গোধূলিলগ্ন ৩১

0
1221

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৩১

সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি মিতু। ভোর হতে এখনও বেশ ভালো সময় বাকী। সেদিন অযত্নে ধার দেওয়া চাপাতি আজ খুব সময় নিয়ে ধার দিল। দুটো কুকুর কিছুক্ষণ পর পর ভয়ংকর শব্দে ডাক ছাড়ছে। মিতু তা শুনে বেশ আনন্দ পাচ্ছে। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসা ফজরের আযানের সুমধুর ধ্বনির ঝংকারে থেমে গেল মিতু। পরনের শাড়িটা বদলে নামাজ আদায় করে মায়ার ঘুমন্ত ঘুমটা মায়াভরা চোখে দেখে নিল এক ঝলকে। রাতে একটা ঘুমের ট্যাবলেট থেকে অর্ধেক অংশ ভেঙে মায়ার খাবারে মিশিয়ে দিয়েছিল। তবে সে জানে না মায়া ঠিক কতক্ষণ পর্যন্ত ঘুমোতে পারবে। খাটের তলায় আলাদা করে বিছানা পাতানো। মিতু সন্তর্পণে মায়াকে কোলে তুলে নেয়। তারপর সেই পাতানো বিছানায় মায়াকে শুইয়ে দিয়ে বিছানার চাদরটা মেঝে ছুঁই ছুঁই অমন ভাবে নামিয়ে নিল। জানালা খুলে দেখল, পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয়ের অভিষেক ঘটেছে। এরপর শুরু অপেক্ষা। দেয়ালে নষ্ট, অকেজো চতুর্ভুজাকৃতির বিশাল এক ঘড়ি ঝুলে। নুরুল বিদেশ থেকে এনেছিল। ঘড়িটায় মিনিটের কাটাটা ছয়ের ঘর, সেকেন্ডের কাটা চারের কাছাকাছি এবং ঘন্টার কাটাটা নয়ের ঘরেতেই নিজেদের জায়গা দখল করে রেখেছে। এ নিয়ে মায়ার কতই না কৌতূহল! মিতু আজ ঘড়িটা খুটিয়ে খুটিয়ে পরখ করছে। ভাবছে, প্রতিটি জীবন্ত মানুষের জীবনও হয়তো এভাবেই কোন একদিন এই তিনটে কাটার কোন এক জায়গায় গিয়ে থমকে যাবে। তখন অচল ঘড়ি আর মরা ব্যক্তিটির মধ্যে বিন্দুমাত্র পার্থক্য বিদ্যমান থাকবে না। ঘড়ি তো ঠিকও করা যায়, তবে মানুষ! মানুষ একবার থেমে গেলে যে আর চলে না! এমন ভাবনা থেকে বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে মিতুর। চোখটাও লেগে আসতে চায়। নির্ঘুম রাতের ক্লান্ত আঁখি জোড়া তন্দ্রা পেতে ইচ্ছুক। মিতু জোরপূর্বক চোখ খুলে রেখেছে। এক সময় অজান্তেই চোখ লেগে গেল। তলিয়ে গেল বেঘোর ঘুমে। বেশ কিছু প্রহর চলে যায়, মিতু টের পায়না। হঠাৎ করাঘাতে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল মিতু। চোখ কোচলে চাপাতির দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে চাপাতি চালাতে উদ্যত হতেই বিস্ময়ে থমকে গেল সামনে চশমা পরিহিত লম্বাচওড়া ছেলেটিকে দেখে। তার অশ্রুসিক্ত চোখ মিতুর নজর কাড়ে আরও। কতক্ষণ চোখের ভাষা চলল জানা নেই কারো। হঠাৎ মিতু অস্ফুটে বলল, ‘কাব্য ভাই!’

হাতের চাপাতি দূরে ফেলে দিল। পেছনে ঘুরে বলল, ‘তুমি এতবছর পর আমার সামনে ক্যান আইলা কাব্য ভাই? চইল্যা যাও তুমি। তোমার মতো ভালো মানুষ আমার মুখ দেখলে, তোমার কুফা লাগব।’

কাব্য চৌকাঠ মাড়িয়ে মিতুর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মিতুর পরনের ছেড়া শাড়িটা নজরে আসলে অস্থিরতা নিয়ে বলল, ‘ছেড়া শাড়ি কেন তোর গায়ে? আমার মিতুবুড়ির গায়ে ছেড়া শাড়ি বেমানান। ছেড়া শাড়ির যোগ্যতা নেই আমার মিতুবুড়িকে অপমান করার। সে যে রাজরানী।’

‘আমি ভালো আছি কাব্য ভাই। তুমি এইহান থেইক্যা যাও। দয়া কইরা যাও। এইহানে ক্যান আইলা? তোমার ঠিক হয় নাই কাজখান করা। সময় থাকতে যাও! আর আসবা না কোনদিনও।’

‘তোর এই নিষ্ঠুরতম কথার মাঝেও আমি স্বস্তি পাচ্ছি, মিতুবুড়ি। তুই আমার মিতুবুড়ি।’

মিতুর মন কাতর হলো। রাগ দেখাতে গিয়েও সে পারছে না। তবে সে চায়না তার জন্য কাব্যর কোন ক্ষতি হোক। তাই মনের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেকে শক্ত করে নিল। মুখে মিথ্যে রাগের আবির্ভাব ঘটিয়ে রুষিনি হয়ে বলল,
‘আপনারে দেখলে আমার ঘেন্না লাগে। আপনি একটা খারাপ পোলা। আপনি বন্ধুত্বের নাম কইরা আমার সুযোগ নিছেন। আর কিসের মিতুবুড়ি আমি? আমার নাম মিতু। আমি কারো মিতুবুড়ি না। হুনছেন আপনি? চিনি না আমি আপনারে।’

কাব্য আহত হলো বেশ ভালো মতো। আঘাতটা ছুরিকাঘাতের ন্যায় ঢুকে গেল কাব্যর বুক চিড়ে। যা সহ্য করার ক্ষমতা ওই মুহুর্তে জুগিয়ে উঠতে ব্যর্থ হলো সে। তারপরও হাসি মুখে বলল, ‘আমি শুধু ভালবেসেছিলাম। সুযোগ নেওয়ার কথাটা বলতে পারলি? আমি ওই বয়সটায় থেকেও কখনো ইচ্ছে করে তোর হাত ধরেছিলাম, যে তুই এরকম জঘন্য অপবাদ দিলি?’

মিতুর নিষ্ঠুর জবাব, ‘আমার মনে নাই কিছু। আমি খালি জানি, আপনি আর পাঁটটা পুরুষের লাগান। যারা মাইয়া মাইনষেরে ভুলায় ভালায় সুযোগ নেয়। কষ্ট লাগতাছে আমার কথায়? এমনেই কষ্ট দিমু যদি এইহান থেইক্যা সুন্দর কইরা বাইরাইয়া না যান তাইলে।’

কাব্য জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘তোর থেকে পাওয়া কষ্টও তৃপ্তির। আমি কষ্ট পেতে রাজী, তবুও আমার সাথে একটু কথা বল। আমি চলে যাব ওয়াদা দিলাম। শুধু পাঁচ মিনিটের জন্য আমার সেই বারো বছরের মিতুবুড়ি হয়ে যা। ওইযে বকবক করা, চঞ্চল, স্বচ্ছ, মিষ্টি মিতুবুড়ির মতো।’

‘কি সমস্যা আপনার? যান না ক্যান? আপনি কি ভুইল্যা গেছেন আমি অন্য ব্যাডার বউ? আমার স্বামী আছে, এক ছেড়ি আছে। আমি আমার স্বামী, মাইয়া লইয়া ভালো আছি। আপনি পরপুরুষ হইয়া আমার কাছে কোন মুহে আহেন?’

কাব্যর পুরো পৃথিবী মিতুর ওই বাক্যটায় থেমে গেল, ‘আমি আমার স্বামী, মাইয়ারে লইয়া ভালো আছি।’ কাব্য বিনাবাক্যে পা সচল করল। দরজার কাছে গিয়ে পেছনে একটিবার তাকিয়ে নির্বিকার কন্ঠে বলল, ‘তোর যখন ইচ্ছে আমার কাছে চলে আসিস, কাব্য নামক দুনিয়া সর্বদাই ফুলের বাগিচা হয়ে স্বাগত জানাবে তার মিতুবুড়িকে।’

সহসাই তিনজন লোক দরজায় এসে হানা দেয়। তাদের সামনে নুরুল। কাব্যকে দেখে অবাক হলেও চিনতে পারল না। তবে কাব্য অচেনা পুরুষ হয়ে তাও আবার তার স্ত্রীয়ের কাছে এত ভোরে কি করছে! বিষয়টা মারাত্মকভাবে নাড়া দিল নুরুলের মস্তিষ্কে। এমনকি উপস্থিত সকলেই এই এক চিন্তাতেই মশগুল। নুরুল কাব্যর ব্লেজার টেনে ধরে দুহাতে। রক্তচক্ষু কাব্যর দিকে নিক্ষেপ করে বলে, ‘তুই আমার ঘরে কি করিস শুওরেরবাচ্চা?’
নুরুল মুষ্টি বদ্ধ করতেই মিতু চাপাতি নিয়ে এগিয়ে যায়। আক্রোশপ্রসূত ভয়ংকরী চাহনি নিয়ে নুরুলের পেটে লাথি বসায়। নুরুল ব্যথা পেয়ে ‘মাগো’ শব্দ করে ওঠে।

মিতুর ঠোঁট, আঁখিপল্লব ঘনঘন কাঁপছে। চোখ দিয়ে আগুনের ঝর্না ঝরছে।
‘কাব্য ভাইয়ের গায়ে একটা টোকা পড়লে সবগুলারে জবাই দিমু কইয়া রাখলাম।

মিতুর মুখ থেকে ‘কাব্য’ নামটি শুনে নুরুল মনে করার চেষ্টা করে বলল, ‘ওওও, এইবার বুঝলাম কাহিনী। আমি সংসার করিনা দেখে সেই আগের নাগরটাকে খবর দিয়ে আনিস তাহলে! বিয়ের আগে ফষ্টিনষ্টি করে হয়নি যে এখনো একেই লাগল?’

বাক্যর কান গরম হলো নুরুলের কুৎসিত কথায়। সে নুরুলের নাক বরাবর ঘুষি দিতেই নুরুল দু’কদম পিছিয়ে গেল।

বাদশা তার সিকিউরিটি গার্ডকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘লুফুরে, খুন-খারাবি হওয়ার আগে জলদি মানুষ ডেকে আন।’

সিকিউরিটি লুৎফর রহমান দ্রুত ছুটে গেলেন লোকজন ডাকতে। বাদশা গিয়ে আবডালে লুকিয়ে পড়লেন।
নুরুল কাব্যর দিকে হাত বাড়াতেই মিতু নুরুলের হাতে চাপাতি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে নুরুলের হাত কেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে। তাজা মোটা হাতটি ফেড়ে গিয়ে হা হয়ে গিয়েছে। মিতু এবার নুরুলের ঘাড়ে কোপ দেওয়ার জন্য উদ্যত হলে বাক্য মিতুর হাত ধরে নেয়।
‘পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই? মরে যাবে তো লোকটা।’

মিতু পাগলের ন্যায় প্রলাপ চালায়, ‘মরুক, ওরে মারার জন্যই আইজ রেডি আছিলাম। ওরে না মারলে আমার শান্তি লাগব না। লোকজন আহার আগে তুমি পালাও কাব্য ভাই। যাও এইহান থেইক্যা।’

‘তোকে বিপদের মুখে ফেলে আমি পালিয়ে যাব?
কক্ষনো না। এই কাব্য মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করবে তার মিতুবুড়ির জন্য।’
কাব্য মিতুর কোন কথাতেই কর্ণপাত করল না। ধস্তাধস্তি, জাবরদস্তি করে শেষমেশ মিতুর হাতের চাপাতিটা কেড়ে আনতে পারল। এইদিকে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ খবর পেয়ে মাছের বাজার বানিয়ে নিয়েছে নুরুলের উঠোন জুড়ে৷ মিতু আর কাব্যকে বেঁধে ফেলা হয় আলাদা আলাদা দুটো গাছের সঙ্গে। আর নুরুলকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। বিকেলে সালিসি বসবে নুরুলের বাড়িতে। শিমুলতলী গ্রামে কর্তব্যরত চেয়ারম্যান খালেক বেপারি, কাব্য ও মিতুর দ্বারা ঘটিত অন্যায়ের প্রধান বিচারক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সেই সালিসে। আশে পাশের গ্রামসহ দূরদূরান্তের গ্রাম থেকেও অনেকে ছুটে আসল সেই সালিস দেখার জন্য।
চলবে ইনশাআল্লাহ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here