত সেতুর হাসিমাখা মুখটা দেখলেই।’

‘তা যা বলেছো মা। সেতু খুবই ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী ছিল। সবসময় আমার সাথে পাল্লা দিয়ে পড়তো। সব দোষ ওই আবুল কালামের। একটু স্বচ্ছল পরিবার দেখলো কি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল।’

রেখা চোখ রাঙিয়ে কাব্যর দিকে তাক করে বলল,
‘উনি তোর থেকে বয়সে ঢেড় বড়। একটু মেপে বুঝে কথা বলবি বলে দিলাম। আবুল কালামের কিবা দোষ? এখনো তাকে সংসারের বোঝা কম বইতে হচ্ছে না। দিন আনে দিন খায় তারা। কি জানি সেতুর মতো মিতুকেও যদি….’

রেখা তার কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। যদি অবধি বলেই থেমে যেতে হলো তাকে। কারণ তার কথার মাঝেই কাব্য বলে ওঠে,

‘বিরাম মা! আর যাই বলো না কেন এই কথাটার আর কখনো পুনরাবৃত্তি করবে বা। ভুলেও মুখে আনার চেষ্টা করবে না। মিতুকে কেউ আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। আমি ওকে আমার থেকে দূরে কোথাও যেতেই দেব না। দরকার পড়লে মিতুকে আমি শেকল দিয়ে বেঁধে রাখবো আমার মন পিঞ্জিরায়।’

রেখা এ নিয়ে আর কথা বাড়ালো না কাব্যর সাথে। ছেলের জেদ বা রাগ সম্পর্কে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা আছে তার। তাইতো নিজ দায়িত্বে চুপ হয়ে গেলেন বিনা রা-শব্দে।
চলবে ইনশাআল্লাহ….

বিঃদ্রঃ গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। অন্যথা উপন্যাসটি পোস্ট দেওয়া হবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here