উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৩৩
সময়টা মধ্যাহ্নের শেষ দিক। এখনো মায়ার সন্ধান মেলেনি। এদিকে মিতু আর সেতু কান্না করতে করতে ক্লান্ত প্রায়। মিতু ও সেতুকে কান্না করতে দেখে মছিদা বেগম তুমুল মেজাজে ছুটে আসলেন। তীর্যক ব্যাঙ্গ করে বললেন,
‘কলিজা ঠান্ডা হয়েছে তোদের বোনেদের তাইনা? আমার ছেলেটা আর নেই দুনিয়ায়। এবার হাস তোরা। মন খুলে হাস। কিন্তু তোরা হাসবি কিভাবে? আমার বুক খালি করে তোরা হাসবি, তা কিভাবে হয়? একদম ঠিক বিচার হয়েছে। আমি অনেক খুশি হয়েছি মিতুর মেয়ে হারিয়ে যাওয়ায়। দোয়া করি, আমার ছেলের লাশ দাফন করার আগে মায়ার লাশও যেন এই দেওয়ান বাড়িতে হাজির হয়। তখন পূর্ণ হবে বদলা।’
সেতু বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। রক্তচক্ষু মছিদার দিকে তাক করে বলল, ‘আপনার লাগান মানুষ রূপী শয়তান আমি বাপের জন্মেও দেখছি বইল্যা মনে হয়না। আপনে কি আদৌ মাইনষের কাতারে পড়েন?’
‘আমি মানুষের কাতারে নাই বা পড়লাম, কিন্তু তোরা দুইবোন? তোরা মানুষের বাচ্চা হয়ে আমার মানিককে কেন কেড়ে নিলি? কেন খুন করলি আমার নুরুলকে?’
সেতু চুপ করে রইল। মিতু বলল, ‘একদম মিছা অপবাদ দিবেন না আমগো নামে। আপনার পোলারে কে খুন করছে হেইডা আমরা দুইবোন কেমনে জানুম? আমরা তো আমগো মাইয়ারে না পাইয়া বেদিশা কাইল থেইক্যা, আপনার পোলারে কই পামু। হেয় তো কাইল বাইত্তে আহে নাই।’
‘আমার পোলা আর তোর কি? স্বাধীর জন্য একটুখানি কান্না করতে তো দেখলাম না। তুই কিসের স্ত্রী হলি রে? মুখপোড়া মেয়ে মানুষ কোথাকার! তোর কক্ষনও ভালো হবে না মনে রাখিস। আমার অভিশাপ তোকে ভালো থাকতে দেবে না।’ মছিদা ডুকরে কেঁদে ওঠেন।
হঠাৎ হুজুর সাহেবের তলব শোনা যায়, ‘সাইড দিন, খাটিয়া তোলার সময় হয়ে গিয়েছে। লোকজন সবাই দূরে সরে যান।’
মছিদা ছুটে গিয়ে সাদা কাপড়ে মোড়ানো নুরুলের লাশ জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। নুরুলের বুকে, হাত-পায়ে কোপ দেওয়া হয়েছে। একটা হাত সামান্য অংশ বাকী ছিল খুলে পড়তে। অর্থাৎ একটুর জন্য শরীর থেকে আলাদা হয়নি। গতকালের চাইতে আজ ভীড়ের পরিমাণ বেশি। কারণ দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে ভীড় জমিয়েছে লাশ দেখার আশায়। মিতু এগিয়ে গিয়ে নুরুলের লাশটা শেষ বারের মতো দেখে নিল। তার কষ্ট হলো না এক তিল পরিমাণও। তবে মনের সব ঘৃণা বিসর্জন দিয়ে নুরুলের জন্য একটু দোয়া চাইল। স্ত্রী হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে। স্ত্রী হিসেবে কখনোই সে নুরুলের মতো এক অধমের জন্য দোয়া চাইবে না। চারজনের কাঁধে চড়ে চলে গেল নুরুলের নিথর দেহ। মিতু নিষ্পল চোখে চেয়ে আছে খাটিয়ার দিক পানে। পলকও পড়ছে না। দল বেঁধে মশা মাছিরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তার শরীরে। তাও যেন কোন হেলদোল নেই। নুরুলের লাশ দেখে সকলেই হতবাক, বিস্মিত। এখনও লোকজন লাশ নিয়েই আলোচনা করে যাচ্ছে। মছিদা ‘নুরুল, নুরুল’ বলে গগনবিদারী কান্নায় গা ভাসাচ্ছেন। সেতু সকলের অগোচরে মিতুকে টেনে একটা ঘরে নিয়ে আসল। দরজার খিল তুলে বলল, ‘তুইতো কাইল রাইত থেইক্যা আমার লগে আছিলি, তাইলে খুনডা করলি কেমনে ক তো?’
মিতু বিস্ময় নিয়ে সেতুর দিকে তাকাল। বিচিলিত হয়ে বলল, ‘বিশ্বাস কর বুবু, আমি খুনখান করি নাই। আমি তো তারে বিকালের পর থেইক্যা দেহি-ই নাই, তাইলে খুন কেমনে করুম ক?’
‘তুই করিস নাই? তাইলে কে করছে? তুই না কইলি মিঞা ভাইরে খুন করবি?’
‘কইছিলাম তো, কিন্তু নুরুলরে তো হাতের কাছেই পাইনাই আমি। তুই ক, যারে দেহি-ই নাই, তারে খুন কেমনে করতে পারুম? তোরে মিছা কথা কইয়া আমার লাভডা কি?’
‘তাইলে মিঞা ভাইরে খুন করল, তো করল কে?’
কাব্য, রাত্রি ও সাজিদকে নিয়ে পাশেই এক হোটেলে গিয়ে উঠেছিল গতকাল। যাবার সময় কাব্য সেতুকে বলে গিয়েছিল তার মিতুবুড়ির খেয়াল রাখার জন্য। কিন্তু সাত-সকালে যে এরূপ মারাত্মক এক ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে তা কাব্য কেন, সকলের জন্যই কল্পনাতীত। গত রাতে রাত্রি ও সাজিদের জোরাজোরিতে দুমুঠো ভাত নাকে-মুখে গিলেছিল কাব্য। অফিসের কিছু কাজ সারতে সকাল, দুপুর পার হয়ে যায় বিধায় বিকেলের দিকে দেওয়ান বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলো। পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। কাব্য একা আসেনি, সাথে করে রাত্রি ও সাজিদ এসেছে। তখনও মোটামুটি ভীড় ছিল। কাব্য ভীড় ঠেলে ভেতরে যেতেই মিতুর দেখা পেল। মিতু উঠোনে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁদছে। এলোমেলো চুল, পরনে গতকালের সেই ছেঁড়া শাড়িটা, পাতলা ফর্সা শরীর, চোখের নিচে কালচে দাগ সব মিলিয়ে মিতুর চেহারায় বেশ পরিবর্তন এসেছে এক রাতের ব্যবধানেই। কাব্যর নিকট এ যেন বিরাট কোন ধাক্কা! দুধে আলতা গায়ে কালো কয়েকটা দাগ স্পষ্ট দৃশ্যমান। কাব্য জহুরি নজরে দেখল সেই দাগ। মারের দাগ ঠাওর হলে, কাব্যর রুহ কেঁপে উঠল। যে কাব্য তার মিতুবুড়ির সামান্য মন খারাপ নিতে পারত না, সে এত বড়ো ধাক্কা কিভাবে নেবে? মাত্র বাইশ বছর বয়সে যতটা ধকল গিয়েছে মিতুর উপর দিয়ে, সে অনুযায়ী বেঁচে আছে, তাই কত! তবে কাব্য যে কিছুতেই তার মিতুবুড়ির এই করুণ দশা সইতে পারছে না। গাল বেয়ে সরু নোনা অস্রু গড়িয়ে যেতেই কাব্যর সম্বিৎ ফেরে। সে আস্তে আস্তে কদম ফেলে মিতুর সামনে হাটু গেড়ে বসল। আবেগপ্রবণ কন্ঠে বলল,
‘মিতুবুড়ি!’
মিতুর কানের ভেতর মিতুবুড়ি নামটা বিদ্যুৎ গতিতে গিয়ে বারি খেল। খানিক্ষণ তাকিয়ে দেখল কাব্যকে। এরপর গগনবিদারী চিৎকার ছেড়ে ‘কাব্য ভাই’ বলে ঝাপিয়ে কাব্যর বুক দখল করে নেয়। মিতুর সেই সময় মনে ছিল না সে আর সেই ছোট্ট মিতুটি নেই। সেই মুহুর্তে কাব্যকে দেখে মিতুর খালি একটা কথাই মাথায় এসেছে। আর সেটা হলো, সে তার থেমে যাওয়া হৃদ স্পন্দনের সন্ধান পেয়ে গেছে। তার কাব্য ভাইকে পেয়ে গেছে। যে তার সকল সমস্যার সমাধান। তাইতো কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে কাব্যর বুকে আশ্রয় নিল। কাব্যও তথাকথিত দুনিয়ার নিষেধাজ্ঞা ভুলে গেল তার মিতুবুড়ির চোখের পানিতে। দুজনেই চাপা কান্নায় আচ্ছন্ন। এদিকে সবাই ইতোমধ্যে ‘ছি, ছি’ শুরু করে দিয়েছে। মছিদা বেগম বারান্দা থেকে ধ্বংসাত্মক দৃষ্টি মেলে রেখেছেন কাব্য ও মিতুর দিকে। হঠাৎ হুংকার ছেড়ে বললেন,
‘কি বেশরম, কি নির্লজ্জ! এই মেয়ের চরিত্র এত খারাপ? কিভাবে একটা পর পুরুষের শরীরে ঝাপ দিল। স্বামী মারা যাওয়ার একদিন হতে পারল না, নাগরের গায়ে ঢলাঢলি শুরু! গতকাল নাকি এদের সালিস হয়েছে? কি ঘোড়ারডিমের সালিস হলো বুঝলাম না! আপনারাই বলেন এখন আমার শ্বাশুড়ি হিসেবে করণীয় কি?’
কথাগুলো বলে চুপ থাকলেন না মছিদা বেগম। তিনি আরও কিছু কথা যোগ করলেন,
‘হায় খোদা, কোন দুশ্চরিত্রা মেয়ের পাল্লায় ফেললা আমার নুরুলকে? এই মেয়ে কালসাপকে কামড় দিলে সেই সাপও বোধয় মারা যাবে! আমার ছেলের কলিজা ভাজা ভাজা করে ফেলছে। আপনারা সবাই আমাকে সাহায্য করেন দয়া করে।’
পাশ থেকে একজন মাঝবয়েসী মহিলা বলে ওঠে,
‘এই মিতু আর ওর নাগররে গণধোলাই দিয়া জীবন বাইর কইরা দেও বেবাকে মিল্লা। এরম চরিত্র ছাড়া ছেড়া/ছেড়িগো বাঁচাইয়া রাখলে আমগোই পাপ বাড়বো।’
সেতু এক দিক দিয়ে মিতুকে টানছে, আর অন্যপাশ দিয়ে রাত্রি ও সাজিদ কাব্যকে টানছে। কাব্য আর মিতুকে আলাদা করার পর আশেপাশের লোকেরা কাব্য ও মিতুকে মারার জন্য একজোট হয়ে তেড়ে গেল। রাত্রি কাব্যর সামনে দাঁড়িয়ে দুহাত দুদিকে মেলে চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আপনারা একটু শান্ত হন। আমরা কিন্তু যেমন তেমন সাংবাদিক নই। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি সাংবাদিক কাব্য রায়হান অথবা মিতুর উপর হাত তোলেন, তাহলে আপনাদের প্রত্যেকটাকে জেলে পুরতে আমাদের এক মিনিটও লাগবে না বলে রাখলাম। এবার আপনারা যা খুশি করতে পারেন। তারপর আমাদের পালা।’
রাত্রির আঙুল উঁচিয়ে দেওয়া ধমকির জোরে সবাই ভয় পেয়ে যায়। যারা যারা মারার জন্য তেড়ে আসছিল, তারা পুনরায় নিজেদের জায়গায় গিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ল।
সেতু সমস্ত শক্তি খটিয়ে মিতুকে দু’হাতের কব্জায় আটকে রেখেছে। সেই অবস্থা ধরে রেখেই রাত্রির উদ্দেশ্যে অনুনয়ের চোখে বলল,
‘আপনারা তাইলে চুপচাপ খাড়ায় আছেন ক্যান? আমার মায়ারে খুঁইজ্যা পাইতাছি না কাইল থেইক্যা। তারে খুঁইজ্যা বাইর করার ব্যবস্থা করেন। আমার মায়ারে কারা যেন সালিসির সুযোগ পাইয়া লুকায় রাখছে। জলদি কিছু করেন।’
কাব্য ও রাত্রি সেতুর থেকে মায়ার সম্মন্ধে জানতে পেরে সরাসরি লাইভ ভিডিও তে চলে যায়। সেখানে মায়ার ছবিসহ সকল তথ্য তুলে ধরা হলো। যাতে কেউ সন্ধান পেলে যোগাযোগ করতে পারে উল্লেখিত নাম্বারে। তার পাশাপাশি কাব্য স্থানীয় পুলিশকে ইনফর্ম করে রাখে। বেশ কিছুক্ষণ পর পুলিশ ফোর্স চলেও এলো। এরপর শুরু হলো নুরুলের খুনীসহ মায়ার নিখোঁজের তদন্ত।
চলবে ইনশাআল্লাহ….
বিঃদ্রঃ পর্বটা হাফ আগের লিখা এবং হাফ এখন লিখলাম। এছাড়াও ২০ এর পর থেকে এভাবে বেশ কয়েকটি পর্বে নতুন করে লিখতে হয়েছে। কখনো বা সম্পূর্ণ পর্বটাই লিখতে হয়েছে প্রয়োজনের তাগিদে। ১৪ তারিখ থেকে কলেজের প্রথম সি.টি অনুষ্ঠিত হবে। হয়তোবা কয়দিন বিরতি নিতে পারি। যেহেতু নতুন কিছু পর্ব যোগ করতে হবে, সেহেতু বিরতি না নিলে ঠিকভাবে লিখায় মন বসবে না। তবে বিরতির আগে বলে দেব, কবে থেকে বিরতি নেব এবং আবার কবে থেকে শুরু করবো। ধন্যবাদ।