গোধূলিলগ্ন ৩৫

0
304

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৩৫

সেতু ইচ্ছে করেই গতরাতে মিতুর সঙ্গে ঘুমোয়নি। নাহিদের সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তার, যা না সারলেই নয়। রাত গড়িয়ে ভোর হলো। পাখির কলতানে ঘুমে আচ্ছন্ন চোখ জোড়া হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল দরজায় সৃষ্ট বিকট শব্দ কর্ণধার হতেই। সেতু দ্রুত পদক্ষেপে ছুটে গিয়ে দরজা খোলে। চোখের সামনে ক্লান্ত নাহিদকে দেখে সেতুর কপালে বিরক্তির ভাজ পড়ল। এমনটা প্রথম নয়, নাহিদ প্রায়ই সকালের দিকে বাড়ি ফেরে৷ সেতু তার তৈরিকৃত প্রশ্নটি সহসাই নাহিদের দিকে ছুড়ে দিল,
‘মায়া কই? মায়ারে কই লুকাইছেন আপনেরা মায়-পুতে?’

নাহিদ ঢুলুঢুলু শরীরে সেতুর পাশ কেটে চৌকাঠ মাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। সেতুর প্রশ্নটি অগ্রাহ্য করে বিছানায় গিয়ে শরীর এলিয়ে বলল, ‘সারারাত দু’মিনিট যদি ঘুমাতে পেরেছি। আমাকে আজ সারাদিন ডাকবি না। খেতে ডাকলেও তোর খবর আছে!’

সেতু অসীম রাগের ছটা নিয়ে নাহিদের দিকে তেড়ে গেল। আঙুল তুলে বলল, ‘আমার মায়া কই কন কইতাছি! কই লুকাইছেন তারে? আমি কিন্তু আপনারে জীবনের মতো শেষ কইরা দিমু আমার মায়ার কিছু হইলে।’
‘কালীটা কোথায়, তা আমি কিভাবে জানবো আজব! ওর কথা ছাড়, ও তোর পেটের মেয়ে না। আমার মার চিন্তা একবারও কি করেছিস? মিঞাভাই চলে যাওয়ায়, মা আমার কেঁদেকুটে বেসামাল। একবারও খোঁজ নিয়েছিস সে খেয়েছে কিনা?’

সেতু তাচ্ছিল্য করে হাসল। পরক্ষণেই মুখ কঠিন করে বলল, ‘আমার খবর কে নেয়? আপনার মারে দেহনের লোকের তো অভাব নাই। আপনি কথা না বাড়াইয়া আমার মায়া কই হেইডা কন। আমার কিন্তু শরীর আর সইতাছে না। যেই কোন সময় আপনের মওত আমার হাতে হইয়া যাইতে পারে কইয়া দিলাম।’

‘তোর খবর নেওয়ার লোকের অভাব বলছিস! দিনরাত সাংবাদিক দল তোর আর তোর বোনের পেছনে লেগে থাকে, সেই খবর কি আমি জানি না ভাবছিস? একদম বেহুদা ভয় দেখাবি না আমায়। আমি তোর উপর চলি না, তুই আমার উপর চলিস। তোকে না বলেছি গলা নামিয়ে, মাথা নুইয়ে কথা বলবি আমার সাথে! বেশ কয়দিন ধরে গলায় আগের সেই তেজ উঠেছে নারে? দাঁড়া।’ নাহিদ উঠে গিয়ে সেতুর গলা টিপে ধরতেই দরজায় দাঁড়ানো রাত্রি গর্জে ওঠে,
‘এত জঘন্য লোক কেন আপনি? ছাড়ুন সেতুকে!’

রাত্রির গলায় ছিল জোড়ালো ধমক। যা নাহিদকে অতি মাত্রায় ভয়ংকর করে তুলে। সেতুর গলা ছেড়ে নাহিদ তার হিংস্র দৃষ্টি রাত্রির দিকে নিবদ্ধ করে বলল, ‘এত পাকনামি করতে বলেনি কেউ। আমার বউ, আমার ইচ্ছে। আমি তাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিতে পারব, আপনি প্রতিবাদ করার কে?’
‘আচ্ছা! দেশে কি আইন-আদালত নেই? বউ হোক বা নিজের মা, এই দুনিয়ায় নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে খুন করার অধিকার কারো নেই। আপনি একে তো স্ত্রীয়ের গায়ে হাত তুলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন, তার উপর ওপেনলি একজন জার্নালিস্টের সামনে স্ত্রীকে মেরে ফেলার কথা বললেন! আপনার ধারণা আছে আমি কি করতে পারি?’

নাহিদের টনক নড়ে উঠতেই সে রাগ চেপে নিল। যথাসম্ভব কন্ঠ কোমল করে বলল, ‘আমি কি সত্যি সত্যি মারবো নাকি! আপনি বলুন ম্যাডাম, বাসায় আসতে পারলাম না ও মায়ার প্রসঙ্গ তুলে আমার মাথা ঝালাপালা করে দিচ্ছে। মায়া কোথায় তা আমি কিভাবে জানবো? আমার আপন ভাইয়ের মেয়ে, ওর সাথে আমার কিসের শত্রুতা?’

‘আজকের মতো ছেড়ে দিলাম, কিন্তু কখনো যদি শুনি আপনি সেতুর সঙ্গে কোনরূপ পাশবিক নির্যাতন করেছেন, তাহলে আই সোয়ের, আপনাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য যা যা করতে হয় আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে করবো।’ রাত্রির কথার সুর ধরে নাহিদ বলল, ‘না,না। আর কখনো করবো না।’
এর পরমুহূর্তে সেতু বলে উঠল, ‘না আপা ওরে ছাইড়েন না। এই জানোয়ারটা জানে আমার মায়া কই। ওরা মায়-পুতে একটাও আমার মায়ারে দেখতে পারে না।’

নাহিদ দাঁতে দাঁত পিষল। শরীরের রক্ত চলাচল দ্রুতগামী হয়ে উঠেছে নাহিদের। সে তার সেয়ানা বুদ্ধির কারবারি থেকে কিছুটা বুদ্ধি সঞ্চয় করে মাথা ঠান্ডা রাখল। কৌশলে বলল, ‘আল্লাহ পাপ দেবেন যদি আমি মায়ার সম্পর্কে জেনে থাকি তবে। বিশ্বাস করেন সাংবাদিক ম্যাডাম, আমি মায়ার সম্পর্কে এক রত্তি পরিমাণ খবর জানি না। মিথ্যা বলে থাকলে আমি বোবা হয়ে যাব।’

রাত্রি নাহিদকে উপেক্ষা করে সেতুর উদ্দেশ্যে বলল, ‘মিতু কোথায় জানো কি তুমি? রাতে যেই রুমে ঘুমিয়েছিল সেখানে দেখিনি তাকে৷’
কথাটি শ্রবণেন্দ্রিয় ছুঁতেই বিদ্যুৎ চমকানোর ন্যায় চমকে ওঠে সেতু। বিচলিত স্বরে বলে, ‘কি কন আপা! মিতু কই যাইব? চলেন দেহি তো।’
________
দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টার ব্যবধানে ঢাকা গিয়ে পৌঁছাল মিতুদের গাড়ি। মিতু গাড়ির কাঁচ ভেদ করে বাহিরের দিকে তীর্থের কাকের ন্যায় চেয়ে আছে। লুৎফর ড্রাইভারের পাশাপাশি হয়ে বসা। পেছনে মিতু ব্যতীত কেউ নেই। গাড়ির দরজা খুলে লুৎফর বলল, ‘নামুন।’

মিতু একবার লুৎফরের দিকে চেয়ে হাতের ব্যাগটি বুকের সঙ্গে চেপে ধরল। একটানা বসে থাকতে থাকতে পা অবশ হয়ে আসায় বের হতে সময় নিল মিতু। মাটিতে পা পড়তেই উৎকন্ঠিত হয়ে বলল, ‘আমার মায়া এইহানেই আছে না!’
লুৎফর সামনের ভবনটির দিকে হাত তাক করে বললেন, ‘এইযে ৬ তলা বিল্ডিং টা দেখছেন, এখানেই ফ্যাশন শো অনুষ্ঠিত হয়।’

মিতু না বুঝে প্রশ্ন করে, ‘মানে?’
লুৎফর হেসে বলল, ‘মানে হচ্ছে এখানে মডেলিং এর সব ধরনের কাজ চলে। ভেতরে গেলে, কয়দিন দেখলেই বুঝে যাবেন একটু একটু করে।’
মিতু চেঁচিয়ে ওঠে, ‘পাগলের প্রলাপ ছাড়েন ক্যান? আমি আমার মাইয়ার ব্যাপারে জিগাইছি, বিল্ডিং, আপনার ওই মডেলিংয়ের কাজ নিয়া না।’
‘আপনি এত বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করেন কেন? আপনার মেয়ে যেখানেই আছে, ভালো আছে।’
‘আমি নিজের চোখে না দেহা পর্যন্ত বিশ্বাস করুম না।’
‘আচ্ছা চলুন।’

লিফট চড়ে তিন তলায় উঠল লুৎফর ও মিতু। সবকিছু অদ্ভুত লাগলেও তেমন ভাবান্তর ঘটেনি মিতুর মস্তিষ্কে। তার মস্তিষ্কের সবটা জুড়ে মায়ার চিন্তাভাবনারাই খুটি গেড়েছে। একটা বিশাল কক্ষে মিতুকে নিয়ে প্রবেশ করল লুৎফর। সেখানে দুজন পুরুষ ছিল। একজন বেরিয়ে গেল। মিতু তাকে চেনে না। অন্যজন বাদশা। মিতুকে দেখে সে একগাল হাসল। সেই হাসি মিতুর শরীরে ফোসকা ফেলল যেন। মিতু কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘আমার মাইয়ার সাথে দেখা করান।’

বাদশা কন্ঠে কৌতুকের রেশ টেনে বলল,
‘সেটা তো অবশ্যই, কিন্তু শর্ত মোতাবেক আগে আমার কাজ, তারপর তোমার মেয়ে তোমার।’
‘এই কথা তো আছিল না আপনার চামচার লগে। হেয় তো কইছে এইহানে আইয়া প্রথমেই আমার মাইয়ার লগে দেহা করাইবো।’

লুৎফর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,
‘সেভাবে স্পষ্ট করে তো কিছুই বলিনি আমি। মিথ্যে বলছেন কেন?’
মিতুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। মিতু তার আগুন ঝরা চোখ লুৎফরের দিকে নিক্ষেপ করে বলল, ‘ঠকাইছেন আমারে আপনারা। মিথ্যা কইয়া নিয়া আইছেন!’
‘মিথ্যে কিছুই বলা হয়নি। মেয়েকে পাবে, এখন দেখতেও পারবে, তবে সরাসরি নয়৷’ বলল বাদশা৷
মিতু সন্দিহান দৃষ্টিতে চাইল। বলল, ‘সরাসরি না দেখলে দেহে আবার কেমনে?’
সঙ্গে সঙ্গে চারিপাশ বাদশা ও লুৎফরের ভয়ংকর হাসির শব্দে কেঁপে ওঠে। মিতু আহাম্মক, হত-বিহবল চাহনি নিয়ে দেখল কেবল। বাদশা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মিতুর সামনে এগিয়ে যেয়ে বলে, ‘ভিডিও কলে কথা বলবে ও দেখবে। এটা নিশ্চয়ই বোঝো!’
মিতুর কঠোর বাক্যবাণ, ‘কোন কলে কাজ হইব না। আমি আমার মাইয়ারে সামনে চাই।’
‘তাহলে আর কি, মেয়েকে কখনোই পাবে না। কাজ শেষ হলে এমনিতেই আমি তোমার মেয়েকে দিয়ে দিতাম। কিন্তু কি করার? মেয়েকে তো চাইনা তোমার। লুফু, তুই এখনই বলে দে মেয়েটাকে মেরে ফেলার জন্য। আর ডেড বডি…;
বাদশা থেমে গেলেন মিতুর ভয়কাতুরে কন্ঠে,
‘এমন কইরেন না, আমি কাজ করুম তো।’
______
দিকবিদিকশুন্য হয়ে মিতুকে খুঁজে চলেছে কাব্য। পুরো শিমুলতলী গ্রামে মাইকিং করা হয়েছে। সব ধরনের প্রচেষ্টার পর ব্যর্থ, বিপর্যস্ত, পরিশ্রান্ত কাব্যর চারিদিক ধোয়াশায় মোড়ানো। ভীষণ অসহায় অনুভব হচ্ছে নিজেকে তার। লাগাতার ‘মিতুবুড়ি’ নামটি ছুঁয়ে রেখেছে তার শুষ্ক ঠোঁট।
কাব্যর এই অস্থিরতায় ভরা রূপ রাত্রির কোমল হৃদয় খন্ডে খন্ডে বিভক্ত করে দিচ্ছে বারবার। রাত্রি সাহস করে কাব্যর পিঠে হাত রাখল। ধীরস্থির ভাবে বলল, ‘কোথায় লুকিয়ে থাকবে আপনার মিতু? দু’একদিনের অন্তর অন্তর ঠিক বেরিয়ে আসবে দেখেন।’
কাব্য নড়েচড়ে বসল চেয়ারে। রাত্রির মুখের দিকে একবার চেয়ে তার দু’হাতের দখলে রাত্রির এক হাত টেনে নিয়ে ভগ্নহৃদয়ের পসরা সাজিয়ে নিল।
‘আমি খুব ক্লান্ত। জীবনের এই দুর্বোধ্য যুদ্ধে আমি আর সায় মেলাতে পারছি না। আমি কি এতটাই দুর্ভাগা! আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার উপর এত ঝড়-ঝঞ্ঝা কেন? সে তো নিষ্পাপ। তার মনে তো কোন কালো ছায়া নেই। সে কেন কষ্ট পায় বারবার? তার কষ্টের তুলনায় বিষের যন্ত্রণাও আমার কাছে মধুর। আমি সব সইতে পারি কিন্তু তার কষ্ট না।’ কাব্যর অঝোর ধারার কান্না থামবার নয়। তার বলা বিষ ও কষ্টের উদাহরণটি যে রাত্রির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
রাত্রি বলল, ‘ভেঙে পড়বেন না কখনো। আপনি তো ভেঙে পড়ার মতো মানুষ নন। আমরা খুঁজে বের করবোই মিতুকে। দেখেন স্যার, খুব শীঘ্রই মিতু ও তার মেয়ে মায়া অবধি পৌঁছে যাব আমরা।’
চলবে ইনশাআল্লাহ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here